আগের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ https://cadetcollegeblog.com/khairulahsan/63352
অভূতপূর্ব উদারতাঃ
মাস দুয়েক আগে আমি আর আমার স্ত্রী হাসপাতালে গিয়েছিলাম, এক্সরে করানোর জন্য। আমি এক্সরে বিভাগে প্রবেশ করে রিসেপশনে যখন জিজ্ঞেস করছিলাম কোথায় যেতে হবে, তখন লক্ষ্য করলাম আমাদের ঠিক পিছে পিছে আসা একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে উঠেই হাতের বাম দিকে চলে গেলেন। রিসেপশন থেকেও আমাদেরকে ঠিক সেই দিকেই যেতে বলা হলো। আমরা একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম, একটা রুমের সামনে লেখা ‘এক্সরে রুম’। দরজাটা খোলাই ছিল, আমি তবুও একটু নক করে ভেতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে পেলাম, একজন মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান এক্সরে ফিল্ম প্রস্তুত করছেন। আর দেখলাম সেই ভদ্রলোককে, যিনি আমাদের পিছু পিছু এসে সরাসরি সেখানে চলে এসেছেন। আমি নিশ্চিত হবার জন্য তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সেখানেই কি এক্সরে করানো হবে কিনা। উনি স্মিতহাস্যে হ্যাঁসূচক জবাব দিলেন। আমাদেরকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারাও কি এক্সরে করাবেন’? আমি হ্যাঁসূচক জবাব দিলাম। উনি তখন একটু সরে এসে বললেন, ‘আমি বাইরে গিয়ে বসি, আপনারা আগে করান’। আমি ওনার বিনয় এবং উদারতায় রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘না না, তা কেন হবে। আপনি আগে এসেছেন, আপনি আগে করান। তাছাড়া আমরা দু’জনই এক্সরে করাবো, তাই আপনার চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগবে’। উনি তবুও অনুরোধ করলেন, আমরা যেন আগে করাই এবং এ কথা বলেই তিনি কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হলেন। আমি এতে খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম, কেননা পরে এসে আগে করানোর এ প্রস্তাবে আমার বিবেক কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। ঠিক সে সময়ে মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান জানালেন, ওনার নামে এক্সরে প্লেট প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। সুতরাং এমতাবস্থায় ওনাকেই আগে করাতে হবে। এ কথা শুনে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম এবং ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দু’জনে রুমের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।
একটু পরেই ভদ্রলোক বের হয়ে এসে আমাদেরকে বললেন, ‘আমার হয়ে গেছে, এবারে আপনারা যান’। আমি তাকে তার সিরিয়াল ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে অগ্রাধিকার অফার করার জন্য আন্তরিকভাবে আবার ধন্যবাদ জানালাম। উনি আবার একটা স্মিত হাসি দিয়ে চলে গেলেন। আজকাল যেখানেই যাই সেখানেই দেখি লাইন কখনো সোজা থাকে না। লাইন একটু বড় হলেই পেছনের লোকজন নানা ওসিলায় একটু সামনে বা পাশে দাঁড়ানোর জন্য নানা কসরৎ শুরু করে। ফলে কাউন্টারের সামনে লাইনটা ইংরেজী ‘I’ অক্ষরের মত না হয়ে ‘T’ এর মত হয়ে যায়। এমন অবস্থা যখন সবখানে, তখন সেই ভদ্রলোকের এতটা উদার আচরণে আমি শুধু মুগ্ধই হইনি, যারপরনাই বিস্মিতও হয়েছিলাম। আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না, কেন তিনি আমাকে এতটা উদারতা ও ভব্যতা দেখালেন। যে কারণেই হোক, আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন নিশ্চয়ই ওনার মনের খবর জানেন। প্রার্থনা করি, ওনার সদিচ্ছাটুকু যেন আল্লাহতা’লা কবুল করে নেন এবং এ জন্য তাকে উত্তম বিনিময় দান করেন।
ক্ষণিকের (শেষ) হাসিঃ
মাসখানেক আগে একটি পারিবারিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের জন্য খুব ভোরে বনানী বাজারে গিয়েছিলাম একটা খাসি কেনার জন্য। দরদাম করে একটা কালো খাসি কিনে কসাইকে সেটাকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে দিতে বললাম। সে কাজ শুরু করার পর দেখলাম, পাশের কসাইও কয়েকটা ছাগল নিয়ে এসেছে জবাই করার জন্য। তার মধ্যে তিনটা ছিল একটু বড় আর চতুর্থটা ছিল কচি। কসাই একাই সেগুলোর পাগুলো বেঁধে শুইয়ে দিয়ে হাঁটু দিয়ে ছাগলের বাঁধা পা এবং শরীরটাকে চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে গলাটাকে টান টান করে ধরে ডান হাত দিয়ে ছুরি চালিয়ে দিল। প্রথমে বড় তিনটাকে জবাই করে সবশেষে সেই কচি ছাগলটাকে শুইয়ে দিল। ছুরি চালাতে যাবে, ঠিক এমন সময়ে বিকট শব্দে তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোনে কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হওয়াতে ছাগলের বাচ্চাটা তার হাঁটুর চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। মুক্ত হয়েই সে দাঁড়িয়ে মাথাটা একটু ঝাড়া দিয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হলো নিজেকে মুক্ত করতে পেরে সে আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসছে। ওকে দেখে আমার এত, এত মায়া হলো যা বলার নয়। মিনিট পাঁচেক পরে সে কসাইটা ফোনে তার কথা শেষ করে সেটাকে ধরে নিমেষেই জবাই করে ফেললো। আমি খুবই খারাপ বোধ করতে থাকলাম। ছাগল তো হাসে না, কিন্তু আমি কেন সেই বাদামী রঙের ছাগলের কচি বাচ্চাটার চোখে মুখে একটি শিশুর হাসি দেখতে পেলাম? এ দৃশ্যটা আমি বহুদিন ভুলতে পারবো না। হয়তো কোনদিনও না!
ঢাকা
০২ অক্টোবর ২০২১