রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমি সাধারণতঃ সেলফোনটা অফ করে দিয়ে বেডসাইড টেবিলে রেখে ঘুমাই। সকালে ফজরের নামাযের সময় যখন উঠি, তখন আবার অন করে নেই। আজ সকালে ফজরের নামাজ পড়ে যখন ফোনটা অন করলাম, তখন দেখি আমার বন্ধু মেজর লুৎফুল কবির ভূঞা (অবঃ)ফেইসবুকে প্রকাশিত আমার একটি অনুবাদ কবিতা “পাহাড়টাকেই নিলাম বেছে” পড়ে গতরাতে সেখানে অনুবাদের প্রশংসা করে একটা মন্তব্য করেছে। বন্ধুর প্রশংসা পেয়ে মনটা খুশী হয়ে গেলো। তার মন্তব্যে শুধু একটা ‘লাইক’ দিয়ে রাখলাম। ভাবলাম, পরে যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসবো, তখন ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে মন্তব্যের জবাব দিব। অভ্যেস বশতঃ নামাযের পর আবার কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম।
সকালে নাশতার পর সেলফোনে চোখ বুলিয়ে দেখি, আমাদের আরেক বন্ধু সতীর্থদের গ্রুপ মেইলে একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছে যে গতরাতে প্রায় একটার দিকে কবিরের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াতে এবং কিছুক্ষণ পর পর ওঠানামা করাতে সে অসুস্থ বোধ করছিলো, তাই তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয়। এখন সে জরুরী বিভাগে চিকিৎসাধীন আছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ততক্ষণে ওর অসুস্থ হবার খবরটা অনেক বন্ধুই জেনে গেছে। এ ওকে ফোন করে সর্বশেষ খবরটা জেনে নিচ্ছে। ওর কথা ভাবতে ভাবতেই বন্ধু লেঃ কর্নেল শহীদ উদ্দিন (অবঃ) এর ফোন পেলাম। ও জিজ্ঞেস করলো, কবিরের অসুস্থ হবার খবর জানি কিনা। ওর সাথে আলাপ করে সাব্যস্ত করলাম, আধ ঘন্টা পরে আমরা উভয়ে একত্রে ওকে দেখতে যাব। সেই অনুযায়ী তৈরী হয়ে নিলাম। শহীদ ওর নিজের গাড়ী নিজেই চালাচ্ছিল, কারণ ওর ড্রাইভার এখনো ঈদের ছুটিতে। রওনা হবার আগে আমরা উভয়ে আমাদের একই পাড়ায় বসবাসকারী আরো ২/৩ জন বন্ধুকে ফোন করলাম এটা জানাতে যে আমরা কবিরকে হাসপাতালে দেখতে যাচ্ছি। গাড়ীতে যেহেতু জায়গা আছে, সেহেতু চাইলে ওরাও আমাদের সাথে যেতে পারে। কিন্তু কাউকেই তখন ফোনে পেলাম না। অগত্যা আমরা দু’জনেই রওনা হ’লাম।
বের হবার পথে বাসার কাছের ‘Y’ জাংশনটা পার হতেই দেখি, একটা আরোহী বিহীন মটর সাইকেল রাস্তার উপরে একটু সাইড করে রাখা, সে কারণে গাড়ী চলাচলে ঐ জায়গাটাতে একটু জটলা হচ্ছে। তবে গাড়ীগুলো তবুও একে একে পার হয়ে যাচ্ছে উভয়দিকে, কেউ থামছেনা। তার আগেই বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা রওনা হবার পর বৃষ্টি কমে আসলেও তখনো ঝির ঝির করে ঝরছিলো। মটর সাইকেলটার পাশে ছাতা হাতে একজন ইউনিফর্মধারী সিকিউরিটি গার্ড, তার সাথে বর্ষাতি পরিহিত আরো দুইজন মটরসাইকেল আরোহী তাদের বাইক থামিয়ে কি যেন কথা বলছে। আমরা তাদের আরো কাছে এসে গাড়ীটা একটু স্লো করে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? কিন্তু ঊত্তর পাবার আগেই পেছনের গাড়ীর তীব্র হর্ণের কারণে সেখান থেকে সরে আসতে হলো। ভাগ্য ভাল ছিল, একটু এগিয়েই গাড়ীটাকে একটু বাম সাইডে কোনমতে চাপিয়ে রাখার মত জায়গা পাওয়া গেল। শহীদ তাই করলো।
কিন্তু ঘটনাস্থলের আপ এন্ড ডাউন উভয়দিকে আপন গতিতে একের পর এক গাড়ী, জীপ, মটর সাইকেল, সিএনজি, বাইসাইকেল সবই ছুটে চলছিলো, কারো হাতে সময় নেই একটু থেমে জিজ্ঞেস করার- ঘটনা কী? ঘটনাটি (আসলে সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা) জানার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ দেখতে পেয়ে সেই সিকিউরিটি গার্ড হেঁটে হেঁটে আমাদের গাড়ীর কাছে এলো। বললো, স্যার একজন মটর সাইকেল আরোহী এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনের একটা গাড়ী হঠাৎ ব্রেক করাতে এবং বৃষ্টির কারণে রাস্তা পিচ্ছিল থাকার কারণে তিনি ব্যালেন্স সামলাতে পারেন নি। বাম দিকে ছিটকে পড়ে ফুটপাথের সাথে বারি খেয়ে তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। ওর পিছু পিছু বর্ষাতি পড়া সেই দু’জনের একজন গাড়ীর কাছে এসে আমাদেরকে অনুরোধ করলেন, আহত ব্যক্তিকে যেকোন একটি হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমরা দু’জনে উপস্থিত সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাকে পেছনের সীটে বসিয়ে নিকটস্থ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারবো, কিন্তু তার সাথে একজনকে যেতে হবে যে ডাক্তারকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারবে। সেই ভদ্রলোক জানালেন, আহত ব্যক্তির কপালের পাশে কেটে রক্ত ঝরছে, সেটা ত্বরিত বন্ধ করতে হবে। আর তার একটা হাত খুব সম্ভবতঃ ভেঙ্গে গেছে, কিন্তু রোগী সজ্ঞানে আছেন, তিনি নিজেই ডাক্তারকে সবকিছু বলতে পারবেন। আমরা রাজী হ’লাম। ঊনি ফিরে গিয়ে রোগীকে ধরে ধরে এনে আমাদের গাড়ীতে বসিয়ে দিলেন। আমাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বিদায় নিলেন, যাবার আগে নিজের পরিচয় জানিয়ে গেলেন যে উনি মেজর কামরান। উনি আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন না।
লোকটার ভাগ্যটা নেহায়েৎ ভাল ছিল। উনি যদি বাম দিকে কাত না হয়ে ডানদিকে কাত হয়ে পড়তেন, তবে নির্ঘাত ওনার উপর দিয়ে পেছনের গাড়ী চলে যেত, নতুবা আঘাত করতো, যেটা মারাত্মক হতে পারতো। গাড়ীতে বসে রোগী একটু একটু কোঁকাচ্ছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, মাথায় ব্যথা পেয়েছেন কিনা। উনি জানালেন, কপালের বাম পাশে ব্যথা পেয়েছেন। তবে তার চেয়ে তীব্র ব্যথা করছে তার বাম হাতটা, উনি হাতটা নাড়াতে পারছেন না। এর মধ্যে শুনতে পেলাম উনি সেলফোনে কাকে যেন বলছেন, “আমি এ্যাক্সিডেন্ট করেছি, আমাকে দুইজন লোক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।“ অপর প্রান্ত থেকে জানতে চাওয়া হলো, কোন হাসপাতালে? উনি আমাকে ফোনটা দিয়ে বললেন, ওনার স্ত্রীকে জানাতে ওনাকে কোন হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। আমি কথা বলে বুঝতে পারলাম যে ওনার স্ত্রী স্বাভাবিক ভাবেই খুবই উৎকন্ঠিত। ওনাকে আশ্বস্ত করে বললাম, মনে হচ্ছে আঘাত তেমন গুরুতর নয়। তবুও আমরা মনে করি ওনাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন, তাই আমরা ওনাকে কাছাকাছি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। উনি যেন কাউকে সাথে করে সেখানে আসেন। উনি জানালেন, উনি মগবাজারে থাকেন, ওনার দেবরকে নিয়ে উনি তক্ষুনি রওনা দেবেন। মগবাজার থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কিভাবে আসতে হবে, পথের বিবরণসহ সেটাও তাকে বুঝিয়ে দিলাম। আহত ব্যক্তির সাথে কথোপকথনে জানলাম, উনি পেশায় একজন ড্রাইভার। একজন মালিকের প্রাইভেট গাড়ী চালান। মালিক একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, এখন ঈদ উপলক্ষে ঢাকার বাইরে আছেন। তাই এই সুযোগে কিছুটা বাড়তি উপার্জনের আশায় তিনি তার ব্যক্তিগত মটর সাইকেলে ‘অন লাইন সার্ভিস’ দিয়ে থাকেন (’পাঠাও’ বা এই ধরণের কোন কিছু)। সেরকম একটি কল পেয়েই তিনি এদিকে আসছিলেন।
হোটেল র্যা ডিসন পর্যন্ত আসার অনেক আগে থেকেই আমি শহীদকে রাস্তার বামে চেপে আসার জন্য বলছিলাম। মুশকিল হলো বৃষ্টির কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই, রাস্তার এই সাইডে তখন বেশ বড় একটা জ্যাম ছিল, যদিও অপর সাইডটা মোটামুটি যানজটমুক্ত ছিল। মিরপুরের দিক থেকে প্রচুর সংখ্যক গাড়ী ফ্লাই ওভার দিয়ে এসে মূল সড়কে নামছিল, আবার মহাখালির দিক থেকেও অনেক গাড়ী আসছিল। র্যা ডিসন হোটেলের কাছাকাছি আসতেই শহীদকে বললাম গাড়ী আস্তে আস্তে বামে চাপাতে। কিন্তু যেভাবে প্রায় বাম্পার টু বাম্পার লেগে লেগে বামের বাস ও গাড়ীগুলো আসছিল, বিশেষ করে বাসগুলো, তাতে অনেক আগে থেকে বামের ইন্ডিকেটর দেয়া সত্তেও গাড়ী বামে টার্ন নেয়া তো দূরে থাক, চাপানোও সম্ভব হচ্ছিল না। আমি ইশারায় বাম দিকের দু’জন ইন্টার ডিস্ট্রিক্ট বাস ওয়ালাকে একটু পাস দেয়ার অনুরোধ জানালাম, কিন্তু তারা পরোয়া করলো না। এর পরে গাড়ীর কাঁচ নামিয়ে আমি দেখি একটা লক্কর ঝক্কর মার্কা বাস, চালকের আসনে ১৯/২০ বছরের কালো কুচকুচে এক চালক। আমার কাঁচ নামানো দেখে সে বাসটা একটু স্লো করলো, কিন্তু চলতেই থাকলো। ওকে বললাম, আমার গাড়ীতে একজন রোগী বসা আছে, তাকে বাম দিকের ঐ হাসপাতালটাতে নিয়ে যাচ্ছি। সে সাথে সাথে বাসটাকে ডেড স্টপ করে বললো, ‘যান স্যার’! একেবারে ঠিক জায়গামত এই স্পেসটুকু পাওয়াতে আমাদের পক্ষে বামে ঢোকা সম্ভব হলো। দুই তিনটা বিলাস বহুল বাস আমাদেরকে অতিক্রম করে গেল, স্পেস দিল না। আর তাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত এই কম বয়সের এবং (সম্ভবতঃ) কম শিক্ষিত ছেলেটা আমাদেরকে যে সৌজন্য দেখালো এবং অদেখা রোগীর প্রতি একটা ছাড় দিল, তার জন্যে মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। তা না হলে আমাদেরকে অনেক পথ ঘুরে আসতে হতো। আল্লাহ যেন সেই লক্কর ঝক্কর বাসওয়ালার সুবিবেচনার জন্য তাকে উত্তম প্রতিদান দেন!
রোগীকে গাড়ী থেকে নামিয়ে ধরে ধরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে প্রবেশ করলাম। সেখানে উপবিষ্ট দু’জন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, ওনাকে কোথায় নিতে হবে। লোকটির কপাল থেকে রক্ত ঝরা দেখে ওরা বুঝতে পেরেছিল এ্যাক্সিডেন্টের রোগী। বসেই বসেই ওরা নির্বিকারভাবে ইশারায় দেখিয়ে বললো, সামনে যেয়ে বামে যান। রোগী গাড়ীতে বসে আমাদের কথোপকথন শুনে বুঝেছে, আমরা আরেক রোগীকে দেখার জন্য রওনা হয়েছিলাম। তিনি নিজেই কৃতার্থ হয়ে বললেন, স্যার বাকীটা আমি এখন একাই পারবো। আপনারা যান আপনাদের রোগীকে দেখতে। আমি তাকে উপস্থিত আরেকজন উৎসাহী ব্যক্তির কাছে হ্যান্ড ওভার করে, তাকে শুভকামনা জানিয়ে গাড়ীতে অপেক্ষমান শহীদের কাছে ফিরে এলাম। কিছুদূর এসে শহীদ জিজ্ঞেস করলো লোকটির মোবাইল নম্বর এবং নাম টুকে রেখেছি কিনা। না বলাতে তার মৃদু ভর্ৎসনা উপহার পেলাম। পরে অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থায় আমি তার নাম ঠিকানা ও সেলফোন নম্বর জেনেছি। ওনার নাম মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু, বাড়ী জামালপুর জেলার ইসলামপুরে।
এর পরে আসলাম সিএমএইচে। ইত্যবসরে জেনে গেছি কবিরকে জরুরী বিভাগ থেকে চেস্ট পেইন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে। সরাসরি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অন ডিউটি ডাক্তারের কাছে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে মোটামুটি আশ্বস্ত হ’লাম যে সে এখন আশঙ্কামুক্ত। তবে রক্ত পরীক্ষার একটা রিপোর্ট আসা তখনো বাকী। সেটা আসলে আরো নিশ্চিত করে বলা যাবে, কতটা আশঙ্কামুক্ত। যেহেতু রোগী ঘুমিয়ে, আমরা আর দেরী না করে গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরে এলাম।
দোয়া, প্রার্থনা ও শুভকামনা—–
কবিরের আশু রোগমুক্তির জন্য, সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে আসতে পারে, পরিবারের কাছে।
সেই নাম না জানা আহত ব্যক্তিটির জন্য (পরে অবশ্য তার নাম ঠিকানা জেনেছি), সেও যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে যেতে পারে, পরিবারের কাছে। তার আঘাতজনিত যন্ত্রণার আশু উপশম কামনা করছি।
সেই লক্কর ঝক্কর বাসওয়ালার জন্য, তার সুবিবেচনাপ্রসূত ছাড়টুকুর জন্য (হাইওয়ে ড্রাইভিং এর স্বাভাবিক নিয়ম হলেও, আমাদের দেশে এটা একটা “ছাড়”ই বটে)। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তাকে সড়কে ও যানবাহনে নিরাপদ রাখুন।
মেজর কামরান এর জন্য- তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আহত ব্যক্তিটিকে দেখার জন্য থেমেছিলেন এবং তাকে হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
বন্ধু শহীদের প্রতি, তার এই সদিচ্ছাটুকুর জন্য এবং একটা শুভকাজে আমাকে সামিল করে নেয়ার জন্য। জাযাকাল্লাহু খাইরান!
ঢাকা
২৯ আগস্ট ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।