ছোটবেলা থেকে আমি ঢাকা শহরে মানুষ হয়েছি। একেবারে শৈশবের প্রথম সাতটি বছর অবশ্য চট্টগ্রামে কাটিয়েছিলাম। আমার শৈশব কৈশোরের রোযার স্মৃতিগুলোও শহরভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে মনে গেঁথে আছে। ছোটবেলায় কোন কোন দিন আম্মার ইফতার বানাতে ইচ্ছে না হলে কিংবা যথেষ্ট উপকরণ তৈরী করতে না পারলে আমাকে মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে বলতেন, পাড়ার ইফতারীর দোকান থেকে কিছু কিছু সামগ্রী কিনে আনতে। রোযার মাসে এখনকার মত তখনও দুপুরের পর থেকেই দোকানীরা পাড়ায় পাড়ায় ইফতারীর পসরা নিয়ে বসতো। আমার এখনও তাদের সেই পেঁয়াজু আর বেগুনীর সুঘ্রাণ নাকে লেগে আছে। তখন আমাদের আশে পাশের বাসাগুলো থেকেও মাঝে মাঝে ইফতারীর আদান প্রদানের প্রচলন ছিল। মেন্যু প্রায় অভিন্ন হলেও মাঝে মাঝে কোন কোন বাসার ইফতারীগুলো বেশী মজা লাগতো। কিন্তু সেদিনের সেই পেঁয়াজুর স্বাদ আর কোথাও পাই না। এর অনেক যুগ পর গত কয়েক বছর আগে আমার এক ভাতিজা-বৌ মিতুর হাতে বানানো পেঁয়াজু খেয়ে সেদিন চমকে উঠেছিলাম, এ তো আমার সেই ছোটবেলায় খাওয়া পেঁয়াজু’র স্বাদ!
ছোটবেলায় ঈদ উপলক্ষে নানাবাড়ী-দাদাবাড়ী বেড়াতে যেতাম বলে রোযার শেষের কয়েকটা দিন গ্রামে কাটানোর অভিজ্ঞতাও আছে। তখন আমাদের দেশের গ্রামগুলোতে বৈদ্যুতিক বাতি ছিলনা। সন্ধ্যার পরে পরেই সবকিছু নিঝুমপুরীর মত নীরব, নিস্পন্দ হয়ে যেত। বাড়ীর মানুষের কথাবার্তার চেয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর শেয়ালের হুক্কা হুয়াই বেশী শোনা যেত। মাঝে মাঝে দুই একটা দলছুট জোনাকি ঘরে প্রবেশ করে আমাদের প্রভূত আনন্দ দিতো। সেখানে দেখেছি ইফতারীর আলাদা আয়োজন বলতে তেমন কিছু থাকতোনা। দুই একটা খেজুর, ছোলা মুড়ি আর দুই একটা বেগুনী পেঁয়াজু খেয়ে সবাই নামাযে দাঁড়িয়ে যেত, মাগরিবের নামায পড়েই লন্ঠনের আলোয় সবাই বসে রাতের খাবার খেয়ে নিতো। আবার মধ্যরাতে উঠে সেহরী খাওয়া হতো। গ্রামে রোযার মাসে বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রাতে (জুম্মারাত) অবস্থাপন্নরা মাসজিদে শিরনী বিতরণ করতেন। ধোয়া কলাপাতায় করে এক ধরণের গরম খিচুরী দরিদ্র গ্রামবাসীকে এবং মাসজিদে আগত মুসাফিরগণকে খাওয়ানো হতো।
কর্মজীবনে দেশের বিভিন্ন জেলায় রোযা পালনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী উজ্জ্বল হয়ে আছে চট্টগ্রাম আর সিলেটের স্মৃতি। এ দুই জেলার মানুষেরা পুরো রোযার মাস বেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করে থাকে। তবে মাজার ভিত্তিক বিভিন্ন কুপ্রথার কারণে তাদের অনেকে জ্ঞাতসারে এবং অজ্ঞাতসারে নানারকমের ধর্মবিরোধী কাজও করে থাকে। ময়মনসিংহে থাকাকালীন আমাকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় কর্মোপলক্ষে যেতে হতো। একবার রোযার মাসে গফরগাঁও এর এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেটা এতই অজ পাড়াগাঁ ছিল যে সন্ধ্যার সময় কোথাও আমি ইফতারী কেনার মত কোন দোকান খুঁজে পাইনি। শেষ পর্যন্ত এক মুদি দোকান থেকে আমরা কয়েকজন মুড়ি কিনে নিয়ে শুকনো মুড়ি আর পানি খেয়ে রোযা ভাঙি। ফেরার পথে গফরগাঁও উপজেলায় যখন পৌঁছি, তখন স্থানীয় একটি মাসজিদে এশার নামায শুরু হচ্ছিল। আমরা তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে জামাতে সামিল হ’লাম। ভাবছিলাম, আমরা যেহেতু মুসাফির, সেহেতু ঐ রাতে ২০ রাকাতের পরিবর্তে ৮ রাকাত তারাবীর নামায পড়ে ফিরে আসবো। এশার ফরয আর সুন্নাত নামায শেষে তারাবীর নামায শুরু হলো। জামাতের পেছনের দিকে ছিলাম, তাই ইমাম সাহেবকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু তার সুললিত কন্ঠে ক্বিরাত শুনে আপন মনে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে সম্পূর্ণ সঠিক উচ্চারণে তিনি ক্বিরাত পাঠ করছিলেন। এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে ৮ রাকাতের পর জামাত ত্যাগ করতে পারিনি। পুরো বিশ রাকাত এবং পরে আরো তিন রাকাত বেতরের নামায পড়ে তবে মাসজিদ থেকে বের হয়েছিলাম। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম এটা দেখে যে পুরো বিশ রাকাত তারাবীর নামাজ সেই ইমাম সাহেব একাই পড়িয়েছিলেন। অন্যান্য মাসজিদের মত দুইজন হাফেজ সাহেব মিলে পড়ান নাই, যদিও ক্বিরাতে ভুল ত্রুটি হলে তা ধরিয়ে দেয়ার জন্য অপর একজন হাফেজ সাহেব স্ট্যান্ডবাই ছিলেন। স্থানীয় লোকজন আমাকে আলাপচারিতায় জানিয়েছিল যে সত্তরোর্ধ এ হাফেজ সাহেব তার যৌবনকালে সে এলাকায় এসেছিলেন। তারপর থেকে দীর্ঘদিন ধরে একাদিক্রমে তিনি সেখানে ইমামতি করে আসছেন।
আমি তখন ঢাকায় থাকি। রোযা শুরু হবার ঠিক আগে আগে একদিন আব্বা আমার বাসায় এসে হাজির হলেন। তিনি জানালেন, এবারের রোযাটা তিনি সাংসারিক চাপমুক্ত হয়ে আমাদের সাথে করবেন বলে মনস্থ করেছেন। আমরা তাঁর এ ইচ্ছের কথা শুনে খুব খুশী হ’লাম। আব্বাকে ছোটবেলা থেকেই আমরা ভাই বোনেরা খুব ভয় পেতাম। আব্বা ঘরে থাকলে কেউ উচ্চকন্ঠে কথা বলতাম না। আমরা বড় হয়েও আব্বার সামনে খুব সাবধানে চলাফেরা করতাম। উনি কখনো তেমন বকা ঝকা করতেন না, তবুও কেন জানি খুব ভয়ে ভয়ে এবং সংকোচে থাকতাম। সেই রোযার মাসটাতে ওনার রুটিন ছিল এবাদত বন্দেগী আর শুধুই পড়াশোনা। আমার বাসায় আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অনূদিত পবিত্র কোরানের ইংরেজী অনুবাদ ছিল। উনি সেটা পড়তেন, বিভিন্ন রেফারেন্স নোট করতেন এবং তেলাওয়াতের সময় আরবী কোরান থেকে তেলাওয়াত করতেন। এছাড়া তাঁকে ইমাম গাযযালীর কয়েকটা বই পড়তে দেখেছিলাম। শুধু বিকেল হলে উনি আমার চার ও দুই বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে বাসার সামনে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসতেন।
ওনার সাথে আমার কথাবার্তা হতো সাধারণতঃ রাতে খাবার টেবিলে। দিনের বেলায় আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে রান্না বান্নার অবসরে এসে ওনার সাথে গল্প করতো। উনিও মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে ওর সাথে গল্প করতেন। একদিন রাতে খাবার টেবিলে উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোন অসুবিধায় আছি কিনা। আমি সত্য সত্যই সেদিন একটা বিষয় নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন এবং অস্বস্তিতে ছিলাম। বৈদেশিক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় অগ্রিম টিএ/ডিএ বিল দাবী করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়ার আদেশপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট একাউন্টস অফিসারের কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছিল না, আজ এটা নেই কাল ওটা নেই, এসব অজুহাতে। যিনি এ ব্যাপারটা নিয়ে ডীল করছিলেন, তিনি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রমোটী অফিসার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উনি ওনাকে ‘খুশী করানো’র ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। আমিও ওনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, সেটা না করতে আমি বদ্ধপরিকর। কিন্তু মনে মনে ভেবে পাচ্ছিলাম না, উনি যদি সময়মত কাগজপত্রগুলো না পাঠান তাহলে আমি এর পরে কী পদক্ষেপ নিতে পারি। আব্বা জিজ্ঞেস করাতে ওনাকে ঘটনাটি সবিস্তারে খুলেই বললাম। পরেরদিন অফিসে যাবার সময় আব্বা আমাকে বিদেয় দিতে দরজা পর্যন্ত এলেন। বের হবার সময় তিনি বললেন, যাও, আশাকরি তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে আমি অবাক হয়ে গেলাম। যে অফিসার পদবীতে আমার জুনিয়র হয়েও এতদিন আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে চেয়ারে বসে থেকে কথা বলতেন, তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন এবং বসতে অনুরোধ করলেন। আমাকে বসিয়ে রেখেই তিনি আমার কাগজপত্রগুলো স্বাক্ষর করে মন্ত্রণালয়ের ফরোয়ার্ডিং লেটারসহ আমাকে হাতে হাতে হস্তান্তর করে বললেন, ‘আপনি এগুলো তাড়াতাড়ি একাউন্টস অফিসে জমা দেন, নাহলে আপনি সময়মত ফ্লাইট ধরতে পারবেন না।’
এর কিছুদিন পরে আমি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনে কর্তব্যে যোগদান করি। ঠিক এক বছর পর, অর্থাৎ এর পরের রোযার মাসেই আমি একটা আঞ্চলিক কনফারেন্সে যোগদান করতে সৌদি আরবের জেদ্দায় যাই। সেই সুবাদে পবিত্র রোযার মাসে ওমরাহ পালনেরও একটা অমূল্য সুযোগ পেয়ে যাই। মনে আছে, পবিত্র রোযার মাসে ক্বাবা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে আব্বার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করেছিলাম। কনফারেন্স শেষে এক সপ্তাহ পর ডিউটি স্টেশনে ফিরে আসি এবং বাসায় এসে দেখি আব্বার একটি চিঠি এসেছে। চিঠিতে আব্বা আমার স্ত্রীকে লিখেছিলেন, ‘গত বছর তোমার বাসায় কাটানো রোযার মাসটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।’ চিঠিটা পড়ে আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। আমার চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। তাঁর জন্য দোয়া করতে বলেছিলেন এবং বাচ্চাদেরকে কড়া শাসন করতে নিষেধ করেছিলেন। আজ স্মরণ করতেও কষ্ট হচ্ছে যে এটাই ছিল আমাদেরকে লেখা তাঁর শেষ চিঠি। সেই রমজানেরই ১৮ তারিখে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। পরে মিলিয়ে দেখি, আমাকে যেদিন তিনি তাঁর জন্যে দোয়া করতে লিখেছিলেন, ঠিক সেদিনই আমি পবিত্র ক্বাবা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন এর কাছে তাঁর জন্য অনেকক্ষণ প্রার্থনা করেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি তাঁর শয্যাপাশে থাকতে পারিনি, পরে ভাইবোনদের কাছে জেনেছি, মৃত্যুর একটু আগে তিনি আমার খোঁজ করেছিলেন এবং আমাকে তাঁর অসুস্থতার খবর জানাতে নিষেধ করেছিলেন।
হে আল্লাহ, এ জীবনে যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু হতে পেরেছি, তা সবই সম্ভব হয়েছে আমার মা বাবার আত্মত্যাগের জন্য। “হে আমার প্রতিপালক! আমার মা বাবার প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, স্নেহ-মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”
ঢাকা
০৯ জুন ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।