‘Last In, First Out’

ছোটবেলায় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা প্রায় প্রতি বছরই নানাবাড়ী, দাদাবাড়ী বেড়াতে যেতাম। উভয়বাড়ী উত্তরবঙ্গে হওয়ার কারণে আমরা ট্রেনেই বেশী যাওয়া আসা করতাম। খুবই আনন্দের ছিল এ জার্নিটা। তখন সারাদিনে ঢাকা থেকে মাত্র দুটো ট্রেন উত্তরবঙ্গে যেত, একটা সকাল ৮ টার দিকে ছাড়তো, নাম ১১ আপ দ্রুতযান এক্সপ্রেস। অপরটা রাত ১১টায়, নাম ৭ আপ নর্থ বেঙ্গল মেইল। প্রথম প্রথম ট্রেনগুলো নারায়নগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করতো, আমরা উঠতাম গুলিস্তানের ফুলবাড়িযাস্থ পুরাতন ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে। পরে ষাটের দশকের শেষের দিকে কমলাপুর স্টেশন চালু হয়ে গেলে ট্রেনগুলো কমলাপুর থেকেই ছাড়তো। সাংবাৎসরিক যাওয়া আসার কারণে আমাদের অর্থাৎ ভাইবোনদের প্রায় মুখস্তের মত হয়ে গিয়েছিল কোন স্টেশনের পর কোন স্টেশন আসবে। এ নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অবতীর্ণ হতাম। যাওয়া আসা করতে করতে আমরা রেলের একটা নিয়ম সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলাম–‘Last In, First Out’। আমরা লক্ষ্য করতাম যে আমাদের ট্রেনটা কোন প্লাটফর্মে প্রবেশ করার সময় সেখানে যদি অন্য লাইনে আরেকটা যাত্রীবাহী ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতো, তবে সেটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই আমাদের ট্রেনটা স্টেশনে কিছুক্ষণ থেমে আবার চলা শুরু করতো। এটা দেখে আমরা খুব খুশী হ’তাম। আবার এর অন্যথা হলে, অর্থাৎ আমাদের ট্রেনটা প্লাটফর্মে দাঁড়ানো অবস্থায় অন্য কোন ট্রেন প্রবেশ করলে আমাদেরকে রেখে ঐ ট্রেনটাই আগে চলে যেত। আমরা তখন জানালা দিয়ে হাত নেড়ে যাত্রীদের ‘বাই বাই’ দিতাম। এটাই ছিল ‘Last In, First Out’ নিয়ম।

অধুনা আমাদের মাসজিদেও এরকম একটা নিয়ম লক্ষ্য করছি। মুসল্লীদের মাঝে অনেকেই আছেন, যারা মাসজিদে এসে জামাতে অংশ গ্রহণের সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের এ নিয়মটা মেনে চলেন। বিশেষ করে জুম্মার দিনে এটা বেশী হয়। সোয়া একটায় খুৎবা শুরু হলেও পৌণে একটার মধ্যেই মাসজিদ প্রায় ভরে যায়। কিন্তু তারা আধা ঘন্টা আগে এসে বসতে থাকতে চান না। আবার ভেতরের এসির ঠান্ডা বাতাসের লোভও ছাড়তে পারেন না। তাই বাইরের প্রাঙ্গণে না বসে ইমাম সাহেবের খুৎবা যখন একেবারে শেষের পর্যায়ে, তখনই তারা স্যান্ডেল জোড়া হাতে করে মাসজিদে প্রবেশ করেন এবং বসে থাকা মুসল্লীদের ঘাড়ের উপর দিয়ে পা ফেলে লম্বা কদমে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনের দিকে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে খুঁজতে অগ্রসর হতে থাকেন। তাদের হাতের স্যান্ডেল জোড়া কার মাথা, কার ঘাড় স্পর্শ করে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে তারা ভ্রূক্ষেপ করেন না। ফরজ দু’রাকাত নামাযের পর যেই না ইমাম সাহেব সালাম ফিরালেন, অমনি তারা তড়াক করে উঠে আবার সেই স্যান্ডেল জোড়া হাতে করে লম্বা পায়ে মুনাজাতরত মুসল্লীদের ঘাড়ের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে যান, অর্থাৎ ‘Last In, First Out’।

সম্প্রতি মিরপুর ডিওএইচএস এ বসবাসকারী একজন পাঠক ফেইসবুকে “জুম্মার নামাজনামা” শিরোনামে তার কিছু অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা লিখে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার পোস্টটা পড়েই নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মনে এসব ভাবনার উদয় হলো….. 🙂 🙂

ঢাকা
১০ অক্টোবর ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

(অন্যত্র প্রকাশিত)

৬,০৪২ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “‘Last In, First Out’”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    ভাল লাগলো পড়ে। সমাজের সব ক্ষেত্রে যেদিন আমরা শৃংঙ্খলা মেনে চলতে, করতে, বসতে ও মানতে শিখবো সেদিন আর এমন দূর্ভোগ রবে না।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।