একটি উচ্ছ্বল প্রাণের ঊর্ধ্বারোহণঃ

Friends at a funeral

আমার বন্ধু জামান, অনেক প্রতিভা ও গুণের অধিকারী। ওর সব গুণের চেয়ে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় যে গুণটি সেটি হলো শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও ধীর স্থির এবং প্রতিক্রিয়াহীন থাকার সক্ষমতা। গত কয়েক বছর ধরে জানি যে ক্রমাগতভাবে ওর উপর দিয়ে নানা রকমের ঝড় ঝঞ্ঝা বয়ে চলেছে। প্রথমে ওর বড়ভাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে কয়েকবার সিঙ্গাপুরে যাওয়া আসা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। এর কিছুদিন পরে সে নিজেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ইউনাইটেড হাসপাতালে বাইপাস সার্জারীর পর সে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক, সুস্থ জীবন ফিরে পায়। ২০১৬ সালে সস্ত্রীক হজ্জ্বে যায়। হজ্জ্বব্রত পালন শেষে একেবারে শেষের পর্যায়ে ভাবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। নির্ধারিত ফ্লাইটের আগেই ওরা দেশে ফিরে এসে ভাবীর চিকিৎসা শুরু করে। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর ডাক্তার ঘোষণা করেন, তিনি প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারে আক্রান্ত। দেশেই একটা জরুরী সার্জারীর পর তাকে উচ্চতর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর শুরু হলো দেড় দু’মাস পর পর ভাবীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাওয়া আসা করা। এর মধ্যে ভাবী বেশ খানিকটা সুস্থও হয়ে উঠলেন। তখন ওদের একমাত্র মেয়ের পূর্ব নির্ধারিত বিয়ের তারিখ কিছুটা পরিবর্তন করে অনুষ্ঠানটি সুসম্পন্ন করা হলো। ভাবীকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখতে পেয়ে আমরা অর্থাৎ ওদের বন্ধুরাও খুব খুশী হয়ে উঠলাম। এর অন্যতম কারণ, ভাবী খুবই একজন প্রাণবন্ত, হাসিখুশী মহিলা ছিলেন। যেকোন অনুষ্ঠানে উনি নিমেষেই আসরের মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারতেন। আমাদের বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে দেখতাম, তিনি নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বন্ধুদের সাহায্য করার নিমিত্তে অভ্যর্থনাকারী বনে যেতেন। বন্ধুদের হয়ে তিনি তাদের মেহমানদের দেখভাল করতেন এবং একেবারে শেষের পর্বে নিজে ভোজে অংশ নিতেন। আমরা ভেবেছিলাম, এমন একজন সজ্জন এবং পরোপকারী ব্যক্তি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না। সকলের দোয়ায় তিনি ক্রমেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গত কয়েকমাস আগে তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সিঙ্গাপুর নেয়া হলে সেখান থেকে জানানো হলো, এখন একমাত্র চিকিৎসা রোগ যন্ত্রণার উপশম করা, আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা নেই!

এতসব দুর্যোগের মাঝেও জামান সর্বংসহা পাহাড়ের দৃঢ়তা নিয়ে তার পারিবারিক, সামাজিক দায়িত্ব সবকিছুই পালন করে গেছে। বন্ধুদের সাথে আলাপচারিতার সময় তার অভিব্যক্তিতে কখনোই তার ভেতরে প্রবাহমান উত্তাল সুনামীর ঢেউ খেলে যায়নি। সেসব ঢেউ সে তার অন্তরের অভ্যন্তরীণ পর্বতমালা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। তিন চারদিন আগে খবর পেলাম, ভাবী পুনরায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর আগেও তিনি যখন কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, আমার স্ত্রী দুই একদিন গিয়ে তাকে দেখে এসেছিলেন। কিন্তু গত পরশুদিন থেকে আমি নিজেই জামান ও ভাবীর জন্য ভীষণ দুঃখবোধ করতে থাকলাম। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামায পড়ার সময় ভাবীর কথা মনে হওয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন এর কাছে তার জন্য দোয়া করলাম, তার মাগফিরাত কামনা করলাম। মনটা খারাপ লাগছিল বলে মাসজিদ থেকে বাসায় ফিরে এসে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হ’লাম। সেখানে গিয়ে শুনি তিনি তখন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ডাক্তাররা শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। আমরা কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে তার জন্য মনে মনে দোয়া পড়ে যাচ্ছিলাম। ভেতরে ভাবীর নিকটাত্মীয়রা তার পরিচর্যা করে যাচ্ছিলেন। জামান মাঝে মাঝে বের হয়ে এসে বাইরে অপেক্ষমান তার বন্ধু ও বন্ধুপত্নীদের সাথে কিছু নৈমিত্তিক আলাপচারিতা চালিয়ে যাচ্ছিল। একবার সে কোমর ধরে মেঝেতে বসার মত হলো। বুঝা গেল, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর কোমর ধরে গেছে। ভাবীরা চেয়ার ছেড়ে উঠে তাকে বসার অনুরোধ জানালেন। আমি আর আমাদের আরেক বন্ধুও ওর সাথে দাঁড়িয়ে আলাপ করছিলাম। আমরাও ওকে অনুরোধ করলাম চেয়ারে বসার জন্য। ও হাসিমুখে বললো, “ভাবীরা দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি চেয়ারে বসে থাকবো, শোকের মাত্রা যতই হোক না কেন, এও কি সম্ভব?”

দেড় দু’ঘন্টা সেখানে অবস্থান করে আমরা যখন বাসায় ফিরে আসি, তখন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে কিছু নতুন টেস্ট দিয়েছিলেন। ভোরে ফজরের নামায পড়েই খবর পাই, ভাবী আর টেস্ট রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করেন নাই। তার আগেই তিনি পরপারে চলে গেছেন। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গিয়ে দেখি, জামান এবং ওর আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা নীচে লবীতে অপেক্ষা করছে, মরদেহ নিয়ে বাড়ী ফিরে আসার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে মুখে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়ে। ওর সাথে নীরবে কাঁধ মিলালাম, ওর ভারী বুকের কিছুটা ওজন অনুভব করলাম। দু’চারটে কথা হলো- ও জানালো, ফজরের নামায পড়ে ও ভাবীর মাথার নীচে হাত রেখে ওনাকে কমফোর্ট দেয়ার চেষ্টা করছিল। ওর হাতের উপরেই মাথা রেখে ভোর ঠিক পাঁচটা এক বা দুই মিনিটের সময় ভাবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! লক্ষ্য করলাম, এ কথা বলার সময় এই প্রথম যেন একটা অটল পাহাড় কিছুটা নড়ে উঠলো!

আমরা নিকট প্রতিবেশী। আমাদের স্থানীয় মাসজিদেই ভাবীর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। নির্ধারিত সময়ের একটু আগে আগেই মাসজিদে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের অনেক বন্ধু এবং জামানদের অনেক শুভানুধ্যায়ী সেখানে একত্রিত হয়েছে। এর আগে কখনো আমি আমাদের এতজন বন্ধুকে একত্রিত হতে দেখিনি। ফরজ চার রাকাত নামাযের পর ইমাম সাহেব নামাজে জানাযার ঘোষণা দিলেন। জানাযার নামাযের আগে আগে মৃত ব্যক্তির নিকট-ওয়ারিশদের মধ্য থেকে একজনের দাঁড়িয়ে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে দু’চারটে কথা বলে তার পক্ষ থেকে উপস্থিত মুসল্লীদের কাছে মা’ফ চেয়ে নেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। ভেবেছিলাম, তদনুযায়ী জামান হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু দেখলাম, ও নয়, ওদের বড় ছেলে দাঁড়িয়ে গেল। বুঝলাম, জামান বেদনা ভারাক্রান্ত বলেই হয়তো কিছু বলতে চায়নি। সুনামীর চোরাস্রোত হয়তো এবারে পাহাড়ের তলদেশে ক্ষয় ধরিয়েছে। আর তা ছাড়া ও কখনো লৌকিকতা পছন্দ করেনা বলেই জেনে এসেছি। জীবনে অনেক ভাল ভাল কাজ ও লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই করে গেছে।

ওদের বড় ছেলেটা খুব সুন্দর করে ওর মাকে ইন্ট্রোডিউস করে বললো, “আমার মা জীবনে কারো উপরে কখনো বেশীক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতেন না। পরিচিত অপরিচিত কারো কোন বিপদের কথা শুনলে তিনি সাহায্য করতে ছুটে যেতেন। এখানে উপস্থিত আপনাদের মধ্যে কেউ যদি কখনো আমার মায়ের উপরে রাগ করে থাকেন, আমি তার ছেলে হয়ে মায়ের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, আপনারা আমার মাকে মাফ করে দিবেন। আমি জানি এখান থেকে আমার মা যেখানে চলে গেছেন, সেখানে তিনি সাথে করে কারো উপর কোন রাগ নিয়ে যাননি। আপনারাও তার উপর রাগ করে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন”। আরও অন্যান্য কিছু কথার সাথে ওর এই কথাগুলো আমার কানে লেগে আছে। আমরা যারা ওদেরকে চিনি, তারা জানি সে এতটুকুও মিথ্যে বলেনি। ওর কথা শুনে আমার চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে উঠেছিল।

নামাযে জানাযার পর ভাবীকে বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওনার দুই ছেলে আর খুব সম্ভবতঃ মেয়ে জামাই ক্ববরে নেমে তার দেহকে অন্তিম শয্যায় শায়িত করে। ওরা ওপরে উঠে এলে শুরু হয় মাটি দেয়া, আমিও একটু মাটি হাতে নিয়ে ক্ববরের উপর ছিটিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে পাঠ করতে থাকলাম সেই অমোঘ সত্য বাণীঃ

“মিনহা খালাকনাকুম,
ওয়া ফিহা নুয়িদিকুম,
ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম
তারাতান উখরা।”
“এই মাটি থেকেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, এখানে তোমাদের ফিরে আসতে হবে, এবং এখান থেকেই আরো একবার তোমাদেরকে উল্থিত করা হবে।”

ফিরে আসার সময় ঘুরে ঘুরে থেমে থেমে সেখানকার বিভিন্ন ক্ববরের উপর স্থাপিত বিচিত্র ধরণের সব স্মৃতিফলক পড়ছিলাম। স্মৃতিফলকের উপর উৎকীর্ণ মৃত ব্যক্তিদের পরিচিতিমূলক নানা বিশেষণে ভূষিত কিছু বাণী পড়ে মনের মধ্যে ভেসে উঠছিলো অনেক দিন আগে পড়া একটি বিখ্যাত ইংরেজী কবিতার কিছু কথাঃ

Death the Leveller

The glories of our blood and state
Are shadows, not substantial things;
There is no armour against Fate;
Death lays his icy hand on kings:
Sceptre and Crown
Must tumble down,
And in the dust be equal made
With the poor crookèd scythe and spade.

Some men with swords may reap the field,
And plant fresh laurels where they kill:
But their strong nerves at last must yield;
They tame but one another still:
Early or late
They stoop to fate,
And must give up their murmuring breath
When they, pale captives, creep to death.

The garlands wither on your brow,
Then boast no more your mighty deeds!
Upon Death’s purple altar now
See where the victor-victim bleeds.
Your heads must come
To the cold tomb:
Only the actions of the just
Smell sweet and blossom in their dust.

James Shirley

ঢাকা
০৯ অক্টোবর ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৬,২০৭ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।