প্রয়াত শিক্ষক, পরবর্তীতে সহকর্মী মীর ওয়ালীউজ্জামান স্মরণেঃ

এম সি সি তে (Momenshahi Cadet College-MCC) আমার কিছুদিনের শিক্ষক ছিলেন মীর ওয়ালীউজ্জামান, ইংরেজীর প্রভাষক। আমরা তখন একাদশ কিংবা দ্বাদশ শ্রেণীতে, উনি ঢাবি থেকে সদ্য মাস্টার্স করা টগবগে তরুণ শিক্ষক, অত্যন্ত সুদর্শন, নায়কোচিত চেহারা। বয়সের ব্যবধান তেমন ছিলনা (গুরু শিষ্যের মত), তদুপরি ওনার সারল্য এবং আন্তরিকতার কারণে আমরা বন্ধুর মত ছিলাম। আমাদের চোখে উনি তখন ভীষণ একজন স্মার্ট টীচার। এ রকম সুদর্শন একজন ব্যক্তিত্বকে আমরা প্রভাষক নয়, বরং কলেজের এডজুট্যান্ট এবং কালক্রমে প্রিন্সিপাল হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা শিক্ষা কোরে তখন অফিসার নেয়া হচ্ছিল। উনি সেখানে যোগদান করবেন কি করবেন না, এ নিয়ে যখন দোদুল্যমান ছিলেন, তখন মাঝে মাঝে এ নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করতেন। আমরা সোৎসাহে তাকে প্রণোদিত করার চেষ্টা করতাম, চোখ বুঁজে সেনাবাহিনীতে যাবার জন্য। শুধুমাত্র আমাদের কথার জন্যই হয়ত নয়, কিংবা হতেও পারে সেজন্যেই, তিনি সেনাবাহিনীতে এডুকেশন কোরে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আজ যখন তাঁর অতীত এবং তৎপরবর্তী জীবন সম্পর্কে জানি যে তিনি কতটা বোহেমিয়ান জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, এবং খেয়ালী জীবনাচারের প্রতি তাঁর কতটা আকর্ষণ ছিল, তখন এই ভেবে আফসোস হয় যে আমরা তাঁকে কী বিপজ্জনক ভুল পরামর্শই না দিয়েছিলাম! সঙ্গত কারণেই তাঁর সামরিক জীবনে অসময়ে যবনিকাপাত ঘটেছিলো, কারণ তাঁর স্বভাবগত জীবন যাপন প্রণালী কঠোর শৃঙ্খ্লার সামরিক জীবনের সাথে আদৌ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

এইচ এস সি পরীক্ষায় আশানুরূপ ভাল ফল অর্জন করতে না পারার কারণে (দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন) উচ্চশিক্ষা নিয়ে তিনি বেশ কিছুকাল দোদুল্যমান ছিলেন। ডাকসু’র ভিপি তোফায়েল আহমেদের সুপারিশে প্রথমে তিনি ঢাবি’র সয়েল সাইন্স বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তার নটরডেমের বন্ধুদের অনেকেই ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে জেনে কেবল তাদের সান্নিধ্য পাবেন, এই আশায় পুনরায় চেষ্টা তদবির করে ফিজিক্সে ট্রান্সফার নি্যেছিলেন। সেখানেও ভাল না লাগার কারণে একদিন সাহস করে সরাসরি ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডঃ সাজ্জাদ হোসাইন এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এভাবেই এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার বছর বিজ্ঞান পড়ার চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে তিনি বিএ অনার্স ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়ার সুযোগ পেলেন। সাহিত্যের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এবং কথাশিল্পী আহমদ ছফা এর সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। কবি আবুল হাসান তাঁর “স্মৃতিকথা” কবিতাটি অন্যান্য আরও চার জন বন্ধুর সাথে তাঁকেও উৎসর্গ করেন।

১৯৪৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর থানার চৌগাছি গ্রামে (নানাবাড়ী, তার পৈতৃক বাড়ী ছিল পাবনা জেলায়) জন্ম নেয়া মীর ওয়ালীউজ্জামান ব্লগে তাঁর নিজের সম্বন্ধে সংক্ষেপে এটুকু বলেছেনঃ
“সেইন্ট গ্রেগরীজ ও পগোজ হাই স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের প্রাক্তন ছাত্র। শিক্ষকতা, চাষবাস, এনজিও কর্ম আর সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। পেশার প্রয়োজনে লেখালেখি করেছেন। সখের লেখা তেমন হয়ে ওঠেনি। জীবনচর্যাই কেমন এলোমেলো। মন লাগেনি কিছুতেই, এ পর্যন্ত”। শেষ পর্যন্ত কোনকিছুতে থিতু না হওয়া মন নিয়েই তিনি চলে গেছেন পরপারে, ২০১৪ সালের পহেলা নভেম্বরে।

আজ মীর ওয়ালীউজ্জামান এর জন্মদিবসও না, প্রয়াণ দিবসও না। তবু আজ সকালে তাঁর কথা মনে পড়লো রাহাত জামান এর একটি ফেইসবুক মন্তব্য পড়েঃ
“নিজের কাজে তো বটেই বন্ধু-বান্ধবের ট্রাক ভাড়া করে জিনিসপত্র টানাটানি করতে হলে ট্রাক চালক হিসাবে আমার একদম ফ্রি সার্ভিস অফার। তো এরকম চার-পাঁচ হাজার কিমি ৩-৫ টনি ট্রাক চালানোটা আমার নেশা হয়ে উঠেছে বলতে পারেন যা সুযোগ পেলে করে ফেলি”।….
“আমি অবাক হইনি যখন এরকম একজন মার্কিন ট্রাক চালক বাংলাদেশী জানতে পেরে আমাকে ইউনুস সাহেবের মাইক্রো-ক্রেডিটের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝিয়ে বলেছিলেন। দূরপাল্লার একটি ট্রাক-চালকদের বিশ্রামাগারে আলাপ শেষে উক্ত চালক যখন আমাকে উনার পরিচয় দিয়ে সুযোগ পেলে আবারো আড্ডা মারার আমন্ত্রণ জানালেন তখন দেখি উনি অর্থনীতির একজন কলেজ শিক্ষকও বটে! বাড়তি কিছু আয় আর আমার মতো ট্রাকের প্রতি ভালোবাসার কারণে এই ইন্টার-স্টেট্ মহাসড়কে”!

২০১১ সাল থেকে তিনি নিয়মিত একটি ব্লগে লিখতেন, সম্পাদনার সাথেও জড়িত ছিলেন। কবিতা ও ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন এবং কয়েকটা বিখ্যাত বই এর অনুবাদ করেছেন। ব্লগে তাঁর একটা লেখা পড়ে জেনেছি, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মীর ওয়ালীউজ্জামান দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ভারী ট্রাক চালাতেন। প্রথমে সখের বসে হলেও পরে এর দ্বারাই তিনি কিছুকাল জীবিকাও নির্বাহ করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা সমাপ্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত এই ট্রাক চালককে নিজেদের মাঝে পেয়ে ভারতের শিলং এর ট্রাক চালকগণ কেউ কেউ প্রথমে একটু বাঁকা চোখে দেখলেও পরে তিনি তার স্বভাবসুলভ বন্ধু বাৎসল্যের কারণে তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন এবং তাদের সাথে সহজে মিশে গিয়েছিলেন। সেখানে যতদিন তিনি এই পেশায় ছিলেন, ততদিন তা আনন্দের সাথেই উপভোগ করেছিলেন।

আমার বই “জীবনের জার্নাল” এর একটি অধ্যায়ে মীর ওয়ালীউজ্জামান এর নামোল্লেখ মাত্র আছে। তবে তাঁকে নিয়ে আরও কিছু লেখার আশা আছে। পাঠকদের যদি তাঁর সম্বন্ধে জানার আরও আগ্রহের উদ্রেক হয়, তবে তাঁর লেখা “কুর্মিটোলা, ময়নামতি” শীর্ষক ব্লগটি নীচের লিঙ্ক থেকে পড়ে নিতে পারেন। ব্লগপোস্ট হিসেবে এটা বেশ দীর্ঘ বটে, তবে আমার মত যাদের বয়স, এবং যারা কখনো ময়নামতি সেনানিবাসে কর্তব্য পালন করেছেন, তাদের মনে সেইসব সোনালী দিনের বহু স্মৃতি জাগ্রত হতে পারেঃ http://arts.bdnews24.com/?p=4264#more-4264

সেনাবাহিনী থেকে একটি শৃঙ্খলাজনিত কারণে বরখাস্ত হবার পর তিনি সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে, মিরপুরের প্রশিকায় এবং ব্র্যাক এর মত এনজিওতে উচ্চপদে চাকুরী করেন। তিনি দ্য ডেইলী স্টার এর অন লাইন এডিটর হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ২০১৪ সালের রাওয়া পিকনিকে, গাজীপুরে। সেদিন অনেকক্ষণ ধরে আমাদের মাঝে এমসিসি নিয়ে পুরনো স্মৃতিচারণ হয়েছিল। আমার বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ করে ডঃ সালেহ তানভীর, যিনি এখন ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, এবং ডঃ নজরুল ইসলাম, যিনি একসময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন এবং বর্তমানে জাতিসংঘে উচ্চপদে কর্মরত আছেন, এদের দু’জনের কথা তিনি আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আজকের এ দু’জন সফল মানুষ হয়তো সেদিনই ছাত্রাবস্থায় তাঁর কাছে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন, যার কারণে এতদিন পরও সেদিন তিনি তাদের কথা এতটা স্পষ্ট করে স্মরণ করেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন যেন এই নীরেট ভাল মানুষটির আত্মাকে শান্তিতে রাখেন এবং শেষ বিচারের দিনে তাঁকে জান্নাত নসীব করেন, এ মুহূর্তে শেষ বিচারের মালিকের কাছে আমার এটাই সনির্বন্ধ প্রার্থনা।

ঢাকা
০১ জুলাই ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৬,৩৭৩ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “প্রয়াত শিক্ষক, পরবর্তীতে সহকর্মী মীর ওয়ালীউজ্জামান স্মরণেঃ”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    স্বাগতম ভাই। আপনার লেখাটা ভালো লেগেছে। অন্যদের কথা জানি না। ব্লগে এখন আসাই হয় কম। তবে আসলে মন্তব্য করার চেষ্টা করি, নিজের মতামত জানাই।

    ওয়ালী স্যারের বিডিনিউজের ব্লগ টা পড়ছি। 🙂 আশা করছি এটিও ভালো লাগবে।

    কষ্ট করে লেখার জন্য ধন্যবাদ ভাই। 🙂 (সম্পাদিত)


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      আবারো ধন্যবাদ তোমাকে। মন্তব্যে আবারো প্রীত ও অনুপ্রাণিত হ'লাম।
      আমিও চেষ্টা করে যাই, ব্লগে এলে যত বেশী পারা যায়, লেখাগুলো পড়তে।
      আমিই বোধকরি এই ব্লগের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক/পাঠক। চেষ্টা করি, তোমাদের লেখাগুলো পড়ে তারুণ্যের সাথে আপডেটেড থাকতে। আর মাঝে মাঝে নিজের ভাবনাগুলোও তোমাদের সাথে শেয়ার করতে- বেশীরভাগই তা করেছি কবিতার মাধ্যমে।

      জবাব দিন
      • মাহমুদুল (২০০০-০৬)

        সম্ভবত আপনিই বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক/পাঠক। চেষ্টা করি পড়তে। আশা করি আরো লিখে যাবেন।

        ওয়ালী স্যারের ব্লগটা পড়েছি। চমৎকার লেগেছে। এত সাবলীল বর্ণনা যে মনে হয় সবকিছু জীবন্ত হয়ে ঊঠেছিল চোখের সামনে। শান্তিতে থাকুন স্যার।


        মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

        জবাব দিন
        • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

          এত সাবলীল বর্ণনা যে মনে হয় সবকিছু জীবন্ত হয়ে ঊঠেছিল চোখের সামনে - ওনার লেখা সত্যিই খুব সাবলীলভাবে এগিয়ে যায়, পড়তে গেলে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। উনি গল্পও করতেন খুব চমৎকার। একজন বন্ধু বৎসল মানুষ ছিলেন।
          মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ, এবং শুভেচ্ছা....

          জবাব দিন
  2. মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলাম

    আহসান স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মীর ওয়ালীউজ্জামান সম্পর্কে লেখার জন্য। একটা নতুন অধ্যায় সম্পর্কে একদম কাছের একজন সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম। ভাল থাকবেন।

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      মন্তব্যের তারিখ দেখাচ্ছে ০৪ মে ২০২১। নোটিফিকেশন পেলাম এতদিন পর! একদিনে একসাথে অনেকের, অনেকগুলো মন্তব্যের।
      যাহোক, মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। তুমি এখন কোথায় আছো, কী করছো?
      "একটা নতুন অধ্যায় সম্পর্কে একদম কাছের একজন সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম" - ওয়ালী স্যার এবং তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা আছে আমার সতীর্থ মেজর ফরিদ আহমদ ভূঞাঁর (অবঃ) কাছে। আমরা মাঝে মাঝেই তার সম্পর্কে আলোচনা করি।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।