জীবনের পুল পুশ ফ্যাক্টরঃ

জীবনে আমার যেটুকু এগিয়ে যাওয়া, তার অধিকাংশই কোন না কোন পুল-পুশ ফ্যাক্টরের কারণে হয়েছে। কখনো কেউ একটু পুশ করেছে, কখনো কেউ একটু পুল করে নিয়েছে, আর মাঝে মাঝে কোন কিছুতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেই সেলফ স্টার্টেড হয়ে সামনে দৌড়িয়েছি। সেখানেও কোন প্রণোদনা হয়তো পুশ করেছে, নয়তো পুল।

৩৩ বছর কলমের খাপটাকে বন্ধ রেখেছিলাম। দূরের বন্ধু (টেনিসি প্রবাসী) ড. হুমায়ুন কবির একবার নিজের লেখা কবিতার একটা লিঙ্ক পাঠিয়ে পড়তে বললেন। পড়ে মুগ্ধ হ’লাম। তিনি লিখতে থাকলেন, আমি পড়তে থাকলাম। প্রথম প্রথম টেলিফোনে মন্তব্য, তারপর থেকে কবিতার অনলাইন মঞ্চেই। একদিন সেই দূরের বন্ধু কাছে (বাসায়) এসে উৎসাহ দিয়ে বললেন, তুমিও তো ভালই লিখো, তুমিও লেখা শুরু কর না কেন? তার এ ছোট্ট কথাটা ছিল একটা পুশ, আমি একটু একটু করে নড়তে শুরু করলাম। একটা দুটো করে কিছু মিছু লেখা শুরু করলাম, মাঝে মাঝে নিজের ফেইসবুক ওয়ালে পোস্ট করতাম। বন্ধুরা অনেকেই সেগুলো পড়ে প্রশংসা করতেন। একদিন আমার ভাগ্নে তাপন শিখিয়ে দিলো, কিভাবে নিজের লেখাগুলো ফেইসবুক এর নোটস এ সংরক্ষণ করতে পারি। তার এ ছোট্ট নির্দেশনাটুকুও ছিল একটা বড় পুশ।

যখন কী বোর্ড চেপে এটা ওটা লিখে ল্যাপটপের মনিটরে দেখতে পেলাম, কবিতার মত কিছু একটা বের হচ্ছে, তখন খুঁজে পেলাম একটা বাংলা কবিতার ওয়েব সাইট, যেখানে উভয় বাংলার নবীন প্রবীণ কবিরা লিখে থাকেন। কবিতা লিখা না হোক, প্রতিদিন সময় করে সেখানে উভয় বাংলার কবিদের কবিতা পড়া শুরু করলাম। কারো কারো কবিতা খুব ভাল লাগতো। পরিচয় হলো অনেক গুণী ও মেধাবী ব্যক্তির সাথে, অনেক ঋদ্ধ কবির সাথে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সব্যসাচীও ছিলেন, যারা কবিতা ছাড়াও উন্নত মানের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি লিখে থাকেন। তেমনি একজন ছিলেন ইংল্যান্ড প্রবাসী অর্থনীতির অধ্যাপক ড. কেতন শেখ। তিনি একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কবিতার বই বের করছিনা কেন? বললাম, এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ। তিনি কয়েকদিন সময় নিলেন এবং সাহায্যের অফার দিলেন। এ ব্যাপারে আমার সাথে তার প্রতিদিনের কথোপকথন ছিল একেকটা পুশ। একেকদিন কথা হতো, আর তার পর থেকে আমি একেকটা স্বপ্ন দেখা শুরু করতাম। অবশেষে তিনি একদিন জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার এর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। প্রথম পরিচয়েই আমি প্রকাশকের সৌজন্যবোধে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এটা ছিল একটা বড় পুশ, আমার এগিয়ে যাওয়া শুরু হলো।

কবিতার পাশাপাশি কিছু স্মৃতিকথা লেখা শুরু করলাম। শৈশবের কথা থেকেই শুরু করলাম। আমি ছোটবেলায় মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়েছি, যার নাম আমরা চলে আসার পর পরিবর্তিত হয়ে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার ক্যাডেট কলেজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ঘটনাবলী স্মৃতিকথায় স্থান পেতে থাকলো। লেখাগুলো আমি ফেইসবুকে পোস্ট করতাম। সেগুলো পড়ে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা এক তরুণ, যিনি এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একদিন আমাকে বললেন লেখাগুলো বই আকারে ছাপাতে। তিনিও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাকে অন্য এক প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। এটাও ছিল একটা বড় পুশ। এই দুই বড় পুশের ধাক্কায় আমার ভাবনাগুলো ল্যাপটপ থেকে বের হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলার দুটো স্টলে ঠাঁই করে নিল। একটা জাগৃতি প্রকাশনী, অপরটা বইপত্র প্রকাশনী । লেখার মান যেমনই হোক, আমি বনে গেলাম একজন পাবলিশড অথার!

মাত্র গত রাতেই আমেরিকা প্রবাসী একজন বিদগ্ধ পাঠকের কাছ থেকে একটা মেইল পেয়ে যুগপৎ আনন্দিত এবং বিস্মিত হ’লাম। তিনি জানালেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা প্রবাসী। প্রতিবছর বইমেলা থেকে তার পছন্দের বই সংগ্রহ করার জন্য তিনি তার ভাইকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তার ভাই সেগুলো কিনে পরে বিভিন্ন মাধ্যমে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু গত বছর তার ভাই বইমেলা থেকে কোন কারণে তার দেয়া তালিকা থেকে শুধু আমার “জীবনের জার্নাল” বইটিই কিনতে পারেন নি। তাই এবারে বইটি মেলার কোন স্টলে পাওয়া যাবে তা তিনি মেইল করে জানতে চেয়েছেন। তাকে জানালাম, বইগুলো আমি প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যহার করে নিয়েছি নানা কারণে। আমার ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর জানিয়ে তাকে বললাম, ইচ্ছে করলে তার পক্ষ থেকে যে কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করে বইটা সংগ্রহ করতে পারেন। পরে তার ভাই আমার সাথে যোগাযোগ করে বইটি সংগ্রহ করেন।

এ বছর নতুন কোন কবিতার বই বের করবো কি না, তা নিয়ে বেশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলাম। কারো একটা পুশের অপেক্ষায় ছিলাম। অপেক্ষার শেষ সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর সে আশাটা একেবারেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তার পরেই বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন, এবারের বই মেলায় আমার কোন বই আসছে কিনা। যখন বললাম ‘না’, তখন দুই একজন অনুরোধ করলেন চেষ্টা করে দেখতে। আমি স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারছিলাম না। তবে অনুভব করছিলাম, তাদের এ প্রশ্নগুলো আমাকে ছোট ছোট পুশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তারপর, একদিন সকালে নিজের কিছু পুরনো কবিতা পড়তে বসলাম। কবিতাগুলো পড়ে আবার ইচ্ছে জাগলো, কবিতায় বলা আমার কথাগুলোকে একটা বই এ ধারণ করে রাখতে। এবারে নিজেই নিজেকে একটা পুশ দিলাম। আমার প্রথম কবিতার বই এর প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলামঃ “এখনো কি পান্ডুলিপি নিচ্ছেন? ইচ্ছে ছিল ৫ ফর্মার একটা কবিতার বই প্রকাশের”। সেদিনই বিকেল থেকে মাসব্যাপী বই মেলার শুভ উদ্বোধন হবার কথা, আর সকালে এমন একটা উটকো অনুরোধ তাকে একটু অপ্রস্তুতই করেছিল হয়তো। কিন্তু একটু সময় নিয়ে তিনি জানালেনঃ ‘আপনি বলে কথা! অবশ্যই পান্ডুলিপি দিয়ে যাবেন’। ছোট্ট দুটো কথা, কিন্তু বড় একটা পুল। আমি বসে গেলাম তৈরী পান্ডুলিপিকে কিছুটা সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করে বই এর আকারে প্রস্তুত করতে। একটানা কাজ করে পরের দিন দুপুরে সেটা তার কাছে মেইল করে পাঠিয়ে দিলাম। অবশেষে বইটি আজ ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে বইমেলায় তার স্টলে উঠেছে।

প্রকাশিত আমার তৃ্তীয় গ্রন্থের নামঃ প্রেমের একটি ফুল ফুটুক, শুষ্ক হৃদয়েই

ঢাকা
১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৭

৫,৪০২ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “জীবনের পুল পুশ ফ্যাক্টরঃ”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    আমার সিনিয়র সিটিজেন পড়শী লরা উইলসন বিকেলে পরিপাটি হয়ে এক পেয়ালা কফি হাতে একখানা বই নিয়ে বসেন তার ব্যাকইয়ার্ডে। ওর উঠোনের কোল ঘেঁসে একটি ওয়াকিং ট্রেইল চলে গেছে বহুদূর। আমি বিকেলবেলা এই ট্রেইলে হাঁটার পথে মাঝেমধ্যে কখনো ভদ্রমহিলাকে দেখে হাত নাড়ি, কখনো বা দাঁড়িয়ে খানিক কথা বলি। একদিন দেখি খুব মনোযোগের সাথে তিনি কিছু পাঠ করছেন। আমার দুই হাতে সেদিন বেগুণী রঙা ডাম্বেল। আমাকে দেখে তিনি খানিকটা উঁচুলয়ে বললেন, হ্যালো ডিয়ার লেডি উইথ দ্য পার্পল ডাম্বেল! প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর বললাম, আজ কি পড়ছো, লরা? পড়শী মৃদু হেসে বললেন, নিজের লেখা বই পড়ছি আজ। আমি মুগ্ধ চোখে বইটি উল্টেপাল্টে বলি, আই ওয়াজ অবলিভিয়াস টু দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট ইউ আর আ রাইটার! আমার কথায় ভদ্রমহিলার আনন্দে যেন খানিক ভাটা পরলো। মুহুর্তে চোয়াল খানিক শক্ত করে বললেন, আই অ্যাম নট আ রাইটার, আই এ্যাম এ্যান অথর! মাননীয় গ্রন্থকারকে লেখক বলার অপরাধে পড়শী যে আমায় শূলে চড়ান নাই এইতো ঢের! যাই হোক, ক্ষমা টমা চেয়ে পার পাওয়া গেল।

    তৃতীয় বইয়ের গ্রন্থকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। লেখালেখি জারি থাকুক নিরন্তর।

    জবাব দিন
  2. কৌশিক(২০০৪-২০১০)

    নীরদ চৌধুরী শুরুই করেছিলেন পঞ্চাশ পেরিয়ে। তাই কোন বয়সে শুরু হলো তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে আমার বিশ্বাস। যতদিন বলবার মতো কিছু আছে, তা অবশ্যই লেখা উচিত। কারণ, ভালো লেখা বরাবরই অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যোগায় লেখালেখির জাদুকরী জগতে ঢুঁ মারতে। যেমন এই লেখাটি--স্বতঃস্ফূর্ত ও ঝরঝরে।

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    গল্পের পেছনের গল্প সবসময়ই একটা আলাদা আকর্ষণের আধার। সেই স্বচ্ছ্ব জলধারায় পদ্মশব্দ মেলে ধরলো প্রাসঙ্গিক সকল আলাপ। পড়লাম মুগ্ধতা নিয়ে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।