ভিতরটা লাল,নীল আর হলুদ এই তিন রঙের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। আসলে এই তিন আলোর মিশ্রণে তৈরি নতুন একটা আলোয় আলোকিত,আবছা ভাবে। ভিন্ন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই ভিন্নতা মনে হয় চোখের ক্লান্তি ডেকে আনার ব্যাপারে বেশ পারদর্শী। সে কারণেই বুঝি কোনার টেবিলে বসা ছেলেটি রীতিমত হাই তুলেই চলেছে। অথচ পাঁচ মিনিট আগেই যখন এখানে এসে বসল বেশ তরতাজাই দেখাচ্ছিল। এরই মধ্যে ছেলেটার মধ্যে টাংগাইল- ময়মনসিংহের লোকাল বাসের একটা ভাব চলে এসেছে। ঢিমেতালে চলতে চলতে সুযোগ বুঝে একটু জিরিয়ে নেয়া।
কাঁচের ভিতর দিয়ে পিঙ্ক কালারের ড্রেস পড়া একটি মেয়েকে সরল ছন্দে হেটে এদিকেই এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। পিঙ্ক রঙটা আসলে মেয়েরা কিনে নিয়েছে। ওদেরই মানায়, আর ওরাও মহা ধুমধামের এবং সফলতার সাথে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারও করে যাচ্ছে। পেন্সিল বক্স থেকে শুরু করে চুলের ক্লিপ, সর্বক্ষেত্রেই পিঙ্কের সফল বিচরণ। এটাকে আবার বাংলা গোলাপী নামেও ডাকা চলবে না। তাহলে নাকি রঙের সৌন্দর্য এবং তাৎপর্য দুটোতেই ব্যাপক পরিমাণের ব্যাঘাত ঘটে।
মেয়েটার চশমা দেখে শান্ত আন্দাজ করতে পারে এটাই শর্মী। যার সাথে দেখা করার জন্য গত কয়েকটা মাস কতই না ঘাম ঝরাতে হয়েছে। কিন্তু আজ যখন শর্মী ওকে দেখা করার কথা জানাল কেন যেন তখন আর দেখা করতে মন চাইছিল না। বিকেলের ছাদের উপর আড্ডাটাকেই তখন অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ আর প্রাণবন্ত মনে হচ্ছিল।আসলে মন নামক অস্তিত্বহীন, অবাস্তব জিনিসটা বড়ই অদ্ভুত। বসের মর্জি বোঝা দায়।
দুজন মুখোমুখি বসে আছে।হালকা একটা হাসির আভা ছড়িয়ে আছে দু জনের মুখেই।
তুমি কি আমাকে চিনতে পারছিলা?
হুম, কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখতেছিলাম,মনে হল এটাই তুমি।
আমাকে রিসিভ করতে গেলা না ক্যান? আমি কতটা আনইজি ছিলাম,কিভাবে তোমাকে চিনব,আর এটা তো ভদ্রতা তাই না?
আসলে আমি উঠতে উঠতেই তুমি চলে আসছ।আর আমি তো তখনই তোমাকে ডাক দিলাম।
এভাবে কেউ ডাক দেয়? আজব! মনে হচ্ছে ছোটবেলার কোন এক বন্ধুর সাথে খেলার মাঠে দেখা হইছে।
টর্চ আনার দরকার ছিল।
এর মধ্যে আবার টর্চ ক্যান?কি আমি তো খুব কালো না যে আমাকে দেখতে পারবা না।
না সেটা না আবছা আলোতে ভাল দেখা যাচ্ছে না।আরো ভাল করে দেখতে চাই,সুন্দর হওয়ার কারণটা একটু বোঝার চেষ্টা করতাম।তুমি কি জান যে আমি এরই মধ্যে তোমার চুলের প্রেমে পড়ে গেছি।আর তোমার প্রেমে পড়ছি নাকি এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত না।প্রথম দেখায় কথাগুলো বেমানান লাগতে পারে কিন্তু আমি কথা আটকে রাখতে পারি না,অস্থির লাগে।
আবছা অন্ধকারে শর্মীর মুখের হাসিটা আন্দাজ করা যাচ্ছে।অনেক সুন্দর লাগছে।খানিকটা লজ্জা মিশ্রিত ছিল বলেই হয়তো।মেয়েদের এই লাজুক হাসিটা তৈরীর সময় বিধাতা মনে হয় একটু বেশীই খুশী মনে ছিলেন।না হলে এত এত সৌন্দর্য আর ভাল লাগা ঢেলে দেওয়া সম্ভব হত না।
টেবিলের উপর ফুচকা রাখা।এটা শর্মীর অনেক প্রিয় একটা খাবার। শান্ত জানে।কিন্তু শর্মী খাচ্ছে না.একটা একটা করে বানিয়ে শান্তর হাতে দিচ্ছে। আর শান্ত, শান্ত ছেলের মত সেটাকে মুখে পুড়ে নিমিষেই পেটে চালান করে দিচ্ছে।শান্ত ফুচকা কখনোই বিশেষ পছন্দ করে না। কিন্তু আজকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে ফুচকা নামক এই বস্তুটার জন্যই তার এতদিনের পথচলা। এদিকে শর্মী একটা ফুচকা মুখে দিয়েই বুঝতে পারে এখানকার ফুচকা জঘন্যের কোন পর্যায়ে পড়ে। এই ছেলে এত্তগুলা কিভাবে খেল?হাসি পায় তার। সামলে নিয়ে মুখে আর কিছু বলে না। আর বানিয়েও দেয় না।কে জানে হয়তো সে বানিয়ে দিচ্ছিল বলেই খারাপ লাগা স্বত্যেও খাচ্ছিল। কত আগ্রহ নিয়েই না খাচ্ছিল,এখনো একটা মুখে নিয়েই আছে।আবার মুখে একটা হাসিও লাগিয়ে রেখেছে। কিভাবে সম্ভব? একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে ছেলেটার হাসিটার মধ্যে। প্রথমদিকে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে শান্তর সাথে।সেসব মনে হয়ে নিজের উপরেই রাগ লাগছে। যে ছেলেটা এই অখাদ্য টাইপ খাদ্যটা হাসিমুখে একের পর এক কোন কথা ছাড়াই খেয়ে যাচ্ছে তার সাথে কঠিন গলায় কথা বলাটা একটু কঠিন ব্যাপার। এখন আবার কেমন বাঁকা হয়ে বসে আছে,আরাম করে। শর্মীর পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু মুখের ওই হাসিটার জন্যই তো কিছু বলা যাচ্ছে না।মানুষ এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?
ভরা পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের অবাক আলোতে পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে। আকাশের রূপসুন্দরী চাঁদটা পাড়ের কাছে কোন এক অপরূপ সৌন্দর্যের সান্নিধ্য পাবার লোভে পুকুরের পরিষ্কার পানিতে প্রতিফলিত হয়ে আছে। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিফলিত চাঁদের পুরো অস্তিত্বটা বিলীন হয়ে ভগ্নাংশে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ঢেউয়ের উৎস খুঁজতে গিয়ে চোখে ধরা পড়ে সৌন্দর্যের উৎস। শান বাঁধানো ঘাটে পাশাপাশি বসে আছে শান্ত আর শর্মী। হাল্কা কাঁচ করা সাদা একটা জর্জেট শাড়ী পড়েছে আজ শর্মী। জ্যোৎস্নার আবছা মায়াবী আলোতে শর্মীকে কোন এক ডানা কাটা পরীর মত দেখাচ্ছে,যেন ভুলক্রমে পৃথিবীতে এসে শান্তর পাশে বসে আছে। শান্তর কাঁধে মাথা রেখে আপনমনে পা দিয়ে পুকুরের পানিতে ঢেউ তুলছে। শান্ত কথা বলছে,গভীর মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনছে আর ক্ষণে ক্ষণে বাচ্চা মেয়েদের মত খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।তার হাসির সাথে চাঁদটাও যেন একবার করে হেসে নিচ্ছে সুযোগ পেয়ে।আজকের উজ্জ্বল জোছনাই তা বলে দেয়।
শান্তর মুখে এই পুকুর ঘাটের কথা অনেক শুনেছে শর্মী। হানিমুনের কথা উঠতেই আবার শুরু হল শান্তর এই ঘাটবিষয়ক কথকতা।ব্যাপারটা ধরে ফেলে শর্মী।গোছগাছ করে তৈরী হয়ে নেয়। কমন সব জায়গায়ই যে হানিমুন করতে যেতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। তাই শান্তর মন বুঝে ও এখানেই আসতে চায়।খুশী মনেই চলে আসে দুজন।যদিও গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকে না। কিন্তু বেশ যত্নে থাকে বাড়িটি। কেন যেন শান্তর পছন্দকে খুব যত্ন নিয়ে দেখে সবাই। যেমনটি দেখে শর্মী।অগোছালো,শান্ত,অশান্ত,বদরাগী,ঠাণ্ডা মেজাজের মিশ্রণের এই মানুষটা একটু আড়াল হলেই অস্থির লাগে ওর। শান্তর বেলাতেও একই রকম।কিন্তু তা কখনো প্রকাশ করতে পারে না শান্ত,চেষ্টাও করে না।কারন ভালবাসা প্রকাশ করার জিনিশ না,এটা বুঝে নেওয়ার জিনিস।
চাঁদটা এতক্ষণে একটু পশ্চিমে হেলে পড়ে।ক্লান্তিহীনভাবে দুজন কপোতকপোতীকে দেখে চলে সে।নিজের আলো পাঠিয়ে শুভেচ্ছা জানায় শর্মীর পায়ের নুপুরে আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে।গভীর আনন্দে দেখতে থাকে অনেক দূরের এক পুকুরঘাট যেখানে দুজন মানুষের মন নামের দুটো অবাস্তব জিনিস একজন আরকজনকে ছুঁয়ে দিয়েছে,যেখানে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে দুজনের হৃদয়ের যতকথা। আজকের এই চাঁদ আর তার জোছনাটা শুধু ওই যুগলটির জন্য যারা মিশে আছে তাদের অস্তিত্বে, ভাবনাতে প্রতি বেলায়,যারা হাতে হাত রেখে হারিয়ে যাচ্ছে দূর সুদূরের তারার মেলায়।
🙂 সুন্দর...
ধন্যবাদ ভাই 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
বাহ! তুমি তো বেশ লিখো 😀 :hug:
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
😀 তাই নাকি বাই 😉
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
শান্ত আর শর্মীর সিগ্ধ গল্প।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি