নগরের কাল বৈশাখী

নগরের কাল বৈশাখী

“বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অপু-দুর্গা দুজনেই সোনামুখী তলায় আম কুড়াতে ছুটছিল। ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদি বা শোনা যায় ঠিক কোন জায়গা বরাবর শব্দ, হইল—তাহা ধরিতে পারা যায় না। দুর্গা আট-নয়টি আম পেলেও ছোটাছুটির পর অপু পেলে মাত্র দুটি। একটু পরেই চারদিক ধোয়াকার করে মুষলধারে বৃষ্টি নামিল। হঠাৎ ঝটিকাসুদ্ধ অন্ধকারে আকাশের এ প্রান্ত হইতে লকলকে আলো জিহ্বা মেলিয়া বিকট অট্টহাসির রোল তুলিয়া এক লহমায় ও প্রান্তের দিকে ছুটিয়া গেল ক্কড় ক্কড় কড়াও শব্দে বাজ পড়ল। ভৈরবী প্রকৃতির উন্মত্ততার মাঝখানে ধরা পড়া দুই অসহায় বালক-বালিকার চোখ ঝলসে গেল নীল বিদ্যুতের তীব্র ঝলকে। ভয়ে এবং শীতে কাতর অপুকে দুর্গা তার আরও কাছে টেনে শেষ আশ্রয়ের সাহসে বারবার আবৃত্তি করিতে লাগিল—‘নেবুর পাতা করমচা, যা বৃষ্টি ধরে যা—। ভয়ে তাহার স্বর কাঁপিতেছিল। অপু-দুর্গা ঝড় থামলে ভাইবোন বাড়ি ফেরে বিজয়গর্বে, শুধু আমই নয়, একটি ঝুনো নারকেল ও নারকেলের মরা ডাল হাতে নিয়ে। এত ঝড়-ঝাপটার পরও দুজনের মুখ ‘বৃষ্টি ধোয়া জুঁই ফুলের মত সুন্দর দেখাইতেছিল”। – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পথের পাঁচালী)

দুই বছর পূর্বের কথা। বৈশাখ মাস। আমি বসবাস করি ঢাকা সেনানিবাস রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায়। রোড নম্বর ১১। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাবার পথে আমার ছোট মেয়ে রাইয়াকে স্কুলে লিফট দিতে হয়। সে পড়ে মহাখালী ডি ও এইচ এস এর বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ক্লাস ফোরে।

সময় সকাল ৭ টা ১৫ মিনিট। বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের সামনে এসেছি। অকস্মাৎ চারপাশ নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে এলো। যেমন করে বাতি নেভানোর পর গ্রাম এলাকায় সন্ধ্যার পর রাত্রির আগমন ঘটে থাকে। রাইয়া শঙ্কিত। বলল, “পাপা,  চলো বাসায় ফিরে যাই! সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে আবার!”

সত্যিই তাই। চারপাশটা হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে শধু সন্ধ্যা নয়, কোন অনন্ত রাত নেমে এসেছে। সকালের এই আলোকিত প্রহরে। রাস্তার পশ্চিম পাশে ঢাকা সেনানিবাস সেন্ট্রাল মসজিদ। গম্বুজটাকে রীতিমতো ভূতুড়ে লাগছে। অতিপ্রাকৃত কোন কাছিমের বিশাল পৃষ্ঠদেশের মতন। মসজিদ ঘিরে জলাশয়। অকারণেই পানি ফুলে ফেঁপে উঠছে তাতে। কিচিরমিচির শব্দে পাখিরা ছুটোছুটি করছে। নীড়ে ফিরছে। অথবা বুঝতে পারছে না কোথায় যাওয়া উচিৎ? কোন গন্তব্যের দিকে!

আমাদের গাড়ির বাইরে প্রবল বাতাস। রাস্তার ওপরে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো উড়ে এসে পড়ছে। রক্তলাল।  পিচের রাস্তাটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। গভীর রাতে শহীদ মিনারের বেদীতে ফুলের নৈবেদ্যের মতন। মুহূর্তের ভেতরেই আবার উড়ে চলে যাচ্ছে!

রাস্তার স্ট্রীট লাইটগুলো নেভানো। প্রতিদিন সকাল পাঁচটার সময়ে নির্দিষ্ট কেউ নিভিয়ে দেয়! ক্যাডেট কলেজে রাত দশটায় বাতি নিভানোর মতন। পূর্বনির্ধারিত। এতোটুকু এদিক-সেদিক হবার উপায় নেই। অতঃপর   নিরালা-নিঝুম অন্ধকার।সকালের বিউগলের সকরুণ সুর বেজে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত। রাস্তার ওপরে অজস্র গাড়ি। অফিসে যাবার সময় এটা। বেশির ভাগের গন্তব্য আর্মি হেডকোয়ার্টার। অথবা সি এম এইচ! প্রতিটা গাড়িতে হেডলাইট জ্বালানো। গভীর অন্ধকারের ভেতরে এগুলোকে মনে হচ্ছে হাজার জোনাকির মেলা। ওরা সর্ব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে কিভাবে আরও কিছুক্ষন পৃথিবীকে আলোকিত রাখা যায়। কবি শহীদ কাদরীর কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল-

‘সেখানে একাকী রাত্রে, বারান্দার পাশে

সোনালী জরির মতো জোনাকীরা নক্সা জ্বেলে দেবে’।

প্রত্যাশার আলো। নিরাশার নয়!

রাইয়া আমার মোবাইলটা হাত থেকে নিয়ে বলল,

“একটা ভিডিও করে রাখি। পরে সূর্য উঠলে আরেকটা ভিডিও করে দেখব পার্থক্য কি হয়?”

চারদিকের অন্ধকার ঘন হতে হতে নিশ্ছিদ্র রহস্যময়ি রাতের রুপ নিচ্ছে। আমি জানি ভিডিওতে তেমন কিছুই আসবে না। তা ছাড়া আমার মোবাইলের ক্যামেরার রেজুলুশনও যথেষ্ট নিম্নমানের। রাইয়া আবার বলে, “পাপা, গতরাতে ইউ টিউবে আমি টর্নেডোর ভিডিও দেখেছি। মনে হচ্ছে টর্নেডো হবে। জানো, টর্নেডো হলে আকাশ থেকে পানি হাতির শুঁড়ের মতন ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে নেমে আসে? চলো আমরা বাসায় ফিরে যাই!”

উল্লেখ্য, মাত্র  কয়েকদিন পূর্বে  (২৫ এপ্রিল ২০১৫) নেপালের প্রলয়ঙ্করী ভুমিকম্পের সেকেন্ডারি ঝাঁকুনি আমাদের সবার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত সবাই। এমনকি শিশুরাও। রাইয়া ইউ টিউবে নিত্য নতুন ভূমিকম্পের ট্রেইলার দেখছে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। ভূমিকম্প, সাইক্লোন, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। এই ট্রেইলার গুলোর এখন নিয়মিত দর্শক সে! কার্টুনের ট্রেইলারের বদলে। অথচ কার্টুন তার ভীষণ প্রিয়।

আমার মনে পড়ে গেল এইচ জি ওয়েলসের গল্প ‘টাইম মেশিন’ এর কথা। ভিক্টোরীয় এই বৈজ্ঞানিক লেখক টাইম মেশিনের স্টার্টিং লিভার চেপে আটশত হাজার বছর পরিভ্রমণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন ভবিষ্যৎ কোন  পৃথিবীতে। তার ভ্রমণের সময়ে দিন আর রাত পরস্পর স্থান বিনিময় করছে মুহুর্মুহু,

“নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে ধপ শব্দ করে অপসৃত হলাম। বাতি নেবানোর মতো করে রাত্রি নেমে এলো। পর মুহূর্তেই আগামীকাল এসে হাজির হলো। গতি বাড়লে কালো ডানার ঝাপটানির মতো করে দিনের পর রাত নেমে এলো। তারপরে রাত দিনের দ্রুত আবর্তন একত্রে লীন হয়ে নিরবচ্ছিন্ন ধূসরতায় পর্যবসিত হলো।”

সেনানিবাসের ‘ব্রডওয়ে’ থেকে সোনালী ব্যাঙ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই আমারও মনে হল আমিও এক নিয়তিহীন অনন্ত অন্ধকারের পাণে ছুটে চলেছি! যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব।

আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উত্তর পাশের নতুন রাস্তা দিয়ে একে বেঁকে আমাদের গাড়ীটা মইনুল রোডের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। স্বাধীনতা সরণী তথা বনানী– কচুক্ষেত সড়কে পৌঁছাতেই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি  নামলো।ভোজবাজির মতন হঠাৎ অন্ধকার চলে গেছে! চারপাশে দিনের আলোর ঝলকানি। পশলা  বৃষ্টির জল যেন সোনা রুপা দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে! কেটে গেছে সকল অন্ধকার। আমাদের মনের সকল কালিমা!

স্যালাইনের নল বেয়ে টিপটিপ করে স্যালাইন অথবা কোনো ওষুধ পরার মতন করে গাড়ীর জানালার কাঁচে  বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। গাছের পাতাতেও।ভিউ কার্ডের মতন ঝিলমিল করছে প্রকৃতি। আনন্দে। রাইয়া তার মায়ের দেয়া রঙিন ছাতাটা নিয়ে নাচতে নাচতে বৃষ্টির ভেতরেই ‘বি আই এস’ এর গেট পার হয়ে তার স্কুলের ভেতরে চলে গেল!

“তবুও আকাশ কালো সবুজ বনে তোমার হরিতকি চুলে”

 

 

৫,০৩০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।