যুদ্ধ এবং শৈশব

যুদ্ধ এবং শৈশব

“বালক হিসেবে আপনি যখন যুদ্ধে যাবেন তখন আপনার মধ্যে অমরত্বের মোহ কাজ করবে। অন্যরা নিহত হবে; কিন্তু আপনি নন…” – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে

স্বাধিকার বা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিই যুদ্ধ। এটা পৃথিবীর আদিমতম সত্যগুলোর একটি। যুদ্ধের রকমফের যাই হোক না কেন, কোন দেশ বা জাতি বা নৃগোষ্ঠীই এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। নিজেদের লুপ্ত অধিকার পুনঃঅর্জনের জন্য অথবা আপনার ওপরে জবরদস্তি করে চেপে বসা কাউকে প্রতিহত করবার জন্য যুদ্ধে আপনাকে অবতীর্ণ হতেই হয়। সাধারণত এর ব্যতিক্রম হয় না।

১৯৭১ সনে আমার বয়স ৭/৮ বছর। বর্তমানের একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ ঐ বয়সের স্মৃতিকে অবিকৃতভাবে ধারন করতে পারে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও থাকতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত যে আমার স্মৃতিশক্তি আমাকে একাত্তুরের সেই অদ্ভুত সময়ের ভেতরে নিয়ে যেতে সক্ষম! ঐ সময়ের অনভিজ্ঞ বয়সের অভিজ্ঞতাগুলোও এতোটা মুখর হয়ে আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে যে, আমি তাদেরকে পূর্ণ অবয়ব দিতে না পারলেও স্পষ্ট বুঝতে পারি এগুলো আমার অবাস্তব কল্পনা নয়।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখে চট্রগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয় দুই শতাধিক মুক্তিকামি জনতা। টঙ্গিতে এবং যশোরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়  অনেকজন। প্রতিবাদে মুখর তখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। এমনকি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল বন্দীরাও এই প্রতিবাদ আন্দোলনের বাইরে নয়। কারাগারের ফটক ভেঙ্গে তিন শতাধিক কয়েদি বের হয়ে চলে যায় শহীদ মিনারে। সেখানে তারা  মুক্তিকামী জনতার আন্দোলনে যোগ দেয়। নতুন মাত্রা যোগ হয় জেল বন্দীদের ইতিহাসে। কারারক্ষীদের গুলিও স্তব্ধ করতে পারে না জীবনের এই সম্মুখবর্তী অগ্রযাত্রাকে। নিহত হয় কয়েকজন।

আমার খেয়াল আছে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ আমি রেডিওতে শুনেছি। আমার কর্ণে এখনো মার্চ মাস আসলেই অনুরণিত হয় সেই বজ্রকন্ঠ, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”!  দৈনিক পত্রিকাতে সেই বিশাল জনারণ্যের ছবি দেখেছি। গাছের শাখায় আরোহণ করে মুক্তিকামী মানুষদের আমি বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে দেখেছি। আমার স্মৃতিতে এত বড় বিশাল জনস্রোত বা মানুষের সম্মিলন আর কখনোই নেই।

১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের কাল রাত্রির কথা আমি শুনেছি। শুনেছি কিভাবে নির্বিচারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাতের আঁধারে ঢাকার নিরস্ত্র মানুষের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল দানবের মতন। এক রাতের ভেতরেই ঘটিয়েছিল অযুত প্রানহানি। এই কালো রাতের আঁধারেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করে নিয়ে অজ্ঞাত কোন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো। তিনি জীবিত আছেন, নাকি তাকে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে গুজবের অন্ত ছিলনা।

১৯৭১ সালের মার্চের শেষের দিকে মেজর জিয়া নামের একজন বাঙালি সেনা অফিসার চট্টগ্রামের কোন রেডিও ষ্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জীবনে এই প্রথম আমি একজন বাঙালী সামরিক অফিসারের নাম শুনেছিলাম।আমাদের পরম চাওয়া মুক্তির পথের বৈকুণ্ঠ যাত্রায় সবই ছিল আমাদের প্রাথমিক নির্মাল্য এবং নিবেদন।

আমাদের বাড়ি জামালপুর মহকুমার মাদারগঞ্জ থানার উত্তর প্রান্তে। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল পশ্চিমে যমুনা নদী। এর একটা শাখা পশ্চিম থেকে পুবে প্রবাহিত। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল উত্তরে। মে অথবা জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এলাকায় আগমন করেছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী স্কুলের টিনের ঘরে ওরা অবস্থান নিলো। আমি সারা দিনমান মুক্তিযোদ্ধাদের ধারেপাশে ঘুরঘুর করি। শুধু আমি না, এলাকার সকল শিশু-কিশোরেরাই।আমরা সবাই উদীপ্ত।

সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা সবাই চিনি। সে আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের ছোট ভাই। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তাকে নিয়ে আমাদের মুগ্ধতার শেষ নেই। তার হাতে স্টেনগান! স্টেনগানের গায়ে অসংখ্য ছিদ্র। আমি মনে মনে ভাবি এই  সবগুলো ছিদ্র দিয়ে গুলি বের হলে এক সঙ্গে কতজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মৃত্যুবরণ করতে পারে?

আমাদের থানার দুই প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো ক্যাম্প। প্রতি ক্যাম্পের জনবল  ছিল এক কোম্পানি করে। একটা ক্যাম্প আমাদের বাড়ির নিকটে। অন্যটা মাদারগঞ্জ থানার সন্নিকটবর্তী স্থানে।খরকা বিলের পাশে। আমার নানাবাড়ির পাশে।

আমাদের বাড়ির কাছের কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা ঝাড় কাটা নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে অনেকগুলো রাইফেল এবং এলএমজি ট্রেঞ্চ খনন করেছিল। লম্বা সারিতে দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত এই ট্রেঞ্চগুলোকে পাকিস্তানী হানাদারদের ভবিষ্যৎ কবর বলে চিন্তা করে আমি সর্বক্ষণ আনন্দে শিহরিত হতাম।

বর্ষাকালের শেষের দিকে জামালপুর শহর থেকে পাকবাহিনী এসে মেলান্দহ থেকে মাহমুদ পুর বাজার পর্যন্ত রাস্তার পাশের সকল ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গেল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ঝাড় কাটা নদীর দক্ষিন পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করল। প্রাণভয়ে নদী সাঁতরে ওপারের সকল মানুষেরা চলে এলো আমাদের এলাকায়। পাকবাহিনী নদী অতিক্রম না করেই পুনরায় ফিরে গেল জামালপুরে।

এর অব্যবহিত পরে আমার এক চাচা চান মাস্টার আমাদেরকে বাড়ির উঠোনে একত্রিত করলেন। আমাদেরকে দিয়ে বাড়ির ভেতরের উঠোনের মাঝখানে বিরাট একটা গর্ত তৈরি করালেন। দেখতে হল ঝাড় কাটা নদী তীরের লাইট মেশিনগান ট্রেঞ্চের মতন। এর ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, “ পাকিস্তানিরা যদি আক্রমন করে তবে আমরা সবাই এই ট্রেঞ্চে ঢুকব এবং মারা গেলে সবাই একসাথে মৃত্যুবরণ করবো”। মৃত্যু চিন্তা আমাদেরকে কোনভাবেই আতঙ্কিত করলো না। বরং বেদনার পরিবর্তে আনন্দই সৃষ্টি করল!

আমি তখন ভীষণ উত্তেজিত এক বালক। বন্ধুদের নিয়ে আমি বাড়ির আশপাশের সকল পুকুরের খাড়া পাড়গুলো এক মুখের গুহা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছি। মাছরাঙাদের বাসার মতন।  প্রতিটা গুহা প্রথমে দেড় থেকে দুই হাত পরিমাণ সোজা পুকুরের পাড় ভেদ করে ভেতরের দিকে খনন করা হয়েছে। অতঃপর সেটা পুকুরের পাড়ের সমান্তরালে অদৃশ্যভাবে ডান অথবা বামদিকে চলে গেছে। খড়কুটো দিয়ে গুহার মুখ বন্ধ করে দিলে গুহার অস্তিত্বই বোঝা অসম্ভব। এর ভেতরেই আমরা বালকেরা একদল মুক্তিবাহিনী এবং অন্যদল পাকবাহিনী সেজে লুকোচুরি এবং যুদ্ধযুদ্ধ খেলি। আমাদের সকল খেলায় শেষ পর্যন্ত অনিবার্যভাবে পাক বাহিনীই পরাজিত হয়।

একটা গিঁঠ যুক্ত আম গাছের ডাল কেটে আমি টিক্কা খানের একটা মডেল বানিয়েছি। ওর গায়ে পরিয়ে দিয়েছি কাকতাড়ুয়ার মলিন ছিন্নভিন্ন জামা। বাঁশের ছিদ্রযুক্ত কঞ্চি কেটে বানিয়েছি খেলনা বন্দুকের ব্যারেল। এই ব্যারেলের শেষ প্রান্তে কচি পাঁটের বিচি রেখে ব্যারেলের অন্য প্রান্তে আরেকটা বিচি ঢুকিয়ে পিস্টন ধরণের একটা কাঠি দিয়ে ঠ্যালা দিলে কঞ্চির ভেতরের বদ্ধ বাতাসের ওপরে চাপ সৃষ্টি হয়। তখন অন্য প্রান্তের বিচিটা বুলেটের মতন শুন্যে নিক্ষিপ্ত হয়। টিক্কা খানের কাকতাড়ুয়া রুপী মডেলটাকে সামনে রেখে আমি সারাক্ষন গুলি করে দিনে সহস্র বার টিক্কা খানকে কল্পনায় হত্যা করি।

একদিন ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমাদের এক আত্মীয় পরিবার আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিল। ঐ পরিবারের এক ছেলে। আমার চেয়ে বড়। ভীষণ সুদর্শন। আমাকে টিক্কা খানকে খেলনা রাইফেল দিয়ে গুলি করতে দেখে সে হেসে অস্থির। দাবি করে বসলো ঢাকা থেকে আসার আগে সে টিক্কা খানকে আসল বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে এসেছে! আমার ভীষণ মন খারাপ! আমি এতদিন ধরে মনে মনে লালন করছিলাম ভবিষ্যতে টিক্কা খানকে আমিই মারবো! যুদ্ধের ভেতরে আমি এত দ্রুতই বড় হচ্ছিলাম!

পাকবাহিনী মাহমুদ পুর পর্যন্ত গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাবার কিছুদিন পর একদিন রাতের অন্ধকারে মাহমুদ পুর এবং মেলান্দহ বাজারের মধ্যবর্তী পাকা ‘পয়লা ব্রিজ’টাকে মুক্তিযোদ্ধারা এক্সপ্লসিভ মেরে গুড়িয়ে দিয়ে এল।

এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল যমুনা তীরের কয়লাকান্দি চরের এক কিশোর। আমার দাদীর ভাতিজা। রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সে গিয়েছিলো ‘পয়লা ব্রিজ’ পর্যন্ত। সবাই ফিরে আসলেও সে ফিরে আসে নি। এলাকার সবাই বলাবলি করতে লাগল যে সে তার বোকামির কারণে রাতের অন্ধকারে হয়তো বা গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে নিয়ে কাউকে দুঃখ করতে দেখলাম না। শুধুমাত্র আমার দাদীকে দেখতাম সূর্য ডুবে যাবার পর  গোধূলির আঁধারে বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড়ের প্রায়ান্ধকারে সুর করে কাঁদতে।

পাকিস্তানীরা আমাদের থানায় ঢুকতে পারেনি। তবে মাহমুদ পুর পর্যন্ত আসার কারণে  আমাদের এলাকার মানুষজনদের ভেতরে শঙ্কা কাজ করত যে, তারা আবার ফিরে আসতে পারে। কাজেই আমার মা চাচীদেরকে দেখলাম সকল কাঁসার তৈজসপত্র  জলের কলসির নীচের মাটির প্লাটফর্মের নীচে পুতে রেখে দিতে। যাতে পালিয়ে যাবার পর যুদ্ধ শেষে আমরা যদি কোনদিন নিজ বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করি, তখন যেন আমাদের এই মূল্যবান জিনিসগুলো আমরা ফেরত পাই। প্রতিটা পালিয়ে যাওয়া মানুষও একদিন তার মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের আশা করে।

কিন্তু আমরা শিশুরা কোথাও যেতে চাই না। নিজ বাড়ির উঠোনের ট্রেঞ্চের ভেতরে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই মরতে চাই। অমরত্বের মোহ মানুষের অন্তর্গত স্বভাব। শিশুদেরও!

৪,৭৫৮ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “যুদ্ধ এবং শৈশব”

  1. কৌশিক(২০০৪-২০১০)
    আমাকে টিক্কা খানকে খেলনা রাইফেল দিয়ে গুলি করতে দেখে সে হেসে অস্থির। দাবি করে বসলো ঢাকা থেকে আসার আগে সে টিক্কা খানকে আসল বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে এসেছে!

    😀 😀

    প্রতিটা পালিয়ে যাওয়া মানুষও একদিন তার মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের আশা করে।

    ফিরলেও চেনা ঘরে সে অচেনা মানুষ হয়ে যায় না তো?
    সতেজ হয়ে গেল মন লেখাটি পড়ে।

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    এই রকমই সেই সময়ের গল্পগুলো। না বয়স, না পেশা, না শিক্ষা, না ধর্ম, না বর্ণ পেরেছিলো টানতে কোনো ভিন্ন সীমারেখা। মানুষ নেমেছিলো ঝাঁপিয়ে মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে; হাসিমুখে উদগ্রীব উচ্ছ্বাস উদ্বেলতায় আবেগে আর ভালবাসায়। মানুষ খেলেছে আপন প্রাণ নিয়ে ভাগ্যের সীমারেখায়, সাহসের ভেলায় বেঁধে অনাগত ভবিষ্যৎ, দেখেছে স্বপ্ন স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মাটি, উড্ডীন আপন পতাকার অজানা আগামীরে।
    ~ প্রাঞ্জল উপস্থাপনায় গল্পগুলো পড়লেই হাজার আবেগের প্লাবন ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার শৈশবের টুকরো টুকরো স্মৃতির বিবরে।

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    চমৎকার লেখা ও স্মৃতিচারণ।
    আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া মূল্যবান এই লেখাটি সিসিবির পাঠকদের জন্য শেয়ার করায়।
    :boss: :boss: :boss:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।