নিখোঁজ সংবাদ
বশির ভাইদের কুড়ে ঘর আমাদের পিছনের বাড়িতেই। তারা এক ভাই, এক বোন! বাবা-মা দুজনেই কবে মরে গেছে আমি জানিনা। বোনের নাম জোহরা। আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। আমার সাথে সকালে মসজিদে কুরআন শরীফ পড়ে। সেই সুত্রে সে আমার সহপাঠিনী! আমাদের বাড়ি আর বশির ভাইদের বাড়ির মধ্যবর্তী স্থানে একটা বিশাল জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা। এত গভীর সে জঙ্গল যে আমি দুপুর বেলাতেও তার ভেতরে ঢুকতে আমি ভয় পাই। গা ছম ছম করে! হাজার ধরনের আগাছা দিয়ে দিয়ে তৈরি সেই জঙ্গল। বেত গাছেরও ঝুপড়ী আছে কয়েকটা। সেই জঙ্গলে প্রচণ্ড স্বাধীনতা নিয়ে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ইন্দ্রনাথের মতন ঘুরে বেড়ায় কিশোরী জোহরা! অথচ আমি ছেলে হয়েও সাহস পাইনা!
বশির ভাই আমাদের বাড়িতে কাজ করেন। কাজ করেন বললে ভুল হবে! তিনি আমাদেরই একজন! ছোটবেলা থেকে আমাকে আর আমার ভাইবোনদের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন তিনি। সারাদিন তিনি আমাদের বাড়িতে থাকেন। আমাদের এবং সবার কাজ করে দেন। শুধুমাত্র রাতের বেলায় বাড়িতে যেয়ে বোনের সাথে তাদের কুড়েঘরে একসাথে ঘুমান। বশির ভাইয়ের কণ্ঠস্বর খুবই সুন্দর। আমাদের মসজিদে কোন মুয়াজ্জিন নেই। বশির ভাইই মসজিদে আজান দেন সকল ওয়াক্তে। অনেকেই তার কণ্ঠস্বরকে হজরত বেলাল (রাঃ) এর কণ্ঠস্বরের সাথে তুলনা করে থাকে! যদিও বশির ভাইয়ের আজানে কোন পশুপাখি ছুটাছুটি করেনা বা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেনা, আমাদের গ্রামের সব মানুষই তার আজানে বিমুগ্ধ। গ্রামের ছোট বড় সবাই বশির ভাইকে ভীষণ ভালবাসে, স্নেহ করে।
১৯৭৩ সাল। আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমাদের স্কুলের পাশেই বশির ভাইদের বাড়ি। উনাদের বংশ পরামানিক বংশ। পুরো বংশটাই এই বিশাল বাড়িতে বসবাস করে। একদিন স্কুলের ক্লাস চলাকালে শুনতে পেলাম বশির ভাইয়ের বোন জোহরা বিষ খেয়েছে! আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম। জোহরাকে বমি করানোর জন্য গরুর গোবর খাওয়ানো হচ্ছে! বিকেলের দিকে জোহরা মরে গেল! কেউ কিছুই করতে পারলনা! কেন সে বিষ খেয়েছিল তাও কেউ জানলনা! শুধু কয়েকদিন পর পরস্পরের মুখে শুনতে পেলাম বশির ভাই নাকি বলেছেন জোহরা মারা যাবার পরের রাতে তিনি যখন রাতে তার কুড়ে ঘরে শুয়ে ছিলেন, তখন জোহরা নাকি দরজার কাঠের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকে বাঁশের ধর্নার ওপরে কিছুক্ষন শুয়ে ছিল! বশির ভাই অবশ্য এ বিষয়ে আমাকে কিছুই বলেননি। কয়েকদিন পর আমি বশির ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে জোহরা কেন এভাবে মরে গেল? তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি জানেন, কিন্তু বলা উচিত হবেনা বা বললেও কেউ বিশ্বাস করবেনা!
তখন সবে হস্তচালিত নলকূপ দিয়ে দেশে ইরি ধানের আবাদ শুরু হয়েছে। বশির ভাই আমাদের জমিতে নলকূপ দিয়ে পানি দেন। আমি সকালে স্কুলে যাবার আগে ঐ নলকূপের পানিতেই গোসল করি। বশির ভাই আমাকে নিজহাতে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দেন! ৫/৬ মাস পরের কথা। একদিন রাতে পাশাপাশি দুইটা নলকূপ একসাথে চুরি হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা সবাই শুনলাম বশির ভাইই নলকূপগুলো চুরি করেছেন! কারন, একটা নলকূপের পাশে উনার ক্যারোলিন এর তৈরি শার্ট পাওয়া গেছে।কিন্তু তিনি স্বীকার করছেন না!
অবশেষে শুরু হল বশির ভাইয়ের ওপর অত্যাচার। তার মুখ গামছা দিয়ে ঢেকে বেঁধে বদনা দিয়ে তার আবৃত মুখের ওপরে পানি ঢেলে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করার উপক্রম করে গ্রামের মাতব্বররা তার স্বীকারোক্তি আদায় করলেন।এর পর আর উনার কথা কেউই শুনতে চাইলো না! প্রবল রকমের প্রহার করা হল তাকে। অতঃপর উনাকে পিঠের পিছনে আড়মোড়া করে হাত বেঁধে আমাদের ঘরের পাশের ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে দেয়া হল। পাশের ঘরের মালিক আমার আব্বার চাচাতো ভাই। প্রবল প্রতাপশালী একজন ব্যক্তি। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন বশির ভাইকে কি শাস্তি দেয়া যায়!
দুপুরের পর আমার চাচীকে বললাম, “উনি তো সকাল থেকেই কিছু খাননি। উনাকে খাবার দেয়া প্রয়োজন!” চাচি আমার চাচাকে যমের মতন ভয় পান। তবুও তিনি লুকিয়ে কাঁসার প্লেটে করে আমাকে কিছু খাবার এনে দিলেন এবং উনাকে আঁটকে রাখা ঘরের দরজার তালাটা কিছুক্ষনের জন্য খুলে দিলেন। বাড়ির পুরুষেরা সবাই এই সময়ে নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছে এবং আজ অন্য কেউ একজন হেঁড়ে গলায় আজ দুপুরের আজান দিয়েছে! আমি বশির ভাইয়ের কাছে খাবার নিয়ে যেতেই তিনি হু হু করে কেঁদে দিলেন এবং তিনি বললেন যে তিনি চুরি করেননি। তবে কে চুরি করেছে সে সম্পর্কে তার কিছুটা ধারনা আছে! গতরাতে এদেরই দুইজন তার ঘরে ঢুকে তার চোখে টর্চ লাইট মেরে তার শার্ট নিয়ে গেছে! তবে একথা কাউকে বলা যাবেনা! বললেও কেউ বিশ্বাস করবেনা। বরং তার ওপরে আরও কঠিন অত্যাচার নেমে আসবে!
ফলে জোহরার মৃত্যুর কারনের মতন এটাও একটা চির রহস্যময় বিষয় হয়েই থাকলো আমার কাছে! সেদিন রাতের বেলায় শালিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে নলকূপ গুলো ফেরত দিতে বলা হল নতুবা তাকে বিনা বেতনে তাকে নলকূপের মালিকের ইরি ধানের ক্ষেতে এই মৌসুমে নলকূপ চেপে পানি দিতে নির্দেশ দেয়া হল!
তার কয়েদিন পরই বশির ভাই এক রাতের আঁধারে আমাদের এলাকা থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন! বোনটা মরে যাবার পর তার তো এখানে আর কোন লিংকই ছিলনা! কেউ আর তাকে কোনোদিন দ্যাখেনি। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা সবাই তাকে ভুলে গিয়েছিলাম! শুধুমাত্র আমাদের এক আত্মীয় যে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে রংপুরে মাইগ্রেট করেছিলেন তিনি একবার এসে দাবী করেছিলেন যে তিনি বশির ভাইকে পঙ্গু অবস্থায় কাউনিয়া ষ্টেশনে ভিক্ষে করতে দেখেছেন!
“নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছি দিনে দিন-ডুবে যাচ্ছি…
মেঝেতে-দেয়ালে-দোলনায়-আয়নায় ও আসবাবে, কোন কথায়-কবিতায় কিংবা ডায়রীতে-ফুটনোটে কোথাও কোন সূত্র রেখে যাচ্ছি না-
ডুবে যাচ্ছি-ওভাবে অন্ধের মতো আমাকে খুঁজো না; অহেতুক নিখোঁজ সংবাদ ছেপে নিঃসন্দেহে আমাকে পাবে না
চায়ের দোকানী-গলিমুখে বসে থাকা চতুর ভিখিরি এবং তুমি- কেউ তো আমাকে চিনেও রাখলে না….” —– মোহাম্মদ জসিম
– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৩ জুন ২০১৬
মর্মস্পর্শী গল্প।
তবে একথা কাউকে বলা যাবেনা! বললেও কেউ বিশ্বাস করবেনা। - এভাবেই জগত সংসারে কত সত্য অপ্রকাশিত থেকে যায়!