আমাদের হারুন স্যার

আমাদের হারুন স্যার

“পুত্রশোকাতুর রবীন্দ্রনাথ রাত্রে ট্রেনে আসতে আসতে দেখলেন জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথা কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। তাঁর মন বললে, কম পড়েনি- সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনওখানে কোনও সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়- যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।” – (রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ: পূর্নানন্দ চট্টোপাধ্যায়)

আমাদের হারুন স্যার! তার কাছ থেকেই আমি প্রথম শুনেছিলাম মানুষের চন্দ্র বিজয়ের কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সে বছর আমাদের পুরো এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়ে গিয়েছিলো। বালিজুরি বাজার থেকে ডিঙি নৌকায় করে ফিরছি আমরা। এক দিগন্ত বিস্তৃত প্লাবিত প্রান্তরের ভেতর দিয়ে এক মহাকাশ যানের মতন তরতর করে ছুটে চলেছে আমাদের ডিঙি নৌকা। পরিচ্ছন্ন আকাশ। সূর্য ডুবে যাবার পর গোধূলির আলোয় আকাশ আর প্রান্তর মিলে একাকার হয়ে গেছে। একটা দুটো করে তারা উঠছে আকাশে। বর্ষার শেষ সময়। পানিতে ঢাকা সারা প্রান্তর শাপলা ফুলে ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে নক্ষত্রের ভেতর দিয়ে চলছে আমাদের নৌকা! নৌকার ছইয়ের বাইরে নৌকার গলুইয়ের পাশে বসে আছি আমি। আমার পাশেই হারুন স্যার। তিনি আমাদের বাড়ীর পাশের ঝাড় কাটা প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমি তখনো উনার স্কুলে বা অন্য কোন স্কুলেই যাই না! বৈঠার ছিটকে পরা পানি এসে আমাদের দুজনকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। একটু পরেই প্রান্তর আর আকাশ জুড়ে অন্ধকার নামবে। হঠাৎ করে হারুন স্যার নৌকার সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “ দ্যাখো, দ্যাখো চন্দ্র মিশন সম্পন্ন করে এপোলো-১১ পৃথিবীতে ফিরে আসছে”! আমরা তার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝিনা। কিন্তু সবাই অবাক হয়ে আকাশ আর প্রান্তর যেখানে মিশে গেছে তার কিছুটা ওপর দিয়ে দেখতে পাই একটা তারা দ্রুতগতিতে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দিগন্তের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। আমাদের দেখা সেই অদ্ভুত তারাটা আসলেই কোন নভোযান ছিল কিনা আমি তা কখনই নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে বড় হবার পরে আমাদের পাঠ্য পুস্তকে পড়েছিলাম যে , ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার চন্দ্রমিশন এপোলো-১১ চাঁদে তাদের মিশন সম্পন্ন করে ফিরে এসেছিল!

হারুন স্যারদের পরিবার আমাদের এলাকার ভেতরে সম্ভ্রান্ত পরিবার। তার বাবাও ছিলেন একই স্কুলের মাস্টার। অন্তত দুই জেনারেশন শিক্ষিত এই পরিবার ঝাড় কাটার মতন অজ পাড়াগাঁয়ে তাদের সম্ভ্রান্তির বিশুদ্ধতা রক্ষা করে কিভাবে টিকে ছিল তা ভাবলে এখনো আমার অবাক লাগে। আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি তখন একদিন আমাদের স্কুলের আরবির টিচার মাওলানা মফিজ মোটা একটা ‘জিগার’ গাছের ডাল দিয়ে মনের আনন্দে ক্লাস থ্রির ছাত্রদেরকে পিটাচ্ছিলেন। আমাদের ক্লাসের সিরাজ স্যার টেবিলের ওপরে পা তুলে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। পাশের ক্লাস থেকে বেতের শপাং শপাং শব্দ ভেসে আসছে। আমার খুব ইচ্ছে হল একবার দেখে আসি! আমি ক্লাস থ্রির দরজার পাশে দাঁড়াতেই মফিজ স্যার পিছন ফিরে তাকালেন এবং আমাকে দেখতে পেয়েই বিদ্যুৎ বেগে আমার পিছন পিছন ছুটলেন। আমি দৌড়ে ফিরে এসে বেঞ্চে বসার পরও শেষ রক্ষা হলনা। মফিজ স্যার আমাদের ক্লাসে ঢুকে আমার ডান হাতের বাহুতে তার সর্বশক্তি দিয়ে ‘জিগারের’ ডালটা ভেঙে ফেললেন। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল। আমার ডান হাতের বাহুর ওপরের অংশে শুধু জ্বালা করছে। আর কোন কষ্ট নেই। শুধু আমার হৃদপিণ্ডটাই কামারের হাঁপরের মতন ধুঁক ধুঁক করছে। সিরাজ স্যারও তার প্রাত্যহিক দুপুরের ঘুম শেষ করে জেগে উঠেছেন। তিনিও মহা কনফিজড। তবে হেডস্যার অর্থাৎ হারুন স্যারও ইতিমধ্যে চলে এসেছেন। আমাকে শান্ত করে মফিজ স্যারকে নিয়ে তিনি তার রুমে চলে গেলেন। কয়েকদিন পরই দেখলাম মাওলানা মফিজ স্যারের বদলি হয়ে গেছে আমাদের স্কুল থেকে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত আমার নানা বাড়ীর পাশের সুখনগরি প্রাইমারি স্কুলে। প্রতিদিন এখন তাকে ৫ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হবে। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আর কোনোদিন কোন টিচার আমাদের গায়ে হাত তুলেন নি!

আমাদের পড়ালেখার ব্যাপারে হারুন স্যারের ছিল প্রবল যত্ন এবং আগ্রহ। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দেবার আগে বাকের স্যার নামের একজন টিচারকে আমাদের জন্য নিয়োজিত করে দিলেন। তিনি আমাদেরকে হাতে ধরে সরল অংক শিখালেন। তার পরেও বৃত্তি পরীক্ষায় আমি ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেলাম না। হারুন স্যার আমাকে বললেন, “ আসাদ তুই যদি শুধু ‘আমাদের গ্রাম’ রচনার নামটা ‘আদর্শ গ্রাম’ লিখতি তাহলে তোর ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পাওয়া কেউই ঠেকাতে পারতো না!”

হারুন স্যারের বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা অসাধারন এবং তার সেন্স অফ হিউমারও প্রবল। প্রতি বছর ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার মাঠে আমাদের এলাকার সকল মানুষ একত্রিত হয় শুধুমাত্র হারুন স্যারের মুখ থেকে কৌতুকপূর্ণ বক্তৃতা শোনার জন্যে। তিনি যখন কড়া রোদের ভেতরে চটের ওপরে কালো ছাতা মাথায় দিয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে তার অঙ্গভঙ্গি সম্বলিত বক্তৃতা আওড়াতে থাকেন, তখন তাদের হাসির দমকে কালো ছাতাগুলো হেমন্তের ধানক্ষেতের দুলতে থাকে। জীর্ণ ক্লিষ্ট এই জনপদের জন্য ঈদ তখন সত্যিকারের ঈদ হয়ে ওঠে!

হারুন স্যারের দুই ছেলে। কামরুল আর শামিম। দুজনেই আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট। কামরুলের ভেতরে একটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ভাব আছে। আমাকে দেখলেই সে দশ হাত দূর থেকেই সালাম দিয়ে বসে এবং যতবারই দেখা হয় ততবারই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ভাইজান, আপনি কেমন আছেন?” এই আদপ কায়দা সে তার বাপের কাছ থেকে শিখেছে। অন্যদিকে শামিম দুরন্তপনার চরম নিদর্শন। আমাদেরকে কেন, কোন স্যারকে দেখলেও সে সালাম দেয়না। এই ছেলেটিকে নিয়ে হারুন স্যার মহা মনোকষ্টে আছেন। সারাদিনমান শুধু খেলাধুলা করে, পড়াশুনা করেনা এমনকি হারুন স্যারের কথাও শুনেনা। তবে এটাও তিনি ঠিক জানেন যে শামিমের মাথা খুব ভাল। কোন পড়াই একবারের বেশি দেখতে হয়না তাকে! কামরুল এক্সাম ফোবিয়ায় ভোগার কারনে ক্লাস নাইন থেকে ক্লাস টেনে উঠতে পারেনি। আমি ক্যাডেট কলেজে পড়ি। হারুন স্যার আমাকে নিয়েই তার গর্ব প্রকাশ করেন।

আমি ক্যাডেট কলেজের ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। সামনে আমাদের এইচ এস সি পরীক্ষা। জীবনের শেষ টার্ম এন্ড ছুটিতে বাড়ীতে এসেছি। শামিম সেবারে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। তার পরীক্ষার ফলাফল কেমন হবে সেটা নিয়ে হারুন স্যার আদৌ নিশ্চিত নন। শামিম তার বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গেছে। একদিন গভীর রাতে হারুন স্যার কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বাড়ীতে এসে হাজির। শামিম তার বন্ধুদের সাথেই ফিরেছে। কিন্তু জীবিত হিশেবে নয়! বন্ধুদের ভাষ্যমতে বীচে একটা বোটের ওপরে খেলার সময়ে শামিম কখন পানিতে পরে গিয়েছিল সেটা তারা খেয়াল করেনি। অনেক পরে তারা বোটের পাশ থেকেই তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে!

একমাস পরের কথা। শামিমের পরীক্ষার ফলাফল বেড়িয়েছে। শামিম ৪ টা বিষয়ে লেটার পেয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। আমাদের হাই স্কুলের রেজাল্ট যথেষ্ট ভাল। গুরুজনরাও খুব খুশি। শুধু বৃষ্টির পরে হারুন স্যারের মুখে রঙধনুর সাত রঙ মিশে গিয়ে তার মুখমণ্ডলকে এক অদ্ভুত বিবর্ণতা দিয়েছে!

হারুন স্যারের ভেতরে এর পরেও তেমন কোন ব্যত্যয় কেউ খেয়াল করেনি। তিনি আগের মতনই তার স্কুলের জন্যে কাজ করতেন। শুধু তাকে আর কোনদিন ঈদের মাঠে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়নি। আর একটা বিষয় শুধুমাত্র খেয়াল করার মতন ছিল! কামরুলকে তিনি কখনো একা হতে দিতেন না। স্কুল থেকে এক মাইল পিছনে হারুন স্যারদের বাড়ী। প্রতিদিন সকালে দেখা যায় হারুন স্যার কামরুলের সাথে হাত ধরাধরি করে স্কুলের দিকে এগিয়ে আসছেন। এ সময়টায় পাশাপাশি তাদেরকে খুব অদ্ভুত লাগে। মনে হয় যেন দুই অসম বয়সী বন্ধু পরস্পরের হাত ধরাধরি করে সৈকতের উল্টোদিকে হাঁটছে আর তাদের পেছনে গর্জন করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র !

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

৩,৬২২ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “আমাদের হারুন স্যার”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    কত কত বিচিত্র ঘটনা যে ঘটে চারিদিকে।
    আর তাঁর প্রভাবে বদলে যায় কত কিছু...

    মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেলাম। এমন লিখা বিনা পয়সায় পড়াটা আসলে ঠিক হচ্ছে না।
    আশা করছি লিখাগুলো জলদি কোনো পাবলিশারের নজরে আসুক, তাহলে এগুলোর বই আকারে বের হওয়াটা কেউ আটকাতে পারবে না।
    তখন ইচ্ছা মতো পয়সা দিয়ে কিনে পড়া যাবে এই লিখাগুলা.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    অনবদ্য। হেমন্তের ধানক্ষেতের মতোন আমিও যেনো দুলতে দুলতে পড়তে পড়তে পৌঁছে গেলাম লেখার শুরু থেকে শেষে। শুধু শুরুতে বুকের ভেতরটা ক্রমশ: যেমন হিলিয়ামে ভরাট হচ্ছিলো আচম্বিতে তা শেষে এসে ঝুপ করে পারদের মতোন ভারী হয়ে গেলো।
    আর হ্যাঁ। পারভেজের কথার প্রতিধ্বনিটা আমিও উচ্চারণ করলাম।
    :boss:

    জবাব দিন
  3. আসাদ (৭৭-৮৩)

    আমি প্রায় সময়েই ব্লগে আসতে পারিনা নিজের কিছু ব্যস্ততার জন্যে। অসম্ভব সুন্দর সুন্দর মন্তব্যগুলো দেখে সত্যি সত্যিই খুব লজ্জিত হলাম। সবাইকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ !!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।