আমার কাজলাদিদিরা -৩ (চামু)
২০০৪ সালের পহেলা এপ্রিল দেশ ছাড়লাম। কোন রকম এপ্রিলফুল ছাড়াই আমরা জাপানে চলে আসলাম। বন্ধুরা মজা করে বলছিল তোদের নিশ্চয়ই প্লেনে তুলে চিটাগং নিয়ে নামিয়ে দিবে। চিটাগং এর ভাষা না বুঝে তোরা মনে করবি আসলেই জাপানে আসছিস। এরকম আরো অনেক মজার কথা বলে অনেকেই মন ভাল করার চেষ্টা করছিল। যখন আসছিলাম তখন ভেবেছি ৪-৫ বছর মনে হয় আর দেশে আসতে পারব না বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না, বাসায় থাকা হল না। প্রবাসী জিনিস কি জানিনা তবে জানি সেটা শুধুই একা একা থাকতে হয় । বাসা থেকে বের হয়েছিলাম সেই ১৯৯৬ সালে কিন্তু তখনো খুব একটা একা থাকতে হয় নি। প্রথম ১ মাসের মধ্যেই বুঝে গিয়েছি বন্ধুরাই আমার সব। কিন্তু প্রবাসের একাকীত্বের কথা গল্প উপন্যাসে পড়েছি এবার নিজে অনুভব করতে যাচ্ছি। এক বন্ধু একটা ডায়েরী দিয়েছিল প্রথম পাতায় একটা বিশাল চিঠি লিখে। আরেক বন্ধুর ৫ পাতা লম্বা চিঠি প্লেনে পড়ে পড়ে কাঁদছিলাম। প্লেন থেকে নেমে আর কাঁদার সময় ও নেই, চারপাশে উদ্ভট সব লেখা কিচ্ছু বুঝিনা কারো কথা কিছু বুঝতে পারছি না মনে হচ্ছে ভিনগ্রহে এসেছি। বিদেশে আসলে ইংরেজি শুনব হালকা নিজের ইংরেজি জ্ঞান দিয়ে ২০% বুঝে যাব এইরকম ধারণাই ছিল কিন্তু এরা যে ইংরেজি বলে না। নিজের রুমে এসে দেখলাম এখানেও ক্যাডেট কলেজের মত অনেকটা রিসিভ করার ব্যাপার আছে। অনেক সিনিয়র এসে আমাদের প্রথম দিন রিসিভ করল। কিন্তু তারপর সবাই যাওয়ার পর নিজের একলা রুমে কান্না করে নিলাম খানিক ক্ষণ। নিজের একটা সিংগেল রুম থাকবে বাসায় এইরকম অনেক চিন্তা করতাম কিন্তু নিজের রুমে চারদিকে তাকালেই খালি শূণ্যতা চোখে পড়ছিল। একা একা থাকা কত কষ্টের প্রথম দিনেই বুঝে ফেললাম।
এরকম করেই দিন কাটছিল জাপানে। ঠিক কবে মনে নেই তবে ২-৩ মাস পরে আমাদের ডর্মে একটা অনুষ্ঠান হয় সেখানে আমাদের অনেক বড় ভাই ভাবী এসেছিল। সেদিনই প্রথম দেখা ওর সাথে। ওকে ডাকতে পাঠানো হয়েছিল আমাকে। আমি চিনিনা আমাকে বলল ওখানে গিয়ে যাকে মনে হবে বাংলাদেশি তাকেই ডাকবা। সালোয়ার কামিজ পড়া থাকাতে কোনটা বাংলাদেশি বুঝতে আমার সমস্যা হয়নি। এরপর আর কোন যোগাযোগ হয়নি। অনেকদিন পরে আরেকটা দাওয়াতে ওর সাথে প্রথম কথা হয় পরিচয় হয়। খুবই সাধারণ ভাবে অন্য সবার সাথে যেমন কেমন আছি জাপানে এসে কেমন লাগছে এইরকম কথাই হয়েছিল মনে হয়। ডিসেম্বরের কোন একদিন ওর ডর্মে দাওয়াত খেতে গিয়ে মনে হয় প্রথম ওর সাথে সেরকম ভাবে কথা হল। ও নিজেও তখন অনেক একা ছিল। জাপানে কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই ওর। সেই সময়ই ওর অনেক কাছে চলে আসলাম আমি। টোকিওর একটা বছর কেমন করে যেন কেটে গেল। টোকিওর বাইরে কলেজে গিয়ে দেখি এতদিন টোকিওতে ছিলাম সেটা যে কত ভাল ছিল। সারা শহরে আমি একাই বাঙ্গালী। মোবাইল হাতে না নিলে বাংলায় কথা বলতে পারি না। জাপানে কথা বলার মত সেরকম কেউ নাইও। তখন আপুর সাথে কথা বলতাম অনেক। কখন যে আপনি থেকে তুমিতে চলে গেলাম । ও তখন পার্ট টাইম করত বাসায় ফিরত রাত ১১টার দিকে। প্রতিদিন বাসায় ফিরেই নেটে এসেই কথা বলতাম আমরা ভাই বোন। বাদ যেত না একদিনও। আমারো কোন কাজ না থাকলেও ওর জন্য নেটে বসে থাকতাম। ওর সারাদিনের গল্প আমার গল্প বলে তারপর ঘুমাতে যেতাম। কত কথা যে হত। আমাকে বলত না এমন কোন কথা নেই ওর। মনে আছে ওর বিয়ের একটা প্রোপোজাল এসেছিল ছেলে মালয়েশিয়ায় থাকে। সেদিন আমি ডায়েরীতে লেখেছিলাম আমার এই আপুটা যদি জাপান থেকে চলে যায় তাহলে আমার কত খারাপ লাগবে। ভাগ্যিস ওর সেই প্রস্তাব বেশি আগায়নি। এরপর ঈদের দিন জাপানে একা একা কিভাবে ঈদ করব খুঁজে না পেয়ে আমি ২ দিনের জন্য টোকিও চলে গিয়েছিলাম ওর সাথে ঈদ করতে।
২০০৬ এর বিশ্বকাপ আমরা একসাথে দেখেছিলাম যদিও দুজন ভিন্ন জায়গায় থেকে। ইয়াহু চ্যাটে ভয়েস দিয়ে আমরা ভাই বোন খেলা দেখতাম আর কথা বলতাম। ওর পছন্দ ছিল ব্রাজিল আর ইতালি। আর আমি আর্জেন্টিনা। খুব খেপাতাম ওকে। ইতালি ফ্রান্সের ফাইনাল খেলায় আমি ফ্রান্স আর ও ইতালি। ঐ জিতেছিল কিন্তু আমি তবুও ওকে অনেক পচিয়েছিলাম। মনে আছে যেদিন ও ভাল কিছু রান্না করত সেদিন জোর করে আমাকেও কিছু না কিছু রান্না করাত। তারপর বলত আস ভাইয়া আমরা একসাথে খাই। হাহাহহা। দুজন দু জায়গায় থেকে আমরা একসাথে খেতে খেতে গল্প করতাম।
২০০৭ সালের প্রথম দিকেই হঠাৎ করেই আমি অনেক ডিপ্রেসড হয়ে গেলাম অন্য একটা পার্সোনাল ব্যাপারে। তখন ওর খুব সাপোর্ট আমার প্রয়োজন ছিল কিন্তু ও বুঝতে পারেনি আমাকে সেই সময়। আমিও বলতে পারিনি আপুকে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল তখন। আমি তখন কারো সাথেই যোগাযোগ করতাম না। ও ফোন করত কিন্তু আমার ফোন করা কমে গেল নেটে ঢুকতাম না তখন। আমার ব্যাপার বুঝতে না পেরে ও ও যোগাযোগ কমিয়ে দিল । তখনই ওর এফেয়ার হল। আমি ততদিনে অসম্ভব রকম নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছি। আপুর এত আনন্দের সময়ে ওর আনন্দের শেয়ার নিতে পারলাম না। স্বাভাবিক ভাবেই আপু ব্যস্ত হল। মাঝে মাঝে আপু ফোন দিত কিন্তু কথা জমত না ও একাই কথা বলে যেত আমি শুনতাম মাঝে মাঝে অল্প একটু কথা বলতাম। ভাইয়ার খবর দবর নিতাম। ওর সেই আনন্দময় গলা শুনে নিজের কষ্টের কথা বলে ওর আনন্দে বাধা দিতে চাইতাম না। ও অবশ্য আমাকে ফোন দিলেই জিজ্ঞেস করত ,” ভাইয়া তোমার কি হয়েছে? কথাবার্তা একদম বল না আমিই বকবক করছি ” আমি বলতাম তোমার অনেক ঘটনা ঘটছে তাই তোমারই তো কথা বলার সময়। আমার তো বলার মত কিছু নেই কি বলব। মাঝে মাঝে অনেকদিন পর পর হয়ত ওকে ফোন করেছি মন খারাপ করে নিজের ডিপ্রেশনের কথা বলার জন্য তখন দেখা গেল ফোন করার পর ও কথা শুরুই করেছে খুব আনন্দিত গলায় আমার আর বলা হত না কিছুই। ওর কোন দোষ ছিল না তাও আমার খুব অভিমান হয়ে গেল। প্রতিদিন কথা না বললে কেমন খালি খালি লাগত সেই আমি আপুর সাথে ফোন করা বন্ধই করে দিলাম। আপু অবশ্য করত টুকটাক কথা হত তখন। এইভাবে অনেকদিন পার হয়ে গেল প্রায় এক বছর। অভিমান করে যা শুরু করেছিলাম সেটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল। কথা বলা অনেক অনিয়মিত হয়ে গেল তবে আপুটা আমার আপুই রয়ে গেছে।
২০০৮ আমি টোকিও ফিরে আসলাম। আগে থেকে আমরা প্ল্যান করতাম আমি টোকিও আসলে প্রতি উইকএন্ডে হয় ও আমার এখানে আসবে নয় আমি যাব। ভাইবোনে মিলে অনেক বেড়াব অনেক মজা করব। কিন্তু তার কিছুই হল না। টোকিও এসেও আমি ওর ডর্মে গিয়েছি বড়জোর ২-৩ বার তাও ওর অনেক পীড়াপীড়ি কিংবা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল এর কারণে। ও সবসময় বলে এখন তো তোমার আরো আপু আছে আমাকে আর এত ভাল লাগে না। আমি কিছু বলি না মনে মনে বলি আপু পাওয়া এত সহজ হলে আর কথাই ছিল না। মনে মনে ওকে কিন্তু আমি অনেক পছন্দ করি কিন্তু কোন কিছুই প্রকাশ করি না।
সম্প্রতি আমার এই আপুটার বিয়ে হয়েছে আমি দেশে যেতে পারিনি ওর বিয়েতে। ওর বিয়ের পরেরদিন গিয়েছি দেশে। এতে ও খুব রাগ করেছে। আমার আসলে কিছু করার ছিল না। ও যখন রাগ করে তখন আমার ভাল লাগে, যখন রেগে গিয়ে বলে আমাকে তো এখন আর ভাল লাগে না, আমার কথা মনে পড়ে না, আপুকে দেখতে আস না, ফোন দাও না তখন আমার ভাল লাগে মনে হয় একজন অন্তত আছে যে আমার উপর কিছু আশা করে না পেলে রাগ করে। এই রাগটাকে ভালবাসা ধরে শান্তি পাই। তাই মনে হয় ইচ্ছা করেই ওর কোন কথাই শুনিনা। কদিন পরে আমার এই বোনটাও আমেরিকা চলে যাবে। তখন হয়ত অন্য সব কাজলা দিদির মতই এও হারিয়ে যাবে বছরে একদিন দুদিন কথা হবে। এটা এখন নিয়ম হয়ে গেছে। এক এক আপু আসবে আমার জীবনে কিছুদিন প্রচন্ড ভাবে আদর করবে, তারপর কিছু একটা হবে হয় আমার আবেদন ফুরিয়ে যাবে, নইলে কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে কিংবা এমন কোথাও চলে যাবে যেখানে যোগাযোগ করা কমে যাবে আর স্বাভাবিক ভাবেই out of sight out of mind. এইজন্য বেশি বেশি কষ্ট লাগে আমার যদি একটা আপন আপু থাকত তাহলে যেখানেই যেত হারিয়ে যেত না।
১২ টি মন্তব্য : “আমার কাজলাদিদিরা – ৪ (নিশুআপু)”
মন্তব্য করুন
১ম নাকি??
অভিনন্দন।
শুধু আপনার কাজলা দিদিদের গল্প পড়ে আমি তাদের ভক্ত হয়ে গেছি।
পুরাটাই আমার নিজস্ব কল্পনা কিন্তু। তোমার চারপাশেও এরকম অনেকে আছে দেখ শুধু কল্পনা করতে পারলেই হবে। কে কতটা কাছের মানুষ জানিনা কিন্তু কাছের মানুষ হিসেবে চিন্তা করলে ভাল লাগে । ফিডব্যাক হয়ত পাই না সেরকম।
এক কাজলা দিদি'র চেয়ে আরেক কাজলা দিদি অতুলনীয়া ...
ইউনিক সব কাজলা দিদি'দের অসাধারণ উপস্থাপনার জন্য কামতপু'কে আজ থেকে 'কামরুলতপু' উপাধী দিলাম। 😀
তুই ভস ...
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
ধন্যবাদ ভাইয়া। আহারে নিজের নামটা ফিরে পাওয়ার যে কি আনন্দ।
আপুকে লেখাটা দেখাইসো?
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
এত দুঃখ কেন? 🙁
দুঃখ বিলাসী...
মিয়া আপনি হইলে গাধা নাম্বার ওয়ান x-( x-( x-( x-(
আপু আগের আপুই আছি ।
এই সিরিজটা ভালো পাই; জানান দিয়ে গেলাম। নিজের ছবি খুঁজি আপনার জায়গায়।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..