মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-হতাশাময় শহুরে আটপৌরে জীবনের রূপকার হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থিতিশীল এলোমেলো সময়ে যার লেখা শীতল বাতাসের মতোই নাড়িয়ে গেছে সাহিত্য পিপাসু বইপড়ুয়া অগণিত মানুষদের। সহজ বাক্য, অনাড়ম্বর বর্ণনা আর নিজস্ব স্টাইল তাঁকে এনে দিয়েছে বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের সম্মান। আমাদের চারপাশের নিত্যনিয়ত ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনাকে তিনি মিহিসুতোর কারুকার্যে একই সাথে সেলাই করেছেন অপরূপ নকশীকাঁথায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোই উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। এক মধ্যবিত্ত তরুণ, যার পিতা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। অর্থকষ্ট, দারিদ্র্য, আর জীবনের সীমাহিন ঘাতপ্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তিনি তাঁর চরিত্রগুলোকে করেছেন নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। হিমু চরিত্রের মাঝে দেখা মেলে এক এলেবেলে বেকার তরুণের যিনি হলুদ রংয়ের পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। তার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হলেও এটাও মিথ্যে নয় যে প্রতিটি তরুণের ভেতরেই একজন হিমুর বসবাস, পারিপার্শ্বিক চাপ কিংবা সামাজিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যে চরিত্রকে চেপে রেখেই প্রত্যহ অভিনয় করে যেতে হয়। এই স্বাধীনচেতা হিমু চরিত্র তরুণদের অবচেতন অবস্থার বহিঃপ্রকাশ যেন। যার জন্য অপেক্ষায় থাকে রূপা নাম্নি এক তরুণী, কিন্তু হিমু কখনো রূপার কথা রাখে না। এই কথা না রাখার মধ্যেও এই ধরণের হেয়ালিপনা, এক ধরণের মেগালোমেনিয়াক পার্সোনালিটি কাজ করে। যে তরুণ তার স্বভাবসুলভ চরিত্র দ্বারা কখনো র্যািব, কখনো পুলিশ, কখনো মাজারের পীর, আবার কখনো রাষ্ট্রের বড় কর্তার সাথে বিচিত্র কথোপকথন দ্বারা বিভিন্ন অসঙ্গতিকে তুলে ধরে। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে আমাদের তথাকথিত সমাজ ব্যাবস্থাকে। তাই হলুদ পাঞ্জাবি পড়া হিমু চরিত্র শুধু একটি চরিত্রই নয়, প্রতিটি তরুণের ভেতর লালন করা একটা আলাদা সত্তা, যাকে আড়াল করে অভিনয় করে যেতে হয় সামাজিক ফর্মালিটিজের। এক্ষেত্রে আমাদের মনে পড়ে সেই বিখ্যাত প্রবাদ। মানুষ মুক্ত হয়ে জন্মালেও সে আসলে আজন্ম শৃঙ্খলে বন্দী, হিমু তাই স্বভাবে বাউন্ডুলে অথচ গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন একজন তরুণ যে এই শৃঙ্খল ভেঙ্গে জোছনা রাতে খালি পায়ে বেড়িয়ে পড়ে ‘যে জীবন ফড়িঙ এর, দোয়েলের’ তার সাথে দেখা হবে বলে।
হুমায়ূন পাঠ করতে গিয়ে একজন তরুণ তাই সহজেই লেখার ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। আর তাই যেন নিজস্ব জীবন আখ্যানই রচিত হয়েছে এই ভেবে তরুণ পাঠক এক তীব্র আকর্ষণ নিয়ে এগিয়ে যাবে সামনে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদের গল্প কিংবা কাহিনী হালকা মনে হতে পারে, কিন্তু এও মিথ্যে নয় যে অহরহ ঘটে যাওয়া দৈন্দনিন ঘটনার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ বেদনার সাতকাহন। একজন তরুণ কিংবা তরুণীর জীবনে তাই হুমায়ূন আহমেদ জড়িয়ে থাকে নিবিড় ভাবে। চাকুরী না পাওয়া বেকার তরুণের যন্ত্রণা, সামাজিক প্রবঞ্চনা, মধ্যবিত্তের চিরায়ত অভাব অনটন, নাগরিক জীবনের বিচ্ছিনতাবোধ, সংকট, কিংবা নীল তোয়ালে মুখ লুকিয়ে অভিমানী তরুণীর কান্না, বিয়ের বয়স পেড়িয়ে যাওয়া তরুণীর সামাজিক দুরবস্থা, পিতার চিন্তাযুক্ত মুখ, আবার কদমফুল হাতে নিয়ে নীল শাড়ি পড়া কোন রূপসীর দাঁড়িয়ে থাকা, প্রেমিকপুরুষের ভেতরে জন্ম নেয়া ভালোবাসার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতি সবকিছুই যেন একাকার হয়ে মিলিয়ে যায় তাঁর লেখায়। ফলে হুমায়ূন আহমেদ প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে গৃহত্যাগী জোছনা কিংবা শ্রাবণসিক্ত কোন বর্ষাবেলায়। হুমায়ূন আহমেদ একটা বিশাল প্রজন্মকে বই পড়া শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন জোছনা আর বৃষ্টিতে ভিজতে। এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। বাংলাদেশে পাঠক সৃষ্টিতে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। বইবিমুখ একটা সুবিশাল প্রজন্মকে বইমুখি করা তাঁর অনন্য সাফল্য।
হুমায়ূন আহমেদের লেখায় বরাবরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে বিভিন্ন ভাবে। ফলে একজন পাঠক স্বাধীনতার চেতনায় সহজেই উদ্বুদ্ধ হবে তাঁর লেখা পাঠে। তোতাপাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ বাক্য উচ্চারণ দ্বারা তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক দারুণ দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে যে বাক্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চে স্ফুলিং হিসেবে কাজ করে। তরুণ প্রজন্মের ভেতর যা জন্ম দেয় অগাধ স্বাধীনতার চেতনা। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। বাংলা চলচ্চিত্রে এক অনবদ্য সৃষ্টি। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখা লিখেছেন। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখার মাঝে গভির ভাবে প্রোথিত ছিল। ‘ জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসটিতে তিনি বিভিন্ন চরিত্রের চোখে বিভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধকে দেখিয়েছেন। ফলে একজন পাঠক বিভিন্ন দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার প্রয়াস পাবে।
ছোটগল্প আর সায়েন্সফিকশন রচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত প্রথার ভেতরে নিজেকে আটকে রাখেননি। আর তাই তাঁর সায়েন্সফিকশনগুলোতে জাগতিক সময়ের ভেতরে থেকেই মহাজাগতিক অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়। আর ছোটগল্পগুলো আকারে ছোট হলেও গভীরতা বয়ে বেড়ায়।
হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা ফিকশোনাল চরিত্রগুলো প্রত্যেকেই তাঁর জায়গায় অনন্য। মিসির আলি চরিত্রের রহস্যময়তা, ফ্রয়েডিয় বিশ্লেষণ, যুক্তি-তর্ক, উপস্থাপন, মনস্ত্বাত্বিক বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখা পাঠকের মনে দারুণ এক ভাবালুতার জন্ম দেয়। আর ঠিক এর বিপরীতেই হিমু চরিত্র মানুষের মনের খেয়ালি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুটি বিপরীতমুখী চরিত্রকে তৈরি এবং উপস্থাপন একজন লেখকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। আর তিনি এই কাজটিকেই নিপুণভাবে করেছেন। মানব মনের এই দ্বান্দ্বিক ঐক্যকে দুটি ভিন্ন চরিত্র দ্বারা রূপায়ন করে তিনি একই সাথে মানুষের জীবনের দুটি বিচিত্রদিককে তুলে ধরেছেন। আর এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ মিশে যান জীবনের সাথে বিচিত্র গল্প আর ঘটনার পাকচক্রে। যেন জীবনের সহজ কোন পাঠ তিনি নিমিষেই তুলে ধরছেন আমাদের সামনে। মনে পড়ে প্রথম হুমায়ূন পাঠের অভিজ্ঞতা। আধাসামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যাডেট কলেজের অজস্র নিয়ম কানুনের ভিড়েও না না কসরত করে হুমায়ূন পাঠ ছিলো অনিবার্য। অভিভাবকহীন চারদেয়ালের বন্দী সে সাদাকালো কঠোর জীবনে হুমায়ূন আহমেদ যে কল্পনার রঙ মেলে দিয়েছিলেন যে রঙ আজো প্রোজ্ব্বল। আর তাই হুমায়ূন আহমেদ মন খারাপের রাত কিংবা এক ঘেয়ে সময়ের অপূর্ব সঙ্গী। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ প্রাসংগিক হয়ে আছে হাজারো তরুণ তরুণীর মাঝে। একজন লেখকের সার্থকতা হয়তো মানুষের জীবনযাত্রার সাথে এই মিলিয়ে যাওয়াতেই।
কিছু সমালোচনা আছে।
পরে করবো।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
তৃতীয় অনুচ্ছেদে কি? অপেক্ষায় রইলাম।
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
তরুণদের চোখে হুমায়ূন আহমেদ, এই শীর্ষক একটি ফরমায়েশি লেখা এটি সাম্প্রতিক দেশকাল নামের সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার জন্য। সম্পাদক মশায় বলেছিলেন, জন্মদিনে যতটুকু সম্ভব সমালোচনা বাদ দিয়ে লিখতে। করলে অনেক সমালোচনাই করা যায়, ভিন্ন দৃষ্টিতেও দেখা যায় অনেক কিছু। তবুও অপেক্ষায় রইলাম 🙂 অপেক্ষা ভালো কিছু এনে দেয় 🙂