শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি নামল। ঝুম বৃষ্টি। করিডরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করলাম। চোখের পাতা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে এল। গাবদাকে মনে পড়ে। গাবদা মানে ওয়াহেদ। আদর করে নাম দিয়েছিলাম গাবদা। একটু মোটা ছিল। ক্যাডেট কলেজের সামরিক পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়তো একটু কষ্টও হয়েছিল। এক সন্ধ্যার কথা। সেনাবাহিনীর এক সদস্য গাবদাকে প্যারেড শেখাচ্ছে। গাবদার মোটা দেহ বেয়ে দরদর করে ঘাম নামছে। ততক্ষণে খেলার সময় শেষ। সবাই যে যার মতো রুমে চলে গেছে। শুধু গাবদাকে তখনো প্যারেড শেখানো হচ্ছে। কোনো একটা ভুল করেছে নিশ্চয়ই। শৈশবে মা-বাবাকে ফেলে জীবন গড়ার এক মহান তাগিদে নিজেকে আবদ্ধ করেছে ক্যাডেট কলেজের চার দেয়ালে। সেই সন্ধ্যার এই কষ্টময় মুহূর্ত চোখে যেতেই অনুরোধ করলাম ওকে ছেড়ে দেওয়ার। সেনাবাহিনীর সে মানুষটি অনুরোধ রাখলেন। গাবদা কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু একটা বলতে চাওয়ার প্রবল আকুতি ওর চোখেমুখে। হুট করে বড়দের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম নেই ক্যাডেট কলেজে। তাই হয়তো ও নীরবে প্রস্থান করেছিল। গাবদার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দেখা ক্যানটিনে। উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে বড়দের অতিক্রম করে কিছু কেনা অসম্ভব ছিল। ব্যাপারটা চোখে পড়তেই ভিড় ঠেলে ওকে কিছু কিনে দিলাম। আর বললাম, ওই গাবদা, তোমার এই নাম কে দিয়েছে? ও চাপা স্বরে বলল, ভাইয়া, সবাই ডাকে। গাবদার চোখে লজ্জার আভা। ভাবলাম, এভাবে সবার সামনে গাবদা ডাকা ঠিক হয়নি। গাবদা চলে যাওয়ার পর মনে হলো, ওকে ‘সরি’ বলতে পারতাম। কেন জানি না অজ্ঞাত কারণে ওকে খুব পছন্দ করতাম। ক্যাডেট কলেজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যা কখনো ওকে জানাতে পারিনি। অনুভব করতাম মোটা হওয়ার কারণে ওর ভেতরে কিছু চাপা কষ্ট আছে। সবাই ওকে তাচ্ছিল্য করে। সেই চাপা কষ্ট ও কাউকে বলতে চায়। একবার ভাবলাম, ওকে রুমে ডাকব। কথাগুলো শুনব, একসঙ্গে দুঃখ প্রকাশও করব।
গাবদার কথাগুলো শোনা হয়নি। এক সকালে গাবদা চলে গেল হুট করে। সকালের রুটিনমাফিক দৌড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি কেউ একজন দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে। ভিড় ঠেলে দেখি গাবদা। আমাদের ওয়াহেদ। ওয়াহেদকে পাঠানো হয় শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজে। ফিরে আসে বিকেল পাঁচটায়। ওয়াহেদকে রাখা হয় কলেজের মসজিদের সামনে। কিছুক্ষণ পর চলে যাবে ওয়াহেদ। চিরদিনের জন্য। সবাই ওয়াহেদকে দেখতে গেলেও আমি যেতে পারিনি। শুধু দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের গাবদা ঘুমিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চাওয়ার প্রবল আকুতিতে ও তখন ম্রিয়মাণ। সবাই গাবদাকে শেষবারের মতো দেখছে। একসময় চলে যায় ওয়াহেদ। কলেজের বিশেষ ব্যবস্থায় ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে শুনেছিলাম, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ। স্ট্রোক করার পর ২০ মিনিট শ্বাস ছিল। সে রাতে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে নেমে আসে নিস্তব্ধ নীরবতা। বুকের ভেতর শূন্যতার স্রোত বয়ে যায়। এর পর থেকে মাঝরাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়। কখনো জোছনা ওঠে। প্রবল জোছনায় ভেসে যায় ক্যাম্পাস। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি অস্বচ্ছ জোছনার আবছায়া মায়াবী আলোয় একটি ছায়ামূর্তি। দূর থেকে মনে হয় গাবদা। বসে আছে চুপচাপ।
(ওয়াহেদ এর মৃত্যুর দিনটি ছিল ১০.১০.১০.
প্রায় দুবছর পূর্ন হল। আমরা সবাই ওর জন্য দোয়া করবো।
“বরিশাল ক্যাডেট কলেজের অকাল প্রয়াত ক্যাডেট ওয়াহেদ স্মরনে”
প্রকাশিত ছুটির দিনে: ০৬.১০.১২
রাব্বী আহমেদ )
ওয়াহেদ যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।
বাবা মার অবশ্যই উচিৎ ছেলে মেয়ের সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে ক্যাডেট কলেজে দেয়া। অনেকেই নিজেদের শারিরীক দূর্বলতা লুকিয়ে কলেজে আসে, এটা পরে অনেক খারাপ ফল বয়ে আনে। ওয়াহেদের জন্য অনেক ভালবাসা রইল।
🙁 🙁
::salute::
Life is Mad.
🙂 🙂