পোট্রেইট

।১।
তার মানে তুই আমাকে পোট্রেইট এঁকে দিচ্ছিস না? পিউ এর কথাটা বেশ ভারী শোনাল। কথক বলল, আর কিছু দিন সময় দে,ঠিক একেঁ দেব। সেমিস্টার ফাইনাল নিয়ে একটু ব্যস্ত। কথকের কথা শুনে পিউ এর মেজাজ খারাপ হল। কোন মতে বিরক্তি ঢেকে বলল,দেখ ভালো ছবি আঁকিস বলে তোকে আমার পোট্রেইট আঁকতে বলেছি। সেই পাঁচ মাস ধরে ঘুরাচ্ছিস। আজ কাল করতে করতে এতটা দিন কেটে গেল। না আঁকলে সরাসরি বলে দে। পিউ এর কথা শুনে কথক কিছুটা লজ্জা পেল। কথা গুলো মিথ্যে না। অনেক আগে থেকেই পিউ একটা ছবির জন্য প্যাঁনপ্যাঁন করছে। বেশ কয়েক বার বলেছেও। না না কারনে কাজটা আর করা হয়ে ওঠেনি।কথক বলল,এবার আর ভুল হবেনা দোস্ত। পরীক্ষাটা দিয়েই তোর ছবি আঁকায় হাত দেবো। শোন তোর যা সুন্দর চেহারা দেখবি ছবিতে আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলবো। পিউ কোন কথা বললোনা। ও জানে শেষ মেষ এই ছবি আঁকা হবেনা। কোন একটা কারনে ছবি আঁকা প্রোগ্রাম ক্যানসেল হবে। গত জানুয়ারীর কথা। কথককে অনেক বলে কয়ে ছবি আঁকানোর জন্যে রাজী করানো হল। কথকের ছবি আঁকার হাত বেশ ভাল। তবে সমস্যা হচ্ছে ও যার ছবি আঁকবে তাকে ওর সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা মূর্তির মত বসে থাকতে হবে। ব্যাপারটা একটু বিরক্তি কর। নড়াচড়া করা যায়না। তারপরেও কোন শিল্পীর ক্যানভাসে জায়গা পেতে খারাপ লাগেনা। ব্যাপারটা যতই বিরক্তিকর হোক। পাবলো পিকাসো কিংবা ভিঞ্চির মধ্যেও ছবি আঁকা নিয়ে অনেক ঢঙ ছিল। পিকাসো যখন তখন ছবি আঁকা শুরু করতেন। হঠাত্‍ কোন একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে তিনি ছবি আঁকা শুরু করে দিলেন। আর ভিঞ্চির ব্যাপারটা সম্মূর্ন আলাদা। তিনি অনেকটা আয়োজন করেই ছবি আঁকতে বসতেন। কি আঁকবেন আগে থেকে ঠিক করে রাখতেন। প্রতিভাবান মানুষদের অনেক পাগলামী থাকে। কথকের মধ্যেও পাগলামীর অভাব নেই। যদিও কথক পিকাসো কিংবা ভিঞ্চির মত বিখ্যাত কেউ না। তবুও মাঝে মাঝে পিউ এর মনে হয় একটা ভালো প্লাটফর্ম পেলে কথক এঁদের কাছাকাছি চলে যাবে। বর্তমানের শিল্পীরা বিমূর্ত ছবি নাম দিয়ে কি আঁকে এঁরাই ভালো জানে। অর্থহীন ছবি আঁকার মানে হয়না। ছবি হচ্ছে ভাষা হীন কবিতা। যা দেখা মাত্র মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আবেগ বেরিয়ে আসবে। কথাটা একজন বিখ্যাত মনিষীর। পিউ এর মাথায় অনেক কিছু ঘুরতে থাকে। একদিন কথক পিউ কে ছবি আঁকার জন্য সময় বরাদ্দ দিল। পাবলিক লাইব্রেরির পাশে একটা বাদাম তলা আছে। শান্ত পরিবেশ। ছবি আঁকার জন্য উপযোগী। অনেক ভেবে চিন্তে কথক এই জায়গাটিই বেছে নিয়েছে ছবি আঁকার জন্য। পিউ আর নিষেধ করেনি। বেচারা যে জায়গায় শান্তি পায়। ছবি আঁকাটাই মুখ্য। পিউ বসে আছে কথকের সামনে। কথক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিউকে দেখছে আর ওর পোট্রেইট আঁকছে। ছবি আঁকা যখন শেষের পর্যায় ঠিক তখন ওপর থেকে একটা কাক হাগু করল। কথক এবং পিউ দুজনের ই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি খারাপ হল পিউ এর। টানা তিনঘন্টা পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা কষ্টের। যদিও এতসময় পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকা জায়না। মাঝেমাঝে পলক পড়ে গেলে কথক পিউকে জোড়েসোড়ে ঝাড়ি দিয়েছে। এবার পিউ এর ঝাড়ি দেয়ার পালা। জায়গাটা পিউ এর শুরু থেকেই অপছন্দ ছিল। পিউ তখন রেগে বলেছিল,হলো তো এবার, ছবি আঁকার জন্য আপনার বাদাম তলা চাই,ঘন্টার পর ঘন্টা সামনে বসে থাকা চাই। ঢঙ। কথক মৃদু হেসে বলল,শোন ব্যপারটা হচ্ছে তোর ছবি দেখে কাক ভেবেছে ওর ছবি এঁকেছি। ভালো লাগেনি দেখে হেগে দিয়েছে। খুব সোজা হিসেব।
তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস আমার চেহারা কাকের মত? পিউ বলল।
ঠিক কাক না আবার কোকিল ও না। কোক টাইপ।
মানে?
মানে কোকিলের কো আর কাক এর ক। দুটো মিলে কোক।
কথকের কথা শুনে পিউ মৃদু হাসলো। ছেলেটার সেন্স অফ হিউমার ভালো। নামের সাথে মিল আছে। ছেলেটার প্রতিভার অভাব নেই। ভালো ছাত্র। ছবিও ভালো আঁকে। সুন্দর গল্প কথক। এত গুন যে ছেলেটার তার সাথে রাগ কিংবা অভিমান কোনটাই বেশিক্ষন করা যায়না।

কিরে কথা বলছিস না যে? কিছু ভাবছিস? কথকের কথায় পিউ সম্বিত ফিরে পায়। পিউ শান্ত গলায় বলে,ভাবছিলাম গত জানুয়ারির কথা। ছবিটা প্রায় শেষ পর্যায়েই গিয়েছিল। শেষে কাক এই কুকর্মটা না করলেই হতো। শোন তুই আমার বিশেষ বন্ধু বলে তোকে আমার ছবি আঁকার কথা বলেছি। গত বানিজ্য মেলায় এক বৃদ্ধ দাদু কত অনুরোধ করলেন আমার ছবি আঁকার। একটা টাকাও চাইলেননা। আমি দেইনি। আমি চাই যে আমার প্রথম ছবি আঁকবে সে হবে আমার কাছের মানুষ। জানুয়ারির কথা মনে হতেই কথকের খারাপ লাগল। বেচারী কত ছোট একটা আব্দার করেছে। শুধু মাত্র একটা পোট্রেইট। কত অল্প চাওয়া। হয়তো একটা ছবি পেলেই মেয়েটি খুশী হবে। কথক পিউয়ের গাল টেনে বলল,আমি বুঝি তোর কাছের মানুষ। হা হা. . .শোন অল্প দিনের মধ্যেই তোর ছবি পেয়ে যাবি। এরপর কি খাওয়াবি ঠিক কর।
পিউ কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, পাগলামি বন্ধ কর। যখন এঁকে দিবি তখন দেখা যাবে।
কথক বলল,আচ্ছা,এখন আসি,আমার টিউশনি ধরতে হবে ভালো থাক।
কথক চলে যাওয়ার পরেও পিউ কিছুক্ষন একা বসে রইল। মানুষটাকে একটু বেশিই জ্বালানো হচ্ছে। পিউ ভাবলো। কথকের সাথে পিউ এর টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি। সেই ছোট বেলা থেকেই একসাথে পড়ালেখা করা। পিউ এর মনে পড়ে,পিউ বরাবর ই আর্ট এ খারাপ। স্কুলে আর্টস এন্ড ক্রাফটস নামে একটা সাবজেক্ট ছিল। পিউ কোন মতে গ্রেজ দিয়ে পাশ করতো। একবার আর্ট পরীক্ষার সিলেবাস ছিল জল রঙে গ্রামের দৃশ্য আঁকা। আর্ট শিক্ষক ওয়াহিদ স্যার শিল্প প্রিয় মানুষ। গ্রামের দৃশ্য তাকে টানে। স্যারের বৈশিষ্ট হলো যে যত উপাদান ছবিতে দিতে পারবে তত নাম্বার। পিউ গরু আঁকতে পারতোনা। পরীক্ষার আগের দিন কথক কে বলে কয়ে কয়েকটা গরু আঁকিয়ে নিল শক্ত কাগছে। এরপর কাঁচি দিয়ে কেঁটে নিল। পরদিন খুশী মনে পরীক্ষা দিতে গেল। খাতার ওপর গরু রেখে 2b পেন্সিল দিয়ে ঘুরাচ্ছে এমন সময় দত্ত স্যারের কাছে ধরা পড়ল। পিউ নার্ভাস হয়ে গেল। সে যাত্রায় স্যারের কাছে কোন মতে মাফ টাফ চেয়ে বাকীটুকু নিজের মত করে আঁকলো। পরীক্ষার খাতা দেয়ার সময় ওয়াহিদ স্যার ক্লাসে জোক করে বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ একজন গ্রামের মাঠে উট এঁকেছো,উট এল কোথা থেকে. . .হা হা. . .

ক্লাস ভর্তি সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। কেউ কেউ স্যারের কাছে নাম ও জিজ্ঞেস করল। ওয়াহিদ স্যার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। নাম বললেন না। শুধু একদিন নীরবে পিউকে ডিপার্টমেন্ট এ ডাকলেন। স্যারের হাতে আর্ট পেপারে মোড়ানো একটা বই। পিউকে দেখে বললেন, বাচ্চা মেয়ে। তোমাকে ঐদিন লজ্জা দেয়াটা ঠিক হয়নি। এই নাও এটা তোমার। পিউ কিছু বলতে পারলোনা। অনেক আবেগ জমে গেলে পিউ কিছু বলতে পারেনা। বাসায় এসে মোড়ক খুলে দেখে,আর্ট শেখার সহজ উপায় নামের একটি বই। পিউ এর চোখে পানি এসে গেল। মেয়েদের ক্লাস আলাদা কক্ষে হওয়াতে কথকের ব্যাপারটা জানার কথা না। তাই পিউ নিজ থেকেই কথক কে ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে কথক বলল, তুই আসলেই একটা বিড়ালের মিউ। চুরীও ঠিক ভাবে করতে পারিস না। তাও ভালো এত সুন্দর একটা বই পেলি। পিউ মৃদু হেসে বলল, বইটা তুই রেখে দে। আমাকে এই বই গুলে খাওয়ালেও আর্ট শেখানো সম্ভব না। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয়না। বরং তোর এটা কাজে লাগবে। কথক পিউকে ধমক দিয়ে বলল,স্যার খুশী হয়ে তোকে এটা দিয়েছে। তুই রাখ। পিউ বলল,ফর্মালিটিজ রাখ। এই বই পড়ে ভালো আর্ট শিখবি। এরপর আমার পোট্রেইট এঁকে দিবি।…কথক আর না করেনি। পিউ এর সব কথাই কথক রাখার চেষ্টা করে। তবে আর্ট নিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার সম্মূথীন হতে হয় ক্লাস টেনের বায়োলোজি পরীক্ষার সময়। পরীক্ষার সময় ছেলে মেয়ে একসাথে বসে। পরীক্ষার ইনভিজিলেটর মফিজ স্যার এসে পিউয়ের খাতার দিকে তাকিয়ে বলল,এটা কি এঁকেছো?
পিউ ভয়ে ভয়ে জবাব দিল, স্যার ব্যাঙের পৌষ্ট্রিক তন্ত্র। পিউ এর কথা শুনে স্যার হেসে বললেন,ব্যাঙ যদি জানতো তার মধ্যে এত কুচ্ছিত একটা প্রানী বাস করে তবে নিজেই ভয় পেত। স্যারের কথা শুনে পিউ লজ্জা পেল। পাশ থেকে কথক বলল,স্যার বলা সহজ আঁকা কঠিন। ছবিটা সার্লিজ মেথডের এর মত হয়েছে। নবম দশম শ্রেনীর পদার্থ বিজ্ঞান বইতে সার্লিজ মেথডের একটা চিত্র আছে। কথকের কথা শুনে অনেকেই হেসে উঠল। মফিজ স্যার পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান। কিছুদিন আগে সার্লিজ মেথড পড়াতে গিয়ে তিনি এই ছবিটি বোর্ডে আঁকেন। কিছুক্ষন পর ক্লাসে অন্য এক স্যার উঁকি দিয়ে বলেন,কি ব্যপার মফিজ সাহেব এটা কি এঁকেছেন গরুর গাড়ী না দেয়াশলাই বক্স। সেদিন ও মফিজ স্যার লজ্জা পেয়েছিলেন। তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন। পিউ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অনেক কিছু ভেবে পিউ এর চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে এল। যে ছেলেটা এত কেয়ারিং,এত ভালো তাকে ইচ্ছেমত জ্বালানোর অধিকার পিউ এর আছে। থাকবে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। পিউ বাসার দিকে রওয়ানা হল।

।২।
টিউশনি শেষ করে এসে কথক কিছুটা চিন্তায় পড়ল। পকেটের অবস্থা ভয়াবহ পর্যায়ের খালি। ভেবেছিল আজ ছাত্রীর মা এমাসের টাকাটা দেবেন। কিন্তু তিনি গ্রামে যাওয়ায় আর টাকাটা নিয়ে আসা হয়নি। কথক একবার ভেবেছিল টাকাটা চাইবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর চাওয়া হয়ে ওঠেনি। কথক মুখচোরা ছেলে। কখনো আগ বাড়িয়ে কিছু চাইতে পারেনা। কিছু টাকা পেলে ভালো হতো। পিউকে ছবি না আঁকার আসল কারনটা বলা হয়নি। ছবি আঁকার জন্য তেল রং কিনতে হবে। ভালো ক্যানভাস ও দরকার। বিশেষ কাগজ কিনতে হবে। সস্তা কাগজে তেল রং ব্যবহার করা যায়না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তুলি গুলোও বেশ পুরনো হয়ে গেছে। এর কোন কিছুই পিউ জানেনা। জানার কথাও না। পিউকে না বললে ও কোন কিছু বুঝবেনা। নিজের দারিদ্রতার কথা পিউকে জানাতে ইচ্ছে হয়না। পিউ কেন কাউকেই জানাতে ইচ্ছে হয়না। এই দারিদ্রতা কথক নিজে বরন করে নিয়েছে। দু একটা টিউশনি করিয়ে যা পায় তার সিংহভাগ ই চলে যায় আর্ট স্কুলের এতিম শিশুদের পেছনে। এই কাজ কথক করে মন থেকে। ঢাকার অদূরে একটা আর্ট স্কুল কয়েকটা বন্ধু মিলে চালায় কথকেরা। নিজেদের খরচেই রং তুলি কাগজ কেনা হয়। কথকের ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন আছে। ও স্বপ্ন দেখে এই স্কুল একদিন বিশালতায় রূপ নিয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসছে নতুন কোন রনবী কিংবা শিশির ভট্টাচার্য। স্বপ্ন আর বাস্তবতাকে এক সুঁতোয় গাঁথতে হিমশিক খেতে হয়। কথক ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। পকেটে হাত দিয়ে দেখে পঞ্চাশ টাকার কচকচে একটা নোট। নোট টা থাকার কথা না। বিকেলে পিউ এর সাথে গল্প করার সময় ভুলে পকেটে থেকে গেছে। একশ টাকার একটা নোট দিয়ে কথক কে আইসক্রিম আনতে পাঠিয়েছিল পিউ। দুটো চকবার পঞ্চাশ টাকা। বাকী পঞ্চাশ টাকা পিউকে দিতে মনে নেই। পিউ হয়তো চায়নি নিতে। প্রিয় মানুষ গুলো কি মনের অবস্থা বুঝতে পারে? হয়তো তাই। রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দ হল। কথক রিক্সাটাকে জায়গা করে দিল। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু একটা খাওয়া যায়। কথক রাস্তার পাশে দাড়িয়ে একটা কেক খেল। টং এর দোকান গুলো না থাকলে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়তো মধ্যবিত্তরা।
কেক খাওয়ার পর কথকের মনে হল মাউনটেন ডিউ খাওয়া যায়। অনেক দিন খাওয়া হয়না। পিপাসাও পেয়েছে প্রচন্ড। ছয় নম্বর বাসে ঝুলতে ঝুলতে বনানী যাওয়া। সেখান থেকে ফার্মগেট ফিরে আসা। একধরনের কষ্ট কর জার্নি। গুলশান বনানীর মানুষ গুলো এই কষ্ট বুঝবেনা। মাঝেমাঝে ছাত্রীর বাসায় আপ্যায়ন রক্ষার্থে বাসি মিষ্টি সাথে এক গ্লাস পানি দেয়। নাকের কাছে নিয়ে আর মুখে দেয়া হয়ে ওঠেনা কথকের। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত পেট নির্বিচারে সব ভক্ষন করতে চায়। সাত পাঁচ ভেবে কথক আবার রেখে দেয়। শেষ পর্যন্ত পানি গ্লাস খাওয়া হয়। পড়ানো শেষে যখন কথক চলে আসতে যায় তখন সারাহ সুন্দর করে বলে,ভাইয়া,আই হ্যাভ সামথিং টু গিভ ইউ। কথক থমকে দাঁড়ায়। সারাহ ওর স্কুল ব্যাগের মধ্য থেকে কিছু একটা বের করে বলে,দিস ইজ গ্রীন অ্যপল,তোমার শরীরের দিকে খেয়াল রাখা উচিত্‍ ভাইয়া। আর এই নাও এই পারফিউমটা তোমার জন্যে কেনা। গরমে ঘেঁমে গেলে শরীর থেকে ব্যাড স্মেল আসে। তুমি কিছু মনে করোনা ভাইয়া। আই হ্যাভ বহট ইট ফর ইউ। ইউ নো আই হ্যাভ নো ব্রাদার। সারাহর চোখে মায়াময় একটা আভা থাকে। কথকের চোখে পানি এসে যায়। কথক অনেক বার ভেবেছে এত দূর আর পড়াতে আসবেনা। সারাহর মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যায়। কথক মাউনটেন ডিউ আর খেলনা। তার চেয়ে এক গ্লাস পানি খাওয়া যায়। পানির দাম এক টাকা। পকেটে উনত্রিশ টাকা থাকবে। পানি খেয়ে টাকা দেয়ার সময় পিউ এর ফোন এল,
তুই কি বিজি?
-না বল. . .
-এখনো কি বাইরে?
-হ্যাঁ
-শোন তাড়াতাড়ি বাসায় যা,আর রাতে খেয়েছিস।
কথক বলল,হ্যাঁ. . .বলেই মোবাইলটা কেটে দিয়ে বন্ধ করে রাখল। এই মেয়ে আজ রাতে আরো অনেক বার ফোন দেবে। রাতে কথক কি খেল না জানা পর্যন্ত হয়তো ঘুমাতে পারবেনা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করবে। ফেসবুকের যুগে একটা মেয়ের এত ভালো হওয়ার কোন দরকার নেই। ইমোশোনাল এ মেয়েটি হয়তো জানেও না উনত্রিশ টাকা দিয়ে ঢাকার কোথাও রাতের খাবার পাওয়া যায়না। কথক ছোট নিঃশ্বাস ফেলে মেসের দিকে হাঁটা শুরু করল। এগারোটার আগে গেটের ভেতরে ঢুকতে হবে। না হলে সারারাত বাইরে থাকতে হবে। হাতে সময় নেই। কথকের পা ফেলার গতি বেড়ে গেল।

।৩।
সকাল বেলা মোবাইল অন করতেই পরপর কয়েকটা মেসেজ এল। তিনটি মিসকল এলার্ট। বাকী দুটো পিউ এর মেসেজ। পিউ এর মেসেজ গুলো কথক একটু আগ্রহ নিয়েই পড়ে। মেয়েটা সচরারচার মেসেজ পাঠায়না। কোন কিছু জানাতে ইচ্ছে হলে সরাসরি ফোন দেয়। মেসেজ পেয়ে কথক বুঝলো জরুরী কোন খবর। প্রথম মেসেজটি সাধারন।
“কি ব্যপার মোবাইল অফ করে রাখলি যে. . .টানা ত্রিশ বারের মত চেষ্টা করে এখন ঘুমাতে গেলাম। শুভ রাত্রী. . .” সময় রাত তিনটা বিশ মিনিট। কথক এমন মেসেজ পেতে অভ্যস্ত। দ্বিতীয় মেসেজটি পড়ে কথকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

“তোর পুরো নাম ই তো মুরসালিন আহমেদ কথক? কংগ্রাটস দোস্ত। প্রথম আলো পেপার দেখ. . .ইয়ে এ এ এ ” সাথে কয়েকটি ইমো। কথক ভাবলো পিউকে ফোন দিয়েই ব্যপারটা জেনে নেবে। পরে মনে হল পত্রিকা পড়ে পুরো ব্যপারটা জেনেই পিউকে ফোন দেয়া যাবে। কোন মতে ফ্রেশ হয়ে কথক নিচে নামল। পত্রিকার দোকানে গিয়ে পত্রিকা কিনল। কৌতুহল আর উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে রাস্তাতেই পত্রিকা খুললো। পত্রিকায় নিজের নাম দেখে অবাক হল। আরো অবাক হল প্রথম স্থানের জায়গায় নিজের নামটি দেখে। জয়নুলের জন্মদিন উপলক্ষে জয়নুল আর্ট একাডেমী একটি আর্ট এক্সজিবিশন এর আয়োজন করেছিল। কথক সবসময় এসব ব্যপার থেকে দূরে থাকে। এক প্রকার পিউ এর অনুরোধেই একটি ছবি ও জমা দেয়।হঠাত্‍ করেই ওর মনে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে। মনে হয় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সকাল আজ। পুরস্কার মূল্য কথক জানে। দশ হাজার টাকা। দশ হাজার অনেক টাকা। কথকের মনে হল এই টাকাটা ওর অনেক দরকার ছিল। আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল। মনে মনে রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথক একটা হিসেব দাঁড় করালো। তিন হাজার টাকার মত ছবি আঁকার আইটেমস কিনতে হবে। রং তুলি পেন্সিল ক্যানভাস। সব মিলিয়ে হয়ে যাবে। সারাহর জন্য কিছু একটা কেনা যায়। বসুন্ধরা থেকে ভালো দেখে একটা পুতুল সাথে কিছু চকোলেট। এক হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যাবে। বাকী থাকবে ছয় হাজার টাকা। দুই হাজার টাকায় পিউ এর জন্য একটা তাঁতের শাড়ী কেনা যায়। মায়ের জন্য একটা জায়নামাজ ও কেনা জরুরী। হাতে একবারে অনেক টাকা আসলে হুঁশ থাকেনা। হয়তো সবচেয়ে জরুরী জিনিস গুলোই করা হয়না। আজকের ব্যপারটা ভিন্ন। অনেক আগে থেকেই কথকের এগুলো প্লান করা। আর্ট স্কুলের বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনতে হবে। বাকী টাকা দিয়ে নিজের জন্য কিছু। জুতো জোড়া পাল্টাতে হবে। অনেক বার পিউ এর দৃষ্টি গোচর হয়েছে। পত্রিকা আর্মপিটের নিচে ঢুকিয়ে কথক মেসের দিকে হাঁটা শুরু করল। মোবাইলে টাকা ঢুকাতে হবে। ঢাকা শহরের সব ফ্লেক্সিলোড দোকান গুলো অলিখিত নিয়ম করে রেখেছে। ত্রিশ টাকার নিচে ফ্লেক্সি করলে একটাকা বেশি দিতে হয়। মোবাইলের দোকানে বিশ ঢাকা দিয়ে কথক ফিরে আসল। বিশ টাকায় উনিশ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও আজ দোকানী বিশ টাকাই দিল। কথক একটু অবাক হল। যেদিন ভালো যাবে সেদিন সবদিক থেকেই যাবে। রুমে এসে পিউকে ফোন দিতেই ও কেটে কল ব্যাক করল।
কথক রাগত স্বরে বলল,তোর কি টাকা বেশি হয়েছে?
পিউ হাসল। চাপা স্বরে বলল,আরে না না। তোর ওয়েল কাম টিউনস টা সুন্দর। যদি মন কাঁদে,তুমি চলে এসো,চলে এসো, এক বরষায়।
কথক কি বলবে ভেবে পেলনা। অনেক গুলো থ্যাংস একসাথে দিতে হবে। যদিও পিউ এসব ফর্মালিটিজ পচ্ছন্দ করেনা। তবু ইতস্তত করে কথক পিউকে বলেই ফেলল,থ্যাংস রে। হয়তো তোর জন্যেই. . .
কথক কথা শেষ করতে পারলোনা। পিউ থামিয়ে দিয়ে বলল,ফর্মালিটিজ আমি পছন্দ করিনা। একদম না। এটা তোর প্রাপ্য ছিল। আমি জানতাম তুই পাবি। পেতেই হবে। একদিন তুই অনেক বড় চিত্রশিল্পী হবি। এই স্বপ্ন আমিও দেখি। তুই আমার পোট্রেইট আঁকবি। মোনালিসা যেমন ভিঞ্চির তুলিতে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। আমিও তাই হবো। আজ থেকে সহস্র বছর পরে কোন ইতিহাসবিদ যদি তোর ইতিহাস লেখে তবে আমিও সেই ইতিহাসের সামান্য অংশ হয়ে থাকবো।..কিরে কথা বলছিস না যে?
কথক বলল,তোর কথা শুনছিলাম। এত গোছানো,এত সাজানো। কোথাও অতিরিক্ত আবেগের আকুতি নেই। কি সুন্দর তোর শব্দের ব্যবহার। আমি মুগ্ধ পিউ ওহ স্যরি বিড়ালের মিউ. . . . . .ওপাশ থেকে পিউ হেসে ফেলল। বলল, এর নাম ইনডাকশন। তোর দ্বারা induced হচ্ছি।
কথক বলল,শুনে অনেক ভালো লাগল কেউ আমার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। আমি কত তুচ্ছ একটা মানুষ। পিউ বলল,শোন,যাঁরা তোর মত প্রতিভাবান তাঁরা নিজেদের সব সময় তুচ্ছ দাবী করে।অথচ তাঁরা নিজেরাও জানেনা তাঁরা কত বিশাল মানুষ। বিকেলে একটু দেখা করিস জরুরী একটা কথা আছে। আর শোন নখ কেটে আসবি কিন্তু। মাথায় শ্যাম্পু দিবি। শেভ করবি। জংলী হয়ে আমার কাছে আসবিনা। কথক বলবো, আচ্ছা।
পিউ মোবাইল রেখে দেয়ার পর কথকের মনে হল বাসায় অনেক দিন কথা বলা হয়না। মাকে ফোন দিয়ে খুশীর সংবাদটা জানানো যায়।যদিও এতে কোন লাভ হবেনা।কথকের কোন সুসংবাদ ই ওর মাকে এখন উচ্ছাসিত করেনা। মা চেয়েছেন কথক ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে। এর কোনটিই কথক হতে পারেনি। নিজের ইচ্ছেমত চারুকলাতে ভর্তি হয়েছে। যার ভবিষ্যত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার দের মত উজ্জ্বল নয়। মধ্যবিত্তের চিরাচরিয়ত অভাব অনটন আর সীমাহীন বাস্তবতায় প্রতিভার কোন দাম নেই। শুধু মধ্যবিত্ত না আমাদের সমাজেই প্রতিভার কোন দাম নেই। তা না হলে সৃষ্টিশীল মানুষ গুলোর এত দুঃখ দুর্দশা কেন হবে। অথচ প্রকৃতি সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দেয় মধ্যবিত্তের ঘরে। হতে পারে এটা প্রকৃতির ই কোন চাল। সাত পাঁচ ভেবে কথক বাসায় ফোন দিল। ওপাশ থেকে মা ধরতেই কথক খুশীর সংবাদটা জানালো। এই প্রথম ওর মা ওকে অবাক করে দিও বললো অনেক অনেক বড় হ বাবা। আনন্দে কথকের চোখে পানি এসে গেল। এত খুশীর দিনে চোখে জল মানায়না।

।৪।
নেইল কাটার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যদিও এটা খুব কমন একটা ঘটনা। নেইল কাটার,কাঁচি,স্টেপলার এইসব খুচরা প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো জরুরী প্রয়োজনে পাওয়া যায়না। হাতের নখ গুলোর অবস্থা ভালোনা। বেশ বড় হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বিকেল তিনটা। পিউ এর ফোন বাজছে। বেচারী নিশ্চই এসে গেছে। বাসে যেতে যেতেও নখ দাঁত দিয়ে কাটা যাবে। আল্লাহ সবকিছুর অলটারনেটিভ দিয়ে রেখেছে। তড়িঘড়ি করে কথক বেরিয়ে পরলো। পিউ এর কাছে যখন পৌঁছালো তখন অলরেডী আধঘন্টা লেট। যদিও পিউ জানে কথকের এটা কমন অভ্যাস। এক প্রকার মেনেই নেয় ও। কথক কে দেখে পিউ শান্ত গলায় বলল,আজ দেরী টা না করলেও পারতি। কাল দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ। সন্ধ্যের আগে বাসায় ফিরতে হবে। এটা রাখ। আর নখ দেখি। কথককে হতভম্ব করে দিয়ে পিউ একটা গিফট বক্স ধরিয়ে দিল। হাতের নখ দেখে পিউ শাষনের সুরে বলল,আবার দাঁত দিয়ে নখ কেটেছিস? তুই আর মানুষ হলিনা। কথক বলল,মানুষ অমানুষ পরের ব্যপার। আগে বল,এটা কি? কেন? পিউ বলল,তোর গিফট। আমার পক্ষ থেকে। এত কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। আসি। ভালো থাক। দেখা হবে। কথককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পিউ চলে গেল। অবশ্য সস্তা ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পিউ কথক কে কখনোই দেয়নি। আজ ও এর ব্যতিক্রম হলোনা।

গিফট বক্সটা খুলে কথক বেশ অবাক হলো। সুন্দর একটা হাফ হাতার শার্ট। একটা নেইল কাটার। একটা চিরুনা। ছোট একটা আয়না। আর কিছু কসমেটিকস। জিনিস গুলো নড়াচড়া করতেই একটা কাগজ বেরিয়ে এল। কথক আগ্রহ নিয়ে কাগজটা খুলল। মেয়েলি হাতে লেখা একটা চিঠি। কথক সবচেয়ে অবাক হলো চিঠিটি দেখে। কাঁচা হাতে পিউ লিখেছে,

কথক,
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগ আমাদের অনেক সুবিধা দিলেও কিছু জিনিস থেকে বঞ্চিত করেছে। এর একটি চিঠি লেখা। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার এমন এক বন্ধু হবে যাকে চিঠি লিখবো। কিন্তু ফেসবুকের এই যুগে কালি কলম আর সস্তা আবেগের মূল্য নেই। তুই হয়তো জানিস ই না আমি অনেক সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারি। এ চিঠি তোকে লিখতাম না। কিছু কথা আছে যা মুখে বলা যায়না। লিখে প্রকাশ করতে হয়। আচ্ছা,আমাকে কি তোর অনেক দূরের কেউ মনে হয়? আমি তোর সব ই বুঝিরে। তুই নিশ্চই গিফট বক্সের জিনিস গুলো দেখে অবাক হচ্ছিস। রাগ ও করে ফেলতে পারিস। রাগ করিস আর যাই করিস আমার এছাড়া কিচ্ছু করার ছিলনা। অনেক দিন থেকে এক শার্ট পড়তে পড়তে এটাকে ইউনিফর্ম বানিয়ে ফেলেছিস। কি ভাবিস? আমি কিছু ই বুঝিনা। শোন প্রিয় মানুষ গুলোর কাছে কিছু লুকোতে হয়না। জানিনা আমি তোর প্রিয় কিনা। তবে তুই আমার প্রিয়। কতটা প্রিয় শোন,আমি জানি তোর আর্থিক সংগতি এখন নেই। তোর একটা স্কুল আছে। স্বপ্নের স্কুল। যার পেছনে অনেক অর্থ চলে যায়। আমি চাই তোকে সাহায্য করতে। কিন্তু অর্থের সাহায্য তুইতো নিবিই না বরং করুনা মনে করবি। ঐ দিন আমার একটুও আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করিনি। তবুও তোকে টাকা দিয়ে আইসক্রিম আনতে পাঠালাম। তুই পঞ্চাশ টাকা ফেরত আনলি। আমি ইচ্ছে করেই চাইনি। প্রথমে ভেবেছিলাম পাঁচশ টাকার নোট দেব। তুই ব্যাপারটা ধরে ফেলবি বলে দেইনি। তুই ক্যানোরে এমন হলি? খুব কি কষ্ট হয় অন্তত আমাকে এগুলো খুলে বলতে। আমি হয়তো তোকে অনেক কিছু দিতে পারবোনা কিন্তু পাশে থেকে উত্‍সাহ টা তো দিতে পারি।

শোন,দাঁত দিয়ে নখ কাটার বদ অভ্যাস তোর অনেক দিনের। এটা আর কখনো করবিনা। তোকে নেইলকাটার দিয়েছি। এখন থেকে এটা দিয়ে নখ কাটবি। সুন্দর ভাবে মাথা আঁচড়াবি। ইদানিং প্রায়ই তুই চুলে স্পাইক করার অপচেষ্টা করিস। আমার কাছে আসার সময় পানি না হয় জেল দিয়ে চুল খাড়া করে রাখিস। আমি জানি তোর জেল নেই। ক্লোজ আপ পেস্টের সাথে পানি মিশিয়ে জেলের কাজ সাড়িস। আমি অনেক বার কাছ থেকে তোর চুলের ঘ্রান নিয়েছি। ভাবিস না আমি শুধু তোর মুখের দিকে তাকাই। তোর সব,সব দেখি আমি। আর কেন এই কৃত্রিমতা? তাও আমার কাছে। শোন চুলে স্পাইক করা যদি স্মার্টনেস হয় তবে সজারু পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট প্রানী। নিজেকে আর যাই হোক সজারু বানিয়ে ফেলিসনা। তবুও তোকে একটা জেল দিলাম। এরপর থেকে যেন আর ক্লোজ আপ পেস্টের গন্ধ না পাই।

নিজেকে একটু চেঞ্জ কর। যখন পুরস্কার আনতে যাবি তখন এই শার্ট পড়বি। এক গাদা বিখ্যাত লোকের কাছ থেকে পুরস্কার আনবি। কত সম্মান তোর। আর তুই যদি যাস এই পাগলের বেশে সবাই কি ভাববে বল। শোন যখন অনেক বিখ্যাত হবি তখন নিজের মত করে চলিস। বিখ্যাত হয়ে গেলে কেউ আর ড্রেস আপ নিয়ে মাথা ঘামায়না। বিখ্যাত দের সাতখুন মাফ।

ভালো থাক। ভালো রাখ।

পিউ

দ্বিতীয় বারের মত চিঠিটা পড়ল কথক। হঠাত্‍ করে মনে হল,একটা মেয়ে,যে এত কিছু বোঝে,এত কেয়ার নেয় সে কি শুধুই বন্ধু। নাকি অন্য কিছু। কথক কিছুই ভাবতে পারলোনা। একবার ভাবলো,পিউকে ফোন দেই। কিন্তু সাহস হলোনা। অনেক আবেগ জমে গেলে কথকের মুখ থেকে কথা বের হয়না। এই চিঠির প্রতিটি পরতে পরতে যে সীমাহীন ভালোবাসা আছে তা ভালো ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা কথকের নেই। কথক কেন হয়তো পৃথিবীর কারো নেই।

5.

দুঃসংবাদটা এল বিকেলের দিকে রায়হান এর কাজ থেকে। সারাদিন বিক্ষোভ সমাবেশ থাকায় আজ এম্নিতেই বাইরে বের হওয়া হয়নি। মোটামুটি বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যেই ঘটে গেল কাহিনীটা। কথক কিছুক্ষন চুপ করে বসে রইল। বিপদ আপদের খবর শুনলে এম্নিতেই ওর হাত পা ছেড়ে দেয়। শরীর আরো দুর্বল লাগতে শুরু করে। তাও যদি বিপদ টা পিউ এর হয় তাহলে সমস্ত পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে রুম মেট এর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে কথক ছুটলো পিউ এর কাছে। যত দ্রুত পৌঁছানো যায়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে কথক পৌঁছালো সন্ধ্যার কিছু পর। সারাদিন টিপটিপ বৃষ্টি থাকায় আবহাওয়াটা এম্নিতেই গুমোট। হালকা বাতাসে মন খারাপ ভাবটা আরো জাগিয়ে দেয়। ডাক্তারের কাছে খোঁজ নিয়ে পিউ এর বেড খুঁজে পেতে আরো কিছুক্ষন সময় চলে গেল।
দূর থেকে পিউকে চিনতে কথকের একটু কষ্ট ই হলো। গতকাল বিকেলে যার সাথে শেষ দেখা হল,শেষ কথা হলো আজ এই অবস্থায়,এই পরিবেশে দেখবে কথক কল্পনাও করেনি। চেনা মুখ হঠাত্‍ করে অচেনা হলে যা হয় অনেকটাই তেমন। কথক ধীর পায়ে পিউ এর বেডের পাশে গিয়ে বসল। সমস্ত শরীরে ফ্লুইড দেয়া। কিছু জায়গা টিস্যু আর কটন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কথক পিউ এর মাথায় হাত রাখতেই ও চোখ মেলে তাকালো। কথক কে দেখে পিউ হাউমাউ করে কেঁদেই ফেলল। কথক অবাক হয়ে প্রথম বারের মত দেখল অত্যন্ত শক্ত সামর্থ্য এবং কঠিন মনোবলের অধিকারী পিউ নামের একটা মেয়ে বাচ্চা দের মত কাঁদছে। কথক চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষন পর বলল,কি হয়েছিল?
পিউ জড়ানো কন্ঠে বলল, তোর কাছ থেকে ফিরছিলাম। নিউমার্কেটের কাছাকাছি আসতেই একদল যুবক বাসে আগুন ধরিয়ে দিল। সম্ভবত বিক্ষোভ কারী। মুহূর্তের মধ্যে বাসের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে আগুন ছড়িয়ে পড়লো।
মনে হয় বাসে তেজস্ক্রিয় কিছু ছড়ানো ছিল। এতটুকু বলে পিউ থেমে গেল। পিউয়ের কথা জড়িয়ে আসছিল। কথক বলল,তারপর?
-তারপর ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিছুই মনে নেই। কে এখানে আনলো জানিনা। শুধু জ্ঞান হারাবার আগে মনে পড়ে প্রচন্ড বড় এক আগুনের গোল্লা আমার দিকে ছুটে আসছে। আর আমি তাকিয়ে দেখছি। মুহূর্তের মধ্যে মানুষের চিল্লাপাল্লা,জানালার কাঁচ ভেঙে,গেট দিয়ে এক এক জন বেরিয়ে যাচ্ছে।হাহ..জ্ঞান ফিরে দেখি শরীরের অনেক অংশ ঝলসানো। ডাক্তার এসে ড্রেসিং করিয়ে গেল। আয়নায় নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না।
কথক বললো,বেঁচে আছিস এটাই অনেক কিছু। অনেক বড় বিপদ ও হতে পারতো।
পিউ বলল,বিপদ যা হবার হয়ে গেছে। বাকি জীবন ঝলসানো মুখ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। একদিক থেকে সুবিধাই হল তোকে আর যখন তখন পোট্রেইটের জন্য জ্বালানো হবেনা। এই অবস্থায় কেউ কারো ছবি আঁকেনা। আঁকতেও পারেনা। কথা বলতে বলতে পিউ এর কন্ঠস্বর ভারী হয়ে এল। কথক তাকিয়ে দেখল পিউ নামের অসম্ভব মায়াবতী এই মেয়েটির চোখ চিকচিক করছে। অশ্রুর ফোঁটা গুলো বড় হতে হতে গড়িয়ে পড়ে হাসপাতালের সাদা বিছানার ওপর অপূর্ব জলছাপ সৃষ্টি করছে। এই প্রথম ওর খেয়াল হল পিউয়ের জন্য ওর বুকের কোথাও অদৃশ্য এক টান আছে। কথক পিউ এর হাতে হাত রেখে বলল,তুই ভালো হয়ে যাবি পাগলি। এটা কোন ব্যাপার ই না। আধুনিক চিকিত্‍সা শাস্রে এর চেয়ে বিকৃত মুখ ও ঠিক করা যায়। প্লাস্টিক সার্জারী করালেই ঠিক হয়ে যাবি। আর বাসায় জানিয়েছিস? আঙ্কেল আন্টির কি অবস্থা?
-আব্বু খবর পেয়েছে কিছু আগে। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে। চলে আসবে,আর শোন অহেতুক সান্ত্বনা আমার ভাল লাগেনা। জানিস তো স্রষ্টার সৃষ্টি কোন কিছু একবার বিকৃত হয়ে গেলে তা আর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কাছাকাছি হয়তো যাবে। তবুও অসম্পূর্নতা থেকে যাবে।
কথকের এক বার মনে হল সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে পিউকে বলেই ফেলবে,এই অসম্পূর্ন পিউকেই আমি পাগলের মত ভালোবাসবো। বাকী টুকু নিজের কল্পনার আল্পনায় নিজের মত করে সাজাবো। কিন্তু বলতে সাহস হলোনা। অনেক সময় ছিল পিউকে এসব কথার বলার। এখন সে অবস্থা নেই। পিউকে ভালোবাসার কথা বলার অর্থ হচ্ছে করুনা দেখানো। একটি ঝলসানো মুখের প্রতি করুনা। পিউ এর মত মেয়েরা আর যাই হোক করুনা গ্রহন করবেনা। কিছুতেই না। পিউ বলল,কি ভাবছিস? কিছু বলবি? কথক ইতস্তত বোধ করে বলল,আমি তোর ছবি আঁকবো। আমার সমস্ত কল্পনা আর বাস্তবতা দিয়ে তোকে যতটুকু দেখেছি সেভাবে। কিছুটা বাস্তবিক কিছুটা কাল্পনিক। সে অনুযায়ী তোর প্লাষ্টিক সার্জারী হবে। শোন ঈশ্বর তাঁর বহুগুনের একটি চিত্রশিল্পীদের দিয়েছে। শুধু ঈশ্বরের সাথে এদের তফাত ঈশ্বর নিজের আঁকা পোট্রেইটে প্রান দিতে পারে আর চিত্রকর রা পারেনা। এই অক্ষমতা ঈশ্বর ইচ্ছে করে করেছেন। তিনি চান না কেউ তাঁর সমকক্ষ হন।
পিউ হাসলো। মলিন হাসি। বললো,অনেক ফিলসফিকাল চিন্তা ভাবনা। তোর কথায় ছোট্ট একটা ভুল আছে। চিত্রকরেরা ঈশ্বরের সৃষ্টি মানুষ গুলোর ই পোট্রেইট আঁকতে পারে। এর বাইরে এরা যেতে পারেনা। কাল্পনিক কোন মুখ আঁকতে গেলে সেটা হয় কার্টুন না হয় এলিয়েন। তোকে এই কথা বলার অর্থ এই যে স্রষ্টার বিশালতার কাছে মানুষ নিতান্তই ছোট। তুচ্ছ। তবুও স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিশীলতার বিন্দু পরিমান একটা অংশ কবি,সাহিত্যিক, চিত্রকর,বিজ্ঞানী দের মধ্যে দিয়েছেন। এরপর এঁরা যখন উপলব্ধি করেছে এঁদের মধ্যে ঈশ্বর প্রদত্ত অতিমানবীয় কিছু গুনাবলী আছে তখন এঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব ভুলে যেতে শুরু করেছে। এক একজন হয়েছে নাস্তিক। তুই যখন অনেক বড় হবি তখন আর যাইহোক নাস্তিক হয়ে যাসনা। পিউ এর কথা শুনে কথক থতমত খেয়ে গেল। বলল, আজ আসি রে। যাওয়ার আগে পিউ বলল, এখনি চলে যাবি? তুই কিছু একটা বলতে চেয়েছিস। এড়িয়ে গেলি। যাওয়ার আগে ঐ কবিতাটি শুনিয়ে যা। তোর লেখা,

মনের মাঝে এঁকেছি তোর অদেখা এক ছবি
সেই ছবির রঙ তুলিতে হয়েছি আমি কবি

কথকের চোখে পানি এসে গেল। পুরুষের আবেগ প্রকাশের অনেক সীমাবদ্ধতা। কোন মতে নিজেকে সংবরন করে বললো,কিছুনা. . .আমি তোকে অনেক ভালোবাসি পিউ। অনেক।…দ্বিধা দ্বন্দ কাটিয়ে কথক এক প্রকার কথাটা বলেই ফেলল। পিউয়ের মুখ দেখার সাহস আর কথকের হলোনা। খুব দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

কথক চলে যাওয়ার পর পিউ কিছুক্ষন কাঁদলো। অগভীর এক দীর্ঘশ্বাসে হাসপাতালের বাতাস আর একটু ভারী হল। কথকটা এত মুখচোরা কিছুই বলতে চায়না। আজ অনেক কাল পরে হাসপাতালের এই গুমোট,ভাষাহীন নিঃষ্প্রান পরিবেশে ভালোবাসার কথাটা একটু বেমানান ই শোনাল। প্রতিভাবান ছেলে গুলো কি আসলেই এমন? নিজ থেকে বিষাদময় জীবন বরন করে নেয়। এমন একটা সময় কথক পিউকে দাবী করল যখন কথক কে দেয়ার মত কোন কিছুই পিউ এর অবশিষ্ট নেই। হয়তো কথকের মত বিশাল মনের মানুষেরা বাহ্যিক রূপ নিয়ে মাথা ঘামায় না। অথবা অন্য কিছু। এই কিছুটা কি পিউয়ের জানতে ইচ্ছে করে। হয়তো ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই এদের কাছে অনেক অর্থ বহন করে। পিউ গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করল,
আমার মনে অনেক জন্ম ধরে ছিল ব্যথা
বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছো পদ্মপাতা
হয়েছো তুমি ভোরের শিশির,শিশির ঝরা স্বপ্ন. . . .

কখনো কখনো কবিতার দু একটি লাইনের সাথে জীবন মিলে যায়। অদ্ভুত বৈচিত্রে ভরপুর আমাদের চারপাশ। পিউ ভাবলো।

|৬|

রাত দশটার কিছু পরে কথক মেসে ফিরল। ফেরার পথে আর্টস এর জিনিস পত্র কিনতে একটু দেরী হল। মন খারাপ এক ভাব নিয়ে কথক পিউ এর ছবি আঁকতে বসল গভীর রাতে। চোখ বন্ধ করে কয়েকবার পিউকে ভাবার চেষ্টা করলো। সেই কালো চোখ,সেই স্নিগ্ধ ঠোঁট,সেই মমতা মাখা মুখ,সেই চিরচেনা হাসি। সবকিছুই যেন আজ ঝাপসা হয়ে আসছে। কথকের চোখ যতবার পিউকে ভাবার চেষ্টা করছে ততবার ই ওর ঝলসানো মুখ এসে সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ফ্লোর থেকে কথক 2B পেন্সিলটা তুললো। একপাশে ক্যামেল আর্টিস্ট রঙ,তুলি সামনে ক্যানভাস। এই ক্যানভাসে পিউকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এবং তা যে কোন মূল্যে। কথক আবার চোখ বন্ধ করল। মনেমনে বলল,আল্লাহ আমি জীবনে তোমার কাছে খুব অল্প জিনিস চেয়েছি। আজ আমি আমার এক জীবনের সকল পূর্নের বিনিময়ে এই মেয়েটির ছবি আঁকতে চাই। তুমি একবার আমাকে সেই সামর্থ্য টুকু দাও। আমি আর কিছুই চাইনা. . . .

সৃষ্টির কোন গভীর প্রার্থনা হয়তো স্রষ্টা শোনেন। কথকের বন্ধ চোখের পাতা হঠাত্‍ নড়ে ওঠে। যেখানে ধীরে ধীরে পিউয়ের ছবি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। চোখের পাতা খুলে কথক ওর পেন্সিল হাতে নিল। কল্পনা খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়। এর মধ্যেই খুব দ্রুত পিউয়ের পোট্রেইটের শেপ দিতে হবে। কথকের সম্পূর্ন মনোযোগ সামনে রাখা ক্যানভাসের দিকে। একটি বিন্দু সিন্ধু সম মমতা নিয়ে বড় হতে থাকে। কথকের পেন্সিল চলতে থাকে তার নিজস্ব নিয়মে।…….

…………………………………………………….উত্‍সর্গ: ওয়াহিদ জামান স্যার। আমি অনেক সৌভাগ্যবাগ অত্যন্ত প্রতিভাবান এই চিত্রশিল্পী ক্যাডেট কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন।…………..

২,২৪৮ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “পোট্রেইট”

  1. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    এত অসাধারন একটা গল্পে বেশি কমেন্ট এখনও পড়ে নাই দেখে অবাক লাগল।
    খুব ই সুন্দর হয়েছে লেখাটা। হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
    :boss: :hatsoff: (সম্পাদিত)


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন
  2. ফখরুল (১৯৯৭-২০০৩)

    ৪র্থ খণ্ডাংশের শেষে চোখে পানি চলে এসেছিল।
    বাস্তব জীবনের বেশ কিছু মজার কাহিনী ঢুকিয়েছ যা খুব ভাল হয়েছে।
    বানানের ব্যাপারে একটু সতর্ক হও।
    বার্নের পেশেন্টের সাথে কথোপকথনটা দীর্ঘ হয়ে গেছে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।