আঁচল

১.”কিন্তু মা সবাই শাড়ী পরবে। ভার্সিটির প্রথম পহেলা বৈশাখ। তুমি প্লিজ একটা শাড়ী ম্যানেজ করে পাঠাওনা।” অয়নীর কথা শুনে রাহেলা বেগম ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন। চাপা কন্ঠে বললেন, মাগো সবাই শাড়ী পরবে আর তোর ও পরতে হবে এমন কোন কথা আছে? এবছর ই তোর বাবা মারা গেল। অনেক কষ্টে তোকে পড়া খরচ পাঠাই। একটু বোঝার চেষ্টা কর।”
মায়ের কথা শুনে অয়নীর কান্না এল। কোনমতে নিজেকে সংবরন করে বলল, তোমার পুরনো কোন শাড়ীও কি নেই? আসলে ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম বলছিলেন ভাসির্টির প্রথম বর্ষবরনে যেন সবাই শাড়ী পরে আসি। ”
রাহেলা বেগম বললেন, জানি মা। তোর এ সময়টা আমিও পার করেছি। কিন্তু মারে মধ্যবিত্ত পরিবারটা খুব খারাপ রে। কারো কাছে হাত পাতাও যায়না আবার বলাও যায়না। পৃথিবীর বিশালতার কাছে আমরা খুব বেশি অসহায়”
অয়নী চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, লাগবেনা। রাখি মা। ভাত খেতে যাবো।”
মোবাইল রাখার পর হঠাত্‍ করে অয়নী লক্ষ করলো ওর চোখের পাতা অকারনে ভিজে যাচ্ছে।
কিছু কিছু মেয়ে আছে মন্দভাগ্য নিয়ে জন্মায়। হয়তো অয়নীও তাই। তা নাহলে হুট করে ওর বাবাও বা কেন মারা যাবে। আর পরিবারের এই দুরবস্থাও বা কেন হবে। আজ অনেক দিন পর অয়নীর খুব বাবাকে মনে পড়ল। বাবার অনেক আদরের মেয়ে ছিল অয়নী। যা চাইতো তাই দেয়ার চেষ্টা করতো। যদিও অয়নীর আব্দার ও ছিল অল্প। বাবার ছোট একটা সরকারী চাকরী। মাস শেষে অপর্যাপ্ত টাকা। এই দিয়ে চারজনের সংসার। গরীবের স্বাদ আহ্লাদ খুব কম। আর মধ্যবিত্তের যাও প্রত্যাশা থাকে তাও অর্থের অভাবে বিলীন হয়ে যায়। প্রাপ্তির আনন্দ যেখানে অল্প। এরমাঝেও রহমান সাহেব পরিবারের সবার মন রক্ষার চেষ্টা করতেন। অয়নীর মনে পড়ে ছোট কালে ওর একটা সাইকেলের ইচ্ছে ছিল। পাড়ার সবার একটা সাইকেল ছিল। সরকারী কলোনীর পেছনের মাঠটায় প্রতি বিকেলে সাইকেল রেস হতো। অয়নী প্রতিদিন একা দাঁড়িয়ে থাকতো। খুব ইচ্ছে হতো সাইকেলে চড়তে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারতোনা। মাঝেমাঝে তৌফিক এসে বলতো, কিরে চড়বি নাকি সাইকেলে? আয় আয়। তৌফিক অয়নীর সাথেই পড়ে। ও পাড়ায় থাকে। খুব ইচ্ছে হত তৌফিকের পেছনে সাইকেলে ঘুরতে। কিন্তু কোথাও যেন একটা বাঁধা কাজ করতো।
একবার মুখ ফুটে বাবাকে বলেই ফেললো একটা সাইকেলের কথা। রহমান সাহেব মেয়ের কথা রেখেছিলেন। পরের জন্মদিনে মেয়েকে একটা সাইকেল কিনে দিলেন। দুই চাকার ছোট্ট এ জিনিসটি পেয়ে অয়নীর মনে হয়েছিল সমস্ত পৃথিবীকে ও হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে। এরপর সেই কলোনীর মাঠে অয়নী প্রায়ই সাইকেল নিয়ে যেত। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ার সময়। নতুন সাইকেল দেখে তৌফিক বলতো, কিরে টুনটুনি নতুন সাইকেল কিনলি মনে হয়। ভাব দ্যাখো মেয়েটার। এত করে বললাম আয় আমার সাইকেলে চড়। তা করবিনা। ঢং! তৌফিকের কথা শুনে অয়নী হাসতো। বলতো, এই আমাকে শিখিয়ে দেনা কীভাবে চালাতে হয়। তৌফিক বলতো, একটা শর্ত আছে,বল রাজী?
-রাজী
-ওমা শর্ত না জেনেই
-আমি যে কোন শর্তে রাজী। বলে ফেলনা।
তৌফিক মুচকি হেসে বলতো, শোন আমি সাইকেল চালাবো। তুই আমার কোমর ধরে পেছনে বসবি। দেখিসনি সিনেমায় নায়ক যেভাবে নায়িকাকে নিয়ে বাইক চালায়।
-তুই সিনেমার নায়ক নাকি?
-হুম। আমি সালমান খান। তুই ঐশ্বরিয়া। আয় আয় তাড়াতাড়ি করনা। একটু পরেই আজান দেবে। দেড়ী হলে মা বকবে।
অয়নী দ্বিধা না করেই শর্তে রাজী হয়ে গেল। তৌফিকের কোমর ধরে পেছনে বসে পড়ল আর তৌফিক এক প্রকার টেনে টুনে কিছু দূর যাওয়ার পর ই ধপাস। সেবার অয়নীর হাঁটুতে খুব কেটেছিল। ফিনকি দিয়ে পরা রক্তের ধারা যখন কলোনির মাঠের মখমল ঘাসকে মেখে দিচ্ছে তখন তৌফিক একপ্রকার অপরাধীর সুরেই বলল, এই সরিরে, বাসায় আবার বলিসনা। মা জানতে পারলে আমাকে মারবে। অয়নী তৌফিকের কথা রেখেছিল। হাঁটুর ওপর দাগটার কথা ও কখনো কাউকে বলেনি। মাঝেমাঝে গোসলের সময় কাটা দাগটা দেখে তৌফিক কে খুব মনে পরে। বাসা বদলের সাথে সাথে তৌফিক ও হারিয়ে যায় জীবনের নিয়মে। অয়নীর নতুন খেলার সাথী হয়। মাঝেমাঝে ভুলে যাওয়া স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে কলোনীর মাঠ, সেই পুরাতন সাইকেল, দুরন্ত তৌফিক আর একটি কাটা দাগ।এক ঘেঁয়ে সন্ধ্যে নেমে আসা মুহূর্ত। সময়ের পরিক্রমে যার অনেকটাই ধুসর। অনেক কিছু ভেবে অয়নীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
স্মৃতি হচ্ছে ঘুমন্ত অতীত যা বর্তমানকে জীবন্ত করে। অয়নীর চোখ থেকে মনের অজান্তেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। অয়নী ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে তাকিয়ে দেখল নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে। অয়নী জোর করে হাসলো। নাবিলা এসে অয়নীর পিঠে হাত রাখলো। অয়নী মলিন হেসে বলল,কি রে, কিছু বলবি?
নাবিলা বলল, তোর কী মন খারাপ?
-কই নাতো। কে বললো তোকে?
-না এম্নি মনে হলো। হঠাত্‍ করেই। নাবিলা পাশ কাটিয়ে গেল। ওদের রুমটা অনেক চাপা। তাই যে কারো ব্যক্তিগত কথা একটু কান পাতলেই শোনা যায়। নাবিলা অয়নীকে কিছুই বুঝতে দিলনা। যদিও ও সবই এতক্ষন শুনেছে। নাবিলা অয়নীকে বললো, আয় খাবি। রাত তো অনেক হয়েছে। অয়নী বলল, খেতে ইচ্ছে করছেনারে। ভালো লাগছেনা। নাবিলা বলল, সে কী কথা। শোন আজ বুয়া আসেনি। আমি রান্না করেছি। চিংড়ি মাছ দিয়ে চিচিঙ্গা। তুই মুখ ধুয়ে আয় আমি খাইয়ে দেব তোকে। নাবিলার কথা শুনে অয়নীর বেশ ভালো লাগলো। হঠাত্‍ মনে হল অয়নীর ছোট্ট এ জীবনে ও যাঁদের ভালোবাসা পেয়েছে তাঁরা সবাই আকাশের মত বিশাল। কিছু কিছু মানুষ এক পৃথিবীর বিশালতা নিয়ে জন্মায়। ওর চারপাশের মানুষ গুলো হয়তো তাই।

২.
আজ ক্লাস খুব তাড়াতাড়ি শেষ হলো। বিকেলে ল্যাব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হলোনা। ক্লাস শেষে অয়নী ক্যাফেটেরিয়ার দিকে গেল। কিছু একটা খেতে পারলে ভালো হতো। ব্যাগে পঞ্চাশ টাকার মাত্র একটা নোট আছে। যদিও এর মধ্যে কিছু খাওয়া যায়। কিন্তু আরো কয়েকজন সাথে থাকায় কিছুটা সংকোচ বোধ হল। নাবিলা বলল,কি রে কিছু খাবি? অয়নী ইতস্তত বোধ করলো। একপ্রকার অস্বস্তি নিয়ে বললো, একটু পানি খেতাম। অয়নীর কথা শুনে নাবিলা অবাক হল। বলল, পানিতো আমার কাছেও ছিল। বললেই পারতি। এত দূর না আসলেও হত। অয়নী খুব লজ্জা লাগলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,না রে, ঠান্ডা পানি খাবো। যা গরম পড়েছে। নাবিলা ব্যাগ থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করে বলল, একটা পানি নিয়ে আয় আর সাথে দুটো ভেজিটেবল রোল নিয়ে আসিস। অয়নীর সংকোচ লাগল। ও টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল,আমার কাছে আছে। তুইতো সবসময় খরচ করিস। নাবিলা জোড় করে ওর হাতে টাকা গুঁজে বলল, এক ই সাথে থাকি তাও এত সংকোচ। যা বলছি কর। ঢং করিস না। আমার ঢং ভালোলাগেনা।
ক্যাফেটেরিয়া থেকে এসে দেখলো ভার্সিটির বাস চলে গেছে। অবশ্য একটু দেরীও হয়েছে।
অয়নী হতাশ চোখে নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলা বললো, এখন কী করবি? ঢং না ধরলেই পারতি। বাস মিস হতোনা।
অয়নী বললো, চল নীলক্ষেতের দিকে যাই। এরপর লেগুনায় গ্রীনরোড যাওয়া যাবে। আজ কপালটাই খারাপ। নাবিলা রাজী হলো। নিউমার্কেট আসতেই অয়নী বলল, এই দেখনা শাড়ী গুলো কী সুন্দর। আঁচল দেখ। শাদা শাড়ীর ওপর ফুলের নকশা। পড়লে যা মানাবেনা। অয়নীর উচ্ছাস দেখে নাবিলার খুব ভালো লাগলো। কয়েকদিন পর পহেলা বৈশাখ। ঢাকা শহরের সৌন্দর্য প্রিয় মেয়ে গুলো শাড়ী কিনতে ব্যস্ত। দোকান গুলোতে মেয়েদের ভীড়। নাবিলা বললো, মানাবে দোস্ত। তুই যা সুন্দর। তোকে সবকিছুতেই মানাবে। এখন তাড়াতাড়ি চল। কাল ক্লাস টেস্ট আছে। অয়নীর আরো কিছুক্ষন থাকার ইচ্ছে ছিল। নাবিলার কথায় চলে এল। লেগুনায় বসে নাবিলা ভাবলো,আহারে বেচারা। একটা সূতী শাড়ীর কত ইচ্ছে। কতই বা দাম। আটশো কিংবা একহাজার টাকা। হাতে টাকা থাকলে নাবিলাই অয়নীকে আজ শাড়ীটা কিনে দিত। অয়নী নাবিলার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,কী ভাবছিস? কারো প্রেমে ট্রেমে পড়ছিস নাকি?
নাবিলা মলিন হেসে বলল,নাহ রে। কিছুনা………
৩.
বিকেলে শাড়ীর কথা ভেবে অয়নীর মন আবার খারাপ হলো। বর্ষবরনে সবাই শাড়ী পড়বে। আর অয়নী সবাইকে তাকিয়ে দেখবে। এক গাদা শাড়ী পড়া মেয়েদের মধ্যে ও কামিজ পড়লে ওকে নিশ্চই খুব বেমানান দেখাবে। হয়তো মেয়েরা গা টেপাটেপি করবে। কেউ কেউ হাসবে। অয়নী এম্নিতেই বেশ সুন্দর। ক্লাসের মেয়েগুলো হিংসায় মরে যায়। মাকে আবার কী বলা যায়? নিজের মনের সাথে অনেকক্ষন যুদ্ধ করে অবশেষে আবার বাসায় ফোন দিল। কিছুক্ষন আমতা আমতা করার পর মাকে বলল, আচ্ছা মা তোমার একটা শাড়ী ছিলনা? ঐ যে ছোটবেলায় পড় বউ সাজতাম। তুমি কুঁচি করে পড়িয়ে দিতে। ঐ শাড়ীটা কি এখনো আছে?
অয়নীর কথা শুনে রাহেলা বেগমের মনের মধ্যে তুমুল ব্যথার দামামা বেজে উঠলো। মেয়েটাকে একটা শাড়ী পাঠাতে পারলে ভালো হতো। এমাসের বাড়ী ভাড়া টা বেড়েছে। নাহলে একটা নতুন শাড়ী পাঠানো যেত। কত ছোট একটা আব্দার করেছে বাপ মরা মেয়ে। তাও তিনি রাখতে পারছেন না। কী অক্ষমতা মানুষের। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বললেন, হ্যাঁ মা, আছে হয়তো আলমিড়াতে কিংবা ট্রাংকের এক কোনে। এতদিন পর এই শাড়ীর কথা মনে পড়লো যে?
-এম্নি মা। হঠাত্‍ মনে হলো তাই বললাম। আচ্ছা মা। না থাক. . .
-কী বলে ফেল? থেমে গেলি ক্যান?
-বলছিলাম কী শাড়ীটা যদি পাঠাতে। অত্যন্ত এবারের মত পড়া যেত। আগামী বার না হয় নতুন একটা কেনা যেত।
রাহেলা বেগম ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা মা। পাঠাবো। দেখি হাতে কিছু টাকা আসার কথা। যদি আসে তাহলে নতুন একটা পাঠাবো। বরিশালে শাড়ীর দাম কম।
মায়ের কথা শুনে অয়নীর প্রচন্ড খুশী লাগলো। এরমানে ওকে আর বর্ষবরনে কামিজ পড়ে থাকতে হবেনা। নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে অয়নী খুশীতে কেঁদেই ফেলল। নাবিলা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কি হয়েছে? বলবিতো। অয়নী খুশী আর কান্নার মাঝামাঝি হাসি হেসে বললো, শাড়ী আসছে।
৪.
দ্বিধা আর সংশয় কাটিয়ে এক প্রকার আগ্রহ নিয়েই পার্সেলটা খুলল নাবিলা। অয়নীর মায়ের পাঠানো শাড়ী। নাবিলার অনুমান ঠিক হলো। পার্সেল খুলতেই মায়ের একটি চিঠি। একপ্রকার ঘোরের মাঝেই নাবিলা চিঠিটা পড়ে ফেলল। দাগটানা কাগজে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা একটি চিঠি।

মা,
আদর নিস। ইচ্ছে ছিল তোকে নতুন একটা শাড়ী পাঠাবো। তোকে কথাও দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাত্‍ করেই হাত খালি হয়ে গেল। তোর বড় বোনের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ফর্ম ফিলাপ চলছে। তোর শাড়ীর টাকাটা ওর পেছনে খরচ হয়ে গেল। তোকে এই পুরনো শাড়ীটা পাঠাতাম না। তুই এমন ভাবে বললি না পাঠিয়েও পারলাম না। ট্রাংকের এক কোনায় পড়েছিল। আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর শাড়ী। তোর বাবা তখন ভালো বেতন পেতো। অনেক পাগল টাইপ মানুষ ছিল। একপ্রকার প্রাগতৈহাসিক যুগের মানুষের মত আমাকে শাড়ী পড়তে হত। শাড়ীর আঁচলটা অনেক সুন্দর। প্রায়ই রাতে আমাকে এই শাড়ী পড়ে মহরা দেয়া লাগতো। সেবার তুই পেটে। একবার এই শাড়ী পড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পা স্লিপ করে পড়ে গেলাম। পেটে সামান্য চোট লাগলো। পরদিন ডাক্তারের কাছে চেক আপ করাতে গেলাম।সব ঠিক আছে জেনে তোর বাবা ভীষন খুশী হলেন। এরপর থেকে এই শাড়ী পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। সেদিনের পর থেকে আর এই শাড়ী পড়িনি। যাহোক,সাবধানে পড়িস। তোকে এই শাড়ীতে ক্যামন লাগছে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মানুষের সব ইচ্ছে পূরন হয়না। ভালো থাকিস।

ইতি
তোর অক্ষম মা

শাড়ীটা ভালো করে পরখ করে দেখল নাবিলা। পুরনো আমলের শাড়ী। সিল্কের। জায়গায় জায়গায় ফেঁসে যাওয়ার চিহ্ন। সবচেয়ে বেশি সমস্যা আঁচলে। যদিও আঁচলটা খুব সুন্দর কিন্তু তিন চারটে ছিদ্র। ভালো করে পড়লে অবশ্য বোঝা যাবেনা। একটু ঢেকেঢুকে রাখলেই হবে। এই শাড়ী পেয়ে অয়নীর মন আরো খারাপ হবে। বেচারী আবার কাঁদবে। নীরবে। হয়তো পহেলা বৈশাখে বের ই হবেনা। কিংবা এও হতে পারে রাগে অথবা অভিমানে অয়নী শাড়ীটাকে কুটিকুটি করে কেটে ফেলবে। আঁচলের দিকে তাকিয়ে নাবিলার মনে হলো এর প্রতিটি পরতে পরতে গভীর মাতৃত্বের ছাপ। নাবিলার মা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছে। আঁচলটাকে জড়িয়ে ধরে নাবিলা কিছুক্ষন কাঁদলো। বুকের ভেতর শুন্যতার স্রোত বয়ে গেল। শুকানো ডিটারজেন্টের গন্ধ লেগে আছে শাড়ীতে। মনে হচ্ছে অজস্র মায়া যেন সুতোর মত করেই বোনা হয়েছে আঁচলে। চোখের জলে আঁচলের একাংশ ভিজে গেছে। নাবিলা নিজেকে ঠিক করে নিল। অয়নী ফেরার আগে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে হবে। হাতে সময় নেই।লকার থেকে নিজের শাড়ীটা বের করল নাবিলা। গত মাসে নিউমার্কেট থেকে কেনা। ভর্তি পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন একটা টিউশনি করিয়েছিল। সেখান থেকে টাকা জমিয়েই শাড়ীটা কেনা। বর্ষবরনে পড়ার জন্য। নাবিলা আহামরি সুন্দরী না। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। এজন্যেই মিল করে এই শাড়ী কেনা। এখনো ভাঁজ খোলা হয়নি। কিছুক্ষন ভেবে নাবিলা নতুন শাড়ীটা পার্সেলের মধ্যে ঢুকালো। অয়নী এখন প্রচন্ড ঘোরের মাঝে আছে। এই ঘোর নতুন শাড়ী পড়ার। নিজের সৌন্দর্যকে আরেকটু জাগিয়ে তোলার কিংবা অনেক সাধারনের মাঝে নিজের অসাধারনত্ব টিকিয়ে রাখার। তাই ওর কাছে এই পুরনো সিল্কের শাড়ী, অপূর্ব আঁচলের মাঝে তিন চারটে ছিদ্র কিংবা অকৃত্রিম মাতৃত্ব কোনটার ই দাম নেই। সব কিছু মূল্যহীন। যাঁর চলে যায় সেই হারানোর যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পারে। নাবিলা অয়নীর মার চিঠিটা সরিয়ে ফেলল। নতুন শাড়ীটা পার্সেলে ঢুকিয়ে কস্টেপ মেরে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনলো। শুধু একটা অগভীর দীর্ঘশ্বাস শেষ বিকেলের আকাশের সাথে মিশে অচেনা এক আবহ তৈরি করল। আকাশে মেঘ জমেছে। সম্ভবত বৃষ্টি হবে। নাবিলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখের কোনে জমা অশ্রুর ফোঁটা তরলের পৃষ্ঠটান সূত্র মেনে আরো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বড় হচ্ছে। যেন একটু দমকা হাওয়া এলেই ঝড়ে পড়বে।
কাক ভেজা হয়ে অয়নী বাসায় ফিরলো সন্ধ্যের কিছু পর। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে নাবিলার ঘুম ভাঙলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই অয়নী বলল, আর বলিস না। ক্লাশ শেষে চুড়ী কিনতে গিয়েই ঝামেলায় পড়লাম। পছন্দ করে কিনতেই পারছিলাম না। যা দেখি তাই পছন্দ হয়। এরমাঝে বৃষ্টি নামলো। এই বৈশাখের কাঠ ফাটা রোদের মাঝে বৃষ্টি নামার কোন মানে হয় বল?
নাবিলা বলল,ভেতরে আয়। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। এরপর সব শুনবো।
অয়নী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,কাঁচের চুড়ী কিনলাম।বুঝছিস। শাড়ীর সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে। এখন শুধু শাড়ীর জন্যে অপেক্ষা। নাবিলা বলল, তোর একটা পার্সেল এসেছে। তুই যাওয়ার পর ই পেলাম। টেবিলের ওপরে রাখা আছে। নাবিলার কথা শুনে অয়নী চমকে উঠল। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে পার্সেল খুলল। শাড়ী হাতে পেয়ে অয়নী খুব খুশী হল। উচ্ছাসের এক পর্যায়ে মাকে ফোন দিয়ে বলল, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মা। আই জাস্ট লাভ ইউ। রাহেলা বেগম কিছুই বুঝতে পারলেননা। শুধু মনে মনে ভাবলেন,আহারে বেচারা পুরাতন একটা শাড়ী পেয়েই এত খুশী। নতুন শাড়ী পাঠালে না কত খুশী হত। আনন্দে তাঁর কাঁদতে ইচ্ছে করল।
৫.
পহেলা বৈশাখের দিন অয়নী খুব সকালে ঘুম থেকে উঠল। গোসল করে শাড়ী পড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষন পরপর নাবিলা এক ই প্রশ্ন,এই আমাকে ক্যামন লাগছে বলতো? শাড়ী পড়া ঠিক হয়েছে? আঁচলটা সুন্দর না? দ্যাখ দ্যাখ আঁচলে কি সুন্দর নকশা। আমার মায়ের চয়েজ আছে। এই কিছু বলছিস না যে। নাবিলা আড়মোড়া ভেঙে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, তোকে অন্নেক সুন্দর লাগছেরে পাগলী। আমাকে আর একটু ঘুমোতে দে। প্লিজ। নাবিলার কথা শুনে অয়নী বলল, এই আর কত ঘুমাবি। ওঠ না। তাড়াতাড়ি রেডী হ। অয়নীর অত্যাচারে নাবিলা বিছানা ছেড়ে উঠল। গোসল করে পুরনো একটা কামিজ পড়লো। এরপর অয়নীকে বললো,চল যাওয়া যাক। নাবিলাকে দেখে অয়নী অবাক হয়ে বলল,কিরে তুই শাড়ী পড়বিনা? নাবিলা মলিন কন্ঠে বলল, নারে। আমিতো তোর মত সুন্দর না। আর আমি সুন্দর করে শাড়ী পড়তেও জানিনা। রাস্তায় শাড়ী পড়ে বের হলে মনে হয় এই বুঝি খুলে পড়বে। অয়নী কিছুক্ষন ভেবে বলল,কিন্তু ব্যপারটা বেমানান হয়ে গেলোন। রাস্তায় দুজন হাঁটছি। তুই পুরাতন কামিজ পড়া আমি শাড়ী। লোকে কি বলবে? অয়নীর কথা শুনে নাবিলা হাসল। বলল,লোকের এত সময় কোথায় আমাদের দেখার?
তারপর ও দোস্ত। তুই এক কাজ কর। বাসায় থেকে যা। বিকেলে না হয় আমরা ঘুরতে বের হবো। নাবিলা এক পলকে কিছুক্ষন অয়নীর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর খুব শান্ত গলায় বলল, সাবধানে যাস। আমার শরীরটাও ভালো লাগছেনা। তোকে আগেই বলতাম।
নতুন শাড়ী পড়ার প্রবল আনন্দ কিংবা উচ্ছাস যে কারনেই হোক নাবিলার কান্না ভেজা কন্ঠ অয়নীর কানে গেলোনা। শুধু আসি বলে অয়নী হনহনিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। নাবিলা শুধু অয়নীর চলে যাওয়ার পথটির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। কাউকে খুশী করার মত আনন্দ পৃথিবীতে হয়তো খুব কমই আছে।

অয়নী চলে যাওয়ার পর নাবিলা খুব সুন্দর করে সিল্কের শাড়ীটা পড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো ওর সমস্ত শরীর জুড়ে অদৃশ্য এক মমতা জড়িয়ে আছে। আঁচলের যে অংশে ছিদ্র সেই অংশ গুলো ভোরের আলো এসে পূর্ন করার চেষ্টা করছে। নাবিলার আবারো কান্না এলো। এ কান্না আনন্দের। এক টুকরো আঁচলে খুঁজে পাওয়া এক চিলতে মাতৃত্বের। কোন মতে নিজেকে সংবরন করলো ও। এ আঁচল ভালোবাসার আঁচল। অজস্র মমতা যেখানে লীন হয়ে আছে। এ আঁচল ভিজতে দেয়া যায়না. . . . . .
উত্‍সর্গ: তাহমিনা শবনম হক আপা।

২,৪১৩ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “আঁচল”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অসাধারন হয়েছে রাব্বী, আমার পড়া তোমার লেখাগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা লেখা। :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।