ফেইসবুক স্ট্যাটাসঃ প্রসংগ ৬০৩ (১৯৮৮-’৯৪), সিসিআর

ফেইসবুক স্ট্যাটাসঃ প্রসংগ ৬০৩ (১৯৮৮-’৯৪), সিসিআর

কেন যেন হঠাৎ করেই নীচের লাইনগুলো লিখতে ইচ্ছা হল। ইদানিং ইমোশোন চেপে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ৬৪২-এর ফেইসবুক স্ট্যাটাস অনুযায়ী আসলেই বোধহয় আমাদের ঘণ্টা বাজার সময় শুরু হয়ে গেছে।

গত কয়েকদিন খুব কষ্ট করে নেট ব্যবহার করতে হয়েছে। ছিলাম দিনাজপুরে, থ্রী-জি কাজ করেনা সেখানে। গরুর গাড়ির গতিতে ৬০৩-এর ব্যপারে প্রতিটা খবর নিচ্ছিলাম। মনের অবস্থা কেমন ছিল, বা এখনো কেমন আছে, বলে বোঝাতে পারব না।

আজ ২রা মে, সারারাত জার্নি করে সকালে বাস থেকে নামলাম। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়েই ভাবলাম ৬০৩-কে দেখতে যাই। কিন্তু, সকালে আর যাওয়া হল না; এমন ঘুম দিলাম যে একেবারে দুপুর গড়িয়ে বিকাল। প্রায় সাড়ে তিনটার পরে ৬৪২ ও ৬২৩ কে ফোন দিলাম, যদি এদের কাউকে সংগী হিসেবে পাওয়া যায়। যাহোক ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে তারা আমাকে সেই মুহূর্তে সঙ্গ দিতে পারেনি। ৬২৩ আমাকে ৬০৩-এর বড় ভাইয়ের ফোন নাম্বার টেক্সট করে পাঠালো।

আসরের নামাজের পরে গেলাম গ্রীণ রোডের গ্রীণ লাইফ হাস্পাতালে। সিএনজি থেকে নেমেই কেমন যেন একটা নার্ভাসনেস কাজ করা শুরু করল। এজন্যই একা আসতে চাইনি। ফোন দিলাম ৬০৩-এর বড় ভাইকে। তিনি গাইড করলেন, চলে গেলাম লিফটের ৫-এ চাপ দিয়ে সরাসরি আইসিইউ-এর ফ্লোরে। সেখানে আবার ফোন দিয়ে ৬০৩-এর বড় ভাইকে খুঁজে নিলাম। কিছুক্ষন কথা বললাম তাঁর সাথে। কি বলব, কিভাবে বলব, কিছুই মাথায় কাজ করছিল না। তিনি বারবার ক্যাডেটদের কথা বলছিলেন, বন্ধুদের জন্য কেউ এমন ভাবে এগিয়ে আসে এটা তাঁর কাছে বেশ অবাক লেগেছে বলেই তিনি জানালেন। আমার মনে হল, তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার চেষ্টা করছেন। আমার ভীষণ রকমের অস্বস্তি হচ্ছিল। তিনি বিশেষভাবে ৬৪৬-এর কথা বলছিলেন। আমিও জানি ৬৪৬ কি পরিমানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ৬০৩-কে বিএসএমএমইউ-এর আইসিইউ-এ একটা সীট ম্যানেজ করে দেবার জন্য। শুধু ৬৪৬-ই না, গত কয়েকদিন ধরে অন্যরাও তো আড়াল থেকে, দেশে-বিদেশে সবজায়গা থেকে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা-সহানুভূতি চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ৬৪৬, ৬৪২, ৬২৯, ৬৪১, ৬১৪, ৬৪৫, ৬০৮, ৬৩৭, ৬১৩, ৬০০, ৫৯৯, ৬২১ ও ৬২৩-এর কথা না বললেই নয়। আরো অনেকেই আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে এদের কথাই বেশি মনে পড়ছে। আর আড়ালে ৬১৯ তো আছেই। নিজেকে যে আমার কি পরিমান ছোট লাগছে প্রতিনিয়ত, তা বোঝাতে পারব না। অনেক-অনেক ছোট আমি। আমার নিজের চাচা-চাচী অনকলোজিস্ট এবং গাইনোকলোজিস্ট হওয়া সত্বেও তাদেরকে ধরেও আমি এবিষয়ে কিছুই করতে পারিনি। নিজেকে নিষ্কর্মা মনে হচ্ছে। ৬০৩ মৃত্যুর সাথে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের অন্যরা জান-প্রান দিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমি দিনাজপুরে বসে যাস্ট দুয়েকজনের ফোন নাম্বার যোগাড় করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করলাম না। সহপাঠী ক্যাডেটদের প্রতি স্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসছে বারবার।

যাহোক, আমি আগ্রহ প্রকাশ করলাম ৬০৩-কে দেখার। দেখি ৬০৩-এর বড় ভাই পকেট থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বের করে কাকে যেন আইসিইউ-এর পোষাক কিনতে পাঠাচ্ছেন। আমি আবার ছোট হয়ে গেলাম। এই ফর্মালিটিজ আমার জানা ছিল না; জানা থাকলে নিজেই কিনে নিয়ে আসতাম। আমি অনেক জোর করে তাঁকে এই টাকা দেয়া থেকে বিরত করে আমিই ১০০ টাকা দিলাম। পোষাক এল। ৬০৩-এর বড় ভাই নিজেই আমার পিঠের দিকে সেই পোষাকের ফিতা বেঁধে দিলেন। মাথায় টুপি ও মুখে মাস্ক পরতে হল। গেলাম আইসিইউ-এর ভিতরে। ১৮ নম্বর বিছানা। নিথর দেহে ৬০৩ আমার সামনে শুয়ে আছে। আমার এক সিনিয়র কলিগ (একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার) আমাকে একসময় রূগী দেখার একটা দোয়া শিখিয়েছিলেন। সেটা পড়ার চেষ্টা করলাম। আল্লাহতালা কতখানি কবুল করলেন বা করবেন জানিনা, মন থেকে সেই দোয়াটা পড়েছি। ৬০৩-এর কপালে হাত রাখলাম। ওর শরীরটা যেন একটু ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। বেশ কয়েকবার ওর মাথায় হাত বুলালাম, কেন, তা জানিনা। কপাল ঘামে ভেঁজা। এর মধ্যে আরো কয়েকবার মনে হল ওর শরীরের ঝাঁকুনি দেখলাম। চোখের সামনে ৬০৩। এই প্রথম সে আমাকে বলল না, “দোস্তো, কেমন আছিস?”

আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলাম। ৬০৩-এর বড় ভাবীর সাথে পরিচয় হল। মহিলা বেশ উদ্গ্রীব। হবারই কথা। এই বয়সের একটা ছেলে দু-দুটো ছোট বাচ্চাকে ফেলে গত শুক্রবার থেকে এই শুক্রবার, এই আটদিন ধরে কোমা’য় আছে, তার পরিবারের লোকজন ছটফট করবে না তো কি আমার মত স্বার্থপর ছটছট করবে! আর ৬০৩-এর বড় ভাইকে দেখে মনে হল শক্ত না থেকে তার আর কোন উপায় নেই বলেই হয়তো শক্ত আছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই কদিন ধরে তিনি আইসিইউ-এর বাহিরেই মেঝেতে চাদর বিছিয়ে রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন। ৬০৩-এর স্ত্রী সে’সময় হাস্পাতালে ছিলেন না, আমার জন্য ভালই হয়েছে, আরেক ধাপ অস্বস্তির হাত থেকে মুক্তি পেলাম। কিন্তু কেন যেন কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমার অপরাধটা কোথায়, সেটাও বুঝছি না, কিন্তু নিজেকে ক্ষমাও করতে পারছি না। ৬০৩-এর বড় ভাইকে একটু আড়ালে ডেকে এনে খুব কাঁচুমাচুঁ ভাবে আমার পকেট থেকে ১০টা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিলাম। আমার খুব লজ্জা লাগছিল। আমি জানি, যে পরিমান খরচ হচ্ছে এই চিকিৎসায়, আর আমাদের অন্যান্য ক্যাডেটরা যা কিছু করছে, তার তুলনায় আমারটা নিতান্তই একটা হাস্যকর প্রচেষ্টা। তিনি কিছুতেই নেবেন না; শুধু বারবার তার ভাইয়ের জন্য দোয়া চাইছিলেন। অনেক জোরাজুরির পরে তিনি তা রাখলেন।

বাসায় চলে এলাম। বাবা-মা-বোন-স্ত্রী সবার সাথে কথা বললাম, গল্প করলাম। আমার মেয়েটাকে সময় দিলাম। কিন্তু ৬০৩-এর বাচ্চাদুটোকে এই মুহূর্তে কে সময় দিচ্ছে! আর যেই হোক ৬০৩ তো নয়ই! অনেক দুরু-দুরু বুকে ৬০৩-এর স্ত্রীকে ফোন দিলাম। কথা বললাম। কি যে বললাম, জানি না, সেভাবে মনেও পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে তিনি বারবার দোয়া করতে বললেন। আমি যত দ্রুত পারলাম লাইনটা কেটে দিলাম।

মনটা ভাল লাগছে না। আগামীকাল থেকে একটা নতুন সেমিস্টার শুরু হবে। প্রত্যেকবারে এই সময়টাতে আমি খুব এক্সাইটেড থাকি, নতুন ব্যাচ, নতুন কোর্স, একটা থ্রিলিং ভাব থাকে। আজ মনে হচ্ছে কাজে না গেলেই ভাল হয়! গিয়ে কি পড়াব!

আসলে আমি যে কি লিখছি এতক্ষন ধরে সেটাও বুঝে উঠতে পারছি না। নীচে আমি সহ গত কয়েকদিনের আরো কয়েকজন ক্যাডেটের ফেইসবুক স্ট্যাটাস এবং কমেন্ট তুলে দিলামঃ

আমার গত ২৯শে এপ্রিলের স্ট্যাটাসঃ
Dear All,
This time I’m seeking prayer from you all for my friend Ex-Cadet Habib Rahman who had a severe brain stroke on last Friday which has caused him a total damage of the brain, as quoted by sources. He is now in coma, in life support. We all are just waiting for a miracle; seeking help from the Almighty.

Whoever reading this, please make a dua for my friend. This is an earnest request. It’ll cost you nothing; please pray for him.

৬৪১-এর স্ট্যাটাসঃ
Dear All, I have visited Habib Rahman today. As Mahbub E Habib mentioned there is no change in his situation. I had a small discussion with Bhabi (Rahman’s wife) regarding the situation, we need to discuss few treatment & financial as soon as possible.

To discuss his treatment & financial issues I am requesting all CCR14 members to join us tomorrow at 5pm in Cadet College Club. Please try to attend.

৬৪৬-এর দুটো স্ট্যাটাসঃ

১।
Dear Boys, As you know we are at the moment going through the most difficult time of our batch. Rahman is battling for his life. It’s the biggest battle for him which is totally uncontrollable to humankind. Only Almighty Allah can give him the recovery. As humble human beings, we can only wait and pray for Rahman. But obviously whatever happens, CCR14 has a greater responsibility to look after his young family as well as to ensure best possible treatment for him. Therefore, I am requesting financial help from everybody. We need a quick response from your good end. Whatever you can contribute just do that. We have done this before, but none of those were as urgent as this one. This time we need to do it for our fight between life and death.

২।
Visited Rahman now. There is no change in his condition. Keep praying guys. I have given Tk 20,000/- to his elder brother and vabi as a token of my support. Their reaction was beyond any description, all I can say I have seen heaven today. So far daily average expenses per day is around Tk 30,000/-. So pls do something if you feel like.

He needs to be transferred to PG Hospital for better treatment. I have done the initial formalities today for a place in ICU. The serial number is 477/14, date: 1 May 2014. It’s a very challenging job. Farid is working but if you have any connection with Prime Minister or Ministers/MPs/ political leaders then pls try to arrange a bed by using that connection.

Rahman had texted himself a sms in that night (7 or 8 hours before the stroke), which is”Hi Habib, tume kemon aso. Ami tomake neya kharap sopno deksi. Khub tension hosse. I wish u r always fine…..” (collected from his cell phone). May Allah bless us all!!

৬৪২-এর গত কয়েকদিনের স্ট্যাটাসঃ

১।
আজ সকালে জানতে পারলাম রহমান (৬০৩) গত শুক্রবার সকাল ৮/৯ টার দিকে ব্রেন স্ট্রোক করছে। স্ট্রোকটা সম্ভবত একটু কঠিন ধরনের হবে। যতটুকু জানতে পারলাম, সকাল বেলায় সে অজ্ঞান হয়ে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা বের হওয়া শুরু হয়। তাকে এখন গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ICU তে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। উপরওয়ালার নিয়ত কি জানিনা, তবে ডাক্তাররা আল্লাহর রহমতের ভরসায় আছেন, ভালো হলেও অনেক দিন সময় নিবে…

রহমান প্রতি বৃহস্পতিবারে ঢাকায় আসতো বউ, ছেলে মেয়ের কাছে। আমাকে প্রায় শুক্রবারে ফোন দিতো খোঁজ খবর জানার জন্য, বাসায়ও চলে আসতো মাঝে মাঝে। বন্ধুদের অনেকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও আমি খেয়াল করেছি রহমান আমাকে সবচেয়ে বেশী ফোন দিতো। প্রায় চার দিন পরে জানলাম তার এই অবস্থা, অথচ সে আমার খুব কাছেই থাকতো।

ICU এর সাথে আমার কোন সুখ স্মৃতি নেই, শুধু ভালো জিনিসটাই কামনা করতে পারি। সারাজীবন আমরা ওকে ‘ঘণ্টা’ বলে ডেকেছি। হয়তো ঘণ্টা বাজিয়ে ও আমাদের বলতে চাচ্ছে…“আমাদেরও শেষের শুরুর সময় হয়ে গেছে বন্ধু”…

২।
603 is still in coma since his attack in the brain. His brain has collapsed totally which is almost unrecoverable. Doctors wanted to remove his life support yesterday and declared the ultimate destiny. Perhaps it was the Almighty who wanted to delay the departure for his CCR friends. Only a miracle can keep him in this world.

623 was crying in ICU lobby … We could not see him for the restrictions. His wife’s mobile no is xxxxxxxxxxx.

Waiting for a miracle within next few days … Otherwise be prepared for 50 minus 603.

৩।
603’s respiratory system starts working without life support system. It’s a positive sign. Doctor has removed his life support in the morning. They are giving him only oxygen. Still he is in coma. Only Allah can help him.

I request CCR14 boys to talk with his wife as if she gets some mental strength in this situation. Her contact no is xxxxxxxxxxx.

I also request those ccr14 boys to pay him a visit who are staying in Dhaka. Please follow the schedule below for the visit.

In the morning: 10~11AM
In the evening: 5~6 PM

৪।
Dear ccr14 brothers, I went to visit 603 and have just returned. Apart from his brain, the remaining organs of the body are functioning well. Doctors made a bypass line on his throat for smooth breathing and he is breathing well. But still he is unconscious. He just needs to open his eyes to connect his brain with the body.

You already heard that we have decided to support him financially. Earlier CCR14 did so on several occasions for many people. Even we did such type of contributions when we were not solvent. Now we are solvent enough to do so. We want to support him strongly. Please extend your hands to support 603.

You can use my bank account from home & abroad as you did earlier.

MS KNITTING
A/C- 0023-0210000544
TRUST BANK LTD
UTTARA CORPORATE BRANCH

Please send me a message once you send your money.

৫।
Those who want to send money from abroad, you can use the below swift code of my bank.

TTBLBDDH 023

By using above SWIFT code you can transfer quickly.

৮ টি মন্তব্য : “ফেইসবুক স্ট্যাটাসঃ প্রসংগ ৬০৩ (১৯৮৮-’৯৪), সিসিআর”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।