ঘরট্ট (সম্ভবত পাঁচ-ছয় পর্বের একাংশ)

সাবজেক্ট হিসেবে দর্শন যে এতো আগ্রহোদ্দীপক সেটা আগে বুঝিনি। দর্শনপাঠ আমাকে সত্যিই অবাক করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে দর্শনের শুরুটাও মানুষের অবাক হবার ক্ষমতা থেকে। অবাক বিস্ময়ে মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করেছে, আচ্ছা আমরা কোত্থেকে এলাম? এই পৃথিবীটা আসলে কিসের তৈরি? আকাশে নিয়ম করে র্সূয উঠে, চাঁদ ডুবে, রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নক্ষত্রকণা – এতোসব আয়োজন – এর পেছনের রহস্য কি? প্রচলিত পূরাণকাহিনী অনুযায়ী এসব এক একজন দেব-দেবী কিম্বা তাদের কোন যাদুকলা। অধিকাংশ মানুষই তাদের অনুসন্ধিৎসু মনটাকে বেশি বেড়ে উঠতে দেয় না। তাকে আঁতুরঘরেই মেরে ফেলে। তার কারণ কৌতুহলী মনকে বাড়তে দিলে তা বড্ড বেয়ারা হয়ে উঠে – পরে তা তাল সামলাতে নাও পারে। কিন্তু  একজন দার্শনিক তা করতে পারে না।  দর্শণের যখন জন্ম, আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে, তখনও কিন্তু খ্রীস্টান কিম্বা ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি হয়নি। সেসময়টায় অবশ্য পূর্ব গোলার্ধ্বে চীনে দাও আর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ছিল। দর্শনের জন্ম তো পশ্চিমে, প্রাচীন গ্রীকে। এই ক্রেডিটটা তারা নিতেই পারে। সে অন্চনের প্রধান ধর্ম ছিল প্যাগান। গৌতম বুদ্ধও জীবনের মানে খুঁজেছেন এবং এর উত্তর হিসেবে নির্ভার হওয়াটাকে সমাধান হিসেবে দেখেছেন। নির্ভার হওয়া মানে পাপমুক্তি। অন্যথায় মানুষের পুনর্জন্ম ঘটতে থাকবে যতক্ষণ র্পযন্ত না সে পাপমুক্ত হচ্ছে। এই পদ্ধতিটি একটি আধ্যাত্মিক সাধনা। অন্যদিকে চীনের প্রথমদিককার দার্শনিক, কনফুসিয়াস, পৃথিবীর জন্ম-মৃত্যু এইসব প্রশ্ন ধর্ম বা প্রচলিত বিশ্বাসের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এসব নিয়ে খুব একটা প্রশ্নও তোলেননি। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল সমাজের নিয়ম-নীতি, মানুষকে ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা দেবার ব্যাপারে। পূর্ব আর পশ্চিমে দর্শনের শুরুটার এটাই বড় পার্থক্য। পৃথিবীর জন্ম নিয়ে সমাজে প্রচলিত যে বিশ্বাস ছিল পূর্বের দার্শনিকরা তা নিয়ে খুব একটা নাড়াচাড়া করেননি। আর পশ্চিমের দর্শনের শুরুটা হয়েছে ঠিক এই জায়গা থেকেই – প্রচলিত বিশ্বাসকে অবিশ্বাস করে। প্রথম দার্শনিক থেলিস সে সময়ের সমাজে প্রচলিত মিথের নায়ক দেবতা জিউসকে নির্দ্বিধায় আইডল মানেননি। থেলিসের জন্ম যিশু খ্রীষ্ট জন্মেরও ৬০০ বছর আগে। অবশ্য থেলিসের সময়েরও ৩০০০ বছর আগে এই পৃথিবীতে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। প্রথমে মেসোপোটেমিয়ায় – জায়গাটা আজকের ইরাকের কাছাকাছি, তারপর মিশরে। প্রাচীন মিশর মানেই আমাদের সবার পরিচিত পিরামিড। চীন, ভারত আর দক্ষিণ আমেরিকায় আলাদা আলাদা ভাবে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেসবই আজ থেকে তিন-চার হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু কোথাও দর্শনের জন্ম হয়নি। অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় রোম আর গ্রীক সভ্যতাকে সবচেয়ে কনিষ্ঠ বলা যায়। আর সেখানেই জন্ম হলো দর্শনের। পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক হিসেবে থেলিসকে বিবেচনা করা হয়।  কি আবিষ্কার করেছিলেন থেলিস? কতগুলো প্রশ্ন আর তার কিছু উত্তর। এই যেমন এতোদিন ধরে মানুষ তার চারপাশে যে পৃথিবী দেখছে তার উৎপত্তি কোত্থেকে? এর গড়ন-গঠনই বা কেমন? এর শেষই বা কোথায়? স্থলভাগ সবসময়ই বিশাল সাগরে গিয়ে মিলেছে। সেই সাগরের কোন কূল নেই কিনার নেই। তবে এই পৃথিবী কী শুধুই বিশাল জলরাশির মধ্যে ভাসমান এক ভূখণ্ড? এই চারপাশের বিশাল জলরাশিই কি সেই ভূখণ্ড সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে? হ্যাঁ, থেলিস ভাবলো সবকিছুর উৎপত্তি পানি থেকে। রাতের বেলা মুখ তুলে দেখলেন অংসখ্য তারার মেলায় সজ্জিত আকাশ আসলে একটা ছন্দ মেনে চলে। ঋতু বৈচিত্র্যের স্থায়ীত্ব আর আবহাওয়া সম্পর্কে তাঁর একটা ধারণা হলো। শুধু ধারণা করেই বসে রইলেন না। হাতে-কলমে সেটা প্রয়োগ করে দেখালেন। ঋতু বুঝে তুলা চাষ করলেন। ফলাফল বাম্পার ফলন। নিজেও বুঝলেন, আর দশজনকেও বোঝালেন যে দেব-দেবীকে খুশী করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় না। এর জন্য দরকার সঠিক জ্ঞান আর তার বাস্তবিক প্রয়োগ।  সামান্য একটা হাস্যকর প্রশ্ন থেকেও দর্শনের জন্ম হতে পারে। ফলাফল ধারাবাহিক জ্ঞান চর্চা আর উন্মুক্ত বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার। তবে দর্শনের প্রথম ভিত্তি হচ্ছে মানুষের কৌতুহলী মন। সে অবাক হবে। বিস্মিত হবে। প্রশ্ন করবে। ঠিক যেমনটা সদ্য কথা শেখা  শিশুরা করে থাকে। শিশুদের অবশ্য যে উত্তর দেওয়া হয় তারা তাই বিশ্বাস করে ফেলে। আমরা বড়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুই থেকে যাই। কারণ আমরাও চুপচাপ রোবটের মতো ছোটবেলা থেকে যা শুনে এসেছি তা’ই বিশ্বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু সবাই তো আর শিশু থাকে না। কেউ কেউ সত্যি সত্যিই বড় হয়। এই যেমন থেলিস। এই মানুষটির কৌতুহলী মন দর্শনের সূচনা করেছে। সে সময়ের গ্রীক সভ্যতায় থেলিস একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। সেখানে ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক দার্শনিকের জন্ম হয়েছে। তাঁরা সব নতুন নতুন তত্ব নিয়ে এসেছেন। কেউ বললেন, না পানি না – সবকিছুর সৃষ্টি মাটি থেকে। আরেকজন পূর্ববর্তী ধারণাগুলোকে প্রশ্ন বিদ্ধ করে নিজস্ব যুক্তিতর্ক সাজিয়ে বললেন, সেটাও না – আসলে সব কিছুর জন্ম আগুন থেকে। সবচেয়ে মজা লেগেছিল দর্শন পড়তে গিয়ে পীথাগোরাসকে আবার খুঁজে পেয়ে। এই ভদ্রলোককে তো আমি কেবল একজন গণিতবিদ হিসেবেই জানতাম। মনে আছে ক্লাস এইটে পীথাগোরাসের উপপাদ্য আমাকে অনেক ভুগিয়েছিল। সেই পীথাগোরাসের আবার দেখা পেলাম দর্শন পড়তে গিয়ে। এই দার্শনিকের মতে প্রতিটি বস্তু এবং ভাবনাকেই সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। শুধু তাই নয় তাঁর মতে সংখ্যাই সব কিছুর উপর আধিপত্য করে। এরই ধারাবাহিকতায় আসলো সক্রেটিস-প্লেটো-আরিস্টটল যুগ। 
মাঝে মধ্যে লাইব্রেরিতে বসে দার্শনিকদের মতবাদ নিয়ে কবিরের সাথে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প হয়, তর্ক হয়। এর মাঝে মাঝে আমরা বই থেকে নোট টুকে নিই। সবকিছুই দর্শন বিষয়ে। আধুনিক দার্শনিকদের মধ্যে এ্য্মানুয়েল ক্যান্টকে আমার বেশ পছন্দ। ক্যান্ট আত্মহ্ত্যা, চুরি, প্রতিজ্ঞা-ভঙ্গ, মদ্যপান, স্বমেহন এবং গরীবদের দান না করা এর প্রতিটি কাজই খুব অপছন্দ করতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও এইসব কর্মকাণ্ড থেকে মানুষদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তবে ধর্মের ভিত্তিটা হলো বিশ্বাসের আর দর্শনের ভিত্তিটা হলো রীজন। বিশ্বাস আর রীজনের পার্থক্যটা কী? কোন প্রশ্ন না করে মেনে নেওয়ার নামই হলো বিশ্বাস। এর জন্য কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা র্পযবেক্ষণের দরকার হয় না। কিন্তু রীজন হচ্ছে কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্য। র্পযবেক্ষণ আর পরীক্ষণের মাধ্যমে এইসব স্বতঃসিদ্ধ সত্যে পৌছাতে হয়। এই যেমন র্সূয প্র্তিদিন পশ্চিমে অস্ত যায়। আমরা অনেকে তা বিশ্বাস করি আবার অনেকে এটাকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে জানি। দ্বিতীয়তটিকে একটি বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে মানতে চাইলে আমাকে সৌরজগত, গ্যালাক্সি আর এদের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কেও জানতে হবে। স্বতঃসিদ্ধ সত্যের ভিত্তিটা অনেক বেশি শক্ত। আমি যখন কোন কিছুকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে জানব তখন আর আমার মধ্যে অজানা আশংকা কাজ করবে না। কিন্তু বিশ্বাসের ভিত্তিটা মানুষ হিসেবে আমার ভেতরটা অনেক বেশি নড়বড়ে করে ফেলে। শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করলে আরেকজন আমার আবেগ নিয়ে আমাকে ব্যবহার করতে পারে। আমি তখনই গরীব থাকবো, দুর্বল থাকবো, অসুখী থাকবো যখন আরেকজন আমাকে তার ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করবে। আমি কেন সহজে নিজেকে ব্যবহৃত হতে দেব? তাই বিশ্বাসের থেকে এখন আমি স্বতঃসিদ্ধ সত্যের উপর জোর দিচ্ছি। আমার চিন্তাভাবনার ধারা বদলে দেবার পর থেকে দেখলাম নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে।যা পাইনি তার জন্য দুঃখবোধটা কমে যাচ্ছে। এখন দেখছি যখন একটা দরজা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন সামনে আরও অনেক দরজা খুলে যায়। মনে আছে আইন বিভাগে সুযোগ না পেয়ে খুব মন খারাপ হয়েছিল। এখন আর তার লেস মাত্র নেই। দর্শন আমার ভেতর টপাটপ অনেকগুলো মনের জানালা খুলে দিচ্ছে। মনের গুমোট ভাবটা আর নেই। ধীরে ধীরে আবার আমি আলোকিত হয়ে উঠছি। আবার জীবনকে খুব ভালবাসতে শিখছি। একজন আলোকিত মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ যে সে  নিজের মতো করে সুখী হতে পারে। অথচ এতোদিন নিজেকে সুখী ভাবার একটা পদ্ধ্তিই জানতাম। তা হলো অন্যের তুলনায় নিজের অর্জন কতখানি তা যাচাই করে দেখা। অর্জন বেশি হলে খুশি নয়তো কষ্ট পাওয়া। স্কুল-কলেজের সময়টাতে আমি সবসময় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থাকতাম। কাউকে আমার সাথে তুলনাই করা হতো না। ছিলাম অতুলনীয়। আর এখন প্রায় অদৃশ্য, অতি সাধারণ একজন। এই অবস্থার মধ্যে থেকেই শিখছি কিভাবে সত্যিকারের সুখ অনুসন্ধান করতে হয়। পেয়ে গেছি বলব না তবে অনুসন্ধানের এই ভ্রমণটাও কম আনন্দের নয়। দর্শন নিয়ে কবিরের সাথে আড্ডা মারা আমার আরেকটা আনন্দের বিষয়। কবির একদমই অজ পাড়াগায়ের ছেলে। ওদের পুরো গ্রামে নাকি মোট তিনটা পাকা ল্যাট্রিন। এই পরিসংখ্যাণ দিয়ে বোঝা যায় একটা গ্রামের আসল অবস্থা। কবিরের কাছ থেকে গল্প শুনে গ্রামের আসল চিত্রটা দেখতে পাই। সেসব জায়গায় কেউ অসুস্থ হলে এখনও পীর-ফকিরের কাছে ছুটে পানি পড়া আনবার জন্য। মেয়েরা সব বোরখা ছাড়া বাইরে চলতে ফিরতে পারে না। মসজিদের ঈমাম সাহেব যদি বলেন জন্মনিয়ন্ত্রন করা যাবে না তো গ্রামের একাংশ কোন প্রতিবাদ ছাড়াই সে নির্দেশ মেনে নেবে। সন্তান সংখ্যা বেড়ে গেলে যখন আর তাদের প্রতিপালন করার সামর্থ থাকে না তখন সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেবে। আমি কবিরকে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে তুমি এরকম হলে কেন?’
‘এরকম বলতে ঠিক কিরকম বোঝাচ্ছ?’
‘এই যে ধর আমার সাথে যে খুব স্বাভাবিকভাবে মিশছ এটা কি সেরকম পরিবেশ থেকে আসা একটা ছেলের জন্য অস্বাভাবিকতা নয়? কাথাটা জিজ্ঞেস করছি এই কারণে আমি জানি তোমার মধ্যে কোন ভণিতা নেই।’
‘আসলে আমার আম্মা একদম অন্যরকম মহিলা। অনেক বই পড়েন। আমাদের ভাইবোনদেরকে দিয়ে স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে নিতেন। এভাবেই উনি কবিরাজী চিকিৎসা শিখেছেন। তিনি হচ্ছেন গ্রামের মহিলাদের একটা বড় রকমের ভরসার জায়গা। আমার আব্বাও আম্মাকে খুব সম্মান করেন। ছোটবেলায় তো মনে করতাম ছেলেদের থেকে মেয়েরাই বেশি ক্ষমতাশালী।’
‘আমিও আমার আম্মাকে দিয়ে বুঝেছি মেয়েরাও যে ছেলেদের মতো পূর্ণাঙ্গ মানুষ মায়েরাই পারে সে ভাবনাটা নিজের ছেলেদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে।’
‘হক কথা। মেয়েদের চাওয়া-পাওয়াগুলোও ছেলেদের মতো।’ 
‘এখন বুঝতে পারছি মা পদটি খুবই ক্ষমতাসম্পন্ন। কারণ একজন মা তার সন্তানের প্র্থম শিক্ষক।’
কবির আমার পৃথিবীর দিগন্তরেখা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আবীর, আমার জেঠাতো ভাই, আর কবির দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা। এই দেশের মধ্যে আবীররা সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়ে বড় হয়েছে আর কবিরকে গ্রামের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এগুতে হয়েছে। অথচ আবীরদের দেশের প্র্তি রয়েছে এক ধরণের উন্নাসিকতা। এই দেশকে তারা নিজেদের দেশ বলে ভাবতে পারে না। উল্টোদিকে কবির তার সীমিত সাধ্যের মধ্যেই চারপাশে আলো জ্বালাবার স্ব্প্ন দেখে। কবিরকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি এতো স্পিরিট পাও কিভাবে?’ 
কবির সরাসরি কোন উত্তর দেয় না। বলে যে জ্ঞানের জন্য অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য যা দরকার তাই করেছে। যেখানে যাওয়ার দরকার সেখানে গিয়েছে। ছোট্ট করে হেসে বলে, ‘বুঝলা এসবের জন্য চোখ কান খোলা রাখতে হয়।’
তখনই ওর কাছ থেকে জানতে পারি সায়ীদ স্যারের পাঠচক্রের কথা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। ঢাকা কলেজের বাংলার শিক্ষক। আমি অবশ্য উনাকে চিনি টেলিভিশনের উপস্থাপক হিসেবে। কবিরকে বললাম, ‘ জান, আমরা ছোটবেলায় উনার অনুষ্ঠানের অনুকরণে কবির লড়াই খেলতাম।’
‘তাই, স্যারকে গিয়ে বলতে হয়।’
‘স্যারের সাথে তোমার কথা হয়?’
‘পাঠচক্রে গেলে তোমার সাথেও স্যারের কথা হবে।’
‘আমার মনে হয় স্যারের পাঠচক্রের কথা আমি আগেও কোথাও শুনেছিলাম। ছোটবেলায় আমাদের বাসার পাশে খান মন্জিলে এরকম বই নিয়ে আলোচনা হতো। তখন শুনে থাকতে পারি।’
‘ও।’, এই একটা শব্দ উচ্চারণ করে কবির চুপ করে গেল। সে ইতিমধ্যে জেনে গেছে আমার একটা খুব আনন্দদায়ক শৈশব আছে। আমি মাঝে মধ্যে সেখানে ডুব দিয়ে কিছু মনি-মাণিক্য কুড়িয়ে আনি। এমনিতে আমার অতীত একটি রহস্যময় অধ্যায়। তাই সে নিজে কোন কিছু জিজ্ঞেস করে না। এ জন্যই কবিরকে আমার এতো ভালো লাগে।
আমি আপন মনে বলে গেলাম, ‘কী অদ্ভুত যোগাযোগ! গতকাল রাতেই ভাবছিলাম ইস আমাদের সময়ে যদি একজন সক্রেটিস থাকতেন! কতো কী জানতে ইচ্ছা করে, শুনতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এর জন্য কোথায় যাব?’ 
‘চল, আমার সাথে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিটিংএ। আজকেই একটা মিটিং আছে।’
‘চল।’, আমিও কিছু চিন্তা না করেই রাজী হয়ে গেলাম।
তখনও কিছু নোট করা বাকী ছিল। সে কাজগুলো শেষ করে আমরা উঠলাম। কবির লাইব্রেরি থেকে কতগুলো বই তুলবে। আমি বাইরে ব্যালকনিতে এসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই লাইব্রেরিটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি। সেসময় জায়গার অভাব ছিল না। তাই ব্রিটিশরা কোন কিছু বানাতে কোন কিপটেমী করেনি। এই ব্যালকনিটা বেশ প্রস্তত। লম্বা লম্বা পিলার ছাদ র্পযন্ত উঠে গেছে। আমি ব্যালকনি ছেড়ে সামনের খোলা যায়গাটায় নেমে এলাম। হঠাৎ করেই আমার সামনে একটা মোটর সাইকেল থামলো। যা ভেবেছিলাম তাই। আবার সেই ছেলেটা। একে বেশ কয়েকবার দেখেছি মটর সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করতে।  একবার তো মনে হচ্ছিল আমার পিছু নিয়েছে। তখন হলে ফিরছিলাম। আবার সেদিন মেলিতা আপার গাড়ি থেকে নামছিলাম তখনও দেখেছিলাম। রোকেয়া হলের সামনে। ছেলেটার চেহারাটা খুব পরিচিত। এখন হঠাৎ মনে পড়লো আমি একে প্রথম দেখি আমাদের ডিপার্মেন্টের করিডোরে। হাতে একটা পিস্তল নিয়ে ছুটোছুটি করছিল। সেসময়টা আমি আর কবির একটা ক্লাসের মধ্যে বেন্চের নীচে লুকিয়ে ছিলাম। পরে ক্লাস থেকে বেরুবার সময় এক পলক তাকিয়ে দেখেছিলাম চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের লাল ছিল। ছেলেটিও আমার দিকে তখন তাকিয়েছিল। সবসময়ই উদ্ধত ভাব। এখনও। শার্টের কলার উঁচু করা। উপরের দুটো বোতাম খোলা। জিন্সের প্যান্টের রংটা একটু চটে গেছে। প্যান্টটাও চোঙ্গা টাইপের। এটাই নাকি এখনকার ফ্যাশন। কায়দা করে একটা সিগারেট ধরালো। এই ছেলেটাকে দেখে প্রতিবারই আমার শফিকের কথা মনে হয়। কবিরের কাজ হয়ে গেছে। আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আর ঠিক সে মূহুর্তেই ইন্জিনে প্রচণ্ড শব্দ করে ছেলেটা মোটর বাইক চালিয়ে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিল। ভালোই তো। কবির এখানে একটা ব্যারিকেডের মতো ভূমিকা রাখলো। একটা ছেলে পাশে থাকার সুবিধা তো অনেক। কবির অবশ্য কিছুই বুঝলো না। ও কারও সাতে-পাঁচে নেই। রাজনীতি করে না। তবে আমাদের এই সময়টাতে ভার্সিটিতে পড়লে রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলা সম্ভব নয়। যে কোন মূহূর্তে এখানে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। ক্লাস বন্ধের ঘোষণা আসতে পারে। পত্রিকার পাতা জুড়ে হাসিনা-খালেদা-এরশাদ তিন সুপারস্টার চরিত্র। আশপাশের পরিচিতরাও এখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পরছে। শুনেছি একরামও নাকি একজন ছোটখাট ছাত্রনেতা। এই বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি মানেই তো হয় মার নয় মর। নয়তো ধর্মঘট ডেকে গেট বন্ধ করে দাও। ক্লাস বন্ধ। ব্যস আর কী? ছাত্রনেতারা মনে হয় এক একজন জহিরুল ইসলামের ছেলে। জহিরুল ইসলাম হচ্ছে এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়লোক। এরকম লোকের ছেলেদের টাকার কোন কমতি নাই। সেশন জট বাড়লে এদের কিছু এসে যায় না। পেছন থেকে জহিরুল ইসলাম টাকা যোগাবে। শুধু বারটা বাজে আমাদের মতো হলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের। এরকম হঠাৎ ছুটিছাটা হলে চিন্তায় পড়ি এখন আমি কোথায় গিয়ে থাকবো। কখনও ভাইয়ার কোয়ার্টার, ছোটমামার বাসা এমনকি বান্ধবী উর্মির বাসাতে গিয়েও থাকতে হয়েছে। একেবারেই ছিন্নমূলের মতো অবস্থা। রেফুউজি না হয়েও রেফুউজির জীবন আমার। মাসিমার, শিপ্রার মা, দুঃখটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। একাত্তরের সময় কলকাতার রেফুউজি জীবন আর যাই হোক কোনো সুখময় স্মৃতি হতে পারে না। আমার এখন একে তো জীবন ভাসমান, তার উপর আছে খরচের চিন্তা। একদিনের অতিরিক্ত খাওয়ার খরচ তো আর কম না!

১,৫৫৫ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “ঘরট্ট (সম্ভবত পাঁচ-ছয় পর্বের একাংশ)”

  1. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    ভাল লাগছে আপু। বরাবরের মতই। "স্বতঃসিদ্ধ" নিয়ে একটা কথা। যতদূর জানি, স্বতঃসিদ্ধ মানে যার কোন প্রমাণ দরকার নাই- যা নিজে নিজেই "সিদ্ধ" বা প্রমাণিত। 🙂

    জবাব দিন
  2. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    ভুলও হতে পারে, এই লেখা থেকে আমার মনে হল, স্বতঃসিদ্ধ সেগুলোই, যেগুলো প্রমাণ করা যায়। আর আমার জানামতে, স্বতঃসিদ্ধ(axiom) গুলো এতই স্বাভাবিক যে এর কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ করাও যায় না। যেমন- "১+১=২" একটা স্বতঃসিদ্ধ। আর স্বতঃসিদ্ধ থেকে শুরু করেই অন্যান্য সূত্র, অনুসিদ্ধান্ত ইত্যাদি প্রমাণ করা হয়। "রিয়েল ট্রুথ" স্বতঃসিদ্ধ কিছুও হতে পারে, আবার অন্য প্রমাণিত কিছুও হতে পারে।

    জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    "আর আমার জানামতে, স্বতঃসিদ্ধ(axiom) গুলো এতই স্বাভাবিক যে এর কোন প্রমাণের প্রয়োজন হয় না।" - ঠিকই তো। আমার তাহলে লেখাটা আবার পড়ে দেখতে হবে তোমার কেন এমন মনে হলো।
    "সত্য সুন্দর, সুন্দরই সত্য।" এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ। প্রমাণ করার উপায় নেই কিন্তু বাস্তব।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।