ধারাবাহিক উপন্যাস – ৬

এক দুই তিন চার এবং পাঁচ

(এই পর্বে আমি একটা গ্রাম আর সেখানকার যুদ্ধকালীন অবস্থা তুলে ধরেছি। সানা ভাইয়ের ‘স্মৃতির ঝাঁপি’র একটা পর্ব থেকে আমি সেই গ্রামের চিত্র পাই। তারপর উপন্যাসের মানুষগুলোকে সেই গ্রামটাতে নিয়ে যাই। সানা ভাইকে এখানে আর ফরম্যাল ধন্যবাদ দিলাম না)

ছয়

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ হিরণ ভাই জিজ্ঞেস করলো।
‘ম্যাজিক কারবার। পূব পাড়ায়।’ রাজা ভাই উত্তর দিল।
‘নাগারচিপা পাড়ায় যাওয়া যায় না?’ হিরণ ভাই বলল।
‘যাবেন? চলেন তাইলে। ম্যাজিক কারবার। আইজক্যা ওগোর ঢোলের বাড়ি শুনতে পারুম।’ কথাটা চটপট বলেই রাজা ভাই দিক পালটাল। পেছনে আমরা একদল ছেলে মেয়ে পথ প্রদর্শক রাজা ভাইয়ের পথ ধরলাম।
রাজা ভাইয়ের পেছন পেছন যাচ্ছে দাদামনু। সাথে হোসেন। আব্বার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। গ্রামে আমাদের দাদাবাড়িতে এখন ওরাই থাকে। গতবছর দাদী মারা যাওয়ার পর থেকে হোসেনের আব্বা মানে আবুল চাচা দাদাবাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করছেন। চাচা আবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং ইউপি মেম্বার। মেহের আর মাসুম বলে এ গ্রামেরই আরও দুটো ছেলে আমাদের দলে ভিড়ে গেছে। সবচেয়ে পেছনে আমি আর হিরণ ভাই। হোসেনের বোন কুলসুম আমার সাথে সাথে হাঁটছে।
রাজা ভাই হচ্ছে গ্রামের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে। আমাদের ছোটদের দলটার অলিখিত দলপতি। মূলত তার নেতৃত্বেই এখন আমরা পুরো গ্রাম চষে বেড়াচ্ছি। গাছে উঠে ফল পেড়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতা অবশ্য আগেও ছিল। এবারে পাখির বাসায় হানা দেয়া, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, ক্ষেতে মটরশুঁটি পুড়িয়ে খাওয়ার মতো নতুন অভিজ্ঞতা হল। এর মধ্যেই চিনে গেছি আলগা বাড়ি, পূব পাড়া, পশ্চিম পাড়া, বাজার, আলাদা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, ফুটবল মাঠ, শশ্মান ঘাট, মসজিদ, ঈদগার মতো জায়গাগুলো। দাদী বেঁচে থাকতে আগে যখন গ্রামে আসতাম তখন সারাক্ষণ আম্মার আঁচল ধরেই বসে থাকতাম। শুধু দাদামনু হোসেনের সাথে ঘোরাঘুরি করতো। আর এবার আমি নিজেও ডানপিটে দলের সাথে ভিড়ে গেলাম। বড়দের কোন শাসন নেই। আম্মা, হোসনা আপা আর চাচীরা রান্নাবান্নার তদারকিতে ব্যস্ত। হোসনা আপা কিছুটা জোর করেই রান্নার দলে ভিড়ে গেছেন। এ বাড়িতে তো এখন মানুষ কম নয়। তার উপর প্রতিদিন বৈঠকখানায় খান দাদার কাছে মানুষ আসছে। নানা বিষয়ে শলা পরামর্শ হচ্ছে।
এ গ্রামের নাম শাহপুর। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া্র মধ্যে। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া তখন মহকুমা, নবীনগর থানা। মানিকনগর লঞ্চঘাটে নেমে হাটা পথে ৭ মাইল, তারপর আমাদের গ্রাম শাহপুর। গ্রামটা নবীনগর থানায় হলেও মুরাদনগর থানার সীমান্তে। শাহপুর গ্রাম থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা ঢিল মারা দূরত্বে। ১২-১৪ মাইল। ইতিমধ্যে গ্রামের অনেক যুবক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে অনেক ছেলেই এ গ্রামের উপর দিয়ে আগরতলা যাচ্ছে। আমার অবশ্য ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ভুলে যেতে চাই যুদ্ধের কথা। গোছলখানার সেই বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা। বেঁচে গেছি এবং বেঁচে আছি এর থেকে আনন্দময় আর কি হতে পারে। গ্রামের এই খোলামেলা পরিবেশ, শাসনহীন ঘুরে বেড়ানো, হই-হুল্লোড়, পুকুরে দাপাদাপি, ধানক্ষেতের আইল ধরে দুরন্ত ছুটে চলা – সবকিছুর মধ্যেই অফুরন্ত আনন্দ। শিপ্রার কথাও আর মনে হয়না। কুলসুম, রাশু, সুফিয়া এরা এখন আমার নতুন বান্ধবী। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা রাজপুত্র এখন আমার বন্ধু। গ্রামে আমাদের এই ছোটদের দলটা কোথায় ঘুরতে গেলে দেখা যায় সবার আগে থাকে রাজা ভাই আর সবার পেছনে হিরণ ভাই আর আমি। আমি প্রশ্ন করতে পছন্দ করি আর উনি উত্তর দিতে পছন্দ করেন। হিরণ ভাই হয়ে গেছে আমার অলিখিত শিক্ষক।
এই যেমন এখন নাগারচিপা পারায় যাচ্ছি। কিন্তু কেন যাচ্ছি? এরাই বা কারা? হিরণ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম।
হিরণ ভাই উত্তর দিলো, ‘নাকারচিপা একটি বিশেষ সম্প্রদায়। এই এলাকার ঐতিহ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওরা হিন্দু, মুসলিম দুই ধর্মেরই আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। পেশায় ওরা মুচি। পাশাপাশি ওরা ঢোল বানায় আর বাজায়।’
‘কিভাবে জানলেন?’
‘দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীতে একটা বই আছে। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের সব আদিবাসী আর উপজাতি সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছু না কিছু উল্লেখ আছে। তুমি পাশে থাক অথচ দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীর খোঁজ জানতে না শুনে আমি খুব অবাক হয়েছি। কেউ বই পড়তে চাইলে দাদাভাই খুব খুশি হয়ে তাকে বই ধার দেয়।’
কিভাবে বলবো যে কেন আমার সে লাইব্রেরীতে যাওয়া হয়নি? এ যুদ্ধ যেমন স্বাভাবিক নয়, ঠিক তেমনি রাজা ভাই, দাদামনু আর হিরণ ভাইয়ের এ বন্ধুত্বও এক আকস্মিক ঘটনা। আমরা যে আসলে কতো গরীব সেটা জানতে পারলে হিরণ ভাই কি দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীতে আমাকে ঢুকতে দেবে?
‘মুক্তিযুদ্ধ কবে শেষ হবে?’
‘দেয়া ভয় নেই। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’ হিরণ ভাই আমার হাতটা তার মুঠির মধ্যে শক্ত করে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
নিজে যতই ঠিক আছে ভাব করিনা কেন আসলে মাঝে মাঝে আমাকে খুব ভয় পেয়ে বসে। গ্রামে আসার পর দু একবার ফিট হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সামনে কারো যুদ্ধের কথা বলা বারণ। ছেলেদের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা বারণ। হোসনা আপার কড়া নির্দেশ। আমি নিজেও জানি না হঠাৎ হঠাৎই কেন যে আমাকে খুব আতংকে পেয়ে বসে! হঠাৎ করেই সব কিছু ছাপিয়ে সেদিনের গোছলখানায় আটকে পড়ার স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে পালিয়ে আসার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা! এতোগুলো মানুষ একসাথে পালিয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! প্রথমে সবাই মিলে রওয়া দিয়েছিলাম খান দাদাদের মাইক্রো-বাস করে। একটা সময়ের পরে আর গাড়ি চলে না। রিকশায়, হাঁটাপথে চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই আমরা পাকিস্তানিদের তৈরি করা নরক ছেড়ে পালাচ্ছি। আর স্থানীয় লোকজন গ্লাস-জগ ভর্তি পানি নিয়ে, মুড়ি নিয়ে পথে পথে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তুদের সেবা করছেন। একদল অপরিচিত মানুষ কোন কারণ ছাড়াই বুকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরছে আর আরেকদল অপরিচিত মানুষ পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিচ্ছে। আব্বা মাঝে-মধ্যে কুমিল্লায় এসে অফিসে হাজিরা দিয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসতেন। শত্রু থেকে পালিয়ে বাঁচলেও তো অর্থের প্রয়োজন থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। তবে খান দাদা আমাদের খরচ করতে দিতে চাইতেন না। আম্মার আবার এসব দিক দিয়ে আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি। হাজার হোক উনারা তো আমাদের মেহমান। তবে হোসনা চাচী যখন চলে যাবার হুমকি দিতেন তখন আম্মা আর কিছু বলতেন না। সিএসপি চাচা লন্ডনে বসে দেশের পক্ষে জনমত গঠন করছে, ফান্ড যোগাড় করছে। আগরতলা আসা-যাওয়ার পথে অনেক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে সিএসপি চাচার সাথে খান দাদাদের যোগাযোগ হতো। চাচা কলকাতা চলে যেতে বলতেন। হোসনা চাচী সেখানে যাবার জন্য তেমন গা করতো না।
যে দুমাস খান দাদার পরিবার আমাদের সাথে গ্রামে ছিলেন তা এখনও আমার জীবনে অন্যতম সুখের স্মৃতি। হিরণ ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বটা আমার আর দাদামনুর তখনই খুব জমে উঠে। মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে যে আমাকে চমকে দিয়ে সরঙ্গা নৌকা বেয়ে হিরণ ভাই আর দাদামনু বিলের মধ্যে চলে গিয়েছিল। প্রতিবার গ্রামে আসলে আমরা এই নৌকায় চড়ি। এটা এই অঞ্চলে দ্রুতগতির বাহন হিসাবে পরিচিত। পাতলা, ছিপছিপে, লম্বা এই নৌকাগুলো বাইচের জন্য আদর্শ ছিল। রাজা ভাই নাকি ওদের শিখিয়েছিল কিভাবে নৌকা বাইতে হয়। বিলের মধ্যে গিয়ে একদম গলা খুলে গান গাইতাম। এ সময়টাতেই আমার গানের প্রতি প্রকৃত ভালবাসা জন্মে। রাত হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শোনার জন্য পাগল থাকতাম। দু-তিনবার শুনলেই এক একটা গান মুখস্থ হয়ে যেতো। কি সহজ কথায় লেখা! মাঝে মাঝে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আগের রাতে শোনা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান করতাম। মনে আছে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’
গানটি গাওয়ার সময় মনে হতো আমি এতো ছোট কেন। আরেকটু বড় হলে যুদ্ধে যেতে পারতাম। সব কয়টা পাকসেনাকে ধরে ধরে এই গান শুনিয়ে মানুষ বানিয়ে ফেলতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আরেকটি অনুষ্ঠান সবার খুব প্রিয় ছিল। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। এরকম একটা চরম পত্র শোনার পর থেকে রাজা ভাইয়ের কথায় কথায় ম্যাজিক কারবার বলার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে। রাজাভাই অবিকল নকল করে বলতে পারতো,”ম্যাজিক কারবার। ঢাকায় অখন ম্যাজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচ্কা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা—আ-আ-আ দম ফালাইতাছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। তোমরা কেডা? ও-অ-অ টাঙ্গাইল থাইক্যা আইছো বুঝি? কতজন ফেরত আইছো? অ্যাঃ ৭২ জন। কেতাবের মাইদে তো দেখতাছি লেখা রইছে টাঙ্গাইলে দেড় হাজার পোস্টিং আছিলো। ব্যস, ব্যস, আর কইতে হইব না—বুইজ্যা ফালাইছি। কাদেরিয়া বাহিনী বুঝি বাকিগুলার হেই কারবার কইর্যা ফালাইছে। এইডা কী? তোমরা মাত্র ১১০ জন কীর লাইগ্যা? তোমরা কতজন আছলা? খাড়াও খাড়াও—এই যে পাইছি। ভৈরব—১২৫০ জন। তা হইলে ১১৪০ জনের ইন্না লিল্লাহে ডট ডট ডট রাজিউন হইয়া গেছে। হউক, কোনো খেতি নাই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলারে বঙ্গাল মুলুকে আনা হইছিল। রংপুর-দিনাজপুর, বগড়া-পাবনা মানে কি না বড় গাংয়ের উত্তর মুড়ার মছুয়া মহারাজগো কোনো খবর নাইক্যা। হেই সব এলাকায় এক শতে এক শর কারবার হইছে। আজরাইল ফেরেশতা খালি কোম্পানির হিসাবে নাম লিখ্যা থুইছে।”
আমরা রাজাভাইয়ের চরমপত্র শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম।
শাহপুরে একদম বিদ্যুৎ ছিল না। জোছনা রাতে চাঁদের আলোর রূপালি ঝালরে গ্রামটা ঝিক মিক করে উঠত। বিশ্বাস হতে কষ্ট হত যে মাত্র দুবছর আগে এই মায়াবী চাঁদের গায়ে মানুষ পা রেখেছে। আমাদের কোরান শেখাতে যে হুজুর সাহেব তিনি আমেরিকার চন্দ্র অভিযানে মহাখুশী। একেকদিন এসে একেক গল্প বলতেন। নীল আমস্ট্রং নাকি চাঁদের মধ্যে ফাঁটল দাগ দেখে পৃথিবীতে এসে মুসলমান হয়ে গেছে। এ খবর শুনে আমরাও খুশি। ভাইয়া অবশ্য তা বিশ্বাস করেনি। ভাইয়াটা জানি কেমন!আম্মা এতো বকে তারপরও জুম্মার নামাজ পড়তেও যেতে চায় না। এ গ্রামের অমাবস্যাও সুন্দর। তখন আমরা ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকি পোকার পেছনে ছুটে বেড়াই।
একবার গ্রামে রব উঠলো এখানে মিলিটারি আসছে। তখন সবাই মিলে সরঙ্গা নৌকায় করে বিলের মধ্যে পালিয়ে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আর আসেনি। তবে আসলেও আসতে পারে। আগরতলা এখান থেকে ঢিল মারা দূরত্বে। হোসনা আপা সেখানে থাকা অবস্থায় আগরতলা থেকে দুবার কিরণ ভাই এখানে এসেছিলেন। উনি তখন পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধা। শীঘ্রই নাকি ঢাকাতে অপারেশন শুরু করবে। সেবারই প্রথম আমি কিরণ ভাইকে প্রথম দেখি। একেবারে সামনাসামনি। সাথে আরও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তারা আমাদের দাদাবাড়িতে খুব অল্পসময় ছিল। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আসলেই বাড়ির মহিলারা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আর আমরা ছোটরা হারিকেন বা কুপির আলোয় ভিড় করে তাদের দেখতাম, তাদের অস্ত্রগুলো হাত দিয়ে ধরতাম। রাইফেল, স্টেনগান থাকতো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কাঁধে। ইস্পাতের ঠাণ্ডা নলের স্পর্শ আমার গায়ের প্রতিটি লোমকূপে উত্তেজনা ছড়াতো। বাড়িটা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে উঠেছিল। আগরতলা যাওয়ার দলগুলো এখানে আশ্রয় নিত। আমি ভেবেছিলাম কিরণ ভাই চলে যাওয়ার সময় হোসনা আপা কাঁদবেন। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কাঁদল শেষে আম্মা। কিরণ ভাইদের সাথে ভাইয়াও যুদ্ধে চলে গেলেন।

আমরা এখানে আসার দুমাস পর জেঠা জেঠি তাদের তিনছেলেসহ এখানে পালিয়ে আসে। হোসনা আপা এর আগে কোলকাতায় যেতে রাজী না হলেও এবার চলে গেলেন। বোধহয় বুঝতে পারছিলেন যে দাদাবাড়িতে আর জায়গায় কুলচ্ছিল না। আমাদের ছোটদের দলটা হিরণ ভাইকে হারিয়ে বেশ অনেকদিন মন খারাপ করে বসেছিল। জেঠার সবচেয়ে বড় ছেলে আরিফ। এ বছর উনার আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল। যুদ্ধের জন্য বোধহয় যাওয়া হয়নি। মেজ ছেলে আমার ছয়মাসের বড়। ছোট ছেলে আমার দুই বছরের ছোট। খান দাদা আর জেঠার পরিবার অদল বদল হওয়াতে পরিবারে সদস্য সংখ্যা বাড়ল। আবার ওদিকে কাজ করার মানুষ কমলো। হোসনা আপার মতো জেঠি রান্নাঘরে আসতেন না। উলটো জেঠির খাবার উনার ঘরে দিয়ে আসতে হতো। এতে আম্মা আর আবুল চাচীর কাজ খুব বেড়ে যায়। আমার খেলার সময় কমে যায়। কারণ এসব খাবার আনা-নেওয়ার কাজ প্রায়ই আমাকে করতে হত। জেঠি আমাকে খুব আদর করে বলে উনার জন্য কিছু করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আরিফ ভাইয়ের খাওয়া নিয়ে যেতে একদম ভাল লাগতো না। বিশেষ করে আরিফ ভাই যখন ঘরে একা থাকতো। চকলেটের লোভ দেখিয়ে হাত ধরে টেনে পাশে বসায়। গান গাইতে বলে। আমার সাথে জানি কেমন কেমন করে। আগ বাড়িয়ে গায়ে হাত লাগায়। একদিন তো ঠোটে একটা লম্বা চুমু দিল। ভাবখানা এই যে ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে আদর করছে। কিন্তু আমি বুঝি এসব সব ভড়ং। কিন্তু কাকে বলবো এসব কথা? আর কিভাবে এসব কথা বলবো সেই ভাষাও তো আমি জানি না। শুধু মনে মনে ওনার উপর ঘৃণা জন্মাতে থাকে। দামড়া ছেলে ঘরে বসে বসে মজা করছে। যুদ্ধে যেতে পারে না? যুদ্ধ না যাক সবার সাথে বসে তো আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনতে পারে। মনে হয় তার এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। । নিজের অসহায়ত্ব সাথে করে বাড়ির উত্তর দিকে গোয়াল ঘরের পেছনে একটা তালগাছ আছে আমি শুধু সেখানে বসে হু হু করে কাঁদি। বুঝতে পারি না কেন আমার এতো দুঃখ, এতো কষ্ট, এতো কান্না।
তখন বর্ষাকাল শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবার সত্যি সত্যিই পাকবাহিনীরা কাছাকাছি তাদের ক্যাম্প স্থাপন করলো। ওরা মাঝে মধ্যে এ গ্রামে হানা দিতো। প্রায়ই তাদের আসার খবর শুনতে পেতাম। তখন সবাই মিলে গোয়াল ঘরে কিম্বা নৌকায় করে বিলের মধ্যে পালিয়ে থাকতাম। মৃত্যুভয়ে দৌড়ানোর কিরকম অনুভূতি হতে পারে তা তখন বুঝেছিলাম। একবার যখন রটে যেত পাকবাহিনী আসছে তখন কোথায় আম্মা, কোথায় দাদামনু কে তার কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না। পরি মরি করে যে যেখানে পারতাম সে সেখানে লুকিয়ে থাকতাম। অধিকাংশ সময় কুলসুম আমার সাথে থাকতো। একদিন কুলসুম বলল, ‘ম্যাইয়ালোকগো বেশি বিপদ। হেগোর বেশি সাবধানে থাকতে হয়।’
‘কেন?’আমি সরলভাবে প্রশ্ন করি। তখন পর্যন্ত নিজের পরিবারে ছেলেমেয়ের পার্থক্য তেমন বুঝি নাই।
‘পাকিস্তানীগুলা বাইছ্যা বাইছ্যা মাইয়ালোক ধইরা লইয়া যায়। তারপর হেগো ডেরায় ন্যাংটা কইর‍্যা রাইখ্যা দেয়।’ কুলসুম কথাটা খুব গোপনে বলে।
আমি অবশ্য সেকথা বিশ্বাস করিনি। শুধু শুধু মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে কেন? মেয়েরা তো আর যুদ্ধ করে না। পরে অবশ্য অনেক মূল্য দিয়ে বুঝেছিলাম কুলসুমকে অবিশ্বাস করে আমি একটা খুব বড় রকমের ভুল করে ফেলেছি। তার শাস্তিও আমাকে পেতে হয়েছিল।
একদিন পাকবাহিনী আসার খবর আসে। তখন আমি আরিফ ভাইয়ের কাছে উনার খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে উনি দৌড়ে গোয়ালঘরে চলে গেল। সেখানে খরের গাদায় লুকিয়ে থাকলাম। দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে এক সময় ঘুমিয়েও গেলাম। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কে জানি আমার জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বুকের উপর হাতড়ে বেড়াচ্ছে। উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি আরিফ ভাই। আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকাই। গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছিল না। অথচ আরিফ ভাই খুব স্বাভাবিকভাবে আমাকে বলে উঠে, ‘দেয়া চকলেট খাবে? আমার কাছে অনেক মজার মজার চকলেট আছে।’ ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি। আমার মনের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটা বোধহয় সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। সেইসাথে প্রচণ্ড ঘৃণা। নিজের দেহের উপর। সব মিলিয়ে আমি বাক-শক্তিহীন, চলৎশক্তি-হীন। উঠে ছুটে যেতে আড়ষ্ট বোধ হচ্ছে। শুধু উলটো ঘুরতে পারলাম। আম্মাকে এ কথা বলতে পারিনি। কিভাবে বলব? এ এমন এক অভিজ্ঞতা যা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। সারাক্ষণ নিজেকে নিজের কাছে অপরিচ্ছন্ন লাগা আর আরিফ ভাইকে দেখে হিম হয়ে যাওয়া।

অবশেষে বুঝতে পারলাম কেন পাকিস্তানীরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। মানুষকে চাইলে অনেক ভাবেই মেরে ফেলা যায়। ছেলেদেরকে মেরে ফেলতে খরচ হয় একটা বুলেট। আর কোনরকম বুলেট-বেয়নেট ছাড়াই মেয়েদের জীবন্ত দেহে খুব সহজেই একে দেওয়া যায় মৃত্যু-ক্ষত।

(চলবে)

১,৬৪০ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “ধারাবাহিক উপন্যাস – ৬”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।