৬
আচ্ছা আপনি কেন সাহিত্য পছন্দ করেন?
নাটক-সিনেমার প্রতিই বা আপনার এতো আগ্রহ কেন?
গান শুনেন কেন? কেন ফটোগ্রাফী, পেইন্টিংএর উপর আকর্ষন বোধ করেন?
উপরের প্রশ্নগুলো নারী, পুরুষ নির্দ্বিধায় কাউকে করলে প্রথমত তারা ঘাবড়ে যাবে। উত্তর পেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হবে – ভালো লাগে, তাই। এই উত্তরটাই অনেকে নানান মোড়কে উপস্থাপন করবে। কেউ কেউ হয়তো নিজের ভেতর আরেকটু গভীরে অবগাহন করে বেশ উচ্চমাত্রার একটা উত্তর দিবে। আমি নিজেও অনেকদিন ধরে এর উত্তরটা খুঁজে বেড়িয়েছি। কিন্তু ঠিক যুৎসই ভাষায় প্রকাশ করার জন্য শব্দ বা বাক্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না যেটা দিয়ে সত্যিকার অর্থেই নিজের ভেতরের কথাগুলো প্রকাশ করতে পারি। একদিন হাতের কাছে মোতাহার হোসেনের ‘সংস্কৃত কথা’ বলে একটা বই পেলাম। সে বইয়ের একটা বাক্য মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে। মনে হলো এই বাক্যটি আমার অনেক না প্রকাশ করা কথা বলে দিচ্ছে। বাক্যটি হলো, ‘ধর্ম মানুষকে পাপ-পতন থেকে রক্ষা করে আর সংস্কৃতি বিকাশে সাহায্য করে।’
শিল্পসাহিত্য তো সংস্কৃতির ব্যবহারিক অবয়ব। শিল্পসাহিত্য দর্শনকে ধারণ করে, একটি জাতির চরিত্র নিরুপনে সাহায্য করে। আমাদের দেশের নাটকে যৌথ পরিবার দেখতে পারবো। এখানে বিয়ের অনুষ্ঠানের চিত্রায়ন মানে শুধু দুটো ছেলে মেয়ের বিয়ে নয় বরং দুটো পরিবারের বিয়ে। অর্থাৎ শিল্পসাহিত্য হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক পাঠ। কেন বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্থান থেকে আলাদা সেটা ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দিয়েই আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি। একটা মানুষের ভেতরে তার নিজস্ব সংস্কৃতির শেকড় যতো গভীর হবে, ততই তার উপরের দিকে বিকাশের সম্ভাবনা থাকবে। বিকাশ বলতে সৃষ্টিশীলতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করা। ডিজুসামীর প্রতি আমাদের ঘৃণা নেই, আছে আশংকা। কারণ ডিজুস একটি ভাসমান প্রজাতি। খানিকটা বুদবুদের মতো। ডিজুস বলছি তাদের যারা নিজ সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে, অন্যের সংস্কৃতির ধারক হয়ে নিজেকে সপ্রতিভ প্রমান করার চেষ্ঠা করে। শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ কিম্বা ক্যাটরিনা কাইফের ‘শীলা কী জওয়ানী’ শুনে ভাল লাগার মধ্যে কোন খারাপ কিছু নেই। সুর, সৌন্দর্য, সাহিত্য, ছন্দের সার্থকতা তো সার্বজনীনতাকে স্পর্শ করার মাধ্যমে। সেই সাথে এটাও ঠিক যে মমতাজের ‘নান্টু ঘটক’ আমাদের প্রতিনিধি। শেকড়ের কাছাকাছি। হতে পারে আমি নাগরিক মানুষ, কিন্তু আমাকে মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে শহরের বাইরেও একটা বিশাল গ্রামাঞ্ছল আছে। এই মমতাজরাই কিন্তু তাদের শিল্পসাহিত্যের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। একজন মমতাজের সাংস্কৃতিক গভীরতা কিন্তু ভারতীয় শাড়ি পরিহিতা রুনা লায়লার থেকে অনেক গভীর। একজন মমতাজকেই দেখা যায় তার এলাকায় চক্ষু হাসপাতাল দিতে এবং নানারকম সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত থাকতে। নানাভাবেই উনি প্রমান করেছেন এসব কাজ লোক দেখানো নয়। যদিও আমাদের নাগরিক কান রুনা লায়লার ‘থমথম মেঘে’ থ মেরে যায় আর চোখ ঝলসে যায় তার পরিহিত ভারতীয় শাড়ির জৌলুসে। অনুষ্ঠান শেষে আমরা মহিলারা স্বামীর সাথে ঝগড়া করে টাকা আদায় করে ছুটে যাই গুলসানের ভাসাবী, পিং সিটি, শপার্স ওয়াল্ড কিম্বা জারাতে। রুনা লায়লা নিঃসন্দেহে অসম্ভব প্রতিভাবান গায়িকা। উনার মতো বিখ্যাতদের ফ্যাশন মহিলাশ্রেণি অনুকরণ করে থাকেন। দেশের স্বার্থেই প্রতিভাবানরা দেশীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করবেন এতটুকু তো আশা করতে পারি। উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে তৈরী একটা জামদানী শাড়ি বিক্রি হলে একজন তাতীর এক সপ্তাহের অন্ন সংস্থান হয়।
৭
আগেই উল্লেখ করেছি নারীর চোখ দিয়ে আমি শিল্পসাহিত্যকে বিশ্লেষন করছি এর মূল কারণ আমি নারী বলে। এই বিশ্লেষন হচ্ছে এক ধরনের ময়নাতদন্ত। কী কর্মজীবি কী সংসারজীবি – কেন আমার স্বজাতি অগভীর হিন্দি সিরিয়ালের আসক্ত হচ্ছে, কেন তারা পাঠক হবার থেকে কম কষ্টের দর্শক হতে চাচ্ছে?
এইসব কেনর উত্তর জানাটা সবার জন্যই খুব জরুরী। কারণে সখি যদি সুখী হতে না পারে তবে সখাও সুখে থাকতে পারে না। আর সুখের সন্ধানেই আমাদের জীবনের গভীরে পৌছাতে হবে। গভীর জীবনবোধ নিজেকে জানতে সাহায্য করে। নিজেকে জানতে পারলে নিজেকে বিকশিত করা যায়। নিজের মতো করে নিজেকে সাজানো যায়। আর সেই সাজানো সত্ত্বার আরেক নাম সুখবোধ।
অর্থবিত্তের প্রয়োজন আছে। কেউ তা অস্বীকার করতে পারবে না। সেই প্রয়োজন একটা পর্যায় পর্যন্ত। যে যার মতো করে সে পর্যায়ের সীমা নির্ধারণ করবে। এবার দেশে মহাজাতকের চারদিনের মেডিটেশন কোর্সে অংশগ্রহন করেছিলাম। শেষদিন অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে থেকে কয়েকজন বক্তব্য রাখলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত। গান শেখান, গান গান। উনার স্ত্রী একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। সেই ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলছিলেন ঢাকা শহরের বাড়িভাড়া নিয়ে। ঢাকা শহরে বাড়িওয়ালা লাগামহীনভাবে ভাড়া বাড়াচ্ছেন। এতে তাকেও ছাত্রদের কাছ থেকে বেশি পয়সা নিতে হচ্ছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। সে রাতে এক বাসায় দাওয়াতে গেলাম। অতিথীরা সবাই বাড়িওয়ালা শ্রেণিও। তাদেরকে ঘটনাটা বললাম। এতে একজন জানাল যে (ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে)সেই শিল্পী ভদ্রলোককে প্রতিমাসে বাড়িভাড়া থেকেও মদের পেছনে বেশি পয়সা ঢালতে হয়। আবার এক শ্রেণি আছে লোভের বশবর্তী হয়ে ষ্টক মার্কেটে সব সঞ্চয় ঢেলে দিচ্ছে। যে কথাটা আমি এখানে বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত চরিত্রের উপরে। বাংলাদেশের গাড়িচালকদের মতো অনেকেই তাদের জীবন চালাচ্ছে। নির্বিচল যোগাযোগমন্ত্রি আবুল হোসেনকে আমরা সরাতে না পারলাম, নিজেরা তো কাপরের মাপ বুঝে জামা বানাতে পারি। এবং সেটা করছি না বলে আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকরা শুধু টাকার জন্য লিখছেন, গান করছেন, নাটক বানাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁরা নিজেরাই অস্থির। এইসব অস্থির মন বাংলাদেশে শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রটাকে হালকা করে ফেলছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মানুষেরা আজ সমকালীন শিল্প-সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা দোষ দিচ্ছি আমজনতার।
কথা হচ্ছে শিল্পী-সাহিত্যিকরা কি তবে টাকার কথা ভাববে না? তাদেরও তো খেতে হয়। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কথায় আসা যাক। বই বেচে জীবনে কয় টাকা উনি পেয়েছেন? নাকি কখনও বই বেচার টাকায় সংসার চালিয়েছেন? এমনকি উনার নোবেল পুরষ্কারের পুরো টাকাটাই মার গিয়েছিল ব্যাংক দেউলিয়া হওয়াতে। সম্পন্ন পরিবারের সন্তান বলে রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ দেওয়া যাবে না? আমাদের দেশেও তো হাজার হাজার সম্পন্ন পরিবার আছে। সেখান থেকে কেন হাতে গোনা একজন দুজন তাহমিনা আনাম (মাহফুজ আনামের মেয়ে, এ পর্যন্ত দুটো ইংরেজী বই লিখে ফেলেছে)বেরুবে? আর সব কি করছে? অধিকাংশ উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারা দেশের সবচেয়ে বড় বেশি বেকার। এদেরকে সমাজসেবার কথা বললে হু হ্যা করে পিছিয়ে যায়। আসলে নিজের ভেতর অপূর্ণতা থাকলে মন খুলে অন্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় না। টাকাপয়সার অভাব তো এদের নেই, তাহলে কিসের অভাব? সেখানেই আবার শিল্পসাহিত্যের প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে আসে। আমরা সাহিত্য থেকে দর্শন নিই। সে দর্শন আমাদের অন্তরের হাহাকার পূর্ণ করে। সাহিত্যের দর্পনে নিজেকে দেখতে চাই। আমার না বলা কথা যখন আরেকজন বলে দেয়, আমার কষ্ট যখন আরেকজনকে বয়ে চলতে দেখি তখন নিজের একাকিত্বের হাহাকার অনেকটাই লাঘব হয়ে যায়। আমাদের আগের প্রজন্ম অনেক ভাগ্যবান যে তারা অনেক জীবন ঘনিষ্ট সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে পেরেছিলেন। মহিলারা কিন্তু পড়তে চায়। পড়ার মতো বই না পেয়ে তারা এখন ধর্মগ্রন্থ পড়ছে। আমাদের দেশে ভাল ধর্মগ্রন্থেরও যথেষ্ট অভাব আছে। এক্ষেত্রটাতেও আমাদের দেলওয়ার হোসেন সাঈদী ধরনের লেখকদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমার এক বান্ধবী সে তার গ্রামে একটা মাদ্রাসা দিতে চাচ্ছে। আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম যে আগে যখন প্রযুক্তি ছিল না তখন মুখে মুখে কোরান শরীফ মুখস্ত রাখার দরকার পড়তো। কিন্তু এখন তো প্রযুক্তি আছে। কেউ ইমাম হতে চাইলে সে স্বেচ্ছায় কোরান শরীফ মুখস্ত করবে ঠিক যেমনি ডাক্তারি শিখে ডাক্তার হওয়া। এখন পর্যন্ত তো মাদ্রাসা থেকে তেমন একটা প্রোডাকটিভ সিটিজেন (আনুপাতিক হারে)বের হতে দেখা যায়নি। তাহলে সে কেন নিয়মিত স্কুল না দিয়ে মাদ্রাসা দিচ্ছে? এর কোন সদুত্তর সে দিতে পারেনি। তবে এক পর্যায়ে সে স্বীকার করলো যে ধর্মের উপর তার লেখাপড়াটা কম। তাই সে গতানুগতিক পথেই এগুতে চাইছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা। চেনা পথে হাঁটতে সবাই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শিল্পসাহিত্যিকরা পাঠকদের সামনে এরকম অনেক চেনা পথের সন্ধান দেবেন, সাহস দেবেন, স্বপ্ন দেখাবেন। কিন্তু আমাদের দেশে সে মানের সাহিত্যিক আসছে কই? লেখার মধ্যেই তো অফুরন্ত আনন্দ। আমি বিশ্বাস করি একজন ভাল লেখক পাঠকের কাছে আসতে পারেন। লেখকদের দরকার ধৈর্য, মানসিক স্থিরতা, গভীর জীবনবোধ। তারা যদি শুরুতেই বাড়িভাড়া, দ্রব্যমূল্য, বাচ্চার স্কুলের বেতনের মাপে মাপে লিখতে চান তাহলে তাদের কাছ থেকে ভাল কিছু আসবে কি করে?
প্রতিভা থাকলে অভাবের মধ্যে থেকেও লেখা যায়। এ ক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’ একটা ভাল রেফারেন্স হতে পারে।
৮
আমার দেখা মহিলাদের দুজন পছন্দের লেখক শরৎচন্দ্র আর মানিক বন্দোপাধ্যায়। কেন পছন্দ সেই বিশ্লেষণে যাব না। সমালোচকরা কাকে কালজয়ী লেখক বলছেন, কাকে বলছেন না সে বিশ্লেষণেও যাবার প্রয়োজন বোধ করছি না। আমাদের বুঝতে হবে কেন এসব লেখকরা মহিলাদের কাছাকাছি আসতে পেরেছেন। প্রথমেই বলব তাদের জীবনঘনিষ্ঠ লেখার কথা। বই হচ্ছে মহিলাদের জন্য একই সাথে জানালা, বিদ্যালয়, দর্পন, মনোচিকিসৎক এবং সাথী। একটি বইয়ের মাধ্যমে তারা বাইরের পৃথিবী দেখতে চায়, কি করা উচিত আর কি নয় এরকম দর্শন পেতে চায়, নিজের চেহারা দেখতে চায়, তার দুঃখকে ভুলিয়ে দেবে এমন কিছু কথা শুনতে চায় এবং একাকীত্বকে ঘুচিয়ে দেবে। আমার মনে হয় এদিক থেকে একজন পুরুষ আর নারীর দৃষ্টিভংগীর পার্থক্য রয়েছে। আমার মনে হয়েছে পুরুষের যখন সাহিত্যকে বিচার করে তখন তারা ভাষা আর ভাবের অভিনবত্ব এবং বৈচিত্রময় বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেয়। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশার খুব একটা সুযোগ নেই। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নারীর সাথে প্রেম করা যাবে,বন্ধু হওয়া যাবে কিন্তু আটপৌরে নারীর দৈনন্দিন সমস্যা বোঝা যাবে না। দেশের কোন একটা সাহিত্য আড্ডায় কয়জন নারীকে পাওয়া যাবে? যে নারী এই বাঁধা ডিঙ্গিয়ে সেখানে পৌছচ্ছে সে পুরুষদের প্রশংসা পাচ্ছে তার সাহসিকতার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে সে নারী নিজেকেই আর অন্য নারীদের সমতুল্য ভাবতে চায় না। আবার সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং সমালোচক এই দুটি ক্ষেত্রই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার জন্য সে নারী তখন পুরুষের প্রশংসাধন্য সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়। সে সাহিত্য মধ্যবয়সী নারীদেরকে কিছুটা অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। সে নারী হয়তো এমন কোন সাহিত্য পড়তে চাইছে যেখানে সে তাকে খুঁজে পাবে। আবার অল্পবয়সী নারীদের চিন্তাভাবনা সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। মনে আছে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল ছেলেরা ভাই, বাবা, বন্ধু হিসেবে খুবই ভাল। যেই তারা প্রেমিক বা স্বামী হয় অমনি এক একজন রাক্ষস-খোক্ষস ধরনের কিছু একটা হয়ে যায়। সাহিত্য আমাকে ছেলেদের বুঝতে সাহায্য করেনি। বাস্তব নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে এই বিষয়টা বুঝতে সাহায্য করেছিল।
এমনিতে আমাদের দেশে নারী বিষয়ক লেখাগুলো খুব জনপ্রিয়তা পায়। জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে যতনা নারীর প্রতি সহমর্মিতা তার থেকে বেশি কৌতুহল। নারীর শরীরে কি আছে, কে কিভাবে কোথায় তাকে ছুঁয়েছে, কার সাথে শুয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার নারীর সমস্যা তুলে ধরা লেখা গুলো ভদ্রলোকদের আরো ভদ্র করেছে কিন্তু বিবেকহীনদের বিবেক জাগাতে পারছে না। রুমানা মঞ্জুরের পক্ষে-বিপক্ষের তর্ক দেখে এমন ধারণা হয়েছে। একজন বিখ্যাত প্রকাশকের সাথে বই ছাপার ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন ‘আপনার আত্মজীবনী হলে ছাপবো।’ আমি উনাকে বললাম,’দেখেন আমার আত্মজীবনীতে কোন ড়গড়গে ব্যাপার থাকবে না। কিন্তু ঘটনার প্রয়োজনে উপন্যাসে আছে। কোনটা চান?’ভদ্রলোক আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ করেননি।
সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে এতো লোক লিখছে কিন্তু সেই তুলনায় প্রতিষ্ঠিত উপন্যাসিকদের সংখ্যা কম। এর একটা প্রধান কারণ তারা নারী পাঠকদের আকর্ষন করতে পারছে না। আমেরিকায় বলা হয় যেদিন মহিলারা বই পড়া বন্ধ দেবে সেদিন আর কোন উপন্যাস বের হবে না। শিশু সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য, দর্শনের মতো মহিলা সাহিত্যও যে সাহিত্যর ক্ষেত্রে একটা আলাদা শাখা বা জেনরি এই সহজ সরল সত্যটা স্বীকার করে নিলে সাথে সাথেই আমি হয়ে যাব সদ্য রুপগঞ্জ থেকে আসা সখিনা কিম্বা ‘বেগম’ পত্রিকার একনিষ্ঠ পাঠক। আমাদের দেশের লোকজনের এই উন্নাসিক চিন্তাভাবনার জন্যই আজ সেই ‘বেগমের’ জায়গায় ‘সানন্দা’ কিম্বা হিন্দি সিরিয়াল দখল করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেই মহিলা সাহিত্য সাহিত্যের একটি স্বীকৃত শাখা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই জেনরির পাঠক হতে পারে। ঠিক যেমন খেলাধূলা মেয়েরাও দেখে। একটা ইংরেজী ব্লগে দেখেছিলাম যে একজন লিখেছে ছেলেরা নন-ফিকশন পছন্দ করে আর মেয়েরা ফিকশন পছন্দ করে। এর বিরুদ্ধে ছেলেদের সরব প্রতিবাদ এসেছিলো। তাদের কথা হলো এই যে একজন পাঠক শব্দ আর ভাষা পড়তে ভালবাসে সেটা ফিকশনই হোক বা নন-ফিকশনই হোক। আবার এক জায়গায় দেখলাম যে মেয়েরা খুব একটা ইতিহাস আর জীবনী পড়ে না। অথচ আমার কাছে এই দুই শাখাই খুব পছন্দের। আসলে পাঠক হিসেবে ছেলে-মেয়ের মধ্যে তেমন বিভেদ নেই। আজকাল তো বাচ্চাপালনের সময় সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য শিশু বিশেষজ্ঞরা ছেলে শিশুদেরকে গোলাপী রংয়ের মেয়েদের খেলনা দিতে বলে।
৮
আমাদের দেশের মহিলারা কেন হিন্দি সিরিয়ালে আটকে থাকে? বাচ্চারা কেন কার্টুন দেখতে চায়? ছেলেদের ক্রিকেট, ফুটবল বা যে কোন খেলার অনুষ্ঠান কেন ধরে রাখে? বিনোদিত হওয়া মানে আমাদের স্নায়ুকে আমরা কিছুক্ষনের জন্য উত্তেজিত করতে চাই। খেলাধূলা আর কার্টুনে উত্তেজিত হওয়ার অনেক উপকরণ আছে। দর্শক আটকে রাখার জন্য হিন্দি সিরিয়াল নিয়েও প্রচুর গবেষণা করা হয়। তাহলে লেখকদের কাছে পাঠককে আকৃষ্ট করার মতো লেখা চাইতে গেলে তা একটা হালকা প্রশ্ন হয়ে যাবে?
অথচ আমরা কিন্তু ঠিকই শিশু পাঠকদের কথা ভেবে উপন্যাস লিখছি, কিশোরদের কথা ভেবে উপন্যাস লিখছি। অন্যদিকে হিন্দি সিরিয়াল দেখার জন্য মহিলাদের ধিক্কার দেওয়া হবে কিন্তু তাদের কথা ভেবে কোন উপন্যাস লেখা হবে না।
বাজারে অনেক উপন্যাস বের হচ্ছে। এ বছর বইমেলাতেই নাকি কয়েকশ উপন্যাস বেড়িয়েছে। অর্থাৎ লিখতে চায় কিম্বা লেখক হতে চায় এমন লোকের অভাব আমাদের দেশে নেই। কিন্তু একটা দুটো বই লিখেই এদের লেখক হবার উৎসাহতে ভাটা পড়ে যায়। ব্লগের প্রেক্ষাপটেও আমরা দেখছি ধূমকেতুর মতো একেকজন ব্লগার আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। ব্লগটা না হয় ধরলাম একটা এ্যমেচারদের জায়গা। আবার এটাও ঠিক ব্লগ অনেক লেখক তৈরী করছে। আসলে ব্লগটা হচ্ছে এখন লেখালেখির মঞ্চ নাটকের মতো। অভিনেতাদের মতো ব্লগাররাও হাততালির মোহে জড়িয়ে যায়। এই হাততালির মোহেই গ্রোয়িং ফেজে একজন লেখক কিন্তু তার সবচেয়ে ভালো লেখাটা লিখতে চায়। যদিও শেষ পর্যন্ত লেখাটা তার ক্ষমতানুযায়ীই বের হয়ে আসবে।
আমাদের দেশের মহিলাদের অনেক আন্ডারস্টিমেট করা হয়। বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে এক মহিলার সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, সস্তাকিছু দেখতে চায় বলেই আমাদের দেশের মহিলারা ভারতীয় চ্যানেল দেখে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি যে মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জিটিভির’সুবর্ণলতা’ নাটকটি। সেই মহিলাকে বললাম, আশাপূর্ণা দেবীর লেখা তো সস্তা কিছু হতে পারে না। আমাদের দেশের কোন টিভি নাটক সুবর্ণলতার মতো স্ত্রিপ্টে হচ্ছে। মহিলা তার পয়েন্ট থেকে সরে আসলেন না। উলটো বললেন যে উনি বার বছর ধরে টিভিতে কাজ করছেন। উনির অভিজ্ঞতা আছে। মহিলার সাথে কথা বলে আমি যে ব্যাপারটা বুঝলাম সেটা হলো এদেশে মানুষ তার বলয়ের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। কোলকাতায় সুবর্ণলতার কাছাকাছি অসংখ্য সাহিত্য রয়েছে। আমাদের দেশে এরকম মানের সাহিত্যের কয়টি উদাহরণ দেওয়া যাবে? যেখানে আমাদের সাহিত্য উন্নত নয় সেখানে আমরা কোন অহংকারে দাবী করতে পারি যে আমাদের টিভি নাটকের স্ক্রিপ্ট ভাল?
৯
এ প্রসঙ্গে গতকাল সানা ভাইয়ের ‘প্রথমা’ প্রকাশনী বিষয়ক কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি। আমি সরাসরি উনার মন্তব্যটি তুলে দিচ্ছি আমাদের প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা বোঝার জন্য।
“বইয়ের বাজারের খবর পেলাম কয়েকদিন আগে “প্রথমা”র কাছ থেকে। কবিতার বই এমনকি বড় লেখকদেরও ৩০০ কপি শেষ হতে বছরের বেশি লেগে যায়। হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবাল ছাড়া বাকিদের গল্প-উপন্যাসের বিক্রি কবিতার চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে উৎসাহব্যঞ্জক নয়। প্রবন্ধের বই, বিশেষ করে রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভালোই চলে। ২/৩ হাজারও বিক্রি হয় বছরে।
পড়ার অভ্যাস কি উঠে যাচ্ছে দেশ থেকে?
”
এই প্রশ্নের উত্তর কি? আমার নিজের উত্তর হলো পাঠকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী লেখক বাজারে কম। তাই বই বিক্রি হচ্ছে না। ঠিক একই কারণে বাংলা ছবিও মুখ থুবড়ে পরছে। এবার আমি অবাক হয়ে দেখলাম এক সময়ে বাংলার ব্যাপারে উন্নাসিক মহিলারাও আমাকে বলছে ‘মনের মানুষ’ ছবিটি দেখার কথা। অনেকে একাধিকবার দেখেছে। সমালোচকরা কি বলবে জানিনা কিন্তু শহুরে নাগরিক মহিলারা এই ছবি খুব পছন্দ করেছে। তারা সুবর্ণলতাও দেখছে। ইংরেজীতে লেখা লেটেস্ট ভাল ফিকশনগুলো পড়ছে। তারা অনেক পড়তে চাচ্ছে। মেয়েরা স্বভাবতই বই পড়ুয়া। ষোল কোটি জনসংখ্যার দেশে সেই অনুপাতে লেখক কয়জন? উপরে বর্ণিত কেন্দ্রের সেই মহিলার মতো লেখক-সমালোচক সার্কেল নিজেদের উঠাচ্ছে, নামাচ্ছে – শুধু বই বিক্রি বাড়াতে পারছেন না। ঠিক এই জায়গাতেই হুমায়ূন আহমেদ প্রসংগ চলে আসে। ভাগ্য ভাল এইবার উনার সাথে দেখা হয়েছে, এইসব বিষয় নিয়ে কথাও হয়েছে। তবে এখন সে প্রসংগে যাব না। যেটা বলতে চাচ্ছি যে হুমায়ূন আহমেদের আগের সময়টাতে কি ছিল? তখন কারও বইই চলতো না। তবে একজন হুমায়ূন আহমেদ বা একজন জাফর ইকবালকে কি আমরা আসমানী লেখক হিসেবে ধরে নিব?
প্রশ্নটা পাঠকের কাছে রেখে লেখাটা এখানে শেষ করছি। আসুন আমরা সবাই মিলে হুমায়ূন আহমেদের জন্য কিছুক্ষণ অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উনার সুস্থতার জন্য শুভ কামনা জানাই।
(চলবে)
ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ তা্নভীর।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
খুব সুন্দর একটা লিখা আপু 🙂
খুব ভালো লাগলো 🙂
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
এখানে নারীদের রুচি, পছন্দ বা মননের স্বাতন্ত্রকে যেমন সাবলীলভাবে তুলে আনা হয়েছে, তাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ অনেক নারীবাদী লেখকই বিষয়টিকে প্রায় স্বীকারই করতে চান না। আর এই বিষয়টা ছাড়াও লেখা ভাল লেগেছে।
আমাদের দেশ অনেক কিছুতেই পিছিয়ে আছে। এই নারীবাদীত্ব হচ্ছে আরেকটা দিক। তবে এটাও ঠিক উনাদের কারণে সমাজে এখনও কিছু কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পুরুষেরা ভাল অবস্থায় পৌছলে তবে তারা নারীকে তুলে আনে। তাই একই সাথে নারী-পুরুষ এই দুই প্রজাতির উন্নতি আশা করি।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
লেখা ভাল লেগেছে আপু...
আশা করি হুমায়ূন আহমেদ শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ। আমরা সবাই তা আশা করছি।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
পোস্ট টা মনযোগ দিয়ে পড়লাম।
মনে হয় কিছু দ্বিমতের জায়গা আছে। তবে সেগুলো গুছিয়ে বলার আগে আড়ো কয়েকবার ভাবতে হবে।
আপাতত পড়ে গেছি তা জানিয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ আমিন সময় করে পড়ার জন্য। লেখাটার প্রথম অংশ অনেক আগে লিখেছিলাম। দ্বিতীয় অংশ একটানে লিখে আর পড়া হয়নি। পরে পড়ে মনে হলো অনেক জায়গায় ভাব প্রকাশ একটু কঠিন হয়ে গেছে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
অনেক দেরীতে হলেও লেখাটা পড়লাম, আর, দ্বিমত করার কোন জায়গা পেলাম না। এই ব্যাপারটা বোধহয় সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য, শুধু টিভি কিম্বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে না। কদিন আগে একটা ছেলে লেখা লিখেছিল, ভুলে গেছি কে, বাংলাদেশী চিপ্স, ভারতীয় চিপ্স...আমরা এখনও দেশী পণ্য আঁকড়ে ধরে আছি, কিন্তু আর কতদিন এই দেশপ্রেম দেখাতে পারব জানিনা। টিভির খেত্রেও তাই, দেশপ্রেম জনিত কারণে অনেক মানুষই টিভি দেখাই বাদ দিয়েছেন।
আর হিন্দী সিরিয়াল মেয়েদের ব্র্যান্ড হিসেবে আমরা চালিয়ে দেই, কিন্তু আমার কাছেই উদাহরণ আছে বাসার কর্তাগণ হিন্দী সিনেমা/কোলকাতার সিরিয়াল না দেখে ভাত খেতে পারেন না। ফিস কাট শর্ট করেন, একটা সিরিয়ালের সময় পেরিয়ে যাবে। আগেও বলে এসেছি, এখনও বলতে চাই, এটা আসলে মেয়ে/ছেলে কোন ব্যাপার না, মানসিকতার ব্যাপার।
যা ভাবছি তা আরেকজনকের সমর্থনে জোড়ালো হয়ে উঠে।
আমি গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সমাজের অনেক মহিলার কাছে বাংলাদেশের টিভি প্রোগ্রাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। সবারই কনটেন্ট আর প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে খুব অভিযোগ। দেখবে হানিফ সংকেত (আমি ঠিক এখনকার কথা বলতে পারবো না) আর হুমায়ূন আহমেদ যেই রস দিচ্ছে তাকে ঠিক ভাড়ামো বলা যায় না। আবার তাদের নকলে কাজল বা এখনকার নাটকে যা হচ্ছে তা সহ্য করা একটু কষ্টকর।
নাটকে কেন এতো এ্যড দিতে হবে? টিভির হর্তাকর্তাদের তো টাকার অভাব নেই। একটা পেপারে পড়লাম এটিএনের ডঃ মাহফুজের বৌএর নাকি বিশ্ব রেকর্ড হচ্ছে মিউজিক প্রোগ্রামের সংখ্যার দিক দিয়ে। তাহলে দাড়াচ্ছে যে সে টিভির এডের টাকা দিয়ে নিজের বৌকে খুশি করছে। এদিকে এডের কারণে দেশের মানুষ টিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরো জোরালো কন্ঠস্বর উচ্চকিত করা উচিত।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
''একজন মমতাজের সাংস্কৃতিক গভীরতা কিন্তু ভারতীয় শাড়ি পরিহিতা রুনা লায়লার থেকে অনেক গভীর। একজন মমতাজকেই দেখা যায় তার এলাকায় চক্ষু হাসপাতাল দিতে এবং নানারকম সমাজসেবামূলক কাজে নিয়োজিত থাকতে। নানাভাবেই উনি প্রমান করেছেন এসব কাজ লোক দেখানো নয়।''
কার গভীরতা বেশি নিশ্চিত হলেন কিসের ভিত্তিতে ?আর শিল্পীর মুল কাজ শিল্পচর্চা করা ,হাসপাতাল বা জনসেবা নয় ।আর কেউ যদি তা করে সেটা তার সাংস্কৃতিক গভীরতা প্রমান করে না ।
''আমাদের আগের প্রজন্ম অনেক ভাগ্যবান যে তারা অনেক জীবন ঘনিষ্ট সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে পেরেছিলেন। মহিলারা কিন্তু পড়তে চায়। পড়ার মতো বই না পেয়ে তারা এখন ধর্মগ্রন্থ পড়ছে। আমাদের দেশে ভাল ধর্মগ্রন্থেরও যথেষ্ট অভাব আছে। ''
এই অংশ পড়েই সন্দেহ হয়েছিল আপনি দেশে থাকেন না ।আপনার প্রোফাইলে গিয়ে দেখি আমার অনুমান ঠিক।পড়ার মত বই দেশে নাই ?আজ পর্যন্ত বাংলাসাহিত্য ও অনুবাদের বিশাল ভান্ডার প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো কই গেল ?পড়া্র বই না পেয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়ছে ?আপনার পরিচিত এমন কেউ আছে নাকি ?
'' আমাদের দেশে ভাল ধর্মগ্রন্থেরও যথেষ্ট অভাব আছে। '
''ভাল'' ধর্মগ্রন্থ জিনিসটা কি ?এটা কোন ধর্মের বই ?বাংলাদেশে ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যায় কি যায় না সেটা যদি কোন বইয়ের দোকানে কোনদিন গেলেই বুঝতে পারবেন ।
'' আমাদের দেশেও তো হাজার হাজার সম্পন্ন পরিবার আছে। সেখান থেকে কেন হাতে গোনা একজন দুজন তাহমিনা আনাম (মাহফুজ আনামের মেয়ে, এ পর্যন্ত দুটো ইংরেজী বই লিখে ফেলেছে)বেরুবে?''
তাহমিমা আনাম বড় লেখক ?বই ইংরেজিতে লেখেছে এইজন্য ?তাতে বাংলাদেশের লোকের কিছু আসে যায় ?ভারতীয় শাড়ি পড়লে দেশের তাতীদের ক্ষতি হয় আর ইংরেজিতে লিখলে জনগনের বিশাল উপকার হয় ?
প্রথম অংশ পড়ে মনে হলো আপনি দেশেই থাকেন কিংবা বিদেশে থাকলেও খুব একটা ডাইভারসিটির সাথে পরিচিত নয়। দয়া করে দয়া করে সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্যিক দার্শনিকদের ভূমিকাটা জেনে নেবেন। এই অঞ্ছলের একটা উদাহরণ দিই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু শুধু একজন কবি-সাহিত্যিকই ্নন, উনি খুব বড় মাপের একজন সংগঠক। আরেকটা দিই। জহির রায়হায় তাঁর একটা ছবি 'জীবন থেকে নেওয়া' দিয়েই একই সাথে সেই সমাজের মানসিকতা তুলে ধরেছেন এবং সমাজকেও একই বিপ্লবী কাতারে এনেছেন। শিল্প-সাহিত্য যদি সমাজের গুণগত পরিবর্তনে কোন কাজেই না লাগে তাহলে আইসক্রিম-চকলেটের সাথে এর পার্থক্য কি? চার্লস ডিকেন্সের লেখা সে দেশের কঠোর শিশুশ্রমের উপর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গরীব শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে সহযোগী আইন গড়তে সাহায্য করেছিল। ফরাসী বিপ্লবের স্ফুলিংগ জ্বেলেছিল সে দেশের শিল্পী-সাহি্ত্যিক-দার্শনিক গোষ্টী। এসব বলে শেষ করা যাবে না।
আর ধ্র্রমগ্রন্থের ব্যাপারে আপনার যে মন্তব্য দেখলাম সেখানে আমার দৃষ্টিতে আপনাকে একজন ডিনাাল চরিত্রের অধিকারী বলে মনে হচ্ছে। আশে পাশে একটু তাকিয়ে দেখেন সমাজের সত্যিকার মানুষগুলোর দিকে। স্যাম্পলিং হিসেবে দুই-একজনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন তারা কি বই পড়ছে। দেখেন আমি স্বভাবে বিশ্লষকধর্মী। যে দুই লাইন মন্তব্য আপনি আমাকে করবেন সেই দুই লাইন থেকেই আমি আপনার সম্পর্কে একটা আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবো। দেশ নিয়ে লেখার জন্য দেশে সশরীরে থাকার দরকার আমার হয় না। আমি তো সাংবাদিক না। খবর পরিবেশন করি না। খবর বিশ্লষণ করি। কখনও জুলভার্ণ পড়েছেন? সেই ভদ্রলোক তো নিজের ঘর ছেড়ে খুব একটা বাইরে বেড়ুয়নি। তাহলে সারাবিশ্ব, আকাশ-পাতাল নিয়ে লিখলেন কিভাবে? সবার কল্পনাশক্তি, বিশ্লষণ ক্ষমতাকে কি এক পাল্লায় মাপা সম্ভব?
তাহমিমা আনামকে কোথায় বড় লেখক বলেছি উল্লেখ করেন? আমি বলেছি আমাদের সম্পন্ন পরিবারের লোকেরা তাদের সন্তানদের লেখক হওয়ার জন্য উৎসাহিত। বেগম রোকেয়া কিংবা জাহানারা ইমামদের টাকা-পয়সা নিয়ে অতো চিন্তা করতে হয়নি বলে তাঁরা লিখেছেনও ভালো এবং তাদের লেখা আর সাংগঠনিক কাজ সমাজের জন্য ইতিবাচক ভুমিকা রেখেছে।
ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। অস্বীকার করে তো লাভ নেই। বিশ্বের সব ভাষার ভাল ভালো লেখা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়। গর্ব করার মতো আমাদের যতো সাহিত্যিক রয়েছেন - রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাস, হুমায়ুন আযাদ - তাঁরা অনেকেই বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য অনেকের লেখা থেকে অনেক আইডিয়া নিয়েছেন। পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখনও অতোটা পরিচিত নয়। কারণ ইংরেজিতে কেউ খুব একটা এই বিষয় নিয়ে লেখেননি। তাই কেউ লিখলে তাকে সাধুবাদ জানাব। আমার কাছে শিল্প-সাহিত্য একটি প্রয়োজনীয় মাধ্যম - কিছুক্ষণ তুড়বুড়ি আড্ডা জমাবার কোন বিষয় নয়। তাই যে শিল্পী তার মাধ্যম দিয়ে একটি মানুষ তথা সমাজের পরিবর্তন অথবা মূল্যবোধ/জীবনবোধ গঠন বা স্রেফ তাকে আনন্দ দিয়ে তার স্থবির সময় কাটিয়ে তুলতে পারেন - তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এ কাজ একদিনে হয়না, অনেক সময় লাগে, অনেকের প্রচেষ্টা লাগে।
আপনার পছন্দের কিছু সমকালীন বাংলা বইয়ের তালিকা দিন - যদি ইচ্ছা হয়। একটি পড়ে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi