আমি তখন অনেক ছোট, খুলনা শহর তখনও সিটি কর্পোরেশন হয়নি। তো, সেবার খুলনা পৌরসভার ইলেকশনে আমাদের পাশের বাড়ীর দবীর চাচা(ছদ্মনাম) কমিশনার পদে দাঁড়ালেন। তাঁর মার্কা হল উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন। খুলনার আঞ্চলিক টানে অনেকেই বলতেন “আইরো পেলেন” – মানে বাঁকা প্লেন, কিছু দুষ্টু লোকেরা আবার ওটাকে “আইঢ়ে পেলেন” বলেও ডাকতেন (একথার অর্থ এখানে লেখা যাবে না)।
প্রতিদিন বিকালে পাড়ার ছেলেপুলেরা “তোমার ভাই – আমার ভাই, দবীর ভাই – দবীর ভাই” ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে দবীর চাচার বাড়ীর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করত। একদিন দেখি চাচার বড় ছেলেও সেই মিছিলে সমানে দবীর ভাই – দবীর ভাই বলে চেঁচাচ্ছে। এরকম দৃশ্য দেখার কোন পুর্বাভিজ্ঞতা না থাকার কারণে আমি রীতিমত বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। পাড়ার বড় ভাইয়েরা ততটা অবাক না হলেও সাদাসিদা ছেলেটিকে একটু বুলিইং করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তাঁরা কয়েকজন মিলে একদিন ছেলেটিকে ডেকে বললেন, বাবার নাম এইভাবে মুখে আনতে হয় না ভাইডি, এটা কঠিন বেয়াদবী। ওনাকে তুমি কি বাসায় দবীর বলে ডাকো না আব্বা বলে ডাকো?
ব্যাপারটা খুব ভালভাবে ছেলেটার মাথায় ঢুকে গেল। সেদিন বিকালের মিছিলে সবাই বলছে দবীর ভাই, আর ওনার ছেলেটা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে – “আব্বা ভাইকে ভোট দিন!” … অনতিবিলম্বেই আশেপাশের দশ বাড়ীর আমরা সবাই দবীর চাচার বজ্র-গর্জন শুনতে পেলাম, “এই হারামজাদা ছিমড়া! এহনি ঘরে আয়, আইজকে তোর বাপের নাম ভুলোইয়ে ছাড়বানি!!” (নিজের ছেলেকে হারামজাদা বলার মত বুকের পাটা খুব কম লোকেরই থাকে, তবুও কেন যে লোকজন তাঁকে ভোট দিল না সেটা আজও আমার কাছে এক রহস্য!) সে যাই হোক, এর পরে আর কোনদিন ছেলেটিকে ভোটের মিছিলে দেখা যায়নি।
আরও পরে ক্যাডেট কলেজে গিয়ে দেখলাম সেখানে সিনিয়র ক্যাডেটদেরকে ভাই বলে ডাকা হয়। আমার চাচাতো বোনের ছেলে ছিল আমার তিন বছরের সিনিয়র ক্যাডেট। অন্যদের সামনে তাঁকেও ভাই বলে ডাকতে হত। এখনও অনেক সময়ে বলতে হয় যে, আমি অমুক ব্যাচের তমুক ভাই এর মামা হই। এই ভাই ডাকটা এখন রীতিমত আমাদের শরীরের অংশ হয়ে গেছে। তো, ক্লাস সেভেনে কলেজে থাকতে একদিন চুরি করে খায়বার হাউসে গিয়ে ক্লাস টুয়েলভ এর তারেক ভাই এর কাছে ধরা খেয়েছিলাম। আমার ছোট-খাট আকার দেখে মুক্তমনে ঝাড়ি দিতে দিতে একপর্যায়ে বলে ফেললেন, ” ব্লাডি চ্যাপ! সময়মত বিয়ে করলে আমার এতদিনে তোমার বয়সী বাচ্চা থাকতো!!” … সন্তান কিভাবে পিতার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট হতে পারে সেই তত্ব চিন্তা ওই পরিস্থিতিতে আমার মাথায় আসে নি। তার বদলে চট করে মাথায় প্রশ্ন এল আর মনে মনে করেও ফেললাম, “সেক্ষেত্রে আপনাকে তারেক ভাই বলে ডাকতাম কিভাবে?”
এরপর বহুদিন এই প্রশ্নটার গুঢ় তাৎপর্য নিয়ে ব্যাপক মাথা ঘামিয়েছি। ভাগ্যিস তখনকার দিনে কোন এক্স ক্যাডেটের আমাদের বয়সী ছেলে ছিল না । আশঙ্কার বাস্তবায়ন হোল অনেক পরে। তখন আমি নিজেই এক্স ক্যাডেট হয়ে গেছি। খুলনা জেক্সকার এক গেট টুগেদারে জানতে পারলাম ফিরোজ ভাইয়ের ছেলে কলেজে চান্স পেয়েছে । পুরানো মাথা ব্যাথাটা সেদিন চিন চিন করে চাগিয়ে উঠলেও আজ এত বছর পরে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে। এইতো কিছুদিন আগেই ইনবক্সে লিখেছিলাম, তৌফিক, ফিরোজ ভাইয়ের শরীরটা এখন কেমন? জবাবে তৌফিক লিখল, মুজিব ভাই, আব্বুর শরীরটা এখন একটু ভালো।*
কলেজের ইমিডিয়েট সিনিয়র, রেজওয়ান ভাইয়ের সাথে আমার নতুন সম্পর্কের সম্পর্কে জানতে পারার সাথে সাথে ইনবক্স করে জানালাম, ভাইজান আপনে আমার চাচা শ্বশুর লাগেন! রেজওয়ান ভাই নির্বিকার হাতে টাইপ করলেন, কোন ব্যাপার না, পৃথিবী গোল। কিন্তু গোল বাঁধালেন আমার শাশুড়ি। সোজা জানালেন, এসব গোলমেলে কথাবার্তা চলবে না। রেজওয়ান ভাই ওনার কাজিন-পতি, সেই সূত্রে আমার চাচা-শ্বশুর। এখন লোকজনের সামনে তাঁকে ভাই ডাকলে সেটা তাঁদের কানে সাংঘাতিক বেসুরো ঠেকবে। অতএব, এহেনও অসুর সুলভ আচরণ কোনভাবেই করা চলবে না! কি আর করা? সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, ওনাদের উপস্থিতিতে কখনওই রেজওয়ান ভাই এর সমানে পরা যাবে না। মনে মনে আক্ষেপ করি, আহা, আইয়ুবটা সেদিন জেক্সকার পার্টিতে কত অবলীলায় বলে দিল, মুজিব ভাই, আমি তো সুলতান ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করেছি। কই, আমরা কেউ তো সেদিন, কোন কারণেই, হাহাকার করে উঠিনি! নাহ্, নন-ক্যাডেটদের নিয়ে আর পারা গেল না।
—
* (এই লেখাটি লেখার মাঝেই একদিন ফিরোজ ভাইয়ের অকাল প্রয়াণের সংবাদটি পেয়েছিলাম। সেই হঠাত শোকের ধাক্কা আমার কখনওই পুরোপুরি ভাবে কাটবে না। তিনি খুলনা জেক্সকার সভাপতি ছিলেন, আমাকে এবং অন্যান্য এক্স-ক্যাডেটদেরকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।)
প্রথম। ভাই সংক্রান্ত জটিলতা এক্স ক্যাডেট জীবনের একটা বড় অংশ। একবার জ্বরের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলাম। পাশের কেবিনে এক ভদ্রলোকের সাথে বাবার কথা বার্তা হচ্ছিল। কথার প্রথম দিকে উনি আমার বাবাকে ভাই সম্বোধন করেন। এক কথা, দু কথায় জানা গেল তিনি আর সি সির এক্স ক্যাডেট। আমার পরিচয় শুনতেই উনি বেমালুম আমার বাবা কে ভাই থেকে আংকেলে নিয়ে গেলেন। =))
-- একই সাথে ফিরোজ ভাইয়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
আমি সিগারেটের ছাই, জানালার ধুলো। চাইলেই ফু দিতে পার। ঊড়ে যাব।
:khekz: :khekz: :khekz:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
(আমাদের সময়ে দেখা) ক্লাস সেভেনের যে কেউ প্রথম যেসব কারনে ঝাড়ি/পানিশমেন্ট খেত তার অন্যতম প্রধান ছিল সিনিয়রকে 'ভাই' না বলে 'ভাইয়া' বলা! এ কারণেই, জেসিসি'র ভাই সংক্রান্ত সবচেয়ে কমন ফান ছিল ক্লাস সেভেনের পোলাপাইনদের কাছে নিজেকে 'দুলা' নামে পরিচয় দেয়া... ;;;
কত কথা মনে পড়ে গেল। :dreamy:
মুজিব ভাই, অনেক ধন্যবাদ। :thumbup:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
"ক্লাস সেভেনের পোলাপাইনদের কাছে নিজেকে 'দুলা' নামে পরিচয় দেয়া" :))
তোমরা পারোও বটে! 😛
আমরা কিন্তু আপা ডাকতাম সিনিয়রদের... আপু টাপু ডাকার প্রশ্রয় পাই নাই কখনই! 🙂
:thumbup:
এই 'দুলা' কাহিনীর একটা এক্সটেন্ডেড ভার্সন আমরা সেভেনে থাকতে শুনেছিলাম। কয়েক বছর আগে ক্লাস সেভেনের কে নাকি এরকম 'দুলা' নামধারী কোন এক সিনিয়রকে বুদ্ধি করে 'ভাই-দুলা' বলে ডেকেছিল। এহেন স্মার্টনেসের জন্য ওনাকে ব্যাপক প্যাঁদানি খেতে হয়েছিল। কিন্ত একই সাথে সিনিয়রদের মাঝে এই 'দুলা' চালাকি করার আগ্রহেও চরম ভাটা পড়ে গিয়েছিল। 🙁
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
আজ আমার ভাইদের ঈদ লেগে গেছে সিসিবিতে! ইয়াহুউউউ! :tuski: লেখার পর লেখা আসছে দেখি... কোনটা রেখে কোনটা পড়ি! 🙂
আমি যদিও তোমাদের সবার মাঝে সাত ভাইয়ের চম্পা হয়েই আছি! 😀 আমাদের জিসি আপুরা কোথায় গেলো গো???
ডাকটা আরেকটু জোরে দেন না আপু! :dreamy: 😕
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
=)) =)) =)) এই যেমন রিমি আপার ছেলে সাকিব আমাকে ডাকে মোকা ভাই। তবে সাবিহা আপার বাবা বজলুল আংকেলকে আর ভাই বলা হয় নাই। 😛
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
=)) :khekz: =))
আপনে সাকিব মামার 'মোকা ভাই' হন! এটা তুমি আগে বলবা না? 😛
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
কথায় বলে লাইফ ইজ স্ট্রেনজার দ্যন ফিকশান। আমি বলি ক্যাডেট কলেজ ভাই-আপাজোনিং বিটস দেম অল! 😀 😀 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
ঢাকা মেডিক্যালে পড়ুয়া এক এক্সজিসি আমার বড় মেয়ে আনীলাকে পড়িয়েছে কিছুদিন। ও তো আমাকে অবলিলায় ভাইয়া-টাইয়া ডেকে অস্থির। আনীলার মাকে ও আপন ভাবীর মতই ভাবী ভাবী বলে ডাকে।
আমি একদিন ভাবছি, আনীলা ওকে কি বলে ডাকে, দেখি তো? মাত্র তো বছর দুয়েকের-এর ছোট।
দেখলাম শুধু আপু বলেই ডেকে ক্ষান্ত না, রীতিমত তুমি তুমি সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে।
ভালোই, ভাল না?
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আমার ব্র্যাকের বান্ধবীর বাবা রাজশাহীর এক্সক্যাডেট। ও একদিন বলছিল, "আমি বুঝি না, আমার চেয়ে বয়সে ছোট পোলাপান আমার বাবাকে 'ভাই' বলে কি যে এক আড্ডা জুড়ে দেয়। জীবনে কোনদিন দেখে নাই এরকম একটা মানুষ এক্সক্যাডেট পরিচয় দেয়ার পরে এভাবে এক লাফে দূরত্ব কমায় কিভাবে?" বলেছিলাম, "আমার ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নাই। ছয় বছর পড়লে হয়তো বুঝতে পারতি বাবা কেন ভাই।" 😛
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
অনেক ভাল লাগলো ভাই লেখাটা পড়ে।
আমার সিভিল ফ্রেন্ডরা অবাক হয়ে যায় যখন অনেক সিনিয়র কোন লোককে ভাই বলে ফেলি অবলীলায়।
অনেক সময়ই এরকম হইছে চেনা নাই জানা নাই খালি শুনছি এক্সক্যাডেট, সাথে সাথে ভাই বলে খাতির জমিয়ে ফেলেছি।
মাহফুজ ভাই একদিন বাসায় যেতে বলছিল, আমি ভাবতেছিলাম- উনার আম্মাকে কী বলে ডাকবো? আপা, নাকি আন্টি? 😛
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
:hatsoff: :hatsoff:
:thumbup: :goragori: :awesome:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
ভাইরে ভাই বড্ড মজা পাইলাম :))
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
:awesome: :goragori: :tuski:
গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।
😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
খুব সুন্দর লিখেছ। অনেক মজা ও পেলাম।
কিন্তু আমার এক বছর কলেজে অবস্থানের বেশীরভাগ সময়ই কেটেছে কলেজ মেডিকেলে আর যশোহর সি.এম.এইচ এ। আর স্মৃতিগুলোর উপরে এতটা বিস্মৃতির ধুলো জমেছে যে, আমি চেষ্টা করেও তেমন কিছু বের করে আনতে পারছি না।
আমার ছোট ভাইয়ের কারণে এবং রাজনতিক যোগাযোগে ফিরোজ ভাইয়ের সাথে একটু কানেকশন ছিল।
ওনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
তোমার জন্যও অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
নিজের মনের আনন্দে লিখালিখি করি।