[ দ্য টরান্টো ডেইলী স্টার-এ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২-এ প্রকাশিত আর্ণেস্ট হেমিংওয়ের কলামের অনুবাদ ]
আমরা বসে ছিলাম সস্তারও সস্তা সেই রেস্টুরেন্টে। যেটা কিনা তীব্র কোলাহলময় সামান্য সেই গলিটাকে আরো সস্তা করে তুলেছিলো। প্যারিসের ‘রু দ্য পেটি চ্যাম্পস’ নামের সেই গলিটার কথাই বলছি।
আমরা মানে মিসেস হেমিংওয়ে, উইলিয়াম ই. ন্যাশ, ন্যাশের ছোট্ট এক ভাই আর আমি। লবস্টার আর ফ্রায়েড সোল মুখে চালান করার ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে থেমে থেমে কথা বলে যাচ্ছিলেন মি. ন্যাশ। সেই কথার মধ্যে জানান দিলেন কলেই উনি যাচ্ছেন মিউনিখে। অনেকটা ঘোষণার আদলেই আমাদের জানালেন যে, উনি ঠিক করেছেন এবারের এই যাওয়াটা হবে আকাশ পথে। ঘোষণাটা শোনার পর থেকে মিসেস হেমিংওয়ে বিষয়টা নিয়ে মগ্নচিত্তে এক নাগাড়ে কথা বলেই যেতে থাকলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না মাশরুমের সংগে কিডনী সুইংস-এর ডিশটা টেবিলে আসলো। একটা কঠিন প্রশ্ন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে থামলো তার কথা। “আচ্ছা আমরা কখনো আকাশ পথে যাই না কেনো কোথাও ? অন্য সবাই তো দিব্যি প্লেনে চড়ে যাচ্ছে কোথাও না কোথাও ! আমরা বুঝি জীবনভর শুধু ঘরেই বসে থাকবো ?”
এমন প্রশ্নেরতো আর সহজ কথায় কোনো উত্তর নেই। খাওয়া শেষ হতেই ন্যাশ সাহেবের সাথে আমি তাই চলে গেলাম ফ্রানকো রুমানিয়ান এ্যরো কোম্পানীর অফিসে। ঝা চকচকে ১২০ ফ্রাঁর বিনিময়ে ঝটপট কিনলাম দু’খানা টিকেট। সাংবাদিকদের জন্য পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছাড়ের কল্যাণে এই দাম। প্যারিস থেকে স্ট্রসবার্গের একটা ফ্লাইটের জন্য যথেষ্ট ভালো দামই বলতে হবে। বেস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে গেলে যে যাত্রাপথে লাগতো সাড়ে দশ ঘন্টা, সেখানে প্লেনে লাগবে সাকুল্যে মাত্র আড়াই ঘন্টা।
আকাশভ্রমণ নিয়ে কোনো রকম প্রত্যাশা বা উচ্ছ্বাস আমার ভেতরে সেভাবে দানা বাঁধতে পারছিলো না। আমার প্রথম আকাশ ভ্রমনের স্মৃতি আর পরে ভোগেস মাউন্টেনের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার বিষয়টা জানতে পারার ফলে মনের মধ্যে তৈরী হওয়া ভীতি আমার সহজাত বিমর্ষতাকে ক্রমশঃ উস্কে দিচ্ছিল। তার উপর আরো যখন জানতে পারলাম অপেরা এ্যভিনিউর অনতিদূরের বিমান অফিসটিতে আমাদের উপস্থিত হতে হবে ভোর পাঁচটায়। বিমান কোম্পানীটির নামের সাথে রুমানিয়ান টাইটেল যুক্ত থাকাটাও খুব উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু ছিলো না। অবশ্য কাউন্টারের পেছনে বসা ক্লার্ক যখন জানালো নামে রুমানিয়ার লেজ থাকলেও কোনো রুমানিয়ান পাইলট তারা নিয়োগ করেনি। কথাটা শোনার পর কিছুটা হলেও যেনো স¦স্তি বোধ করলাম।
পরদিন ঠিক ভোর পাঁচটায় সেই বিমান অফিসে আমরা পৌঁছেছিলাম বটে। তবে তার পেছনের কাহিনীটুকু কম লম্বা না। এজন্য আমাদের ঘুম থেকে উঠতে হয়েছিলো ভোররাতে। চারটার আগেই। ব্যাগ গুছিয়ে কাপড় পাল্টে তড়িঘড়ি আমাদের যেতে হয়েছিলো মহল্লার একমাত্র ট্যাক্সির মালিককে ঘুম থেকে ওঠাতে। প্রায় অন্ধকার সেই ভোরে দরজার ওপর এক রকম বোমা ফাটিয়ে তবে ওঠাতে পেরেছিলাম লোকটাকে। বেচারা ! বাড়তি রোজগারের জন্য দিনভর ট্যাক্সি চালিয়ে রাতে একর্ডিয়ান বাজাতো স্থানীয় এক ‘বাল-মিউস্টি’ পানশালাতে। প্রায় কাঁচা ঘুম থেকে মানুষটাকে ওঠাতে আমাদের তাই এক প্রকার দরজা ভাঙ্গার উপক্রম করতে হয়েছিলো।
লোকটা ঘুম থেকে উঠেই লেগে পড়লো ট্যাক্সির চাকা পাল্টাতে। আমরা ততোক্ষণ গলির মোড়ের স্বাদু খুচরো খাবারের দোকানী ছেলেটার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করে সময় কাটাচ্ছিলাম। এই ভোরে ছেলেটা দুধওয়ালা আসবার অপেক্ষায় দেকান খুলে বসে ছিলো। এই ফাঁকে সে আমাদের এক জোড়া স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিলো। কথায় কথায় জানা গেলো দোকানী ছেলেটা যুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিমানের পাইলট ছিলো। আমাকে সে জিজ্ঞেস করছিলো এনগুইনের সেই প্রথম রেসের কথা আমি জানি কিনা ! টায়ার পাল্টানো শেষ হতেই ট্যাক্সি ওয়ালা আমাদেরকে এক কাপ কফি খাওয়াবার প্রস্তাব দিয়ে ডাকলো তার বাসায়। সেই সাথে আরো সে বললো, যে কফি খেতে ইচ্ছে না করলে আমরা হোয়াইট ওয়াইনও নিতে পারি। আমরা স্বাদু স্যান্ডউইচের সাথে কফি খেয়ে গা গরম করে চটপট গাড়ীতে উঠে রওনা দিয়ে দিলাম। ফাঁকা শুনশান ধূসর রঙা প্যারিসের রাস্তা দাবড়ে চললাম আমরা বেশ তাড়াতাড়িই।
ন্যাশরা দু’ভাই আগেই পৌঁছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো সেই বিমান অফিসটিতে। দু’খানা ভারী স্যুটকেস হাতে বয়ে মাইল দু’য়েক দূর থেকে তাদের আসতে হয়েছে হেঁটে। আমাদের মতোন মহল্লার কোনো ট্যাক্সিওয়ালাকে তারা ব্যক্তিগতভাবে চিনতো না। অতো ভোরে তাই তাদের কোনো বাহন জোটেনি বাড়ী থেকে এতোটুকু আসতে।
চারজন মিলে এবার বিশাল এক লিম্যুজিন করে চললাম লে বোজেইয়ের দিকে। প্যারিসের সবচেয়ে বাজে রাস্তা। যন্ত্রণাদায়ক পথ ভ্রমন বলা যায় এই পথে যাওয়াকে। পৌঁছে ফ্লাইং ফিল্ডের বাইরে ছাউনীর নীচের একটা ছোট্ট দোকানে আরো একবার কফি খেয়ে নিলাম আমরা সবাই। তেল চিটচিটে একখানা সোয়েটার গায়ে চাপানো একজন ফরাসী লোক আমাদের টিকেটগুলো নিয়ে দুভাগ করলো ছিঁড়ে। বললো দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিমানে হরে আমাদের চারজনের এই আকাশ ভ্রমণ। শেডের জানালা দিয়ে ভেতরে অপেক্ষমান প্লেন দুটোকে দেখা যাচ্ছিল। ছোট, আঁটোখাটো, রূপালী রঙ করা প্লেন দুটো এ্যারোড্রামের সামনে দাঁড়িয়ে চকচক করছিলো কাঁচা ভোরের রোদে। সাকুল্যে আমরা চারজনই ছিলাম যাত্রী।
আমাদের স্যুটকেসটাকে ওঠানো হলো আগে। পাইলটের জায়গাটার পাশে একটা সীটের নীচে জায়গা হলো ওটার। দু’খানা ধাপ বেয়ে এরপর ওপরে উঠে এলাম আমরা। গুমোট একটা ছোট্ট কেবিন। সিটে বসতেই মেকানিকটি আমাদের হাতে কিছু তূলা দিলো কানে গুঁজবার জন্য। তারপরই প্লেনের দরজা আঁটকে দিলো। এরপর পাইলট উঠে এলো তার সিঁড়ি বেয়ে। আমাদের বসবার জায়গাটার পেছন দিকে ঘেরাও দেয়া ককপিটের ভেতর তার সীটে। একজন মেকানিক প্রপেলরের একখানা পাখা উপরের দিক থেকে টেনে নামিয়ে ঘুরিয়ে দিলে ইঞ্জিনটা গর্জনের মতোন শব্দ করে চালু হলো।
মাথা ঘুরিয়ে আমি পাইলটের দিকে তাকালাম। বেঁটে খাটো একজন মানুষ। তার টুপিটা তখনো মাথার পেছন দিকে ঝুলে আছে। তেল চিটচিটে একখানা ভেড়ার চামড়ার কোট তার গায়ে। হাতে বিশাল মাপের গ্লাভ্স। প্লেনটা এতোক্ষণে মাটির উপর চলতে শুরু করেছে। একখানা মোটর সাইকেলের মতোন লাফিয়ে বাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চলতে চলতে একসময় আস্তে করে উঠে পড়লো প্লেনটা আকাশের বুকে।
আমরা প্যারিস ছেড়ে প্রায় সোজা পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ঠিক যেনো একখানা নৌকাকে কোন অতিকায় দানব আস্তে করে ওপরের দিকে তুলে আনছিলো, যার ভেতরে আমরা আসন নিয়ে বসে ছিলাম। অসমতল পৃথিবী ক্রমশ আমাদের নীচে পুরোপুরি সমতল একটা চেহারা পেতে থাকলো। সমস্ত জমিনকে দেখতে কিছু বাদামী, হলুদ, সবুজ খোপ খোপ চৌকোর সমাহার মনে হচ্ছিলো। কোথাও গাছ গাছালি বন-জঙ্গল থাকলে সেগুলোকে মনে হচ্ছিলো মাটির গায়ে ফুলে থাকা বুদবুদের মতোন সবুজ রঙের ফুস্কুড়ি। নীচের দিকে তাকিয়ে আমি যেনো সহজেই কিউবিস্ট পেইন্টিং-এর মর্ম বুঝে যেতে থাকলাম।
প্লেনটা কখনো কখনো যখন বেশ নীচুতে নেমে উড়ছিলো। তখন রাস্তার উপর চলমান সাইকেলগুলো অনায়াসে আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। অবশ্য চলমান সাইকেলগুলোকে ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেনো চিলতে সাদা দাগের উপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া ধাতব মূদ্রা পেনি। কখনো কখনো আমরা আবার উপরের দিকে উঠছিলাম। তখন গোটা পৃথিবীর ল্যান্ডস্কেপ যেনো আনায়াসে আমাদের দৃষ্টিসীমার বৃত্তের ভেতর দৃশ্যমান হচ্ছিলো। এক রকম ধোঁয়াটে বাদামী দিগন্ত বেষ্টিত হয়ে আমরা উড়ে যাচ্ছিলাম বেশীর ভাগ সময়। গোটা পৃথিবীটাকে তখন আমাদের নীচে বড্ড একঘেঁয়ে চ্যাপ্টা আর অনাকর্ষণীয় লাগছিলো। আমাদের জগৎ জুড়ে চলছিলো সারাক্ষণ এঞ্জিনের অবিরাম জোর গর্জন। বাইরের জগৎটাকে দেখবার জন্য ছিলো কেবল প্লেনের পোর্টবেল জানালাগুলো। আর ভেতরে দৃশ্যমান শুধু আমাদের পেছনে পাইলটের খোলা ককপিট। তার সামনে প্লেনের চওড়া নাক আর ভেড়ার চামড়ার তেল চিটচিটে কোট ও নোংড়া বড় বড় দস্তানা মোড়া পাইলটের এক জোড়া হাত, যা জয়স্টিক ধরে হয় এপাশ ওপাশ নয়তো উপর নীচ করছে বিরামহীন ভাবে।
কখনো আমরা উড়ে যাচ্ছিলাম বিশাল বনভূমির ওপর দিয়ে। যা দেখে মনে হচ্ছিল যেনো একটা সবুজ ডেলভেটের বিছানো চাদর। আমরা উড়ে যাচ্ছিলাম বার ল্য ডুক এবং ন্যান্সির উপর দিয়ে। লাল আর ধূসর ছাদের বাড়ীময় একটা শহরের ওপর দিয়ে। আমরা উড়ে গেলাম সেন্ট মিহাইয়েল এর উপর দিয়ে। যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছিলাম খোলা এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর যার সারা গায়ে এখানে ওখানে এঁকে বেঁকে গ্যাছে অগুন্তি পুরানো পরিখা (ট্রেঞ্চ) আর সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তর জড়ে বিন্দু বিন্দু হয়ে দৃশ্যমান ছিলো শেলের আঘাতে তৈরী অগুন্তি গর্ত। মিসেস হোমিংওয়েকে আমি চিৎকার করে বলছিলাম বাইরের দিকে দেখতে। কিন্তু আমার চিৎকারের বিন্দুমাত্র আওয়াজও তার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিলো বলে মনে হলো না। কখনো কোনো প্লেন ট্রিপে পরবে বলে কেনা নতুন ফার কোটটার সামনের ফোলা কলারের ওপর চিবুক লাগিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে ছিলো তার মাথাটা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে এই আওয়াজের হট্টগোলের মাঝেও। সেই ভোর পাঁচটায় ওঠে আসার ধকল আর তার আগের প্রস্তুতি পর্ব, সব মিলিয়ে ঘুম ঘাটতি আর ক্লান্তি তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।
১৯১৮ সালের ফ্রন্টিয়ার ওয়ারফিল্ডের সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরটা পেরুতেই আমরা পড়লাম এক ঝড়ের মধ্যে। পাইলট তখন প্লেনটাকে মাটির যতোটা সম্ভব কাছাকাছি দূরত্বে, খুব নীচ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। বৃষ্টির ভেতর দিয়েও আমাদের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটাকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশ অনেকক্ষণ ধরে একঘেঁয়ে আর অচিত্তাকর্ষক সমতলের ওপর দিয়ে উড়ে নীরস গ্রামাঞ্চল পাড়ি দেবার পর বৃষ্টির ভেতরই আমরা পার হলাম ভোগেস এর মানবগম্য নীচু পাহাড়গুলো। তারপর ক্রমশঃ উপরে উঠতে থাকলাম বন-বাদারের চাদরে ঢাকা উঁচু উঁচু পর্বতগুলো পাড়ি দেবার জন্য। বৃষ্টির ভেতর মনে হচ্ছিলো যেনো কুয়াশাচ্ছন্ন সমতল থেকে মাথা উঁচিয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা পর্বতগুলো থেকে থেকে আবার সেই বৃষ্টির দাপটে কুয়াশাবৃত্ত সমতলের সাথে মিশে যাচ্ছে এখানে ওখানে।
ঝড়ের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবার পরই প্লেনটা ক্রমগত উপরের দিকে উঠতে থাকলো। উজ্জ্বল সূর্যালোকের ভিতর দিয়ে তখন আমাদের ডান পাশে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম দু’পাশে কাদার সরু ফিতার আর সারিবদ্ধ গাছের বেষ্টনী নিয়ে বহমান রাইন নদীটাকে। আমরা আরো উপরে উঠে বাঁ দিক থেকে বিশাল একটা বৃত্তাকারে ঘুরে এবার ঝুপ করে নামতে শুরু করলো প্লেন নীচের দিকে। হৃদপিন্ডটা যেনো ঝট্কায় তার জায়গা ছেড়ে উঠে এলো আমাদের মুখের ভেতর। দ্রুত ধাবমান একটা এলিভেটরে যখন নীচে নামতে থাকলে যেমন জানটা বুকের ভেতর থেকে তড়পে উপরের দিকে উঠে আসতে থাকে, ঠিক তেমনি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ নামার পর মাটির খুব কাছাকাছি এসে থিতু হলো প্লেন। এর একটু পরই মাটি স্পর্শ করলো তার চাকাগুলো। লাফিয়ে ঝাঁকিয়ে আবার সে মোটর সাইকেলের মতোন চলতে থাকলো শান্ত ফ্লাইং ফিল্ডের নীরবতা ভেঙে তর্জন গর্জন করতে করতে, একেবারে হ্যাংগারের কাছাকাছি না পৌঁছানো পর্যন্ত।
আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষমান ছিলো একখানা লিম্যুজিন। যেটায় চড়ে আমরা পৌঁছাবো স্ট্রসবার্গে। প্লেন থেকে নেমে আমরা এগিয়ে গেলাম যাত্রী ছাউনীর দিকে। সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম ন্যাশ ভাইদেও নিয়ে পরের প্লেনটা আসবার জন্য। ওখানকার বারে বসা লোকটা আমাদের কাছে জানতে চাইলো আমরা ওয়ারশ যাচ্ছি কিনা ! সব কিছুই একেবারে নৈমিত্তিক সাদামাটা অথচ খুব আরামপ্রদ ছিলো। কেবলমাত্র ইঞ্জিন থেকে বের হয়ে আসা এস্টর অয়েলের বিরক্তিকর গন্ধটাই ছিল সব কিছুর মাঝে ব্যতিক্রম। প্লেনটা বেশ ছোট ও দ্রুতগামী হওয়ায় আর খুব সকাল সকাল আমাদের আকাশ ভ্রমনের সময়টার কল্যাণে কোনো রকম এয়ার সিকনেস ছিলো না কারোই।
অপেক্ষার ফাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম আমি রিফ্রেশমেন্ট বারের পেছনে বসা লোকটাকে।
“সবশেষ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলে কবে?”
“গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি”, সে জানালো। “তিন জন মারা গিয়েছিলো”।
আমরা যখন এই আকাশ ভ্রমণে ঠিক সেই সকালেই দক্ষিণ ফ্রান্সে পূন্যার্থী বহনকারী ধীরগতির একখানা ট্রেন পর্বত শ্রেণীর ভেতর দিয়ে যাওয়ার কোন এক সময়ে অনেক উঁচু থেকে পিছলে টেলিস্কোপের আনুলাম্বিক দৃষ্টি পথের মতোন খড়ো এসে পড়েছিলো পর্বতের শুরুর দিকে পথ বেয়ে উঠতে শুরু করা আর একটা ট্রেনের ওপর। দুটো ট্রেনই খন্ড-বিখন্ডে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। তিরিশ জনেরও বেশী লোকের প্রানহানি ঘটিয়েছিলো সেই দুর্ঘটনা। সেই জুলাই দুর্ঘটনার পর প্যারিস স্ট্রসবার্গ রুটে ট্রেনযাত্রী কমে গিয়ে ট্রেনের বাণিজ্যিক সংকট শংকা তৈরী করেছিলো। তবে তা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আবার কিন্তু সেই আগের মতোন ভীড় জমিয়েই ট্রেনে চড়ছে মানুষ। অন্য সব রুটে যেমন, সেই প্যারিস স্ট্রসবার্গ রুটেও তেমনি।
[ আর্ণেস্ট হেমিংওয়ের পত্রিকায় প্রকাশিত কলামের সংগ্রহ নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে অনুবাদ। ]
২১-২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
১ম B-)
অনুবাদ ভালো লেগেছে ভাইয়া।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ধন্যবাদ অনেক অনেক।
বাড়তি ধন্যবাদ প্রথম মন্তব্যের জন্য 🙂
জম্পেস ছিল 🙂
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
বিশেষ কোনো কিছু নয়।
তবু তাঁর লেখার ঢং আর সর্বোপরি সেই সময়ের একটা চিত্র।
লেখক হিসেবে তার বই আমরা পড়লেও সাংবাদিক হিসেবে কলাম সবাই পড়েনি।
সেই সুবাদে তাঁর নির্বাচিত কলামের সংকলন বইটা অনুবাদের একটা ইচ্ছে মাথায় চেপেছে।
সেটার যন্ত্রণাটা এখানে ঢালা, এই যা।
লুৎফুল ভাই,
প্রথমে আসলে নিজেকে ধন্যবাদ দেবো, তাড়াহুড়ো করে এ-লেখাটা আগেই পড়ে না ফেলার জন্যে।
আজ একদম ঝাড়া হাত পা হয়ে ধীরে সুস্থে তারিয়ে তারিয়ে পড়লাম।
স্বাদু গদ্যের এমন স্বাদু অনুবাদ (একটুও বাড়িয়ে বলছিনা) সুলভ নয়।
আপনার কাছে জোর জোর দাবী থাকলো -- একটা উপন্যাস অনুবাদ করুন। আমার অনুরোধ হবে - অরহ্যান পামুকের কোন উপন্যাস। প্লিজ। (সম্পাদিত)
নুপূরের সঙ্গে আমি কিন্তু একমত লুৎফুল।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
সানা ভাই যে ব্যাপারে নুপূরদার সাথে একমত হলেন আমিও তাতে সমর্থন দিলাম। 🙂
উপন্যাস চাই
লুৎফুল ভাই। 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আমার দুস্তর নিয়তি যে ভালোবাসায় টেনে নেয় তাকে আলিঙ্গন করি আমি সহাস্যে সোতসাহে ...
🙂 🙂
হ, জুনাদা এন্ড গং এর সাথে ঐকমত্য জানাইলাম 😀
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
ওজনখানা নিজের বেড়ে হয়েছে কত স্টোন বলা মুশকিল।
গত রাতেই কথা হচ্ছিলো সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাথে। অলরেডী হেমিংওয়ের এই মোটা বইটা থেকে অনেকগুলো অংশ অনুবাদ করবো বলে স্থির করেছি। আর ইতিমধ্যে হাত লাগিয়েছি মধ্যপ্রাচ্যের নির্বাচিত কতগুলো ছোটগল্প অনুবাদের। যার প্রথমটা ছিলো "জেহরা"। এর পরে দেবো "মিউজিয়াম গার্ল" এটাও আর এক সিরীয় লেখকের।
ইতিমধ্যে ওসমান সেম্বেনের দুটা সাক্ষাৎকারের বই অনুবাদের ফরমায়েশও জুটেছে। আর জুটেছে ফুকোর একখানা সাক্ষাৎকার গ্রন্থেরও।
অরহ্যান পামুক। ভালো বলেছো। সত্যিই করতে পারলে দারুন হবে। কোনটা করা যায় !
লুৎফুল, বেশ স্বাদু এবং ঝরঝরে তোমার অনুবাদ টেনে নিয়ে গেল ৯০ বছর আগের ইউরোপে। দারুণ উপভোগ করলাম সেই সময়টাকে।
কাল তো তোমার সাথে এ নিয়ে অনেক কথা হলো। সাহিত্যমূল্য বাদ দিলেও ভালো সাংবাদিকদেরও লেখা শেখার জন্য প্রচুর পাঠ প্রয়োজন। কস্টটা সেখানেই। আমাদের সাংবাদিকরা না জানে ভাষা, না জানে পড়া। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
লিখো, লিখে যাও। অনুবাদ তোমার মতো লেখকদের হাতেই হওয়া উচিত। (সম্পাদিত)
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
আপনাদের অতসাহ আমার সাহস।
আমি চেষ্টা করবো সর্বান্তকরনে। আর তার উতপাত কিছুটাতো দেবো আবশ্যই এ ফোরামে।
এর চেয়ে ভালোবাসায় আর ভালোলাগার ফোরাম আর কোনটিইবা আছে ভাই !
উৎসাহ
উৎসাহ
বেশ লাগলো, লুৎফুল ভাই। দারুণ হচ্ছে অনুবাদগুলো।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
ভাই, তোমাদের ভালোবাসা আমার শুধু অনুপ্রেরণা নয়।
অঙ্গীকারের শেকড় ...
সাংবাদিক আর্ণেস্ট হেমিংওয়ের কলামের এই অনুবাদ কর্মটা বেশ চমৎকার হয়েছে। উপভোগ করলাম।
ধন্যবাদ ভাই।
এটা সেভাবে পাঠক নৈকট্য পায়নি।
তাই মনে হলো অনুবাদের কথাটা।