পাঠ-প্রতিক্রিয়া : গাং শালিখ

কিছু তার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।

রবি ঠাকুরের এই উক্তিটি কবিতার বেলায় ঠিক ঠিক খেটে যায়। একসময় ভাবতাম, কবিরা কেন কবিতার পরতে পরতে এমন করে রহস্য বুনে যান? এ কেমন প্রগলভতা? তবে কি ইচ্ছে করেই তাঁরা অমন করেন?

আমি মনে করি, বার বার পাঠে প্রতিবার একটি কবিতার পুনর্জন্ম হয় প্রতি পাঠকের কল্পনায়। ভিন্ন রূপে, ভিন্ন আদলে। অভুতভাবিত রহস্যের জন্ম দিয়ে। আমি পাঠ করে ভাবি, কবি হয়ত এমন করে ভেবেছেন। আপনি ভাবেন, অমন করে। এই মুহূর্তে ভাবি, তেমন করে বলেন নি তো! পরমুহূর্তেই এই আমিই অন্যরকম করে ভেবে অবাক হই, “আরে এমন করে তো ভাবি নি আগে!” এভাবেই একটি কবিতা সহস্র পাঠে সহস্র প্রতিমূর্তিতে প্রতিফলিত হয়, বহুকোণ বিশিষ্ট প্রিজমে প্রতিফলিত বহুবর্ণা আলোর বহু প্রতিমূর্তির মতো। একটির সাথে আরেকটির পুরোপুরি মিল নেই। শুধুই যে অমিল, তাও নয়।

এত সাফাই গেয়ে নেবার কারণ হলো, আমি একটি কবিতার পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছি। কবিতা নিয়ে আলোচনা নয়, শুধুই পাঠ-প্রতিক্রিয়া।  কবিতাটি পড়ে আমার ভেতরে নতুন যে কবিতাটি জন্ম নিয়েছে সেটি সম্পর্কে দু’টি কথা জানাতে এসেছি। এর বেশি কিছু নয়! হয়ত আমার এ বোধ নিতান্তই অর্বাচীন। পিপীলিকাসম, তবু তার পাখা আছে।

শিরোনামেই স্পষ্ট, কবিতাটি একটি অনাদরে হারিয়ে যেতে বসা পাখিকে নিয়ে লেখা। বিলুপ্তির পথগামী পাখিটি এই বাংলারই।  ‘গাং শালিখ‘। কবি কেন জানি ‘গাঙ’ লিখেন নি। যাহোক, আমার ভেতরে পুনর্জন্ম নেয়া কবিতাটির নাম দিলাম, ‘গাঙ শালিখ’। শুরুটা এমন,

লোকালয়ে রেখে গেছো কতোটা অভিমান!
শহর-নগর ভরা সব মানুষ সমান!

একটি শালিখ, একদিন সে এখানে ছিল, এখন চলে গেছে। বস্তুতঃ এখানে তারই নীড় ছিল, অনাবিল প্রকৃতির কোলে, গাঙ-জংলার ধারে। তারপর হয়ত এখানে সূচিত হয়েছে দর্পিত লোকালয়। মানুষের আত্মকেন্দ্রিক প্রয়োজনে প্রতিদিন তা একটু একটু করে বেড়েছে। আর আদিবাসী পাখিটি একটু একটু করে হারিয়েছে তার অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র ও আনন্দ, নিজভূমে হয়েছে পরবাসী। গাঙ-জংলার সবটুকুই হয়ত একসময় বিলীন হয়েছে। সর্বগ্রাসী দখলের রূঢ়তাপ সহ্য করতে না পেরে একসময় পাখিটিকেও চলে যেতে হয়েছে। সাতপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে যাওয়া উদ্বাস্তুর মতন। যাবার বেলায় সেই লোকালয়ে, সেই লুটেরা শহর-নগরে পাখিটি কতটুকু অভিমান রেখে গেছে, কবি যেন সযতনে তারই পরিমাপ করতে চেয়েছেন। এটুকু স্পষ্ট।

টিয়ে, ফিঙে, দোয়েল, হড়িয়াল ছেড়ে কবি কেন গাঙ শালিখকে বেছে নিলেন? আমাকে ভাবায়। যে পরিণতি কবির মনকে ব্যথিত করেছে, সকল সবুজ টুকরো টুকরো করে দূষণ-দখলের যে মচ্ছব তাঁর অনুভূতিকে পীড়িত করেছে, জীবনানন্দকেও কি সেই একই বোধ পীড়িত করে নি? অন্ততঃ ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে ঘুরে ঘুরে কেঁদে কেঁদে উড়ে উড়ে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে গেছে যে চিল, সেও তো হয়েছে অভিমানী রাঙা রাজকন্যার রূপ নিয়ে দূরে চলে যাওয়ায় ব্যথিত। আমরা যদি জীবনানন্দে আরেকটু ডুব দেই, তবে আমরা এই শালিখটিকেও খুঁজে পাবো। সেও এক বেদনাগন্ধী বিষণ্ণ পাখি। হেমন্তের শেষে হলুদ ঠ্যাঙ দুটি উঁচু করে অফুরন্ত ঘুমের শান্তিতে মৃত্যুর কোলে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়। এই পাখিটিকে আমরা আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ-র কবিতাতেও বর্ণিত হতে দেখি,

বাড়ীর পাশে ডোবা পুকুর
চোখ তুলতে জারুল ফুল
আধময়লা শাড়ীর মতো গোধূলি
ডোবা পুকুর, জারুল ফুল, গোধূলি
এগুলোর সাথে আমার মায়ের খুব মিল
মা কি শালিখ পাখি?
খয়েরি শাড়িতে তার বাদামির ছোপ
তারপর একদিন তিনি শুভ্র কাফন পরে ভোরের বকুল

তবে কি শালিখ পাখিটি আমাদের বসুমতী মাতারও প্রতিরূপ?

কিন্তু কবি যখন বলেন, ‘শহর-নগর ভরা সব মানুষ সমান!’ তখন কি আমাদের মনে একটু হলেও রহস্যের সৃষ্টি হয় না? আপাততঃ এ রহস্যকে অনাবিষ্কৃত রেখেই কবিতার শরীর বেয়ে নিচে নামি,

দরাজ দালান আর লাইটপোস্টের
বাগান তোমার কাড়ে নাই একটুও
মন, কাড়ে নাই কারখানা, শ্রমিকের দল,
পার্কের জোড়ামুখ, সাজানো লেকের
পাড়, গ্রীলের গেটে বোনা বোগেনভেলিয়া, নীল
অপরাজিতা, ছাদে ও বারান্দায়
গহনার মতো রাখা দুষ্প্রাপ্য ফুল,
ক্যাকটাস কিংবা সেই সব নাগরিক
সভাসদ, গেলো বছর যারা আইল্যান্ড
মুখর করে লাগিয়েছিলো কৃত্রিম
মার্বেলে আঁকা রংগীন লতা পাতা কুল।

লক্ষ্য করুন, কবি যেন ইচ্ছে করেই বর্ণনার পরতে পরতে জৌলুস বুনে যাচ্ছেন, অথচ সেইসব সৌকর্য নিদারুণ ব্যাঙ্গ ছুঁড়ে দিচ্ছে নিজেদের দিকেই। ‘লাইটপোস্টের বাগান’, ‘গহনার মতো রাখা দুষ্প্রাপ্য ফুল’, ‘মার্বেলে আঁকা রংগীন লতা পাতা কুল’, এসবের অন্তঃসারশূন্যতা যেন ফিরে ফিরে নিজেদেরই ব্যাঙ্গ করছে প্রতিবার, প্রতিপলে। কী অপূর্ব অথচ অনিবার্য বিরোধাভাস! কারণ এখানে সভ্যতাকে ব্যাঙ্গ করে গোঁয়ার প্রকৃতিরই তো শাসন করবার কথা।  কেমন সেই শাসন? কবির ভাষায়,

শাপলা শালুক কচুরীরা যেখানে
জলের বুকে স্বপ্ন আঁকে ভীষণ
পাগল করা এক অলৌকিক ঘ্রাণে ।
সন্ধ্যা লাগা ঘাস ও গাছেদের গানে
আঁধার নামলেই জলের বুকে পিঁড়ি
পাতে মন্ত্রমুগ্ধ চাঁদ সন্ধানে ।

আহা, কী চিত্রময় ও মায়াবী!

একবার চীনে গিয়েছিলাম, সরকারি অতিথি হয়ে। প্রায় পনের দিনের সফর। পাঁচতারা হোটেলে কী খাতির-যত্নেই না রেখেছিল তারা। লাঞ্চে-ডিনারে কত পদের কত নাম না জানা খাবারের ডিশ! সাগরের তলা থেকে শুরু করে অন্তরীক্ষের ছাদ পর্যন্ত সর্বত্র চষে আনা জীব ও উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি অভিজাত বিলেতি খাবারের সুতীব্র চোখের মদির আমন্ত্রণ আমাকে টানেনি তবু। আমি শুধু শান্তিমত একথালা ভাত খেতে চেয়েছিলাম, একটু সালুন দিয়ে, একটি কাঁচা লঙ্কা মেখে। পাখিটার কি তেমনই হয়েছিল? আপন আনন্দে, বান্ধব পরিবেশের কোলের মমতায় যে নিজস্ব ভুবন সে গড়ে নিয়েছিল, সেখানেই সে থাকতে চেয়েছিল নিজের মত করে, নিজস্বতা সম্বল করে! গান গাইতে চেয়েছিল একান্তই নিজের খেয়ালে!

কবিতার পংক্তি ধরে ধরে আরেকটু এগিয়ে যাই। পড়ি,

নিঃসংগ মাচার নীচে গাছেদের
ছায়ারা যেখানে, নিস্তরংগ
জীবনেরে দিয়েছে মোহন হাতছানি,
ঘাসফুল বুনোলতা স্নায়ুবশ ঘ্রাণে বুনি
কিনারে বহতা নদীরে জীবনের
মাঝখানে সখ্যসন্ধানে নিছে টানি ।

হঠাৎ যে মনে হয়, আমিও কি চাইনি এমনই জীবন? তবে পাখিটি কী আমি?

কবিও হয়ত চান, যে পাঠক তাঁর লেখাখানি পড়ছে, সে নিজে নিজেই কল্পনা করে নিক না কেন সুন্দরের আরেকটি প্রতিমূর্তি, নিজের মনের মত করে! তাই প্রতিবার পঠনে যে লেখা নতুন কল্পনার, নতুন বোধের, নতুন অজানা রহস্যের জন্ম দিতে পারে, কবিতা হয়ত আমরা তাকেই বলি।

৩,৩৩৭ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “পাঠ-প্রতিক্রিয়া : গাং শালিখ”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    সিসিবির পাতাটা খুলেই চলে গিয়েছিলাম বাইরে । পড়বো নতুন লেখাগুলো, তা আর হয়নি। ওভাবেই ছিলো খোলা পড়ে ...
    অনেক পরে এসে ঘুমন্ত মনিটর জাগিয়ে তুলে চমকে উঠলাম প্রথম শিরোনামে ।
    বোঝা গেলো মন্তব্যে ছুঁড়ে দেয়া কথাটুকু ছিলো না তোমার কেবলি কথার কথা ।
    মোস্তফা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরবার জন্য ।
    ঋদ্ধ হলাম । কৃতজ্ঞ হলাম ।
    যথার্থ বলেছো ।
    ছবি নিয়ে লেখার প্রয়াস দেখে এক ভার্চুয়াল বন্ধু তার প্রকৃতি দর্শনেচ্ছু ভ্রমণের এই ছবিটা পাঠিয়েছিলো আমাকে ।
    কিছু লিখবার জন্য । কর্মব্যস্ততা খুব একটা সুযোগ দিচ্ছিলো না বেশ কিছু দিন ।
    এর মাঝে একদিন লেখা হয়ে গেলো ...
    আর হ্যাঁ । ঠিক যেসব কথা আর ব্যাখ্যার আংগিক তুলে এনেছো তেমন ভাবনাগুলোই কাজ করছিলো মনে ।
    কতোটা যুতসই তুলে আনতে পেরেছিলাম ভাবনাগুলো ... প্রকৃতির আর্তনাদ, নাগরিক ইট-কাঠের জীবনের প্রতি ব্যাঙ্গ তা নিশ্চিত ছিলাম না কোনো পরিমাপকের মাপকাঠিতে । তবে সেই লেখা পোস্ট করবার পর মন্তব্যে আর আজ এই পাঠ প্রতিক্রিয়া পড়ে সার্থকের চেয়েও বেশী প্রাপ্তির অনুভূতি মন উপচে আসছে ...
    গাং শব্দটায় "উয়"ই লিখতে চেয়েছিলাম । টাইপিং-এর অপারঙ্গমতায় তা তেমনই রয়ে গিয়েছিলো "অনুস্বারে" । ‘গাঙ শালিখ’ (এখন কপি করে আনলাম) - এভাবেই ।

    আবারো অনেক ধন্যবাদ । (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আমি মনে করি, বার বার পাঠে প্রতিবার একটি কবিতার পুনর্জন্ম হয় প্রতি পাঠকের কল্পনায়।
    আমারও তাই মনে হয়।
    তোমার আলোচনার ঢংটি চমতকার। আর শব্দ যেখানে যেটি বসাও মনে হয় শব্দটি যেন তৈরি হয়েই ছিলো।


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "তবে পাখিটি কী আমি?" - আমারও তো মনে হয় যে পাখিটি আমিই!
    "তাই প্রতিবার পঠনে যে লেখা নতুন কল্পনার, নতুন বোধের, নতুন অজানা রহস্যের জন্ম দিতে পারে, কবিতা হয়ত আমরা তাকেই বলি"
    চমৎকার উপসংহার!

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এ লেখাটি প্রথম দিনেই অশেষ মুগ্ধতা নিয়ে পড়েছিলাম। লেখার উপায় ছিলোনা ব্যস্ততার অজুহাতে। কিন্তু মাথায় ছিল -- শব্দগুলো, সযত্ন পাঠপ্রতিক্রিয়ার অনুরণনটুকু।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।