মিল-অমিলের খেলা

এবার একটু মিলের কথা পাড়ি। ছন্দ বুঝা যতটা কঠিন, মিল কিম্বা অমিল বুঝা ততোটা নয়। জানি, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। তবু এ সামান্য প্রয়াস।

কথা যখন বলব তখন কোন একটি কবিতাকে তো বেছে নিতে হয়, তাই না? এমন একজন কবির সন্ধান করা যাক, যিনি আধুনিক কবি হিসেবে পেয়েছেন ব্যাপক খ্যাতি। সাকুল্যে ১৩০ খানা কবিতা লিখেছেন মাত্র। তবু মহৎ পাঁচের খাতায় নাম লিখিয়েছেন অনায়াসেই। আর হ্যাঁ, আধুনিক কবি হয়েও তিনি কিন্তু একটিও গদ্য কবিতা লিখেন নি। সুতরাং মিল দিলেই যে আপনি সেকেলে, তা কিন্তু ঠিক নয়।

আমাদের এই কবির নাম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর একটি আশ্চর্য কবিতার মিল-বিন্যাস নিয়ে কথা বলি।

কবিতাটির প্রথম কয়েকটি চরণ এরূপ,

উত্তীর্ণ পঞ্চাশ বনবাস প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে
অতঃপর অনিবারণীয়; এবং বিজ্ঞানবলে
পশ্চিম যদিও আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে
ইদানীং তবু সেখানেই মৃত্যুভয় যৌবনের
প্রভু, বার্ধক্যের আত্মপহারক। অশ্রুত তাড়ক

অর্থাৎ কিনা, বয়স যখন পঞ্চাশ পেরুবে তখন প্রাচীন প্রাজ্ঞদের মতে বনবাসে যাওয়া মঙ্গলকর। তারপর শরীরের ব্যাধি আর নিরাময়যোগ্য নয়। যদিও বিজ্ঞানের কল্যাণে পশ্চিমের দেশগুলিতে মানুষের আয়ু সামান্যকিছু বেড়েছে তবুও সেখানের মানুষের মনে মৃত্যুভয় অনেক বেশি প্রকট। আপাতঃ দৃষ্টিতে টানা গদ্য কবিতা। একটুও মিলের বালাই নাই। কিন্তু যদি এভাবে বিন্যস্ত করি, তবে কেমন দেখায়?

উত্তীর্ণ পঞ্চাশ

বনবাস

প্রাচ্য প্রাজ্ঞদের মতে অতঃপর অনিবারণীয়;

এবং বিজ্ঞানবলে পশ্চিম যদিও

আয়ুর সামান্য সীমা বাড়িয়েছে ইদানীং তবু

সেখানেই মৃত্যুভয় যৌবনের প্রভু,

বার্ধক্যের আত্মপহারক।

এই হলো অন্তর্মিল। চরণের শেষে নয় ভেতরে ভেতরে লুকিয়ে থাকা মিল।

একই কবিতার অন্য কয়েকটি চরণের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সেখানে ‘যযাতি’ বলছেন যে তাঁর জন্য অনুতাপ করা সংগত নয়। কারণের বিশদ ব্যাখ্যায় যাই না। কারণ আমরা মিল-অমিলের খেলা দেখতে বসছি, ‘মহাভারত’ অধ্যয়নে নয়। সেটাই দেখি বরং,

অবশ্য আমার
পক্ষে সংগত যে নয় অনুতাপ, সে-কথা স্বীকার
করি; কারন যদি মগ্ন শৈলে আমার মাতাল
নৌকা বানচাল হয়ে বর্তমানে বিশিষ্ট কঙ্কাল
অপ্রাপ্ত সৎকার শব পচে পচে অস্থিসার যেন
তথাপি সেকালে নিরুদ্দেশ যাত্রার সংজ্ঞায় হেন

প্রতিটি চরণের শেষ শব্দটি লক্ষ্য করুন। বাঁকা অক্ষর দিয়ে নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। স্পষ্ট বুঝতে পারছেন মিলের খেলা। এটা অন্তঃমিল

এবারে অমিল। হ্যাঁ, একই কবিতার অন্য কিছু চরণে,

ভেলা
আমি ভাসিয়েছিলুম একদা তাদেরই মতো, আজ
এটুকুই আমার পরম পরিচয়। আমাকেও
লক্ষ্যভেদী নিষাদের উল্বন উল্লাস উদাসীন
নদীর উজানে দিয়েছিল অব্যাহতি মাল্লাদের
গুণটানা থেকে…

যেমন খুশী বিন্যস্ত করে দেখুন না কেন, কোনভাবেই কোন মিল বের করতে পারবেন না। অমিল

এবার নিজেই নিজের পরীক্ষা নিয়ে ফেলি।

কিন্তু গত শতকেও উল্লিখিত ত্রাসের সন্ধান
পায়নি স্বয়ং র্যাঁ বো, সার্বজন্য রসের নিপান
মৃগতৃষ্ণানিবারণে অসমর্থ বলে, সে যদিও
ছুটেছিল জনশূন্য পূর্ব আফ্রিকায়, পরকীয়…

কি ধরণের মিল?  অন্তঃমিল। পেরেছি।

এবারে একটু গভীরে যাওয়া যাক।

উপরন্তু, দেবযানি শর্মিষ্ঠার কলহকলাপে
আমার অদ্বৈতসিদ্ধি পন্ড হয়ে থাক বা না থাক,
অকাল জরায় আমি অবরুদ্ধ নই শুক্রশাপে;
অজাত পুরুষ, সঙ্গে ব্যতিহার্য নয় দুর্বিপাক
অর্থাৎ প্রকট বলে সম্ভোগের নও বঞ্চনা,
পঞ্চাশে পা না দিতেই, অন্তর্যামী নৈমিষে নির্বাক:
এবং রটায় বটে মাঝে মাঝে আজও উদ্ভাবনা
পরিপূর্ণ মহাশূন্য ভস্মীভুত জ্যোতিষ্কের প্রেতে,
প্রাক্তন অভ্যাস দোষে ভুলে যায়, মৌনের মন্ত্রণা
উন্নীত অমর কাব্যে কাগজের সুকুমার শ্বেতে।

এটিও অন্তঃমিল, তবে একটু ভিন্নতর। মিলগুলো পাশাপাশি চরণের শেষে নয় বরং একটু দূরান্বয়ী। এই হলো জটিল অন্তঃমিল

একই কবিতার ভেতরে নানারকম মিলের কুশলী খেলা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি না।  প্রতিটি স্তবকে ২২ টি করে পঙক্তি। প্রতিটি পঙক্তিতেই ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের নাচ। অক্ষরবৃত্তের নাচ নিয়ে আরেকদিন কথা বলা যাবে। আজ এখানেই ইতি। ও হ্যাঁ, কবিতাটির নাম ‘যযাতি’, ‘সংবর্ত’ কবিতাগ্রন্থের।

৩,৮৮২ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “মিল-অমিলের খেলা”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আবদুল মান্নান সৈয়দের "শুদ্ধতম কবি" পড়েছিলাম সেই তারুণ্যে । "শুদ্ধতম কবি" বোধে ও চর্চায় মানতে পারলে অবশ্যই যে কেউ হয়ে উঠবে শুদ্ধতম কবি ।
    তবে আমার হয়েছিলো এক জটিল অনুভূতি । সেই আনাড়ী শল্য চিকিতসকের মতোন । পড়ে মনে হয়েছিলো যে, কিছু না জানা বুঝে মনের আনন্দে লিখছি যা খুশী, লিখা হচ্ছে (মানে বেরুচ্ছে)। ওই জ্ঞান নেবার পর কলমকে ড্রয়ারে বা শেলফেই সাজিয়ে রাখতে হবে ।
    এমন ভাবনায় বার বার পড়তে শুরু করেছি । আর বারবার পড়া বন্ধ করে দিয়েছি । আবার কখনো কোনো কারণে কিংবা ঔতসুক্যে খুলে সেই বই কিছু একটা খুঁজেছি । তবে একটু খেয়াল রেখে লিখে গেলে এক সময় মনে হয় আপনাতেই কলমের ডগায় চলে আসে ।
    শামসুর রাহমানের এই বিষয়টা আমার মাথায় এমন একটা ভাবনা এনে দিতো যে, উনার বাজারের ফর্দ বা দৈনন্দিন জীবনের কথাগুলো প্রকাশেও বোধ করি মাত্রার হিসেবে শব্দ সাজানো থাকতো ।

    তোমার এ প্রচেষ্টাকে অগণন সাধুবাদ । চালিয়ে যাও ভাই । আর আমরা ঝালিয়ে যাই তোমার লেখা পড়ে পড়ে ।
    :boss: :boss:

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      'শুদ্ধতম কবি'-তে সৈয়দ সাহেব কী অসাধারণ নৈপুণ্যে জীবনানন্দকে বিভিন্ন আলোকে দেখার চোখগুলো উন্মোচিত করেছেন। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের ভাষাটা আমার কাছে কেমন যেন খটোমটো লাগে। মনে হয়, ভাষার গায়ে শলমা আঁকা উত্তরীয় চড়াতে গিয়ে তিনি যেন গলায় ফাঁস লাগিয়ে ফেলছেন। তবু তাঁর পাণ্ডিত্য অতুলনীয়, তাঁর দেখার পুঞ্জাক্ষী বহুভেদী।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
        • সাইদুল (৭৬-৮২)

          ভালোই হল অনুশীলন। অনেক সহজ করে লিখেছো মস্তফা।

          আমি এত কিছুর পরও কান ও মনের ভরসায়।
          আমার গল্প যখন পত্র পত্রিকায় একটু আধটু ছাপা হচ্ছে, তখন আমার গুরু, আমার প্রিয় শিক্ষক রফিক নওশাদ আমাকে সৈয়দ হকের গল্পের কলকব্জা ধরিয়ে দিলেন।
          এরপর সাত বছর আমি কিছু লিখিনি।
          পরে মনে হল, সৈয়দ হকের তো গল্পের কলকব্জা ছিলোনা, উনি রক্ত গোলাপের মত গল্প লিখলেন কী করে?


          যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

          জবাব দিন
          • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

            ছন্দ আর মিলের ব্যাপারে চোখের চাইতে কানই যে বড় হাকিম, তা অনস্বীকার্য। তবু সবকিছু মাপার তো বৈজ্ঞানিক (বিজ্ঞান মানে বিশেষ জ্ঞান--এই অর্থে) কিছু পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছে। এই ধরুন, সেই কবে থেকেই মানুষ দিন-রাত্রির হিসেব রেখেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ সেকেন্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হিসেব পর্যন্ত রাখা যাচ্ছে। অনেকটা এরকম।

            আপনার মন্তব্য পড়ে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতায় ছন্দের অপূর্ব কারুকাজ দেখে সমসাময়িক ক'জন কবি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কিভাবে সেটি সম্ভব হলো। মুখার্জী বাবু উত্তরে কি বলেছিলেন, জানেন? বলেছিলেন, "কি জানি বাপু, আমি তো তোমাদের মতো অত ছন্দ-টন্দ বুঝিনে, ধোপার বাড়ির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলুম, মন লাগিয়ে কাপড় ধোয়ার ধপ ধপ আওয়াজ শুনলুম, আর তাই তুলে আনলুম কবিতায়!" এবার ভাবুন, শিখে-পড়ে অল্পই হয়, প্রতিভাই শেষতক কিস্তিমাত করে। তবে শিখে-পড়ে যে অল্পটুকু হয়, তারও অবদান কম নয় কিন্তু। এই ধরুন, কবি একটানে কিছু একটা লিখলেন। লেখা শেষে, ছন্দ-জ্ঞানের নিক্তিতে সেটা ফের যাচাই করে দেখলেন, তারপর আরো ঘষামাজা কারুকাজ করে অনিন্দ্যসুন্দর করে তুললেন লেখাটিকে।

            পাঠকের ব্যাপারেও এমন কিছু কথা খাটে। সম্ভবত: সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে, "শৈল্পিক ছবি দেখার জন্য দর্শকের ন্যূনতম শিল্পজ্ঞান থাকতে হবে"। একইভাবে একটা কবিতা বোঝার জন্য কবিতার পাঠকেরও ন্যূনতম কাব্যজ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে ছন্দের জাদু; রস সম্পর্কে জানা না থাকলে কাব্যরসের মজা - এগুলো পাওয়া সম্ভব না। সমস্যা হচ্ছে কবিতার পাঠকদের খুব কম অংশ এই কষ্টটা করতে চান। অথচ এই পরিশ্রমটুকু করলে সেটা তাকে বহু বহুগুণ বেশি ফিরিয়ে দেবে। (সম্পাদিত)


            দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

            জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    কত সহজ করেই না কত কঠিন কথাগুলো ব্যাখ্যা করলে ভাইয়া তুমি! সিসিবির সকল অকবির পক্ষ থেকে তোমার জন্য সশস্ত্র সালাম ::salute:: ::salute:: ::salute:: ::salute::

    আমি ভাবছিলাম, তুমি এই 'মিল অমিলের খেলা' কোন গ্রুপের অডিয়েন্সের জন্য লিখেছো, ভাইয়া। তোমার উদ্দেশ্য যদি হয়, কবিদের সাথে আলোচনা করা তাহলে আমার কোন কথা নাই, তবে আমার মত অকবিদের কথা ভেবে যদি লিখো, 'তাইলে আমার দুইখান কথা আছেগো', ভাইয়া!

    অকবিদের জন্য তুমি আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম টাইপ কবিতা দিয়ে আলোচনা শুরু করলে ভাল হতো; বলতে চাইছি আরো সহজবোধ্য এবং পরিচিত কবিতা দিয়ে শুরু করলে আমার মত অভাজনেরাও ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে গলাবাজি করতে পারতো এই আড্ডায়!

    তোমার লেখার সবিশেষ অনুরাগী পাঠক হিসেবে বলি, আরো ক'টি পবর্ লিখ তুমি আমাদের জন্য। অকবির তকমাটি বড় পীড়াদায়ক মনেহয় মাঝেমধ্যে!

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      মিল বা ছন্দজ্ঞান থাকলেই বা এই জ্ঞানের প্রয়োগ করতে পারলেই যে কেউ কবি হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়, সাবিনা। কাব্যগুণ বিবর্জিত এমন অনেক লেখাই পাবে। সেগুলো শুধু বাক্যের ব্যায়াম, কাব্য নয়।

      আমি আলোচনাটি সবার জন্যেই করেছি। ছন্দ-মিল মেনে যাঁরা লিখতে চান তাঁদের জন্য যেমন, কবিতায় ছন্দ-মিলের খেলা আবিষ্কার করে যারা আনন্দ পেতে চান তাঁদের জন্যও বটে। খুব সচেতনভাবেই এই কবিতা বেছে নিয়েছি, যাতে করে দেখানো সম্ভব হয়, একটিমাত্র কবিতায় কি করে নানা ধরণের মিলের এমনকি অমিলেরও সমাহার ঘটানো সম্ভব। লুকিয়ে থাকা মিলগুলো কি করে সচেতনে কান পেতে আবিষ্কার করতে হয়। আগডুম-বাগডুমের মত কিছু দিয়ে শুরু করা হলে এইসব উদ্দেশ্য কি সাধন হতো? তখন বাক্যের ব্যায়াম শিখে কিছু 'সিক্স-প্যাক' পদ্য দেখেই কাব্য বলে ভ্রম হত, আনন্দলাভের ঠিকুজী মিলতো না।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
      • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

        🙂 🙂 🙂 🙂

        রবি ঠাকুরের ছন্দ নামের গ্রন্থটি ইউরোপ থেকে অবশেষে আমার বাড়ি অব্দি পৌঁছুতে পেরেছিল ফরমাশ মত। আমার মত অস্থির অকবির জন্য ছন্দ অবশ্যই গুরুপাচ্য বিষয় তবুত্ত তৃষ্ণা মেটানোর বাসনা তো থাকতেই পারে। সেই মহতী উদ্দেশ্য নিয়েই পড়া শুরু করেছিলাম। হায়! তিনশো বাহাত্তুর পৃষ্ঠার বইখানি এখনো শেষ করতে পারিনি।

        হেমন্তবালা দেবীকে লেখা একটি পত্রে ঠাকুর বলছেন, ছবি ও গানে তুমি আমার ভাঙা ছন্দ দেখে হেসেচ- ভেবেচ ছেলেরা হাঁটতে গিয়ে যেমন পড়ে, ওর ছন্দপতনও তেমনি। ঠিক তা নয়- আমি আমি আজন্মকাল বিদ্রোহী- বালকবয়েসেও স্পধর্ার সংগে বাঁধা ছন্দের শাসন অস্বীকার করেই কবি-লীলা সুরু করেচি। বাঁধনে ধরা দিতে আপত্তি করিনে যদি সে ধরা দেবারও স্বাধীনতা থাকে। ঘরে বাস করতে হয় বলেই যদি বাগানে বেরোলেই লোকে চার দিক থেকে তেড়ে আসে তা হলে সেটা হোলো জেলখানা। বস্তুত কাব্যে দেয়াল-ছাঁদা ঘরও কবির, নিদর্েয়াল বাগানও তার। আমার কবিতার কোথাও কোথাও ছন্দের দেয়াল দেওয়া নেই বলে মনে কোরো না ইঁটের পাঁজা পোড়ে নি, মিস্ত্রির মজুরীর অভাব।

        তোমাদের সাথে আলোচনায় যোগ দিতে পারিনি বটে তবে মিল অমিলের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করি সর্বদাই!
        :hatsoff: :hatsoff:

        জবাব দিন
        • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

          বাহ, 'ছন্দ'-ও দেখছি বনেদি যাত্রী। গন্তব্য তার ইউরোপ থেকে ম্যারিকা। তবে আমি ওকে ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউটের ফুটপাথের সামনে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে কি মনে করে যেন তুলে এনে স্থান দিয়েছিলাম আমার ছোট্ট অনাড়ম্বর স্টাডিতে। এক দু'বার খুলে দেখেছিলাম, কিন্তু দাঁত ফোটাতে ইচ্ছে করেনি। ছন্দকে আমি আনন্দের জারকরসে ভেজাতে চাই, গুরুপাচ্য করে তুলতে চাই না।

          রবীন্দ্রনাথ ঠিকই লিখেছিলেন। ছন্দ যদি কাব্যের চাদ্দিকে দেয়াল তুলে দেয় তবেই ঝঞ্ঝাট! তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো' কবিতাগ্রন্থে ছন্দ ভাঙার বিষয়ে একটি চমৎকার কবিতা আছে। অনেক আগে পড়েছি, আবছা আবছা মনে পড়ছে, উদ্ধৃতিতে ভুল হতে পারে।

          জানিনা কিভাবে ছন্দের বারান্দা ভাঙা হবে
          মিস্তিরি মজুদ;
          .................................
          .................................
          বারান্দাও জেনে গেছে ভাঙায় সকলে নয় দড়!
          ভাঙারও নিজস্ব ছন্দ আছে
          অপরূপ ভাবে ভাঙা গড়ার চাইতেও সুন্দর!


          দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

          জবাব দিন
  3. টিটো মোস্তাফিজ

    এ ব্যাপারে আরো লিখুন ভাই। আমি কাব্যজ্ঞানে গণ্ডমুর্খ একজন। বাংলার কিছু ছাত্র এবং শিক্ষককে আমার লেখা পদ্য দেখিয়ে ছিলাম। তাদের মতে কিছু ছন্দ বা সমাজসচেতক বয়ান দিলেই কবিতা হয় না। আমার তখন ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। মন খারাপ করে পদ্য লেখায় ইতি টেনেছিলাম। কিন্তু আমার সহকর্মী এবং বন্ধু মিঠু বলছিল -ক্রিটিক্স আর নট পোয়েটস, চালিয়ে যাও বন্ধু! সিসিবিতে নূপুর সব সময় সমর্থন ও প্ররোচনা দিয়ে গেছে। আর আমি সমানে কবিতার সর্বনাশ করেছি। সব শালাই কবি হতে চায়- এ রকম আরও কিছু বচনামৃত প্রায়ই মন কে বলে - অনেক হয়েছে আর নয়।


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      তোমার বন্ধুটি একটি কঠিন সত্য কথা বলেছেন। জীবনানন্দ এই কথাটিকে তার 'সমারূঢ়' কবিতায় তীব্র শ্লেষ মাখিয়ে উপস্থাপন করেছেন। কবিতাটি পড়ে যেমন কবিতা লিখতে উতসাহ বোধ করি, তেমনি কাব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে হতোদ্যম হই।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  4. টিটো মোস্তাফিজ

    শিক্ষনীয় বিষয় অবশ্যই লিখুন ভাই। রেফারেন্স কাজে লাগবে। আর আমি আসলে খুব তাড়াতাড়ি মন খারাপ করি। আপনাকে বিব্রত করে থাকলে দুঃখিত।


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
  5. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    যাদের মন খুব তাড়াতড়ি খারাপ হয়, সুখের কথা হলো, তারা আবার খুব তাড়াতাড়ি সব ভুলে নির্মল হাসি হাসতে পারে।
    বিব্রত হবার মতো কিছু তো বলোনি। সত্যি কথা বলতে ও মেনে নিতে বিব্রত হবার কিছু নেই।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  6. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মিল অমিলের খেলাটা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। কবিতাকে দেখার, তার কারুকাজকে উপলব্ধি কত উপায় যে আছে -- অবাক হয়ে যাই। তবে নানা মন্তব্যে আপনার বক্তব্যের সারমর্মটুকুর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আমি। একটি সার্থক কবিতাকেই কেবল এমন উলটেপালটে নেড়েচেড়ে নানান রূপে দেখতে ভালো লাগে। ছন্দের নির্ভুল অনুশীলন দেখে তো কখনো কাব্য বলে ভ্রম হয় না! সেই রিনরিনে অনুভূতিও হয় না।

    আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় কবিতা কল্পনাদেবীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত হলে ছন্দ মেনে কি না মেনেও সার্থক হয়ে ওঠে -- পাঠকের মানসপ্রিয়া হয়ে উঠতে পারে। তবে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি - সব কবিতা সব সময় টানেনা। কখন যে কোন কবিতার যাদু আচম্বিতে উন্মোচিত হবে বলা ভার। একই কবিতার কখনো শুধু ছায়া চোখে পড়ে, কখনো বা কায়া।

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      আমি মনে করি শিখবার পর্বগুলি ছোট ছোট রাখাই ভাল। তাতে মনে রাখা সহজতর হয়।

      মিল কিম্বা ছন্দহীন হলেও বচন যেমন কাব্যগন্ধী হয়ে উঠতে পারে, তেমনি সুকাব্যের পরতে পরতে মিল কিম্বা ছন্দ দিয়ে সৃষ্টি করা যায় বিস্ময়কর শোভা।

      সৈয়দ শামসুল হকের কথা ধার করে বলি,

      একটি উপমা আমি প্রায়ই দিয়ে থাকি – চেয়ারের চারটে পা যদি মেঝেতে ঠিকমতো না-ই বসলো তো সে চেয়ার দেখতে যতই মনোহর হোক আমার তাতে কাজ নেই। চেয়ার বসবার জন্যে। মেঝের উপর জুত্‌ মতো সেটি বসতে হবে, তার পা চারটে স্থির মতো থাকতে হবে, কোথাও এতটুকু টলমল করবে না – তবে সে চেয়ারে আমি বসবো। বসে তারপর দেখব আসন কতটা আরামদায়ক, পিঠ কতটা সুখপ্রদ। সে সব হলো তো দেখব চেয়ারটির নকশা কেমন, পালিশ কেমন, সবশেষে যাচাই করব টেকসই কতদূর। তবেই সে চেয়ার হবে আমার চেয়ার। লেখা সম্পর্কেও আমার একই দাবী। লেখাটি মিস্তিরির হাতে ঐ চেয়ারের মতো পাকাপোক্ত হতে হবে। কবিতা হলে ছন্দের নির্ভুল ব্যবহার আমি দেখতে চাই; ছন্দ নির্ভুল তো আমি দেখব কবিতার অন্তর্নিহিত যে যুক্তির সিঁড়ি সেটি আছে কি না; থাকলে সে সিঁড়ি কতটা মজবুত। তারপর দেখব কবিতায় বলবার কথাটি জ্যামিতিক সম্পূর্ণতা পেয়েছে কিনা। এই জ্যামিতিক সম্পূর্ণতা বলতে বুঝাতে চাচ্ছি ত্রিভুজ কিংবা বৃত্ত অথবা আয়তক্ষেত্রের বা বর্গক্ষেত্রের তৃপ্তিকর একটি নির্মাণ। ছোট্ট করে এখানে বলে নিতে পারি যে, দৃষ্টিগ্রাহ্য উপমা ছাড়া মানুষ যে কিছুই আলিঙ্গন করতে পারে না, মানুষের এ এক অলঙ্ঘ্য সীমাবদ্ধতা। আর তাই আমার কল্পনায় মানুষের যে কোন সৃষ্টিশীল উচ্চারণ হয় বৃত্ত অথবা আয়তক্ষেত্র কিংবা ত্রিভুজ বা বর্গক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনীয়। কবিতায় মিস্তিরির হাত চৌকষ দেখতে পেলে আমি কবিতাটি কবিতা কিনা বিচার করতে বসবো। বলতে হবে না, মিস্তিরির কাজটুকু কবিতা নয়। আগে যে দৃষ্টির কথা বলেছিলাম, শিল্পীর সেই দৃষ্টিই রচনাটিকে এবার হয় কবিতা করে তুলবে অথবা তুলবে না। যদি না তোলে তো বড়জোর সাময়িক পত্রের একাংশ পূরণ করবার যোগ্যতা স্বীকার করে নেব মাত্র; আর যদি কবিতা হয়, যদি এমন করে এই কথাটি আর কেউ বলে না থাকে তো সে কবিতাকে সাময়িক পত্রের পাতা থেকে তুলে এনে অভিজ্ঞতার অন্তর্গত করে নেব, কিংবা কবিতাটি নিজেই তার প্রবল শক্তিতে আমার অন্তর্গত হয়ে যাবে। আসলে যে কোন ভাল লেখাই পাঠককে পরাস্ত করে তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে যায়।
      ... ... ...

      কিছুদিন আগে আমাদের প্রধান এক তরুণ কবি আমাকে তাঁর নতুন লেখা ছোট্ট একটি কবিতা দেখিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, এই কবি যাঁর বেশ কয়েকটি বই আছে, বাংলাদেশে সাহিত্য পাঠক প্রায় প্রত্যেকেই যাঁর কবিতা না হোক নামের সঙ্গে পরিচিত, তাঁর এই বারো লাইনের কবিতায় ছন্দটি নির্ভুল নয়। বিশেষ করে একটি লাইনে ছন্দের শোচনীয় পতন আমাকে দ্বিখন্ডিত করে যায়। স্বীকার করবো দশ বছর আগে হলে কবিতাটি কবির হাতে নীরবে ফিরিয়ে দিতাম; কিন্তু এখন সুকুমার রায়ের সেই নব্বই বছর বয়সী নাজিরের মতো আমিও ভাবি – একদিন তো মরবই, অতএব মন্ত্রীর জামা শুঁকে দেখতে ভয় কিসের? কবিকে ছন্দের ভুলটা দেখিয়ে দিতে আরো অবাক, তিনি বললেন, এ ভুল তাঁর নতুন নয়, তাঁর বিভিন্ন বইতেও এ ধরণের পতন রয়ে গেছে এবং এখন তিনি আর কিছু মনে করেন না। না, পারিনা, আমি ভাবতেও পারিনা, একজন কবি যদি তিনি কবি হন, এই অনুতাপ বর্জিত উচ্চারণ তাঁর, এই অকুঞ্চিত মুখ ঠিক তাঁরই।
      ... ... ...

      মিস্তিরি শিল্পী নন, কিন্তু প্রতিটি শিল্পীই নিপুণ মিস্তিরি। যে চেয়ারের পা টলমল করছে, পিঠ খোঁচা দিচ্ছে, তার নকশা যত নতুন হোক, ঘরে দিন দুয়েক রাখবার পর গৃহস্ত তাকে বারান্দায়, বারান্দা থেকে চাতালে, অবশেষে বিস্মৃতির গুদামে ফেলে রাখবেন। মহাকাল নির্মম এক গৃহস্থ; তিনি এইসব আপাত মনোহর আসবাব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
      ['মার্জিনে মন্তব্য', সৈয়দ শামসুল হক]


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      'কবিতার ক্লাশ' বইটি প্রাথমিকভাবে ছন্দ বোঝার জন্য খুবই ভালো। এখনও আজিজে একশ' টাকায় বিকোয়। কিন্তু বইটিতে মারাত্মক একটা সমস্যা আছে। সেটি হলো, বইটি আগা-গোড়া এমন একটা ধারণা দিতে পারে যে, বাংলা ছন্দ বোধহয় বর্ণ গুনে গুনেই বুঝতে হয়। যদিও শেষের দিকে নীরেন্দ্রনাথ - 'সব ছন্দই কি সিলেবিক?' এরকম একটা চ্যাপ্টার যোগ করে ধ্বনিভিত্তিক ছন্দ বিশ্লেষণের চেষ্টা করে বোঝাতে চেয়েছেন যে ছন্দ মূলতঃ কানের বিষয়। কিন্তু চ্যাপ্টারটি অতি জটিল। আর দ্বিতীয়ত এই চ্যাপ্টারটিতে আসার আগে ছন্দ সম্পর্কে ভুল ধারণা যা তৈরি হবার তা হয়েই যায়।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।