ছন্দে আনন্দভ্রমণ ৪

ছন্দে আনন্দভ্রমণ ১ (ভূমিকা ও মাত্রাবৃত্তের আলোচনা)

ছন্দে আনন্দভ্রমণ ২ (মাত্রাবৃত্তের উদাহরণ)

ছন্দে আনন্দভ্রমণ ৩ (স্বরবৃত্তের আলোচনা)

অক্ষরবৃত্ত
অক্ষরবৃত্ত বাংলা কবিতার বনেদী ছন্দ। এর মাত্রা গুনবার নিয়মটা হলো,

  • মুক্তদল (ওপেন সিলেবল) সবসময় পাবে ১ মাত্রা।
  • শব্দের শুরুতে কিম্বা মধ্যে থাকলে রুদ্ধদল (ক্লোজড সিলেবল) পাবে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা।

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যায়দণ্ড’)

চিত্ত = চিত্(১)+তো(১)=২ মাত্রা ; শব্দের শুরুতে থাকায় ক্লোজড সিলেবল ১ মাত্রা পাচ্ছে।
যেথা = যে(১)+থা(১)=২ মাত্রা ; ওপেন সিলেবল ১ মাত্রা পাচ্ছে।
ভয়শূন্য = ভ(১)+য়(১)+শূন্(১)+নো(১)=৪ মাত্রা ; শব্দের মাঝে থাকায় ক্লোজড সিলেবল ১ মাত্রা পাচ্ছে।
উচ্চ = উচ্(১)+চো(১)=২ মাত্রা।
যেথা = যে(১)+থা(১)=২ মাত্রা।
শির্ (২) = শব্দের শেষে থাকায় ক্লোজড সিলেবল ২ মাত্রা পাচ্ছে।

এবার পর্ব বিন্যাস করে দেখি,

চিত্ত যেথা/ ভয়শূন্য/ উচ্চ যেথা/ শির/
চিত্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ ভ(১)য়(১)শূন্(১)নো(১),/ উচ্(১)চো(১) যে(১)থা(১)/ শির্(২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।

জ্ঞান যেথা/ মুক্ত, যেথা/ গৃহের প্রা/চীর
জ্ঞা(১)ন(১) যে(১)থা(১)/ মুক্(১)তো(১) যে(১)থা(১)/ গৃ(১)হের্(২) প্রা(১)/চীর্(২)/
৪+৪+৪+২= তিনটি সম্পুর্ণ ও একটি অতিপর্বে মোট ১৪ মাত্রা।

তবে ঝামেলা বাঁধে অক্ষরবৃত্তের ক্লোজড সিলেবল হিসাব করতে। একটু উদাহরণ দেই,

প্রচলিত সূত্র: অক্ষরবৃত্তে ক্লোজড সিলেবল শব্দের প্রথমে এবং মধ্যে থাকলে এক মাত্রা আর শেষে থাকলে দুই মাত্রা পায় (প্রবোধচন্দ্র এই সূত্র দিয়েছেন)।

এই হিসেবে ‘সবসময়’ শব্দটার মাত্রাগণনা করি : সবসময়= ৪ মাত্রা ।
আবার অনেকে লিখে এভাবে :  সব সময় = ২+৩= ৫ মাত্রা । 

ঝামেলাটা এখানেই। তাহলে কি লেখার ধরনের জন্য মাত্রা বদলাবে? নাকি বদলানো উচিত?

এমন ঝামেলার সমাধান দিতে আমরা ‘উচ্চারণসূত্র’-এর সহায়তা নেব। বিষয়টাকে যদি উচ্চারণসূত্র দিয়ে বিচার করি তবে দেখি, ‘সবসময়’ এই কথাটা যেভাবেই লেখা হোক না কেন; আমরা কিন্তু আলাদাভাবেই উচ্চারণ করি। মানে, ‘সব সময়’ (‘সব্সময়’ নয়)। ফলে যেভাবেই লেখা হোক না কেন উচ্চারণ অনুযায়ী ‘সবসময়’ কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ৫ মাত্রার দাবিদার। ল্যাঠা চুকে গেল।

‘একদিন/একজন’ দুই বাংলাতেই এটার লেখার তফাত নেই। ‌’একদিন/ এক দিন- একজন/এক জন’ দুভাবেই লেখা হয়। কিন্তু দুই বাংলায় উচ্চারণ করা হয় দু’ভাবে। বাংলাদেশে উচ্চারণ হয় ‘এ্যাক দিন/এ্যাক জন = ৪ মাত্রা; আর কলকাতায় ‘এ্যাগ্দিন/এ্যাগ্জন’= ৩ মাত্রা; (ক’ এর উচ্চারণ গ-তে বদলে যাবার সাথে সাথে শব্দদুটো জোড়া হয়ে উচ্চারিত হয়)।  এ তো দেখি নতুন ল্যাঠা!

উচ্চারণসূত্র দিয়ে এর একটা সমাধান বের করা সম্ভব।

ক) স্বরধ্বনি সূত্র: অক্ষরবৃত্তে ক্লোজড সিলেবলের লং ভাওয়েল পায় ২ মাত্রা আর শর্ট ভাওয়েল পায় ১ মাত্র
খ) ব্যঞ্জনধ্বনি সূত্র: ক্লোজড সিলেবলের স্বতন্ত্রভাবে উচ্চারিত কনসনেন্ট সাউন্ড পায় ১ মাত্রা আর যুক্তভাবে উচ্চারিত (২টা কনসোনেন্ট সাউন্ড) পায় ১ মাত্রা। সব স্বরধ্বনিও পায় ১ মাত্রা।

এই সূত্র ধরে যদি হিসাব করি তাহলে কী দাঁড়ায়?

সবসময়

স্বরধ্বনি সূত্র: ‘সব’ এ ‘স’ এর পরে ব্যবহৃত ‘অ’ লং ভাওয়েল। একইভাবে ‘সময়-এ ‘স’ এর সাথে ব্যবহৃত ‘ও’ লং ভাওয়েল= স/২+ব+ সো/২+ম/১ (য়)= ৫ মাত্রা (শেষ ম শর্ট ভাওয়েল)। 

ব্যঞ্জনধ্বনি সূত্র: ‘সবসময়’-এ ব এবং স স্বতন্ত্রভাবেই উচ্চারিত হয়। সুতরাং দুটোই ১ মাত্রা করে পাচ্ছে। অর্থাৎ,  স/১+ব/১+ স/১+ম/১+য়/১= ৫ মাত্রা

একজন

বাংলাদেশ উচ্চারণ= এ্যাক জন।
স্বরধ্বনি সূত্র: ‘এ্যা’= লং ভাওয়েল। ‘জ’-এর সাথের অ/ও= লং ভাওয়েল।
সুতরাং এ্যা/২+(ক)+জ/২+(ন)= ৪ মাত্রা।
ব্যঞ্জনধ্বনির সূত্র: ক এবং জ স্বতন্ত্রভাবেই উচ্চারিত হয়ে ১ মাত্রা করে পেয়ে হচ্ছে ২ মাত্রা।
সুতরাং, (এ্যা/১+ক/১+জ/১+ন/১= ৪ মাত্রা)।

কলকাতা উচ্চারণ= এ্যাগ্জন (ক’র উচ্চারণ গ-তে পরিবর্তিত এবং গ+জ যুক্তভাবে উচ্চারিত)।
স্বরধ্বনি সূত্র: ‘এ্যা’ শর্ট ভাওয়েল। ফলে ১ মাত্রা পাচ্ছে। ‘জ’-এর সাথের অ/ও= লং ভাওয়েল; ফলে পাচ্ছে ২ মাত্রা। ‌এ্যা/১+(গ্জ)অ/ও)/২+(ন)= ৩ মাত্রা।
ব্যঞ্জনধ্বনির সূত্র: গ এবং জ একসাথে উচ্চারিত হয়ে পাচ্ছে মোট ১ মাত্রা (এ্যা/১+গ্জ/১+ন/১= ৩ মাত্রা।

এই সূত্র ধরে অন্য উদাহরণ দেখুন।

হরতাল (উচ্চারণ হর্তাল) = ৩ মাত্রা।
কাকতাল (উচ্চারণ কাক তাল; কাক্তাল নয়) = ৪ মাত্রা।

এখানে আলোচনায় বাংলা উচ্চারণের যে দুটো সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে তা হলো :

ক) বাংলায় যুক্তাক্ষরের আগের ভাওয়েল সব সময় শর্ট ভাওয়েল হিসেবে উচ্চারিত হয়।
খ) যদিও বাংলা বর্ণে মাত্র কয়েকটি ভাওয়েলের লং আর শর্ট ফর্ম আছে। কিন্তু উচ্চারণে মৌলিক সাতটি ভাওলেরই লং আর শর্ট ফর্ম আছে।

এবারে অক্ষরবৃত্ত নিয়ে বিশদ আলোচনা হোক।

অক্ষরবৃত্তের বিন্যাস

চার বা চারের গুণিতকের সাথে দুই যোগ করলে যে সংখ্যাটি পাই, সেই সংখ্যক মাত্রা দিয়েই তৈরি হয় অক্ষরবৃত্তের লাইন (ব্যতিক্রম আছে)। অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতার লাইনগুলো সাধারণত এভাবে বিন্যস্ত থাকে,
১। ৪+২=৬ মাত্রা ; ৪ মাত্রার একটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
২। ৪+৪+২=১০ মাত্রা ; ৪ মাত্রার দুটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৩। ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রা ; ৪ মাত্রার তিনটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৪। ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রা ; ৪ মাত্রার তিনটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৫। ৪+৪+৪+৪+২=১৮ মাত্রা ; ৪ মাত্রার চারটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৬। ৪+৪+৪+৪+৪+২=২২ মাত্রা ; ৪ মাত্রার পাঁচটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৭। ৪+৪+৪+৪+৪+৪+২=২৬ মাত্রা ; ৪ মাত্রার ছয়টি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।
৮। ৪+৪+৪+৪+৪+৪+৪+২=৩০ মাত্রা ; ৪ মাত্রার সাতটি পূর্ণ পর্ব আর ২ মাত্রার একটি অতি পর্ব।

মাত্রার সংখ্যা চার চার করে বাড়ছে, শেষে জিরিয়ে নেবার জন্য বাড়তি ২ মাত্রার একটি অতিপর্ব। কি সোজা তাই না? কবিতার শরীরে দেখি,

১০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত

সে এক সকাল বেলা খুব
ঘরের জানালা খুলে দিয়ে
চোখ শুধু দেখেছিলো আলো
যুদ্ধহীন পৃথিবীর রূপ
ঝরে পড়ছে শান্ত মাটিতে।
(ভাস্কর চক্রবর্তী, ‘সময়ের চেয়ারে’)

অক্ষরবৃত্তের নিয়ম-চরিত্র মনে আছে তো? ওপেন সিলেবল সবসময় পাবে ১ মাত্রা। শব্দের শুরুতে কিম্বা মধ্যে থাকলে ক্লোজড সিলেবল পাবে ১ মাত্রা, শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা।

সে(১) এক্(২) স(১)/কাল্(২) বে(১)লা(১)/ খুব্(২)
ঘ(১)রের্(২) জা(১)/না(১)লা(১) খু(১)লে(১)/ দি(১)য়ে(১)
চোখ্(২) শু(১)ধু(১)/ দে(১)খে(১)ছি(১)লো(১)/ আ(১)লো(১)
যুদ্(১)ধ(১)হীন্(২)/ পৃ(১)থি(১)বীর্(২)/ রূপ্(২)

উপরে সবকটি চরণ ভেঙে ভেঙে দেখালাম, বাদ রাখলাম পঞ্চম চরণটি। প্রথম চার চরণে ৪+৪+২=১০ মাত্রা। এবারে পঞ্চম চরণে আসি। পঞ্চম চরণে কয় মাত্রা? ছন্দপতন ঘটেছে কি? টের পাওয়া যাচ্ছে? অক্ষর গুণে গুণে কিন্তু ঠিকই ১০ মাত্রা।

১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত : ৮+৬ বাঁধুনিতে

দশের বৃত্ত পেরিয়ে আমরা যখন ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে উপনীত হই, তখন বাড়তি ২ মাত্রার অতিপর্ব নিজেকে এমনভাবে ঢেকে রাখে যে তখন ওদের ছন্দের মূল চালেরই অঙ্গ বলে মনে হয়। কারণ লাইনের টুকরো টুকরো অংশের মধ্যে যেমন ছোট মাপের চাল থাকে, তেমনি গোটা লাইনেরও একটি বড় মাপের চাল থাকে। ছোট মাপের চালের দিকে তাকালে বাড়তি ২ মাত্রাকে আলাদা করে দেখতে পাই; কিন্তু বড় মাপের চালের দিকে তাকালে আর দেখতে পাই না। তখন ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রা রূপান্তরিত হয় ৮+৬ কাঠামোতে। উদাহরণ দিই,

হে দারিদ্র্য/ তুমি মোরে/ ককরেছ ম/হান
তুমি মোরে/ দানিয়াছ/ খ্রীস্টের/ সম্/মান।
(কাজী নজরুল ইসলাম, ‘দারিদ্র’)

ঠোঁট থেকে/ মুছে ফেলে/ জীবনের/ কণা
স্নায়ুর সন্তাপে শেষে পাও কি সান্/তনা?
(হাসান হাফিজুর রহমান, ‘অন্বিষ্ট অসুর’)

বুঝাই যাচ্ছে, ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রা। কিন্তু এভাবেও তো দেখা চলে,


হে দারিদ্র্য তুমি মোরে/ করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ/ খ্রীস্টের সম্মান।

ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে/ জীবনের কণা
স্নায়ুর সন্তাপে শেষে/ পাও কি সান্তনা?

৮+৬ কাঠামো ; ১৪ মাত্রার সনেট রচনায় এই কাঠামোটি ব্যাপক ব্যবহৃত।

১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত : ৮+১০ বাঁধুনিতে

এবারে চারের লাফে ১৪ পেরিয়ে ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে পৌঁছই,

সে-কথা ভু/লো না তুমি।/ ভুলো না পা/থর চাপা/ ঘাসে
তোমারি সৌ/হার্দে, নারী,/ ঈশ্বর শি/শুর মত/ হাসে।
(দিলওয়ার, ‘তোমাকে’)

অনন্ত ক/থার রাজ্যে/ তুমি এক/ নিঃসঙ্গ প/থিক।
মুক্তার ফ/সল তুলে’/ কবিতায়/ বর্ণের বা/হার
নিয়ত ছ/ড়িয়ে তুমি/ তারপর/ সুরের সে/তার
অলক্ষ্যে বা/জাও একা;/ সেইসুর/ ভোলে না ক’/ দিক।
(আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ‘কোনো কবির প্রতি’)

৪+৪+৪+৪+২=১৮ মাত্রা। কেমন কেটে কেটে গেছে তাই না। কিন্তু যদি অন্যভাবে দেখি ভালোই লাগবে, বোধকরি।


সে-কথা ভুলো না তুমি।/ ভুলো না পাথর চাপা ঘাসে
তোমারি সৌহার্দে, নারী,/ ঈশ্বর শিশুর মত হাসে।


অনন্ত কথার রাজ্যে/ তুমি এক নিঃসঙ্গ পথিক।
মুক্তার ফসল তুলে’/ কবিতায় বর্ণের বাহার
নিয়ত ছড়িয়ে তুমি/ তারপর সুরের সেতার
অলক্ষ্যে বাজাও একা;/ সেইসুর ভোলে না ক দিক।

হ্যাঁ, ৪+৪+৪+৪+২=১৮ মাত্রা পেল ৮+১০ কাঠামো, ১৮ মাত্রার সনেট রচনায় ব্যাপক ব্যবহৃত।
পাঠকের কাছ প্রশ্ন, নীচের ১৮ মাত্রার কবিতাংশটি ভালো করে লক্ষ্য করুন। এবার বলুনতো এর কাঠামোটি কি রকম?

সবুজ চাঁদের নীচে প’ড়ে আছে আমার শরীর।
চেতনা, তারার নীচে। আমার চিৎকার উঠে যায়
অলীক ফিটনে চ’ড়ে ঘুরে ঘুরে আরক্ত চাকায়
নীল শূন্যে। নদী : আমার জীবন : বাকী সব তীর।
(আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘মরণের অভিজ্ঞান’)

২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত


ইতিহাস/ ছেনে তারা/ স্বপ্ন দেখে/ একদিন/ সুন্দর আ/গামী
তাদেরি আ/সামি করে/ রায় দেবে/ পৌরাণিক/ কয়েদ খা/নায়।
(সৌমিত্র দেব, ‘বাঙালি অতীত মুখি’)


আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
(জীবনানন্দ দাশ, ‘আবার আসিব ফিরে’)


বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি — চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম — বট — কাঠালের — হিজলের — অশথের করে আছে চুপ;
(জীবনানন্দ দাশ, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’)


যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে – দূর কুয়াশায়
চ’লে যাবো, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;- সেদিন দু’দণ্ড এই বাংলার তীর —
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;-
সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে –এই সোঁদা ঘাসের ধুলায়
(জীবনানন্দ দাশ, ‘যেদিন সরিয়া যাব’)


যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে
কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে –
(জীবনানন্দ দাশ, ‘যখন মৃত্যুর ঘুমে’)


একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ন বটের নীচে শুয়ে রব- পশমের মত লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে-বাঁকা চাঁদ জেগে রবে- নদীটির জল
বাঙ্গালি মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
(জীবনানন্দ দাশ, ‘একদিন জলসিড়ি নদীটির’)


ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর — চিল একা নদীটির পাশে
জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে;
(জীবনানন্দ দাশ, ‘ভিজে হয়ে আসে মেঘে’)

বুঝতেই পারছেন ‘রূপসী বাংলা’ জুড়ে ২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের ছড়াছড়ি।

২৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত


শ্যাম মেঘপুঞ্জ যথা ঢেকে রাখে আকাশের লজ্জাহীন নীলিম নগ্নতা,
বিদ্রোহী তৃণের দল অনাবৃতা ধরিত্রীর রুক্ষ বক্ষে পরায় বসন,
প্রেমের পবিত্র ব্যথা আচ্ছাদন করি’ রাখে কুমারীর কাম-চঞ্চলতা;―
তেমনি ঢাকিয়া রাখো তোমার রূপের স্বপ্নে আমার সমস্ত প্রাণমন।
(বুদ্ধদেব বসু, ‘অসূর্যস্পর্শ্যা’)


মাঠ থেকে মাঠে মাঠে — সমস্ত দুপুর ভরে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি — নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে
(জীবনানন্দ দাশ, ‘শকুন’)


মানুষের সঙ্গ ছাড়া আর সব ভালো লাগে; অতিশয় দূরে বেঁচে আছি,
পথের কুকুর দেখে মুগ্ধ হই, দেখি দূরে আজো ওড়ে মুখর মৌমাছি।
(হুমায়ুন আজাদ, ‘মানুষের সঙ্গ ছাড়া’)


তোমাকে ফিরিয়ে দেবো, এতোটা স্পর্ধার শক্তি অনুপূর্ব কোথায় আমার?
আজন্ম তোমার মুখ, তোমারই হাতের ছোঁয়া, ও-দুটি রাতুল পদচ্ছাপ
বুকের নিভৃতে রেখে, অশেষ এ-তমসায়, ত্রিতাপ- তৃষ্ণার শম খুঁজে
ঝড়ের শিরোপা নিয়ে পাহাড়-উদাস আমি পেরিয়েছি দীর্ঘ পরবাস।―
(ঊর্ধ্বেন্দু দাশ, ‘দেবী মুখ’)

৩০ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত

আছে আছে, রূপসী বাংলাতেই পেয়েছি। তবে পুরো কবিতায় নয়, একটি কি দু’টি চরণে।

দেখা যায় — রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ — রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসী
চলে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল ছেলের মতো রাজার ছেলের মতো মিলে
(জীবনানন্দ দাশ, ‘ঘাসের ভিতরে যেই’)


আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, — আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –
(জীবনানন্দ দাশ, ‘এইসব ভালো লাগে’)


দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি –
(জীবনানন্দ দাশ, ‘ভেবে ভেবে ব্যথা পাব’)

এই তো গেল রীতিসিদ্ধ অক্ষরবৃত্তের খেলা। তাহলে কি এই শেষ? না আরো আছে। আছে অক্ষরবৃত্তের ছোট বড় চাল। এই পর্বে শুধু দু’টো উদাহরণ দিই, পরের পর্বে বিস্তারিত লেখা যাবে।


ভালোবেসে/ দেখিয়াছি/ মেয়ে মানু/ষেরে, ৪+৪+৪+২
অবহেলা/ করে আমি/ দেখিয়াছি/ মেয়ে মানু/ষেরে, ৪+৪+৪+৪+২
ঘৃণা করে/ দেখিয়াছি/ মেয়েমানু/ষেরে; ৪+৪+৪+২
আমার সে/ ভালোবাসি/য়াছে, ৪+৪+২
আসিয়াছে/ কাছে, ৪+২
উপেক্ষা সে/ করেছে আ/মারে, ৪+৪+২
ঘৃণা করে/ চলে গেছে/ — যখন ডে/কেছি বারে/বারে ৪+৪+৪+৪+২
ভালোবেসে/ তারে; ৪+২
তবুও সা/ধনা ছিল/ একদিন/ — এই ভালো/বাসা; ৪+৪+৪+৪+২
আমি তার/ উপেক্ষার/ ভাষা ৪+৪+২
আমি তার/ ঘৃণার আ/ক্রোশ ৪+৪+২
অবহেলা/ করে গেছি;/ যে নক্ষত্র/ — নক্ষত্রের/ দোষে ৪+৪+৪+৪+২
আমার প্রে/মের পথে/ বারবার/ দিয়ে গেছে/ বাধা ৪+৪+৪+৪+২
আমি তা ভু/লিয়া গেছি; ৪+৪
তবু এই/ ভালোবাসা/ — ধুলো আর/ কাদা — । ৪+৪+৪+২
(জীবনানন্দ দাশ, ‘বোধ’)

আমার ফেসবুকের কবিবন্ধু হাসান আল জামীর একটি কবিতা দেখি,


প্রতীক্ষা প্রা/চীন ! ৪+২
আজন্ম বু/কের ভাঁজে/ জমে থাকে/ স্থির ; ৪+৪+৪+২
নেশাবৃত/ অন্ধকার-/ পাস্তুরিত/ হিমবাহ/ যেনো ৪+৪+৪+৪+২
হৃদয়ের/ নোনাজলে/ নিমগ্ন নি/বিঢ় ! ৪+৪+৪+২

আবেশের/ শীতঘুম/ শেষে, ৪+৪+২
কখন যে/ হৃতদিশা/ নেশা কেটে/ যাবে ! ৪+৪+৪+২
জীবনের/ আয়োজনে/ নির্নিমেষ/ সহসা স/রল ৪+৪+৪+৪+২
যতিচিহ্ন/ এঁকে দিয়ে/ – তবে ৪+৪+২
ভোরের রো/দের রঙে/ পাশে এসে/ দাঁড়াবে সুন্দর , ৪+৪+৪+৪+২
‘প্রতিক্ষা’ প্র/সূন ! ৪+২
(হাসান আল জামী, ‘প্রতীক্ষা’)

আজ এখানেই ইতি। জানি অনেকেই মাঝপথেই ইতি নিয়েছেন।

৩,০৩২ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “ছন্দে আনন্দভ্রমণ ৪”

    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      শিশুকেও তো একদিন দুধ ছাড়ান দিতে হয়, তাই না। শক্ত খাবার তুলে দিতে হয় পাতে। তারপর সারাজীবন ধরে কতই না মনোহর খাবারের স্বাদ নেয় তার পরিণত জিহবা। 'ফ্রি ভার্স'- অনেকটা সেরেলাকের মত। শ্রম এড়িয়ে যাবার জন্য এর ব্যবহার হলে তা রীতিমত ক্ষতিকর।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
        • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

          'ফ্রি ভার্স'-এর কথা যখন তুললেই, তখন এর সংজ্ঞাটা একটু দেখে নেই

          Free verse is a literary device that can be defined as poetry that is free from limitations of regular meter or rhythm and does not rhyme with fixed forms. Such poems are without rhythms and rhyme schemes; do not follow regular rhyme scheme rules and still provide artistic expression. In this way, the poet can give his own shape to a poem how he/she desires. However, it still allows poets to use alliteration, rhyme, cadences or rhythms to get the effects that they consider are suitable for the piece.

          অর্থাৎ প্রচলিত ছন্দ-বিন্যাস না মেনেও নন্দনচেতনা তৈরি করার প্রয়াস যাতে করে ছন্দের নিগড়ে সৌন্দর্যের নিটোল রূপটি সীমাবদ্ধ পরিসরে বাঁধা না পড়ে। সুতরাং আমরা দেখছি এর দু'টি অনুষঙ্গ। এক, প্রচলিত ছন্দ-বিন্যাস থেকে বের হয়ে আসা (ছন্দহীন হওয়া নয়); দুই, নন্দন চেতনা তৈরি করা। সেই বিচারে 'ফ্রি ভার্স' সহজ বস্তু নয়। তবে যদি, বিমূর্ততার দোহাই দিয়ে যথেচ্ছাচারী হবার বাসনাই প্রকটিত হয়, তবে সেই এলোমেলো পথচলা শুধু সহজই নয়, আয়াসবিহীনও বটে!


          দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

          জবাব দিন
  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    উচ্চারণসূত্র দিয়ে সমাধান বের করাটা খুব আরামদায়ক ।
    তবু লেখার মাঝে মাত্রার গোনাগুনতি অনেক ক্ষেত্রেই ভাবনায় ছেদ এনে দ্যায় ।
    অথচ প্রণিধানযোগ্য কবিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিষয়টা 'আমাদের চেনা ঘরে রাতের অন্ধকারে অনায়াসে হাঁটার' মতোই সাবলীল রপ্ত করে নিয়েছিলেন।
    আমার যেমন মনে হয় শামসুর রাহমান বাজারের ফর্দ লিখলেও তাতে নিশ্চিত মাত্রার ভাঁজটুকুন খুঁজে পাওয়া যেতো অনায়াসে ।

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      যথাযথ বলেছেন। আমি লেখালেখির মাঝে ক্যালকুলেটর হতে চাই নে। সাধারণত, নিজে যেটা করি, প্রথমে একটানে লিখে যাই, পরে যথেষ্ট সময় নিয়ে পলেস্তরা লাগাবার কাজটি করি। চেনা ঘরে রাতের অন্ধকারে অনায়াসে হাঁটবার উদাহরণটা মোক্ষম হয়েছে। তাছাড়া অন্ধকারেও তো একসময় চোখ সয়ে আসে।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    প্রথমে কপি করলাম। কী জানি কখন প্রথম পৃষ্ঠ থেকে সরে যায়।
    আলাদা করে পড়তে হবে। তারপরে মন্তব্য


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।