নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে….

একজন শ্রোতা যখন কোন গান শোনেন, আর সে গানটি যদি তার ভালো লেগে যায়, তখন তার তিনটে ইন্দ্রিয় একত্রে কাজ করতে থাকে- কর্ণ, মানস (মন, কল্পলোক) আর নয়ন। গানের সুর কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র তার মন সেই গানের কথা ও সুরের আবহে স্পর্শিত হয়ে, স্পন্দিত হয়ে, তরঙ্গায়িত হয়ে কল্পলোকে বিস্তৃত হয় এবং একইসাথে সেই সুরসৃষ্ট কিছু ছবি তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে থাকে। যতক্ষণ সেই সুর তার কানে প্রবেশ করতে থাকে, ততক্ষণ সে দু’চোখে ছবি দেখতে থাকে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তার চোখের সামনে দেখার মত কোন ছবি থাকে না। এই ছবি দেখানোর কাজটা মন করে থাকে, তার কল্পলোকের মাধ্যমে। এই তিন ইন্দ্রিয়ের সমন্বিত কার্যক্রমে তার মনে ভালোলাগার অনুভব তৈরী হয় এবং তার দেহমনে positive vibes সৃষ্টি হয়।

ধরুন, তার শোনা কোন একটি গান শেষ চরণে এসে “নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে” কথাগুলো দিয়ে শেষ হয়ে গেল। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কোন গানটির শেষ চরণে এ কথাগুলো রয়েছে। গান শেষ হবার সাথে সাথে তার কান আপাততঃ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কিন্তু মন ও চোখও কি তাই? না, মন ও চোখের যৌথ ক্রিয়াকলাপ তখনও চলতে থাকে। নীরব রাতের নিবিড় আঁধারের কথা ভাবতে ভাবতে মনের তোরঙ্গে সযত্নে সজ্জিত কিছু ছবি তখন তার চোখের সামনে চলে আসে। শ্রোতা বিশেষে এই ছবি ভিন্ন ভিন্ন হবে অবশ্যই, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। সে অভিজ্ঞতাটা হতে পারে কখনো আনন্দের, কখনো বিষাদের, কখনো ভয় বা ত্রাসের। যাদের নীরব রাতের নিবিড় আঁধার অবলোকন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে ছবি দেখতে থাকবে। যাদের তা নেই, তাদের মন তাদেরকে নিয়ে যাবে তাদের কল্পলোকে, যেখানে বিচরণ করে তারা আপন কল্পনাশক্তির বলে ভিন্ন ভিন্ন ছবি দেখবে। আপন খেয়ালে ঐন্দ্রিয় বিচরণে এই ছবি দেখাকেই কবিগুরু বলেছেনঃ

“গানের ভেলায় বেলা অবেলায় প্রাণের আশা
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা ….
কোথায় জানি ধায় সে বাণী দিনের শেষে
কোন ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা
ভোলা মনের,
ভোলা মনের স্রোতে ভাসা…”।

এই “নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে” কথাগুলোয় দুটো শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, রাত হতে হবে নীরব, অর্থাৎ কোলাহলমুক্ত স্থান ও পরিবেশ। আর দ্বিতীয় শর্ত, আঁধার হতে হবে ’নিবিড়’ অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত হতে হবে। এটা হতে পারে কোন নির্জন এলাকায়; যেমন পাহাড়ের কোলে, নদীতীরে, বৃক্ষতলে, বাঁশবাগানে, গোরস্তানে কিংবা শ্মশানঘাটে, নদীবক্ষে জেগে ওঠা নির্জন চরে কোন ভূমিশ্রমিকের পর্ণকুটিরে, এমনকি নীরব আপনালয়ে। এ দুটো শর্ত পূরণ হলে মুহূর্তেই কোন শ্রোতা স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিকে পরিণত হয়ে যেতে পারে। তখন একসময় গান থেমে যাবে, শ্রোতা ছবি দেখতে দেখতে স্বপ্ন দেখা শুরু করবে। অবশ্য ভোরের আলোয় সে স্বপ্ন মিলিয়েও যাবে! আর সেটা মিলিয়ে যাবার পর সে আপন মনে ভাবতে থাকবে… “আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে”! এই স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্ন মিলিয়ে যাওয়ার খেলা নিয়েই মানুষের ’গানের ভেলায় বেলা অবেলায় …..ভোলা মনের স্রোতে ভাসা’। মানুষ জানে না, ’কোন ঘাটে যে ঠেকে এসে চিরকালের কাঁদা-হাসা, (এই) ভোলা মনের স্রোতে ভাসা’…! তখন সে আত্মস্থ হতে চায় এই ভেবে যে, “তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে, বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে। কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি, আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে”!

ঢাকা
২৬ মার্চ ২০২৪

৩৭ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।