জাতিসংঘের ‘উন্নয়ন গবেষণা প্রধান’ ড. নজরুল ইসলাম কে যেমন দেখেছিঃ একজন সহপাঠীর দৃষ্টিতে

এটি মূলতঃ একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা। ড. নজরুল ইসলাম বর্তমানে জাতিসংঘে সিনিয়র ইকনমিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ তাকে ‘উন্নয়ন গবেষণা প্রধান’ (চীফ অভ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ) হিসেবে নিয়োগ দান করেছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের একটি বিষয়। আমি স্কুল-কলেজ জীবনে তার সহপাঠী ছিলাম। তাকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। অর্ধ শতাব্দীরও কিছু বেশি সময় আগের স্মৃতির ঝুলি হাতড়িয়ে এসব কথা আজ মনে হলো। নজরুলের সাম্প্রতিক সাফল্যে আমি এতটাই অভিভূত হয়েছি যে আমার মনের ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করেছি, ওর মত একজন গুণী ব্যক্তির একসময়ের সহপাঠী হিসেবে আমার দৃষ্টিতে দেখা ওর কিছুটা মূল্যায়ন রেখে যেতে। এ জন্যেই এটি লেখা, তা ছাড়া আর কিছু নয়!

আমাদের নজরুল! সবার প্রিয় এবং সম্মানীয় নজরুল, যার পুরো নাম মোঃ নজরুল ইসলাম। অনেকটা এ নামে এক মস্ত বড় কবি ছিলেন, সবাই যাকে বিদ্রোহী কবি নামে চেনেন, কিন্তু আমি যাকে প্রেমের কবি, গানের কবি, ভক্তির কবি, গীতের কবি, গযলের কবি এবং একজন চারণ কবি হিসেবে চিনি, জানি ও মানি। তিনি আমাদের জাতীয় কবিও বটে। শুধু তার নামের শুরুতে ‘মোঃ’ এর জায়গায় ‘কাজী’ ছিল, এটুকুই যা পার্থক্য। তো সেই নজরুলের নামে আমাদের নজরুলের নাম রাখা হলেও, তাকে কিন্তু আমি বাংলা সাহিত্যের আরেক মহীরুহ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত, অনুসারী এবং অনুরাগী হিসেবে দেখেছি ও জেনেছি। তার লেখায়ও আমি কবিগুরুর প্রভাব লক্ষ্য করেছি। এমনকি তার বাংলা হস্তলিপিও অবিকল কবিগুরুর হস্তলিপির মত সামান্য ডান দিকে বাঁকা, হেলানো, cursive।

নজরুল ও আমি, এবং আমরা অন্যান্যরা, বয়ঃসন্ধিক্ষণকালের বন্ধু। আমাদের বয়স যখন “টীন এজ” ছুঁই ছুঁই, তখনই আমরা ৫৬ জন্য কিশোর বালক বিভিন্ন ঘাট থেকে এসে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের বংশাই নদীর পাশে গোড়াই ইউনিয়নের রাজাবাড়ী এলাকায় নির্মিত “মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজ” এর ঘাটে (যা পরবর্তীকালে ‘মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ’ নামে অভিষিক্ত হয়) আমাদের জীবন-তরী ভিড়িয়েছিলাম। তখন থেকেই আমরা একে অপরের আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু। আমরা একই তরুশালার (নার্সারি) চারা হিসেবে লালিত হয়েছি। তার মধ্যে নজরুলের মত কেউ কেউ আজ মহীরুহে রূপান্তরিত, বেশিরভাগই আত্ম-পরিচয়ে সফল বৃক্ষ, এবং বলতে গেলে কেউই আগাছা হিসেবে পরিত্যাক্ত হইনি।

একদম শুরুতে, নজরুল আর আমি উভয়ে, সপ্তম শ্রেণির ‘ফর্ম এ’ তে ছিলাম। তবে আমরা ছিলাম ভিন্ন ‘হাউজ’ এ (ডর্মে)। তাই হাউজমেটদের সাথে যতটা নিবিড় সখ্য সহজাতভাবে গড়ে ওঠে, নজরুলের সাথে আমার ততটা ছিলনা। কিন্তু শ্রেণীকক্ষে আমি তাকে লক্ষ্য করা শুরু করলাম যখন দেখতাম যে সে প্রতিটি পাক্ষিক পরীক্ষার মূল্যায়নে উচ্চমান অর্জন করতো। ‘টার্ম-এন্ড’ এবং বার্ষিক পরীক্ষাগুলোতেও তার সাফল্যের গ্রাফ শুরুর তুলনায় পরের দিকে সেই যে ঊর্ধ্বমুখি হতে থাকলো, আর কখনো নামেনি। প্রথম দিকে না হলেও, খুব সম্ভব নবম শ্রেণীর পর থেকে, যতদূর স্মৃতি থেকে মনে পড়ে, কলেজ ছাড়া পর্যন্ত ওকে প্রথম আর দ্বিতীয় ছাড়া তৃতীয় পজিশনের মুখ দেখতে হয়নি। ক্লাসে চুপচাপ থাকতো, ওর আশে পাশে সবাই দুষ্টুমি করা শুরু করলে ও তা কখনো স্মিতহাস্যে উপভোগ করতো, কখনো নীরবে প্রত্যাখ্যান করতো। সবসময় সদাপ্রস্তুত হয়ে ক্লাসে আসতো। ক্লাসে নিজে থেকে তেমন প্রশ্ন করতো না, কিন্তু টীচারদের প্রশ্নের উত্তরে প্রায়শঃ বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দিত। মোটামুটি বলা যায়, নবম শ্রেণীতে ওঠা পর্যন্ত নজরুল সবার অলক্ষ্যেই বেড়ে উঠতে থাকে, এবং একই তরুশালার ৫৬টি চারার মধ্যে ভূমির অভ্যন্তরে ওরই শেকড় সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হতে থাকে। আর যতই তার শেকড় পোক্ত হতে থাকে, ততই তার বাহ্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। একজন ভালো ছাত্র হিসেবে শুধু নয়, দিনের পর দিন তার লিখন ও বাচন, উভয়টিই ক্ষুরধার হতে থাকে এবং এসব ইতিবাচকতার স্পষ্ট প্রতিফলন তার ব্যক্তিত্বে প্রতিভাত হতে থাকে।

নজরুল আমারই মত, কিংবা বলা যায় আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিল। তার পিতা জনাব মোঃ সিরাজুল ইসলাম আনসার বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মোপলক্ষে ওনাকে বিভিন্ন জেলায় বদলি হতে হতো, কিন্তু আমরা দেখেছি নজরুলের পরিবারের আর সবাই ঢাকার রায়েরবাজারের নিকটস্থ ‘মধুবাজার’ এলাকায় ওদের নিজ বাড়িতেই থাকতো। এলাকাটা তখন বেশ খোলা মেলা, অনেকটা গ্রামের মত ছিল। কলেজ ছুটির সময় আমি দুই একদিন ওদের সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর বড় দুই বোন ছিল, ছোট তিন বোন এবং দুই ভাই। আমার এসব তথ্য পাঁচ দশকের পুরনো স্মৃতি থেকে হাতড়ে নেয়া, তাই তথ্যের কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যেতে পারে, একথা সবিনয়ে স্বীকার করে নিচ্ছি। নজরুলের বড় বোনেরাও বিদুষী ছিলেন, এবং সম্ভবতঃ ওনারা সে সময়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সক্রিয় ছিলেন। ওদের বাসায় সবসময় একটা ভালো পড়াশোনার এবং মুক্ত আলোচনার পরিবেশ বিরাজ করতো। নজরুলের মানসিক এবং মানবিক বিকাশে ওর বড় বোনদের বেশ কার্যকর প্রভাব ছিল বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে ১৯৭২ সালের মার্চ নাগাদ যখন কলেজ খুললো, তখন দেখি নজরুলের ব্যক্তিত্বে অনেক পরিপক্কতা এসে গেছে। তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। আমাদের শ্রেণীগত স্বার্থে (এখানে একাডেমিক শ্রেণী বুঝিয়েছি) যেসব আলোচনা হতো, সেখানে সে যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কথা বলতো। ফলে সহজেই সে সবার আস্থা অর্জন করতে পারতো। আর নেতৃত্বের গুণাবলী তার মধ্যে আসবেই না বা কেন। যে ছয় বছর আমরা একসাথে ছিলাম, সে ছয় বছরে আমি ওকে কখনো কোন নীতি-বহির্ভূত কাজ করা তো দূরের কথা, নীতি-বহির্ভূত কোন কথাও বলতে শুনিনি। আমরা অনেকটা অভ্যেসবশতঃ একে অপরকে “টাইটেল” বা ‘নিকনেইম’ দিয়ে বসতাম এবং সেসব নামে তাদেরকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করতাম। নজরুলকে আমি কখনোই শুনিনি কাউকে সেসব ‘নিকনেইম’ ধরে ডাকতে। তার জন্যেও আমাদের দেওয়া একটা নিকনেইম বরাদ্দ ছিল, আমরা তাকে ‘বড়সাব’ বলে ডাকতাম। কিন্তু যেহেতু সে নিজে কাউকে কখনো এসব বরাদ্দকৃত নামে ডাকেনি, আমিও তাকে সামনাসামনি এ নামে ডাকতাম না, তবে বন্ধুমহলে তাকে রেফার করতে হলে আর সবার মত ‘বড়সাব’ই বলতাম। তাকে কখনো কোন ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে দেখিনি, এমন কি কৌতুকের ছলেও কোন অসত্য কথা কখনো বলতে শুনিনি। এসএসসি পরীক্ষায় সে মেধাতালিকার বেশ উপরের দিকেই স্থান পেয়েছিল, তবে প্রথম হয়নি, যদিও আমরা আশা করেছিলাম, সে প্রথম হবে। এসএসসি’র পরে এটা আরও স্পষ্ট হয় যে সে উপস্থিত বক্তৃতায় ভালো ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছে। এটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি হয়নি, এর পেছনেও নিশ্চয় ওর সচেতন প্রয়াস ছিল।

এসএসসি’র পরে আমরা যথারীতি একাদশ শ্রেণীতে উঠলাম। স্বাধীনতার পর পর সর্বত্র একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ এবং নিয়ম না মানার প্রবণতা বেশ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। দ্বাদশ শ্রেণী এবং একাদশ শ্রেণীর মধ্যে আড়ালে আড়ালে একটা শীতল স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল এবং সেটা প্রকাশ্য রূপ নিতে খুব বেশিদিন দেরি হয়নি। দেশের সবখানে তখন অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যেত। আমাদের কলেজটাও দেশ থেকে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল না, সুতরাং আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসেও অস্ত্রধারীদের যাতায়াত আছে, এমন কানাঘুষা শোনা যেত। ঠিক সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে কলেজে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসা যাওয়া করতে দেখা গেল। কর্তৃপক্ষ অনেকটা বাধ্য হলেন, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত আমাদের কলেজেও সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার অনুমতি দিতে। ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন, এই দুই সংগঠনের এমসিসি শাখা গঠিত হলো। যথাসময়ে নির্বাচন হলো, সে নির্বাচনে নজরুল ছাত্র ইউনিয়ন থেকে “এসো দেশ গড়ি” শ্লোগানে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বেশ ভালোভাবে জিতে গেল। ওর ব্যক্তিত্বের দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়ে আমিও আমার হাউজের, তথা ফজলুল হক হাউজ সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলাম, এবং জয়লাভও করলাম। কিন্তু সেই নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে আমি দেখলাম, আমার যেখানে ছাত্র রাজনীতির অআকখ এর সাথে পরিচয় তখনো হয়নি, নজরুল সেখানে শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, মূল ধারার রাজনীতির পথ ঘাট, অলিগলি সবই চেনে। ও যখন বক্তৃতা দিত, তখন সে একজন ঝানু ছাত্রনেতার মতই কথা বলতো। কিন্তু তার কথায় কখনো হুংকার শোনা যেত না, ওর শারীরিক অঙ্গভঙ্গিতে কখনো কোন আস্ফালন দেখা যেত না, কিন্তু প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ ছিল দৃঢ়তায় ও প্রেরণায় আচ্ছাদিত। বিশেষ করে ও যখন বাংলায় বক্তৃতা দিত, তখন পারতপক্ষে সে কখনো ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতো না, যদিও ইংরেজী ভাষার উপরেও তার শক্ত দখল ছিল।

নির্বাচন হলো বটে, কেন্দ্রীয় এবং হাউজ সংসদও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এবং অভিষিক্ত হলো, কিন্তু সেসব ছাত্র সংসদ বেশিদিন কাজ করতে পারলো না। স্বাধীনতার পর পর কলেজে বেশ কিছুদিন কোন সামরিক অধ্যক্ষ কিংবা এ্যাডজুট্যান্ট নিয়োগপ্রাপ্ত হন নাই। প্রভাষকদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠতম ছিলেন, তিনিই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলেন। আর UOTC (The University Officers’ Training Corps, পরবর্তীতে BNCC) ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষক জনাব নাজমুল হক, কিংবা তখনকার ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগের নিয়মিত খেলোয়ার স্বনামধন্য জনাব নাজমুল আহসান স্যার ভারপ্রাপ্ত এ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপর দ্বাদশ শ্রেণীর কয়েকজন ক্যাডেটের নিরঙ্কুশ প্রভাব ছিল, তিনি তাদের কথামত চলতেন, চালাতে চাইতেন। ফলে শুরুতেই একটা গণতান্ত্রিক উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হলো। এর মাঝে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও ছাত্র রাজনীতিতে মোটেই আগ্রহী নয় এমন একটি তৃতীয় ধারার ছাত্র সংগঠনও আত্মপ্রকাশ করলো। সব মিলিয়ে এক বিরাট হযবরল অবস্থা। সন্ত্রাসের আশঙ্কায় কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কলেজ ক্যাম্পাসে একটি ক্ষুদ্র পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপিত হলো। সেখানে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ অস্থায়ী ক্যাম্প বানালো। ওরা কলেজ হাসপাতাল কিংবা তখনও চালু না হওয়া ওয়ার্কশপ এর কাছাকাছি কোথাও অবস্থান করতো। সেই পুলিশ দলের দলনেতা ছিল একজন হাবিলদার। সে সুযোগ পেলেই রেগুলার মীল টাইমের কিছু পরে ক্যাডেট মেসে এসে কর্মচারীদের কাছে খাবার দাবার কিংবা এটা ওটা দাবী করতো। না পেলে সে বিভিন্ন বিষয়ে রিপোর্ট করার ভয় দেখাতো। তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে একদিন বাদানুবাদের সময় কলেজের হেড বাবুর্চি চট্টগ্রামের গনি মিঞা একটা লাকড়ির (জ্বালানী কাঠ) ফালা দিয়ে সজোরে আঘাত করে সেই পুলিশ হাবিলদারের মাথা ফাটিয়ে দিল। তার কপাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। সে রুমাল দিয়ে সেই ক্ষত ঢেকে তার ক্যাম্পে গিয়ে এ কথা জানালে তা দেখে বাকি পুলিশরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং তারা তাদের অস্ত্র থেকে আকাশপানে ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে।

কলেজ প্রশাসনের দৃঢ়তার অভাবে এমনি রকমের অরাজক পরিস্থিতি সর্বত্র বিরাজ করতে থাকে। নানা ধরণের অঘটন ঘটনের পর, আমরা পরের বছর দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠলাম। নজরুল প্রত্যাশিত এবং অবিসংবাদিতভাবেই কলেজ ক্যাপ্টেন এর শিরোপা পেল। তার সিভিল লীডারশীপে আমরা উজ্জীবিত হতে থাকলাম। অত্যন্ত কঠিন একটা সময়ে নজরুল তথা আমাদের ব্যাচ নেতৃত্ব দিয়ে কলেজ প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হলো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল আমাদের কলেজের জন্য একজন সামরিক অধ্যক্ষ এবং এ্যাডজুট্যান্ট নিয়োগের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। নজরুল এ ব্যাপারে কয়েকজন ক্যাডেট প্রতিনিধি নিয়ে ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছিল। তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী স্টপগ্যাপ মেজার হিসেবে রাঙামাটি কলেজের অধ্যক্ষ জনাব এম এ আজিজ কে (ইংরেজীর অধ্যাপক) জরুরী ভিত্তিতে এমসিসি তে বদলির আদেশ দিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা জনাব এম এ আজিজকে অধ্যক্ষ হিসেবে পেলাম। তিনি একজন উচ্চমানের শিক্ষক ছিলেন, শৃঙ্খ্লার ব্যাপারেও মোটামুটি কঠোর ছিলেন, কিন্তু সেই উত্তাল সময়ে প্রয়োজন ছিল ক্যাডেট কলেজ সিস্টেমের সাথে পরিচিত একজন অধ্যক্ষ, যিনি শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। তাই একজন সামরিক অধ্যক্ষ এবং এ্যাডজুট্যান্ট নিয়োগের জন্য প্রভাবশালী অভিভাবকদের মাধ্যমেও যোগাযোগ অব্যাহত থাকলো। কিছুদিন পরেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে এমসিসি’র প্রথম সামরিক অধ্যক্ষ হিসেবে উইং কমাণ্ডার এ কে এম বদিউর রহমান (বর্তমানে মরহুম) কে এবং এ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে ক্যাপ্টেন আজিজ আহমেদ কে পাই। আমাদের পরের ব্যাচগুলোর তরুণরাও স্বতঃস্ফূ্র্তভাবে নজরুলের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছিল। তাদের এ আস্থা অর্জন ছিল নজরুলের নেতৃত্বের একটা বিরাট সাফল্য।

কলেজ ক্যাপ্টেন হিসেবে নজরুলের ভাবমূর্তি অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল। সে খুব সহজেই ছোট বড় সব ক্যাডেটদের, সহপাঠীদের, শিক্ষক-কর্মচারীদের, বয়-বেয়ারা-বাবুর্চি-ওয়েটারদের সমীহ আদায় করে নিতে পারতো। এজন্য কখনো তাকে উচ্চস্বরে কথা বলতে হয়নি। তার নেতৃত্বের গুণাবলী ছিল সহজাত, মানবিক গুণাবলী ছিল হৃদয়স্পর্শী। আমাদের একজন সহপাঠী স্বাধীনতার পরে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে আর পরীক্ষা দেবে না বলে মনস্থির করে। পরীক্ষার আগে আগে নজরুল আরেকজন সহপাঠীকে নিয়ে তার বাসায় এসে তাকে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়াতে রাজী করায় এবং তাকে কলেজে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এর ফলে সেই সহপাঠী ব্রেক অভ স্টাডি থেকে রক্ষা পায়। সে আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং একজন চিকিৎসক হিসেবে সগৌরবে জনহিতকর কাজ করে যাচ্ছে।

আমাদের শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়, এইচএসসি’র অংশটুকু নানা ডামাডোলের মধ্যে পার করলেও, বোর্ডের পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে নজরুল এবং মানবিক বিভাগে মোস্তাফিজ (সিপিডি’র প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক) ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে আমাদের ব্যাচকে গৌরবান্বিত করে। একসাথে অনেক কাজে ফোকাস রাখতে পারার ব্যাপারে নজরুল এক অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। অন্যান্যরা পড়াশোনার জন্য যে সময়টুকু পেত, নজরুল তার এক তৃতীয়াংশ পেয়েই বোর্ডে সর্বোত্তম ফলাফলটি অর্জন করতে পেরেছিল। লীডারশীপ কাজে তাকে অনেক সময় দিতে হতো। এ ছাড়াও সে কলেজ ম্যাগাজিন কমিটির সম্পাদক ছিল। তার নেতৃত্বে আমাদের সময়ে একটি উচ্চমানের কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। কলেজ থেকে বের হবার পরেও আমরা কয়েকজন ঢাকার ‘ভূতের গলি’তে এক বন্ধুর বাসায় নিয়মিত মিলিত হ’তাম এবং সেখানে বসে ‘কৌমুদি’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশনার ব্যাপারে কাজ করতাম।

কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে আমাদের থেকে নজরুলের কিছু পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। উপমহাদেশের এখনকার বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী আলমগীর হক তখন থেকেই আমাদের কলেজের সাংস্কৃতিক মঞ্চ মাতিয়ে রাখতেন। তিনি আমাদের দুই ক্লাস জ্যেষ্ঠ ছিলেন। এ ছাড়া ছিলেন কামরুন নূর ভাই, তিনিও চমৎকার ইংরেজী গান গাইতেন। তিনি এবং কলেজ ক্যাপ্টেন শফিক চৌধুরী ভাই মিলে আকর্ষণীয় গীটার বাজাতেন। আলমগীর ভাই ইংরেজী, উর্দু এবং বাংলা ফোক গান গাইতেন বেশি। সে সময়ের ইংরেজী গানগুলোর মধ্যে ও ব্লাডি-ও ব্লাডা, ডিলায়লা, কংগ্রাচুলেশনস এ্যান্ড সেলিব্রেশনস, সামারওয়াইন এবং সর্বোপরি বীটলস এর লেট-ইট-বি গানগুলো আমাদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। কিন্তু নজরুলের মুখে আমি কখনোই কোন ইংরেজী বা উর্দু গান/গযল উচ্চারিত হতে শুনিনি। তবে শ্রাবনের এক বর্ষণমুখর অলস দুপুরে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাসে বসে ওর কন্ঠে একদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘মন মোর মেঘের সঙ্গে’ শুনেছিলাম। হেমন্তের একটি বিখ্যাত গান যা আলমগীর ভাই খুব ভালো গাইতেন, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’- সেটাও একদিন নজরুলকে সুন্দর করে গাইতে শুনেছিলাম।

বোর্ডে প্রথম হবার পর নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়। তার কিছুদিন পর অবশ্য সে সরকারী বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতি অধ্যয়ন করার জন্য (এমএসসি ইন ইকনমিক্স) মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সেটা শেষ করে পরবর্তীতে সে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে। শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করলেও ২০০৬ সালে সে জাতিসংঘে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগদান করে এবং বর্তমানে সে জাতিসংঘের সিনিয়র ইকনমিস্ট হিসেবে কর্মরত আছে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ তাকে ‘উন্নয়ন গবেষণা প্রধান’ (চীফ অভ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ) হিসেবে নিয়োগ দান করেছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের একটি বিষয়। নতুন নিয়োগে তার কাজ হবে, “To lead the preparation of UN flagship reports on global development issues and provide policy input and advise to the senior management of the organisation.”

নজরুল একজন প্রভাষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্ট জন’স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছে। এ যাবত তার প্রকাশিত বই এর সংখ্যা ২০টি, যার মধ্যে অর্ধেকই বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা সংক্রান্ত। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে পরিবেশ এবং উন্নয়ন নিয়ে তার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং গবেষকদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে নজরুল নিউ ইয়র্কে Bangladesh Environment Network (BEN) প্রতিষ্ঠা করে এবং তার নেতৃত্বে এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে এবং বিদেশে বহু সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং সমাধানের পথ অনুসন্ধান নিয়ে গবেষণা করেছে। নজরুল অনেকদিন ধরে প্রায় প্রতি বছরই এসব কাজে বাংলাদেশে আসে এবং আসার আগে সে তার কলেজ বন্ধুদেরকে এসব আলোচনায় আমন্ত্রণ জানাতে কখনো ভুল করে না। ২০০০ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (BAPA) প্রতিষ্ঠায় নজরুল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্রাবস্থায় নজরুলের লেখা “জাসদের রাজনীতি” বইটি প্রকাশিত হলে তা তৎকালীন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে সেটা আমার মত রাজনীতিতে নবিশ তার সহপাঠীদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।

নজরুলের একজন সহপাঠী হিসেবে আমি তাকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত। এত শত ব্যস্ততার মাঝেও সে আমাদের যে কোন শুভ উদ্যোগে ত্বরিত সাড়া দিতে ভুল করে না। কারো অসুস্থতায় ফান্ড কালেকশন, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের জন্য চেয়ার টেবিল বানিয়ে দেয়া, কোন দরিদ্র মেধাবী ছাত্রকে সাহায্য করা, ইত্যাদি অনেক উদ্যোগে নজরুল বিদেশে বসে তার সহায়তার অদৃশ্য হাতটি যথাস্থানে বাড়িয়ে দেয়। আমার মনে সুপ্ত আশা রয়েছে, ড. নজরুল একদিন বিশ্বকে নতুন কিছু দিয়ে চমকে দেবে। নজরুলকে তার অসামান্য অর্জনের জন্য হৃদয় নিংড়ানো অভিনন্দন এবং অভিবাদন জানিয়ে শেষ করছি। তার মনরোগ বিশেষজ্ঞ স্ত্রী ড. তানভীরা ইসলাম, পুত্র রাহুল এবং কন্যা নুসায়বাকেও অভিনন্দন, পারিবারিক পরিমণ্ডলে এমন একজন গুণী ব্যক্তিকে লালন করে তার মেধা বিকাশে সহায়তা করার জন্য।

ঢাকা
২৩ অগাস্ট ২০২১

৮১৮ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “জাতিসংঘের ‘উন্নয়ন গবেষণা প্রধান’ ড. নজরুল ইসলাম কে যেমন দেখেছিঃ একজন সহপাঠীর দৃষ্টিতে”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।