এর আগের পর্বটি দেখতে পাবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপি-৪ঃ ঘরোয়া জন্মদিন পালন এবং ঘরের বাহিরে ইংরেজী নতুন বর্ষবরণ
(আমি দিনভর সময়ে সময়ে ব্যালকনিতে এসে আমার প্রিয় আকাশটাকে দেখে গিয়েছি)
আগের রাতে দেরী করে ঘুমালেও, বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ইংরেজী ২০২০ সালের প্রথম প্রত্যুষে ব্যালকনিতে এসে দেখি তখনো মেঘের কোলে রোদ হাসেনি, তবে দূর থেকে আসা রাঙা প্রলেপ মেঘের গায়ে গায়ে লেগে আছে। সামনের খোলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভাল লাগছিল। তখনো অন্যান্য দিনের এ সময়ের মত জনপদ ব্যস্ত হয়নি, তবে হাইওয়ে ধরে কয়েকটা গাড়ী মাঝে মাঝে ছুটে চলছিল, ট্রেন চলাও শুরু হয়েছিল। ভোরের পাখিরা নীড় ছেড়ে আকাশে পাখা মেলেছিল, ব্যায়ামবিলাসী লোকজন কেউ পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে, কেউ সাইকেলে চেপে পথে নেমেছিল। আমি দিনভর সময়ে সময়ে ব্যালকনিতে এসে আমার প্রিয় আকাশটাকে দেখে গিয়েছি। কখনো একটু মেঘলা, আবার কখনো রৌদ্র করোজ্জ্বল, নীল সাদা মেঘের ভেলা আমাকে বিহ্বল করে চোখের সামনে দিয়ে আপন মনে ভেসে যাচ্ছিল। তাদের পাশাপাশি মাঝে মাঝে কিছু গোমরামুখী মেঘও যেন কোথা থেকে ভেসে এসে তাদের দুঃখের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছিল।
বিকেলে নেপিয়ার হাইওয়ের পাশ দিয়ে সমান্তরাল ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। এদের হাইওয়েগুলোর পাশ দিয়ে সাধারণতঃ সমান্তরালভাবে ওয়াকওয়েও থাকে, সেখান থেকে রক্তনালীর শিরা উপশিরার মত সরু সরু ফুটপাথ ছড়িয়ে ছিটিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায় অলিগলিতে, নাগরিকদের বসতবাটির দ্বারপ্রান্তে। কি সুশৃঙ্খল, জনবান্ধব চলাচল ব্যবস্থা এদের! আর সবচেয়ে ভাল লেগেছে, প্রতিটি অলি গলিরও একটা নাম দেয়া আছে, সেটা স্পষ্টভাবে সাইন পোস্টিং এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়। কেউ পথ হারালে তাই অতি সহজেই চোখের সামনে দৃশ্যমান সাইন পোস্টিং দেখে গুগল ম্যাপের সাহায্যে পথ খুঁজে পেতে পারে। এখানকার সাইন পোস্টিংগুলো এতই প্রচুর ও সহজবোধ্য যে পথ হারাবার কোন উপায়ই নেই। যেমন, কোন সরু পথের শেষে যদি আর কোন পথ না থাকে, তবে সে তথ্য পথের প্রবেশমুখেই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান থাকে। কোন পথের সামনে কী কী বাধা থাকতে পারে, পথের শুরুতে তারও উল্লেখ থাকে। খুবই স্বস্তিদায়ক এবং উপকারী এসব ছোট ছোট ব্যবস্থাপনাগুলো!
প্রতিটি বাড়ীর সামনের আঙিনা এবং বাড়ীর বাইরের রাস্তা পর্যন্ত সামনের অংশটুকু খুব পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকে। ভেতরে যেমনই থাক, বাইরে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে হবে। তা না হলে সিটি কাউন্সিলের পরিদর্শক এসে তাদের স্টাফ দিয়ে তা পরিষ্কার করিয়ে বিল পাঠিয়ে দিবে, যা অনতিবিলম্বে পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। কোন আপত্তি থাকলে বিল পরিশোধ করেই তবে পিটিশন দাখিল করতে হবে। মাঝে মাঝে আমি হাঁটতে হাঁটতে থেমে যাই। হাঁটার পথের পাশে লাগানো গাছগুলোর ফুল ও পত্রপল্লব স্পর্শ করে দেখি। সুন্দর সুন্দর গাছ ও ফুলগুলো দেখলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে, ওদের চারিদিকে কেমন যেন একটা ঝলমলে খুশীর আবহ বিদ্যমান থাকে। মনে হয়, আমাকে পেলে ওরাও খুশীতে নেচে ওঠে। কখনো কখনো আমরা দু’জনে থেমে ওদের সাথে সেলফী তুলি। ওদের স্মৃতি সাথে নিয়ে আসি। ওয়া খুশী হয়।
২০২০ সালের প্রথম জুম্মার নামায (০৩ জানুয়রী) পড়ার জন্য আমাদের বাসার অনতিদূরে (গাড়ীতে আধা ঘন্টার ড্রাইভ) তুর্কীদের দ্বারা পরিচালিত একটি মাসজিদে গিয়েছিলাম, যার নাম “KEYSBOROUGH TURKISH ISLAMIC AND CULTURAL CENTRE”। অত্যন্ত ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি মাসজিদ, যেখানে প্রচুর সংখ্যক মুসল্লীরা সমবেত হয়েছিলেন। মাসজিদটিতে আলাদা একটি কক্ষে মহিলাদের জন্যও নামাযের ব্যবস্থা আছে। গিন্নী ও বৌমা সেখানে নামায পড়তে গেল, ছেলে আর আমি মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। এখানে মুসল্লীদের মোজাবিহীন অবস্থায় মাসজিদের ভেতরে প্রবেশ বাঞ্ছিত নয়, এটা জনস্বাস্থ্যের কারণে, কোন ধর্মীয় কারণে নয় বলে মাসজিদের বাহিরে লেখা আছে। প্রবেশের সময় লেখাটা আমাদের চোখে পড়েনি, তবে টেবিলের উপরে রাখা অনেক জোড়া নতুন মোজা রাখা আছে, সেটা আমি খেয়াল করেছিলাম। দাখলুল মাসজিদের সালাম ফিরিয়ে দেখি, কেউ একজন আমার পাশে এক জোড়া নতুন মোজা রেখে গেছেন। ছেলে আমাকে বললো, মোজা জোড়া পরে নিতে। এখানে নাকি এটাই নিয়ম। সেও এটা জানতো না। কেউ একজন বলাতে এবং মোজা দিয়ে যাওয়াতে সেও মোজা পরে নিয়েছে।
নামাযের পর Nando’s এ লাঞ্চ করে Chadstone এ গিয়েছিলাম ছেলে ও বৌমার সেখানে কিছু কাজ ছিল বলে। ওরা যতক্ষণে ওদের কাজ শেষ করে, ততক্ষণ আময়া ঘোরাঘুরি করে য়ার ছবি তুলে সময় কাটিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাসায় এসে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিলাম। মাগরিবের নামাযের ঠিক আগে আগে বেরিয়ে পড়লাম “Green Point Reserve, Brighton Beach” এর উদ্দেশ্যে, সূর্যাস্ত দেখতে। সেখানে গিয়ে দেখি প্রচুর জনসমাগম, কারণ করোনা ভাইরাস কভিড-১৯ তখনো বেপরোয়া হয়ে উঠেনি এবং এখানকার জনগণ রোগটি সম্পর্কে তখনও অবহিত ছিল না। মহাসমারোহে সেখানে “Night Market” চলছিল- যেটার কথা আমাদের আগে থেকে জানা ছিলনা। এরা এখানে প্রতিমাসের প্রথম শুক্রবারে, এবং তা কোন কারণে সম্ভব না হলে দ্বিতীয় শুক্রবারে (যা আগেই জানিয়ে দেয়া হয়) ব্রাইটন বীচের এই গ্রীন পয়েন্ট রিজার্ভে খোলা আকাশের নীচে, বীচের ওয়াক ওয়ের আশে পাশে সবুজ ঘাসের উপর তাঁবু খাটিয়ে এই ‘নাইট মার্কেট’ বা ‘নৈশ বাজার’ এর আয়োজন করে। অনেকটা আমাদের গ্রাম বাংলার “হাট বার” এর মত এ মাসিক আয়োজন, কিংবা বলা চলে হাল আমলের নাগরিক “মীনাবাজার” এর অনুরূপ একটি আয়োজন। এখন এখানে সন্ধ্যা নামে নয়টায়, সাড়ে নয়টা পর্যন্ত গোধূলির আলো থাকে। কাজেই নামে এটা ‘নাইট মার্কেট’ হলেও, আদতে এটা একটি ‘বিকেলের হাট’, শুরু হয় মধ্যাহ্নের পর থেকেই। অবশ্য এদের শীতকালে সন্ধ্যা নামে পাঁচটারও আগে। তখন এটা সত্য সত্যই নৈশ বাজারে পরিণত হয় বলে অনুমান করছি।
নানা বৈচিত্রের সামগ্রী নিয়ে সাজানো হয়ে থাকে এই নাইট মার্কেট। মনে হলো, মানুষজন, আবালবৃ্দ্ধবণিতা দুপুরের পর থেকেই তাদের প্রিয়জনদের নিয়ে এখানে সমবেত হতে থাকে, যতটা না কেনাকাটা করার জন্য, তার চেয়ে বেশী উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁটাহাটি করে, দৌড়াদৌড়ি করে, রৌদ্রস্নান ও সমুদ্রস্নান করে আনন্দ উপভোগের জন্য। অনেক লোকই তাদের পোষা কুকুর কিংবা পাপ্পিটিকে সাথে নিয়ে আসে। বেড়াল বা অন্য কোন পোষা প্রাণী আমার চোখে পড়েনি। মানুষের সাথে সাথে এই আদুরে প্রাণীগুলোও ছুটাছুটি করে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। যে যার মত স্নান সেরে উঠে আসে খাদ্য ও পানীয়ের তাঁবুগুলোর সামনে, বৈচিত্রপূর্ণ সম্ভারে যেগুলো সমৃদ্ধ থাকে। হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি কিংবা এক মাগ চিল্ড বীয়ার নিয়ে কোন খালি বেঞ্চ খুঁজে নিয়ে সাগর দেখে, আকাশ দেখে, সূর্যাস্ত দেখে, আবার কেউবা আপন মনে কোন কিছুতে ধ্যানমগ্ন হয়।
চা-কফিসহ খাদ্যের দোকানই বেশী থাকে, সেই সাথে থাকে কুটির শিল্পের দোকান, নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক সামগ্রীর দোকান। তবে কাঁচা বাজারের কোন সামগ্রী চোখে পড়েনি। রাত একটু ঘন হওয়া শুরু করলে যে যার মত বাড়ী ফিরে যায়। আমরাও রাত দশটার দিকে (প্রকৃত অর্থে সন্ধ্যার পর পর) বীচ ত্যাগ করি। এখানে সেদিনের আবহাওয়াটা ছিল সত্যি চমৎকার, নাতিশীতোষ্ণ হলেও, শীত শীতের পাল্লাটাই যেন একটু ভারী। এখানকার আবহাওয়া সম্পর্কে সকাল দেখে বিকেলের কোন ধারণা পাওয়া যায় না। আজই সকালে ও দুপুরে বেশ গরম ছিল। পড়ন্ত বিকেলে সেটা আরামদায়ক পর্যায়ে নেমে আসে। আমরা যখন ফিরে আসি, তখন গায়ে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল একটু শীত শীত হাওয়া, আকাশে ছিল সপ্তমীর চাঁদ। পরের শুক্রবারে এ সময়ে থাকবে সাগর আর প্রান্তর জুড়ে বিছানো পূর্ণ জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোর চাদর। তখনও এখানে কিংবা অন্য কোন একটা সৈকতে কিছুটা সময় কাটাবার আশা নিয়ে বাড়ী ফিরলাম।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
০৩ জানুয়ারী ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ১০১৪
(KEYSBOROUGH TURKISH ISLAMIC AND CULTURAL CENTRE)
(আমাদের ব্যালকনি থেকে দেখা ‘মুরাব্বিন স্টেশন’ এ দাঁড়ানো মেট্রো রেল ট্রেন।)
(ভেতরে যেমনই থাক, বাইরে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি থাকতে হবে)
(ভোরের পাখিরা নীড় ছেড়ে আকাশে পাখা মেলেছিল, ব্যায়ামবিলাসী লোকজন কেউ পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে, কেউ সাইকেলে চেপে পথে নেমেছিল)
(হাইওয়ে ধরে কয়েকটা গাড়ী মাঝে মাঝে ছুটে চলছিল, ট্রেন চলাও শুরু হয়েছিল)
খুব ভাল লেগেছে। আপনার সাথে আমরাও এক ঝলক দেখে নিলাম...ভাল থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ, আল-মামুন। সিসিবিতে আজ পাঠকের প্রবল খরা চলছে। তার মাঝে তোমার এ মন্তব্য অনেকটা জলসিঞ্চন করে গেল।
সিসিবি'র সেই সোনালী দিনগুলো খুব মিস করি।
ভাল থেকো, শুভকামনা.....