অস্ট্রেলিয়ার পথে (৩) …. অবশেষে মেলবোর্নের মাটিতে!!!

এর আগের পর্বটি পাবেন এখানেঃ অস্ট্রেলিয়ার পথে (২) …. আকাশ যাত্রা শুরু হলো!

পানীয় জল সংগ্রহ করে ফিরে এসে দেখি CZ343 CAN-MEL ফ্লাইট এর জন্য অপেক্ষমান যাত্রীরা বোর্ডিং এর জন্য সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরাও তাড়াতাড়ি করে লাইনের প্রায় শেষে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। পিঁপড়ের সারির মত আস্তে আস্তে দন্ডায়মান সবাই বোর্ডিং কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছি। সংশ্লিষ্ট স্টাফদের অসাধারণ দক্ষতার কারণে খুবই অল্প সময়ে সে দীর্ঘ লাইনটি বিলীন হয়ে গেল। বিমানের দুয়ারে দাঁড়ানো চীনা কেবিন ক্রুদের স্মিতহাস্য অভিবাদনের মাধ্যমে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম এবং আমাদের নির্ধারিত অবস্থান খুঁজে নিয়ে যার যার আসন গ্রহণ করলাম। প্লেন উড্ডয়নের পূর্বেই একজন বিমানবালা এসে খোঁজ নিয়ে গেল, আমরা আমাদের জন্য আগে থেকেই “মুসলিম ফুড” চয়েস দিয়েছিলাম কিনা। আমি হ্যাঁ বলাতে সে তার হাতে থাকা একটি তালিকায় “টিক” চিহ্ন দিয়ে চলে গেল। নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট আগেই প্লেন ট্যাক্সিইং শুরু করলো এবং সকাল ০৯-১৪ টায় গুয়াংজু’র ভূমি ত্যাগ করে অনন্ত আকাশে ঊর্ধ্বারোহণ শুরু করলো।

সময়ানুবর্তিতা যেকোন পেশায় সাফল্যের চাবিকাঠি। খানিকটা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, এ পর্যন্ত দু’টি টেক-অফ এবং একটি টাচ-ডাউন, প্রতিটিতেই চায়না সাউদার্ন এর ফ্লাইটগুলো নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই খুব স্মুদলী টেক-অফ/ল্যান্ডিং করে এয়ারলাইনটির পেশাগত মানের স্বাক্ষর রেখেছে। ইনফ্লাইট এনাউন্সমেন্টগুলোও বোধগম্য ও স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছিল। কেবিন ক্রুদের আচরণ ছিল মার্জিত এবং সহায়ক মনোভাবসম্পন্ন। ফ্লাইটে পরিবেশিত খাদ্য নিয়ে আমার কিছুটা পূর্ব-সংশয় ছিল, কিন্তু সুস্বাদু লাঞ্চ গ্রহণের পর সে সংশয় দূর হলো। লাঞ্চের পর গিন্নীকে বললাম ঘুমিয়ে নিতে, কারণ আগের রাতে আমাদের কারোই ভাল ঘুম হয়নি। লাঞ্চের পর পরই কেবিন ক্রুরা এসে যাত্রীদেরকে জানালার পর্দাগুলো (উইন্ডোস্ক্রীন) নামিয়ে ফেলতে বলে গেল। সবাই এ নির্দেশ পালন করার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনের বেলাতেও প্লেনের অভ্যন্তরে রাতের পরিবেশ এবং ঘুমের আবহ তৈরী হলো। আমি প্রায় ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙার পর কেবিন ক্রুদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জানালার পর্দা উঠিয়ে দু’চোখ ভরে বাইরের আকাশ, সাগর আর ভাসমান মেঘের নৈসর্গিক শোভা দেখার প্রবল ইচ্ছেকে কিছুতেই সংবরণ করতে পারছিলাম না। পর্দা অর্ধেক উঠিয়ে দেখি, প্লেনের বাইরে তখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুনীল আকাশ, তার মাঝে জায়গায় জায়গায় ঘন শ্বেতশুভ্র মেঘের শয্যা বিছানো, কোথাও বা দলছুট সাদা মেঘের বেখেয়ালী আনাগোনা। আর নীচে রয়েছে সাগরের সুনীল জলরাশি। পরিষ্কার আকাশের কারণে এত উপর থেকেও সাগরের বুকে চলমান কিছু নৌযানের আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছিল। তেত্রিশ থেকে সাঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতা বজায় রেখে প্রায় ৬০০ মাইল গ্রাউন্ডস্পীডে প্লেনটি আকাশে উড়ে চলেছিল।

গুয়াংজু- মেলবোর্ন নয় ঘন্টা পঁচিশ মিনিটের আকাশ পথ। ওরা যতই বলুক, এতটা দীর্ঘ পথ তো আর কোন কিছু না করে, শুধু ঘুমের চেষ্টা করে কাটিয়ে দেয়া যায়না। আর আসনের সামনের মনিটরে যতই গান-বাজনা ও মুভির ব্যবস্থা থাকুক না কেন, ঘরে বসে শোনা বা দেখার মত প্লেনে ওগুলো কখনোই আমাকে আকর্ষণ করেনা। আমি শুধু মাঝে মাঝে স্ক্রীনে ফ্লাইটের গতিবিধি লক্ষ্য করি, আবার ফিরে যাই অন্য কাজে, অন্য চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর পর পর্দা উঠিয়ে আকাশ আর মেঘ দেখি, ঝটপট ওসবের কিছু ছবি তুলে রাখি। এভাবে অর্ধেকের বেশী পথ পাড়ি দেবার পর থেকে মনের মধ্যে শুরু হয় এক ধরণের ছটফটানি- কখন গন্তব্যে পৌঁছাবো। ১৮ বছর আগে যখন আরেকবার অস্ট্রেলিয়া এসেছিলাম, তখন দেখেছিলাম ওরা প্রশিক্ষিত ডগ-স্কোয়াডের কুকুর দিয়ে আগমনকারী যাত্রীদের লাগেজের নিরাপত্তা স্ক্রীনিং করে থাকে। কুকুরগুলো কখনো কখনো যাত্রীদের কোমর পর্যন্ত উঠে গন্ধ শোঁকে। এটা আমার কাছে তখনো ভাল লাগেনি, জানি এবারও ভাল লাগবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে কেবিন ক্রুদের দেয়া “ইন-কামিং প্যাসেঞ্জারস’ ডিক্লেয়ারেশন কার্ড” দুটো পূরণ করতে শুরু করলাম। ঢাকা থেকে যেন কোন প্রকার খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল কিংবা ফলমূলের ও শাকসব্জীর বিচি সাথে না আনি, এ ব্যাপারে অনেকেই আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কার্ড দুটো পূরণ করার ব্যাপারে বৌমা আমাদেরকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়েছিল। পূরণের সময় তার কথাগুলো মনে রেখেছিলাম। ডিক্লেয়ার করার মত আমাদের সাথে আনা কেবল একটিই সামগ্রী ছিল, সেটা হলো আমাদের দু’জনার জন্য আলাদা আলাদা ঔষধের প্যাকেট। এদের দেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ আনা বা কেনা-বেচা নিষেধ। তাই আমাদের প্রেসক্রিপশনগুলো হাতের নাগালের মধ্যেই রেখেছিলাম। কার্ডগুলো পূরণ করে অধীর আগ্রহ সহকারে আসনের সামনের মনিটরে ফ্লাইটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে মনোনিবেশ করলাম।

আকাশে যতক্ষণ ছিলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত সন্ধ্যা নামেনি। মেলবোর্নের Tullamarine বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করার জন্য প্লেনের চাকা যখন তার লুকোনো গহ্বর থেকে বের হয়ে এলো, কেবল তখনি দেখলাম গোধূলির আলোর সাথে সাথে নীচের হাইওয়ের আলোও একসময় জ্বলে উঠলো। সূর্যাস্তের (সন্ধ্যা ০৮-৪৫) কিছুটা পরে ডানা মেলে ধেয়ে আসা প্লেনটির চাকা Tullamarine বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করলো। এবারেও সময়ের কিছুটা আগেই নেমে পড়ায় প্লেনটিকে বোর্ডিং ব্রীজের সন্নিকটে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। ঠিক নয়টা পঁচিশ মিনিটে বোর্ডিং ব্রীজের সাথে সংযোগের পর একেবারে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নয়টায় প্লেনের দরজা খুলে গেল। প্লেনে বসে থাকাকালীন সময়ে অভ্যন্তরীন ঘোষণায় বলা হয়েছিল, বাইরে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সহনীয় এ তাপমাত্রার কথা শুনে খুশী হ’লাম, কেননা পরিধানে মোটা কোন শীতের কাপড় ছিলনা। প্লেন থেকে বের হয়ে ইমিগ্রেশন লাউঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। প্লেনে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কারণে আমাদের পা দুটো বেশ ভারী ভারী লাগছিল। আমরা আস্তে আস্তে হেঁটে এসে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সম্মুখস্থ দীর্ঘ লাইনের প্রায় শেষের দিকে দাঁড়ালাম।

ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনের লাইনটি বেশ দীর্ঘ হলেও, এদের দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে খুব তাড়াতাড়িই আমরা ইমিগ্রেশন অফিসারের সম্মুখীন হ’লাম। উনি আমাদের ডিক্লেয়ারেশন কার্ড দু’টোর উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ঔষধগুলো কার জন্য এনেছি। আমি বললাম, আমাদের উভয়ের জন্য। পরের প্রশ্ন, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সাথে আছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, আছে। উনি তা দেখতে চাইলেন না; কার্ড দু’টোর উপর ইংরেজীতে দুটো সাংকেতিক অক্ষর লিখে আমাদের শুভকামনা জানিয়ে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিত করলেন। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও ডগ স্কোয়াড এর কোন কুকুর আছে কিনা। নেই দেখে আমরা খুশীমনে বের হবার পথ ধরলাম। একটা জায়গায় এসে আমরা একজন নিরাপত্তা স্টাফের সম্মুখীন হ’লাম, যিনি আমাদের লাগেজগুলো সহ আমাদেরকে একটা নির্দিষ্ট চ্যানেলে ঢুকিয়ে দিলেন। ঐ চ্যানেলে আমাদের ঠিক সামনেই ছিলেন আরেক বাঙালি দম্পতি। তারা আমাদেরকে বললেন, (তাদেরসহ) আমাদের লাগেজগুলো হয়তো ওরা পরীক্ষা করবে। আমি গিন্নীকে বললাম, স্যুটকেসের চাবিটা হাতে রাখতে। সেখানকার পরীক্ষাকারী অফিসার ছিলেন একজন মহিলা। দেখলাম, তিনি আমাদের আগে দাঁড়ানো বাঙালি দম্পতিকে তাদের একটা লাগেজ খোলার নির্দেশ দিচ্ছেন। লাগেজ খোলার পর সেখান থেকে একটা খাদ্যজাতীয় দ্রব্যের প্যাকেট বের করে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আমি আমাদের লাগেজগুলো স্ক্রীনিং বেল্টে উঠিয়ে দিলাম। লাগেজগুলো বেল্ট পার হবার পর সেই কর্মকর্তা জানালেন, আমাদের লাগেজ ক্লীয়ার, আমরা যেতে পারি। আমরা রাত সাড়ে দশটায় লাউঞ্জের বাইরে বের হয়ে আসলাম।

এতক্ষণ ধরে নানারকম টেনশনের কারণে এয়ারপোর্টের ফ্রী ওয়াই-ফাই যোনের সন্ধান করার কথা খেয়ালে ছিলনা। লাউঞ্জ থেকে বের হবার সময় আমাদের ঠিক আগে আগে দেখি এক ভারতীয় দম্পতি ট্রলী ঠেলে বের হচ্ছেন। ভদ্রলোক কাকে যেন টেলিফোন করে তার অবস্থান জানাচ্ছেন। আমি তাকে অনুরোধ করলাম, তার টেলিফোন থেকে বাহিরে অপেক্ষমান আমার ছেলেকে একটি টেলিফোন করতে পারি কিনা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াটস এ্যাপে তার নম্বরে যোগাযোগ করা যাবে কিনা। আমি বললাম, যাবে। তিনি রিং দিলেন, কিন্তু সেটা রিসীভড হলোনা। তিনি তাকে আমার অবস্থান জানিয়ে একটা মেসেজ দিলেন। তারপর আমরা উভয়ে আউটসাইড পার্কিং এর দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম, ‘বাবা’! তাকিয়ে দেখি বৌমা। সে জানালো, কাছেই আমাদের ছেলে গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে আমার হাত থেকে ট্রলীটি নিয়ে নিকটেই পার্ক করা গাড়ীর দিকে অগ্রসর হলো, আমরা তার পিছু পিছু গেলাম। আমাদেরকে দেখে ছেলে গাড়ী থেকে বের হয়ে এলো। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আমরা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তার পর ছেলে একাই গাড়ীতে সব লাগেজ উঠালো। আমাকে একটুও ধরতে দিল না।

হাইওয়েতে উঠে ছেলে তার গাড়ীতে রাখা কিছু বাংলা গান ছেড়ে দিল। মনে এক সঞ্চারমান প্রশান্তি অনুভব করতে থাকলাম। সকল শান্তির উৎস যিনি, যার দয়ার কথা স্মরণমাত্র মনটা শান্তিতে ভরে ওঠে, তাঁর স্মরণে মাথাটা নত হয়ে আসলো। প্রায় ঘন্টাখানেকের পথ নিমেষে যেন শেষ হয়ে এলো। ছেলের বাড়ীতে পৌঁছে আমরা ঝটপট গরম জলে গোসল সেরে নিলাম। ওদের সংসারে আমাদের এই প্রথম আতিথ্য গ্রহণ। বৌমা মনে হয় সারাদিন ধরে আমাদের আগমন উপলক্ষে অনেক পদের রান্নাবান্না করে রেখেছিল। খুব আদর যত্ন করে ও সেগুলো পরিবেশন করলো এবং আমাদেরকে অতিভোজনে বাধ্য করলো। এ যেন আদরের অত্যাচার!!!

ওরা সবাই ওদের অনেক জমানো কথার আলাপ শুরু করে দিল, আমি নীরবে সেসব শুনতে থাকলাম। কখন যে রাত দুটা বেজে গেল, তা টেরই পাইনি। অবশেষে ঢুলু ঢুলু চোখে আমরা দু’জনে আমাদের কক্ষে এসে শয্যা নিলাম। ওরাও বোধকরি আরো কিছুক্ষণ ধরে টুকটাক কিছু কাজ শেষ করে, আলো নিভিয়ে দিয়ে শান্তির আমেজ নিয়ে ঘুমাতে গেল।

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
০১ জানুয়ারী ২০২০
(বছরের প্রথম মধ্যাহ্নে)


মন মোর মেঘের সঙ্গে…… As my mind accompanies the clouds….
(At 231741 December 2019)


মেঘশয্যা…. A bed of clouds
(At 231240 December 2019)


মন মোর মেঘের সঙ্গে…… As my mind accompanies the clouds….
(At 231741 December 2019)


মেঘশয্যা…. A bed of clouds
(At 231240 December 2019)

৪,৯৯৭ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “অস্ট্রেলিয়ার পথে (৩) …. অবশেষে মেলবোর্নের মাটিতে!!!”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।