অস্ট্রেলিয়ার পথে (১)…. অবশেষে এক মাস বিলম্বে যাত্রা শুরু!

গত ২২-২৪ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে অস্ট্রেলীয় শহর সিডনীতে Mirzapur Ex-Cadets’ Association (MECA) এর অস্ট্রেলিয়া চ্যাপ্টার কর্তৃক তিন দিন ব্যাপী একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হয়ে গেল, যার নাম MECA-Australia Global Reunion-2019। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের নানা দেশে অবস্থানরত MCC এর এক্স-ক্যাডেটরা সিডনীতে একত্রিত হয়েছিল এক মহা মিলনমেলায়। আয়োজকদের আমন্ত্রণে আমিও সস্ত্রীক সে মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ও প্রত্যাশী ছিলাম। আমার অবশ্য আরেকটা অতিরিক্ত কারণ ছিল যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে আমার মেজ ছেলে এবং বৌমাও প্রবাসী। তারা সম্প্রতি সেখানে “স্থায়ী নিবাসী” (পি আর) স্ট্যাটাস পেয়েছে। ওরা আমাদেরকে অনেক আগেই আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে আমরা যেন একটু সময় করে ওদের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসি। সিডনীতে অনুষ্ঠিতব্য “মেকা-অস্ট্রেলিয়া গ্লোবাল রিইউনিয়ন” আমাদের জন্য সে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। তাই ভেবে খুশী হয়েছিলাম যে রিইউনিয়নে গেলে আমাদের রথ দেখা, কলা বেচা- দুটো কাজই একসাথে হবে।

অস্ট্রেলীয় ভিসার জন্য ওদের ওয়েবসাইট পড়ে দেখলাম যে ভিসা পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র জমা দেবার পর অপেক্ষার স্বাভাবিক মেয়াদ ২০ থেকে ৩০ দিন। এই সময়ের মধ্যেই আবেদনের ফলাফল ওরা ইমেইলের মাধ্যমে আবেদনকারীকে জানিয়ে দেবে। পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজনে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। অপরিহার্য সে অনুষ্ঠান শেষ করে দু’দিন বিশ্রাম নেয়ার পর অস্ট্রেলীয় ভিসার জন্য কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। অবশেষে সব কাগজপত্র জোগাড় করে হাতে ৪২ দিনের সময় রেখে গত ০৯ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে ভিসার আবেদনপত্র জমা দিলাম। VFS Global এর Pemium Lounge এ আবেদনপত্র জমা দেয়ার সময় পুনরায় ওদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আবেদনের ফলাফল পেতে কতদিন সময় লাগতে পারে। ওরাও একই কথা বললো- স্বাভাবিক অবস্থায় ২০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে। আমি একটু সন্দেহের মধ্যেই ছিলাম, কারণ কিছু কিছু এক্স-ক্যাডেট আমাকে জানিয়েছিল, ওদের কেউ কেউ ৪ সপ্তাহেই ভিসা পেয়ে গেছে, কেউ কেউ পেয়েছে ছয় থেকে আট সপ্তাহেও। আবার একজন মোটেই পায়নি। আমি প্রায় ১৮ বছর আগে আরেকবার অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছিলাম। সেবারে সিডনী, ক্যানবেরা এবং পার্থ সফর করে গিয়েছিলাম। তাই আমার মনে মনে একটু আশা উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল যে আগেও একবার আশার কারণে হয়তো এবারে আমার ভিসা পেতে অসুবিধে হবেনা। কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে সেটা ছিল ১৮+ বছর আগের কথা। তখনো তাদের ইমিগ্রেশণ বিভাগ পুরোপুরি ডিজিটালাইজড হয়নি, তাই আমার সেই রেকর্ডও তাদের ক্লিকাগ্রে থাকার কথা নয়।

যাহোক, অস্ট্রেলীয় ভিসার জন্য আবেদনপত্র জমা দেয়ার পরে ৩০ দিন পর্যন্ত আর কিছু করণীয় ছিলনা, শুধু ২০ দিন পর থেকে দৈনিক অন্ততঃ একবার করে মেইলবক্স চেক করা ছাড়া। “সময়মত” ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে আমার আশাটা বোধহয় একটু বেশীই ছিল। তাই আমি ১৫ অক্টোবরেই আমার অনুজপ্রতিম এমসিসি এলামনাস, বিজনেস ট্রাভেল সার্ভিসেস এর মালিক সাঈদ হাসানের অফিসে গিয়ে ২০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে ঢাকা-সিডনী যাত্রা শুরু করে, দু’মাস পরে ফেরার মেলবোর্ন-ঢাকা টিকেট কিনে ফেললাম। এর পর নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু হলো প্রথমে দৈনিক কয়েকবার করে, পরে প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় মেইলবক্স চেক করার পালা। কিন্তু দিনের পর দিন ধরে চলছিল একই অবস্থা- All quiet on the Eastern Front!

এদিকে, আমাদের অস্ট্রেলিয়া যাবার কথা শুনে দীর্ঘদিন ধরে নিউজীল্যান্ড প্রবাসী আমার বাল্যবন্ধু হাসান তওফিক চৌধুরী (এর পর থেকে শুধু তওফিক) ফোন করে অনুরোধ করতে শুরু করলো আমরা যেন এ যাত্রায় ওদের ওখান থেকেও বেড়িয়ে আসি। তওফিক আমার ক্যাডেট কলেজ জীবনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর অনুরোধে এতটা আন্তরিকতা ছিল যে তা অমান্য করতে কষ্ট হচ্ছিল। ওকে বললাম, অস্ট্রেলীয় ভিসা পেতে পেতে আমার অনেক দেরী হয়ে যাবে, তখন আর নিউজীল্যান্ডের ভিসার জন্য আবেদন করার সময় থাকবেনা। একথা শুনে ও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললো, সে নিউজীল্যান্ডের নাগরিক। আমি যদি ওর চাহিদামত আমাদের পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্রের স্ক্যানড কপি ওর কাছে পাঠিয়ে দেই, তাহলে সে-ই আমাদের হয়ে (ওর অতিথি হিসেবে) আমাদের ভিসার জন্য আবেদনপত্র নিউজীল্যান্ড ইমিগ্রেশনে জমা দেবে। আমি ওর চাহিদামত কাগজপত্র পাঠাতে শুরু করলাম।

ধাপে ধাপে কাগজপত্র পাঠাচ্ছি, আর নিউজীল্যান্ড ভিসা সংক্রান্ত নানা নীতিমালার কথা অবগত হচ্ছি। এক পর্যায়ে জানতে পারলাম, ভিসা পেতে হলে আমাদেরকে আমাদের মূল পাসপোর্টগুলো নিউজীল্যান্ডের দিল্লীস্থ হাই কমিশনে পাঠানোর জন্য ভারতের যেকোন ভিসা সেন্টারে জমা দিতে হবে। নতুন এক উৎকন্ঠার সম্মুখীন হ’লাম- অস্ট্রেলীয় ভিসা হয়ে গেলেও, যদি এর মধ্যে পাসপোর্টগুলো ভারত থেকে ফিরে না আসে! এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের অস্ট্রেলীয় ভিসাও ঢাকায় নয়, বরং তাদের ভারতীয় হাই কমিশনে প্রক্রিয়া করা হয়ে থাকে। কিন্তু এজন্য আমাদেরকে পাসপোর্টগুলো ভারতে পাঠাতে হয়না, এখানকার ভিসা সেন্টারই সেগুলো পরীক্ষা করে আমাদের হাতে নগদ নগদ ফেরত দিয়ে দেয়। যাইহোক, ভিসার আবেদন যখন করতে যাচ্ছি, তখন আর এত কিছু ভেবে লাভ নেই। তাই তওফিক ২৫ অক্টোবর তারিখে আমাদের নিউজীল্যান্ডের ভিসার জন্য আবেদনপত্র জমা দিল, আর আমি ২৯ অক্টোবর তারিখে বনানীর ডিএইচএল অফিসে গিয়ে আমাদের পাসপোর্টগুলো তাদের হাতে তুলে দিয়ে কম্পমান হৃদয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

ডিএইচএল এর ট্র্যাকিং নাম্বার অনুসরণ করে আমাদের পাসপোর্টগুলোর গতিবিধির উপরে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলাম। ০১ নভেম্বরে সেগুলো ডেলিভারী দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন শুক্রবার জুম্মার নামায পড়ে ফিরে এসে ডিএইচএল এর ট্র্যাকিং পেইজ খুলতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ! দেখি সেখানে লেখা, প্রাপক আমাদের পাসপোর্টগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কোনমতে লাঞ্চ করে ছুটলাম ডিএইচএল অফিসে। ওরা আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইলো এই বলে যে এরকম মাঝে মাঝে হয়েই থাকে, এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। পরের দুই দিন ছিল শনি ও রবিবার, ভারতে সরকারী অফিসগুলোর ছুটির দিন। সোমবারে ডিএইচএল পুনরায় আরেকবার ডেলিভারীর উদ্যোগ নেবে, তাতে সফল না হলে প্রেরকের খরচে পাসপোর্টগুলো প্রেরকের নিকট পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু আমি ওদের কথায় মোটেই আশ্বস্ত হ’লাম না। ওখানে বসেই ভিসা সেন্টারের ঠিকানাটা ওয়েবসাইট থেকে চেক করে নিয়ে দেখলাম, আমি সঠিক ঠিকানাই লিখেছি। তাই ওয়েবসাইট থেকেই ভিসা সেন্টারের একটা ল্যান্ডফোন নাম্বার পেয়ে সেখানে ফোন করলাম। যিনি ফোন ধরলেন, তিনি জানালেন যে আমি যে দেশের ভিসার জন্য পাসপোর্টগুলো পাঠিয়েছি, সে দেশের নামটি ঠিকানায় ব্রাকেটে উল্লেখ করেছি কিনা। আমি বললাম, আপনাদের ওয়েবসাইটে সেটা উল্লেখ করার কথা লেখা নেই। ওয়েবসাইটে যেভাবে ঠিকানা দেয়া আছে, আমি সেভাবেই ঠিকানাটা লিখেছি। আর খামটা খুললেই তো মূল চিঠি পড়ে বোঝা যাবে, আমরা কোন দেশের ভিসা চাচ্ছি। উনি বললেন, না ব্রাকেটে সে দেশের নাম উল্লেখ করতে হবে। অগত্যা, ডিএইচএল এর সেই তরুণ অফিসিয়ালকে অনুরোধ করলাম, ঠিকানায় ব্রাকেটে “নিউজীল্যান্ড ভিসা” উল্লেখ করে ভারতের সংশ্লিষ্ট ডিএইচএল অফিসে একটি সংশোধনী মেইল পাঠাতে। উনি যথেষ্ট তৎপরতার সাথে কাজটি করে দিলেন। আমি সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ী ফিরে এলাম।

অস্ট্রেলীয় ভিসা আবেদনের ফলাফল জানার প্রত্যাশিত দিনটি পার হয়ে গেল ০৮ নভেম্বর তারিখে। এর পরে কিছুতেই ওদের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না, না ঢাকার ভিএফএস গ্লোবাল এর সাথে, না তাদের ভারতের অফিসের সাথে। ওরা টেলিফোনও ধরেনা, আবার ওদের কাছে মেইল পাঠাবারও কোন উপায় রাখেনি। অস্ট্রেলীয় ওয়েবসাইটে একটি ঘোষণায় জানানো হচ্ছিল যে কিছু কারিগরি ত্রুটিজনিত কারণে অস্ট্রেলীয় ভিসা আবেদনকারীদের তাদের ফলাফল জানতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তাদের দুঃখ প্রকাশে তো আর আমার উৎকন্ঠা দূর হবার নয়। এদিকে ১৪ নভেম্বর তারিখের সন্ধ্যায় নিউজীল্যান্ডের একজন ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ইমেইলে জানালেন, পরবর্তী ৫ দিনের মধ্যে আমাদের অস্ট্রেলীয় ভিসা আবেদনের ফলাফল তাদের ওয়েবসাইটে “আপলোড” করে দিতে হবে। এটার কারণ, আমাদের আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল যে আমরা অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজীল্যান্ড বেড়াতে যাব। বুঝলাম, ওদের ভিসা পাওয়াটা নির্ভর করছে আমাদের অস্ট্রেলীয় ভিসা পাবার উপর। ৫ দিন শেষ হবার কথা ছিল ১৯ তারিখে। আমি ভেবেছিলাম, পঞ্চম দিনের অফিস টাইম পর্যন্ত অপেক্ষা করবো, তার পরেও না পেলে বিকেলের দিকে মেইল করে দেব। কিন্তু ১৯ তারিখ সকাল ১১টায় নাতাশা নামের সেই ইমিগেশন অফিসার আমাকে সরাসরি ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি আস্ট্রেলীয় ভিসার ফলাফল আপলোড করছিনা কেন। আমি বললাম, ফলাফল পাইনি, তাই আপলোডও করিনি, আর তাছাড়া আপলোডের সময়সীমা তখনো অতিক্রান্ত হয়নি। ৫ দিনের সময়সীমা শেষ হবার আগেই (সেইদিন সন্ধ্যায়) আমি একটা কিছু অবশ্যই জানাতাম।

১৯ নভেম্বর তারিখে ভগ্ন হৃদয়ে আমার ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে গিয়ে আগের করা টিকেটটা ক্যান্সেল করতে বললাম। ট্রাভেল এজেন্টের মালিক সাঈদ হাসান স্বয়ং তখন রিইউনিয়নে যোগদানের জন্য সস্ত্রীক এবং সবান্ধব সিডনীতে উপস্থিত। তাকে আর এ নিয়ে বেশী বিরক্ত করলাম না, তার স্টাফকে অনুরোধ করেই টিকেট বাতিল করলাম। পরেরদিন ২০ তারিখে অনেক কয়েকবার প্রচেষ্টার পর আমি অস্ট্রেলীয় ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে ঢুকতে পেরে আমাদের ভিসা আবেদনের ফলাফল জানতে চেয়ে একটা আনুষ্ঠানিক “ইনকোয়ারী” জমা দিতে সক্ষম হ’লাম। ২১ তারিখে জবাব পেলাম, সেটা তখনও তাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে এবং আমি ই-ভিসার আবেদন না করে পেপার আবেদন পাঠিয়েছি বলে সময় কিছুটা বেশী লাগছে। ওরা এটাও উপদেশ দিয়ে রাখলো যে ভবিষ্যতে যেন ভিসার আবেদনপত্র পেপারে না করে ই-ভিসার আবেদন করি। এই উপদেশে ইঙ্গিত পেলাম যে ভিসা মঞ্জুর হবার সম্ভাবনা আছে, নইলে ভবিষ্যতে আবেদনের কথাটা বলতো না। ২৭ তারিখ দুপুরে অস্ট্রেলীয় ইমিগ্রেশন অফিসারের মেইল পেলাম, তিন মাসের মাল্টিপল এন্ট্রীসহ ভিসা মঞ্জুর হয়েছে, যা এক বছরের মধ্যে এভেইল করতে হবে। বিকেলে এ ফলাফলটা নিউজীল্যান্ড ইমিগ্রেশন এর ওয়েবসাইটে “আপলোড” করলাম। এক ঘন্টার মধ্যে নিউজীল্যান্ড ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছ থেকেও মেইল পেলাম, মাল্টিপল এন্ট্রীসহ এক মাসের ভিসা মঞ্জুর হয়েছে। এবারে শুরু হলো নতুন করে টিকেট করা ও ট্যুর প্ল্যান প্রস্তুত করার পালা……..

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
২৮ ডিসেম্বর ২০১৯

৪,৪৩৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।