‘রাজা, তোমার বাবা এখন কোথায়’?
ছোট ফুপির এ কথাটা শোনার সাথে সাথে রাজার দু’চোখ বেয়ে প্রথমে নীরবে ফোঁটা ফোঁটায়, পরে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ও কী বুঝলো, কী ভাবলো, কে জানে! ফুপি যখন এ প্রশ্নটা করেছিলো, তখন কেবলমাত্র ও ছাড়া ওদের বাড়ীর এবং আশে পাশের সব বাড়ীর পুরুষ লোকেরা গিয়েছে স্থানীয় মাসজিদে, জুম্মার নামাযে। তবে অন্যান্য দিনে জুম্মার নামাযের সময় এরকমভাবে সবার বাড়ী পুরুষ শূন্য থাকেনা বা হয়না। আজ অন্য কথা, অন্য কারণে।
আজ বা’দ জুম্মা মাসজিদে রাজার বাবার জানাযা পড়ানো হবে। তার মৃতদেহ ইতোমধ্যে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজার সদ্যপ্রয়াত বাবা এই মাসজিদেই গত প্রায় দুই যুগ ধরে নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েছেন। অবশ্য শেষের দিকে বছর খানেক অসুস্থতার কারণে সব ওয়াক্ত নামায মাসজিদে পড়তে পারতেন না বলে খুবই অস্থিরতায় ভুগতেন। আযান শুনলেই তার মনটা আকুলি বিকুলি করতো। এমন অস্থিরতা নিয়েই তিনি শেষের দিকে আযান শুনে নিজ বাড়ীতেই নামায আদায় করতেন। গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি প্রতি রাতে নিয়ম করে ফজরের ওয়াক্তের ঘন্টা দুয়েক আগে শয্যা ত্যাগ করতেন। প্রথমে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন, তারপর পাঞ্জেগানা সুরা অর্থাৎ সুরা ইয়াসিন, রাহমান, ওয়াক্কিয়াহ, মুলক এবং মুযাম্মিল মুখস্থ তিলাওয়াৎ করতেন। ততক্ষণে ফজরের আযান পড়ে যেত। উনি ফজরের নামায পড়ে আরও কিছুক্ষণ দোয়া দরুদ পড়তেন। সূর্য ওঠার পরে একেবারে ইশরাক এর নামায পড়ে তবে তিনি কিছুক্ষণ সময়ের জন্য ঘুমিয়ে নিতেন।
রাজার পৃথিবীটা বলতে গেলে আজন্ম চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিংবা বলা যায়, নিজেদের ঘর, বারান্দা আর বারান্দায় বসে দু’চোখ মেলে যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুতেই সীমিত ছিল। জন্মের পর বড় জোর মাস কয়েক সে মায়ের নিবিড় পরিচর্যা পেয়েছিল। মা বাবা উভয়ে চাকুরীজীবি হওয়ায় দু’তিন মাস বয়স থেকেই দিনের অংশটুকুতে তার যত্ন পরিচর্যার ভার ন্যস্ত ছিল বেতনভুক্ত বুয়ার উপর। বলা বাহুল্য, রাজার মা বাবা উভয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাবার পর থেকে বুয়া আর বুয়া থাকতোনা। সে বনে যেত বাসার মালকিন। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে বিছানায় ফেলে রেখে সে তার মায়ের প্রসাধন সামগ্রী মেখে পাড়া বেড়াতে বের হতো। ফিরতো নিজ ইচ্ছে মাফিক। রাজা একবার কান্না শুরু করলে সহজে থামতে চাইতোনা। কিন্তু জনমানবহীন ঘরে কে শুনবে তার কান্না? একসময় কাঁদতে কাঁদতেই ক্লান্ত হয়ে আবার সে ঘুমিয়ে পড়তো। বুয়ার এ অমানবিক আচরণের কথা আন্দাজ করতে রাজার মায়ের বেশীদিন সময় লাগেনি, কিন্তু ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ভেজা বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে (তখনো দেশে প্যাম্পার ব্যবহার চালু হয়নি) শিশুটির ঠান্ডা লেগে তা বুকে বসে যেত। তাই কয়েক মাস পর পরেই রাজা অসুখে ভুগতে লাগলো। ঘন ঘন বুয়া পরিবর্তন করেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না।
এভাবেই রাজা প্রতিটি কর্মদিবসের দিনের সময়টুকুতে অনাদর আর অবহেলায় (তখনকার পরিস্থিতিতে বলা যায়, কিছুটা অপরিহার্যভাবে) বড় হতে থাকলো। ছুটির দিনগুলোতে অবশ্য তার মা বাবা ঘরে থেকে তাকে যত্ন আত্তি করতে এতটুকু কসুর করতেন না। ওনারা একসময় লক্ষ্য করলেন, ছেলের মুখে বোল ফোটার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে কথা বলছে না। ওনারা জানতেন যে যারা জন্ম থেকে বোবা হয়, তারা একই সাথে বধিরও হয়। তাই ওনারা একটু দূরে কিংবা রাজার শয্যার এক পাশে সরে গিয়ে ওর নাম ধরে ডেকে পরীক্ষা করতেন যে ও কানে শোনে কিনা। ডাকের সাথে সাথে ও যখন ঘার ফেরাতো, ওনারা নিশ্চিত হতেন যে ও কানে শোনে। সুতরাং ওনারা অপেক্ষা করতে লাগলেন, একদিন ওর মুখে কথা শোনার জন্য। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছরও যেতে লাগলো, কিন্তু ও মুখে কিছু শব্দ করলেও কথা বলা শিখলোনা। দিনে দিনে ওর মা বাবার দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো, সেই সাথে বাড়তে থাকলো তাদের হীনমন্যতাবোধ। ঘরে বাক প্রতিবন্ধী শিশু বড় হবে, এটা ভেবে তারা মুষড়ে পড়তে থাকলেন। বেড়াতে যাওয়া কমিয়ে দিলেন, ক্রমে সেটা শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। পাঁচ বছর পরে তাদের ঘরে জন্ম নিল রাজার বোন রানী। এতে রাজার ওপর থেকে নজরটা ভাগ হয়ে যেতে থাকলো। রানী যখন সময়মত কথা বলা শিখলো, তখন মা বাবার সযত্ন দৃষ্টি ওর উপরেই কেন্দ্রীভূত হতে থাকলো। রাজা হতে থাকলো কিছুটা উপেক্ষিত। দিনে দিনে সেটা বেড়ে যেতে থাকলো এবং সে হতে থাকলো ঘরকুনো। বাসায় অতিথি এলে সে লুকিয়ে থাকতো, সহজে বের হতোনা। কেউ আদরের আতিশয্যে জোর করে কাছে টেনে নিলে সে অস্বস্তি বোধ করতো। বিকেলে সে একা একা বারান্দায় বসে বসে ওর বয়সী ছেলেমেয়েদের খেলা দেখতো। একাই হাসতো, আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠতো। মুখেও কিছু একটা বলতো যা সাধারণের বোধগম্য ছিলনা। ধীরে ধীরে সে ঘরের ফুট ফরমাশ খাটার কাজ শিখে নিল। কেউ ওকে পড়াশোনা শেখানোর বা ওর জন্য কর্মমুখী শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলোনা। ফলে ওর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। সেও খুশী মনেই গৃহস্থলী কাজে মা বাবাকে সাহায্য করা, ফুট ফরমাশ খাটাকে তার দৈনন্দিন কাজ হিসেবে মেনে নিয়েছিল। অবসরে নিজের ঘরে বসে বসে টিভিতে কার্টুন আর কুস্তি দেখে সে খুব মজা পেতো। সেটাই ছিল এ জীবনে তার একমাত্র আনন্দের অনুষঙ্গ।
রাজার বাবা যখন মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন রানী একদিন অনেক অনুরোধ করে, বলা যায় জোর করেই ওকে হাসপাতালে নিয়ে এলো। বহুদিন পরে ঘর হতে বের হয়ে হাসপাতালে গিয়ে রাজা তার বাবাকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এরকম নাকে মুখে নল ঢুকানো কোন রোগীকে এর আগে সে কোনদিন দেখেনি। হাসপাতাল থেকে যখন তার বাবাকে ছেড়ে দিল, তখনো তার জ্ঞান থাকলেও তিনি মুখে কোন কথা বলতে পারতেন না, নিজ পায়ে দাঁড়াতেও পারতেন না। এ্যাম্বুলেন্সশায়ী বাবাকে ঘরে নিয়ে আসার পর রাজা তাঁকে খুব নিবিষ্ট মনে পরিচর্যা করতো। মৃত্যুর দিন এশার আযান শুনে উনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে একপাশে ঢলে পড়লেন, তখনও রাজা ওনার পাশে বসে থেকেও বুঝতে পারেনি যে তিনি আর এ ইহজগতে নেই। ওর একজন কাজিন যখন সেটা বুঝতে পেরে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলো, কেবল তখনই ও কিছুটা আঁচ করতে পেরে নীরবে প্রস্থান করলো এবং তার নিজ কক্ষে গিয়ে শয্যার উপর মাথা গুঁজে বসে থাকলো। ওর বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ওর মেজচাচা সে রাতেই ওদের বাসায় ছুটে এসেছিলেন। তিনি পরিবারের আর বাদবাকী সবার সাথে কিছুক্ষণ সান্তনামূলক কথাবার্তা বলে রাজার খোঁজ করলেন। তিনি দেখলেন রাজা অন্য একটি কক্ষে চুপ করে মাথা নীচু করে বসে আছে। উনি ভেবে পেলেন না রাজাকে উনি কী বলবেন। ওর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি নিঃশব্দে ওর মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। সেও উঠে দাঁড়িয়ে চাচার বুক ঘেঁষে মাথা পেতে থাকলো, যতক্ষণ না তিনি হাত বুলানো বন্ধ করে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনে উদ্যোগী হলেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন, ওর চোখ লাল, কিন্তু চোখে অশ্রু নেই। কেউ কেউ ওর সাথে আবেগী কথাবার্তা বলে পরখ করে নিচ্ছিল যে ওর চোখে জল আসে কিনা, আসলে হয়তো একটা ইমোশনাল ক্যাথারসিস হয়ে ও কিছুটা স্বস্তি পেত। কিন্তু না, তা হয় নি।
রাজা ঘরের বাইরে বের হতে খুব ভয় পায়, কারণ শৈশবে পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো, টিটকারি দিত, এমনকি ওকে মারধোরও করতো। তাই কখনো সে সহজে ঘর হতে বের হয় না। হঠাৎ কোন সময় কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে ওকে নিয়ে ওর বাবা মা বেড়াতে গেলে ও কোন একটি কক্ষকোণে গুটিয়ে থাকে। একমাত্র নিজেদের বাড়ী ছাড়া কোথাও সে স্বস্তি পায় না। ওর মনে কোন আনন্দ বা দুঃখবোধ আছে কিনা, সেটা সহজে বোঝা যায় না, কারণ সে মোটেই interactive নয়। ফলে কেউ ইচ্ছে থাকলেও বেশীক্ষণ ওর সাথে কথা বলতে পারেনা। তারপরেও সেদিন অনেকে ওকে বুঝিয়েছে, ওর বাবার নামাযে জানাযায় যাবার জন্য, কিন্তু ও রাজী হয়নি। নামায শেষে ওর মেজচাচা রানীকে ফোন করে অনুরোধ করে বলেন, ‘ওতো জানাযায় এলোনা, চেষ্টা করে দেখ ওকে দাফন অনুষ্ঠানে যেতে রাজী করানো যায় কিনা। রাজী হলে আমি নিজে এসে ওকে বাসা থেকে নিয়ে যাব এবং নিজ তত্তাবধানে রাখবো’। কিন্তু না, রাজা রাজী হয়নি। তখন ওর ছোট ফুপি এসে ওকে গল্পের শুরুর প্রশ্নটি করেছিলেন। আর তখনই প্রথমে নীরবে এক ফোঁটা দু’ ফোঁটা করে, পরে ঝর ঝর করে ওর গাল দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। সে অনবরত ফোঁপাতে থাকে। এর আগে কেউ কখনো নির্বাক, অন্তর্মুখী রাজাকে কাঁদতে দেখেনি।
এতক্ষণ ধরে যার কথা বললাম, সে কোন বালক নয়, যুবকও নয়, বরং বলা যায় সে এখন প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে। রাজার বয়স এখন ৪৮। কিছুদিন আগে ওর বাবা, হক সাহেব ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। রাজা ভাগ্যাহত এক ব্যক্তি। সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নয়, শুধুই বাক প্রতিবন্ধী। জন্মগত এ সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেকেই কাজ করে খায়, পরিবার প্রতিপালন করে। কিন্তু তার ভাগ্যে এরকম কোন প্রশিক্ষণ প্রাপ্তি ঘটেনি, যার দ্বারা সে জীবিকা অন্বেষণ করতে পারে। ভবিষ্যত জটিলতার কথা ভেবে ওকে বিয়েও দেওয়া হয়নি। ফলে, তার একটি জন্মগত অপ্রাপ্তির সাথে আরেকটি অপ্রাপ্তির বঞ্চনা যোগ হয়েছে। তার স্বাভাবিক প্রকৃতিগত মনোদৈহিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। নির্বাক হবার কারণে সে জীবনে কখনো মিথ্যে কথা বলেনি। এদিক থেকে তার গুনাহ’র খাতা শূন্য। নিজের বাবা, মা আর বোন ব্যতীত সে অন্য কারো কাছে কখনো কিছু চায়নি। জীবনে কারো কাছে ওর কোন ঋণ নেই, তবে ওর কাছে অনেকের থাকতে পারে। পাড়া পড়শী এবং কাজিনদের মধ্যে কেউ কেউ ওর ভাষা বুঝলেও তাদের প্রতি অন্যায় করার কোন ক্ষমতা ওর নেই, ছিলনা। এদের বাইরে পৃথিবীর আর কোন মানুষের সাথে তার কোন লেনদেন নেই, কখনো ছিলনা। বাবার মৃত্যুর পর আজ সে বয়স্কা মায়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। যেদিন ওর মাও থাকবেনা, সেদিন ওর কি হবে, তা একমাত্র ভবিতব্যই জানে!
(গল্পের চরিত্রগুলো কাল্পনিক)
ঢাকা
২০ আগস্ট ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।