কোন পীর আউলিয়ার নামে নয়,
যেমন জালালাবাদ, জামালপুর।
কোন সাহসী নারীর নামে নয়,
যেমন চৌধুরাণী বা ভবানীপুর।
তবু করি সেই অখ্যাত নাম স্মরণ,
বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশন!
বুকে ধরা ছিলো চারটে প্লাটফর্ম।
স্লিপার বসানো, পাথর বিছানো
সমান্তরালে আঁকাবাকা রেলপথে
দিনে রাতে ট্রেনগুলো ছয়দিকে
আনমনে আনাগোনা করতো দ্রুত।
বসত ভিটেয় কাঁপুনি লাগিয়ে যেত।
যমুনার ভাঙ্গনে তিস্তামুখ ঘাট
স্থান বদলাতো প্রায় হঠাৎ হঠাৎ।
ট্রেনগুলো খুব ধীর লয়ে চলতো।
ঘটাং ঘটাং করে বালুচর পার হতো।
এরপর পিঁপড়ের মত পিলপিল করে
বোনারপাড়া জংশনে পৌঁছাতো।
সাথে সাথে চারিদিকে হৈ হুল্লোড়ে
যাত্রী ও কুলিরা হাঁকডাক ছেড়ে,
প্ল্যাটফর্মটাকে সহসা সরগরম করে
তল্পিতল্পা নিয়ে ছোটাছুটি করতো।
যাত্রীরা ধেয়ে যেত হোটেলের পানে,
পানবিড়ি সিগ্রেট আর চায়ের দোকানে।
হঠাৎ প্রাণচঞ্চল এই বোনারপাড়ায়
বিধাতা কেন যেন অভিশাপ নামায়।
স্রোতহারা যমুনাবক্ষের এধারে ওধারে
বহু চর জেগে ওঠে মাথা উঁচু করে।
নয়া ঘাট খোঁজে সব রেলের বাবুরা,
বালাসীর ঘাটটাকে বেছে নেন তারা।
সেই থেকে ট্রেনগুলো বোনারপাড়াকে
বাইপাস করে যায় বালাসীর ঘাটে।
রেলশহর বলে খ্যাত এই বোনারপাড়া
পুনরায় বনে যায় শুধু এক অজ পাড়া।
রেলসেতু বসলো যখন যমুনার ‘পরে,
বোনারপাড়াও গেলো ঘুমে চিরতরে।
পাদটীকাঃ একদা রাজধানী ঢাকার সাথে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর রেল যোগাযোগের এক অন্যতম সংযোগ কেন্দ্র ছিলো বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশন। ছোটবেলায় যখন স্কুল ছুটির পর নানাবাড়ী দাদাবাড়ী বেড়াতে যেতাম, ট্রেনযোগেই যেতাম। স্টীমার থেকে যমুনার পাড় ভাঙ্গা গড়ার খেলা দেখতাম। বিস্তীর্ণ ধূ ধূ বালুচরের উপর দিয়ে ট্রেন যখন পিলপিল করে এগিয়ে চলতো, জনহীন দু’ধার দেখে অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম, এখানে রেলপথ বসানো হলো কি করে! খুবই অল্প গতিবেগে ট্রেন চলতো ভরতখালী স্টেশন পর্যন্ত, তারপরে স্বাভাবিক গতিতে চলতো। বোনারপাড়ার পর থেকে খুব দ্রুতবেগে চলতো। প্রথমে টানতো কালো ধোঁয়া ছাড়া কয়লার ইঞ্জিন, বোনারপাড়া থেকে টানতো কানাডা সরকারের দেয়া হলুদ ডিজেল ইঞ্জিন।
ছোটবেলায় দোতারা হাতে ফকিরদের গাওয়া গানে বোনারপাড়া জংশনের নাম শুনেছিলাম। বড় হয়ে যাতায়াতের সময় দেখেছি বোনারপাড়া কতটা ভাইব্রেন্ট ছিলো। এই প্রাণচঞ্চল জংশনটি প্রথমে স্তিমিত হয়ে পড়ে রেলওয়ের স্টীমারঘাটটি তিস্তামুখঘাট থেকে বালাসীঘাটে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে। আর একেবারে থেমে যায় যমুনা সড়ক সেতুর সাথে রেলসেতু যোগ হবার পর থেকে। সভ্যতার উন্নয়নে কোথাও আলোর চমক লাগে, আবার কোথাও বা অন্ধকার নেমে আসে চিরতরে। একই কথা প্রযোজ্য একদা সদাচঞ্চল, চিরজাগ্রত আরিচা ও নগড়বাড়ী ফেরীঘাট সম্পর্কেও।
ঢাকা
২২ মার্চ ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
কবিতাটি সত্যিই দারুন হয়েছে। আমি সময় পেলে যাব ভাবছি
কবিতা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তব্যে প্রীত হ'লাম।
অসাধারন একটি কবিতা। যুগে যুগে সময় আর সভ্যতার নাগপাশ ছিন্ন না করতে পারায় জনপদের আপামর জনগোষ্ঠী কিভাবে বেঁচে থাকে তা আমরা অনেকেই হয়ত কম-বেশী জানি, কিন্তু মন থেকে উপলব্ধি করে তা প্রকাশ করার ক্ষমতা আমাদের সকলের নেই। আপনার লেখনীর মাধ্যমে আমরাও সেখান থেকে ঘুরে এলাম... এখন স্বশরীরে সেখানে একবার যাবার তাগিদ অনুভব করছি। পাঠককে উজ্জিবীত করার কম্ম সবার থাকে না.... আপনার লেখা সার্থক!!! ভাল থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ। মন্তব্যে প্রীত ও অনুপ্রাণিত হ'লাম।