রমজানের স্মৃতি – ১

ঠিক কত বছর বয়সে রমজানের প্রথম রোযাটা রেখেছিলাম, তা আজ সঠিক মনে নেই। অনুমান করি, ৬/৭ বছর হবে। আরো আগে থেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলাম, কিন্তু আম্মা রাখতে দেন নি। মনে আছে এখনকার মত বড় দিনেই প্রথম রোযাটা রেখেছিলাম। দুপুর পর্যন্ত ভালই ছিলাম, তার পর থেকে দিন আর কাটছিল না। ঘড়ি দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি ইফতারের সময় আসন্ন। সাথে সাথেই প্রসন্ন বোধ করতে শুরু করলাম, ক্লান্তি দূর হতে শুরু করলো। ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনী, সেমাই আর নানারকমের অন্যান্য সামগ্রী ভাজার সুগন্ধ নাকে আসছিল। এসব ছাড়াও আমাদের ইফতারে সব সময় একটা কমন মেন্যু ছিল কাঁচা ছোলা, সাথে কাটা আদা, মুড়ি আর লেবুর শরবত তো থাকতোই। মাঝে মাঝে কিছু কেনা জিনিসও আনা হতো। ইফতার সামগ্রী খাওয়ার চেয়ে পানি পান করে বেশী তৃপ্ত হয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। ইফতার টেবিল থেকে যখন উঠি, তখন ছোট পেটটা ফুলে ঢোলের মত হয়ে গিয়েছিল এবং ভরা পানিতে ঢক ঢক করছিলো।

ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বাসায় পুরো মাস ধরে রোযা রাখা হয়নি। প্রথম প্রথম একটা দুটো, আস্তে আস্তে সংখ্যাটা বাড়ছিলো। এখন যেমন প্রায় সব পরিবারেই বাসার ছোট বড় সবাই রোযা রাখে, আমাদের সময় আমাদের পরিবারে নিয়মটা অন্ততঃ দশ বার বছর পর্যন্ত এতটা কড়াকড়ি ছিলনা। ক্যাডেট কলেজে গিয়েই প্রথম নিয়মিতভাবে প্রতিদিন রোযা রাখা শুরু করি। প্রায় পনের রোযা পর্যন্ত কলেজে থাকতাম, তাই বাসায় এসে স্বাভাবিকভাবেই বাকীগুলো সব পুরো করতাম। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার কয়েক বছর পর রমজান মাস আসতো শীতের সময়। এমনি সেখানে প্রাকৃতিকভাবে গ্রামীন পরিবেশ ছিল, তাই খোলামেলা জায়গায় শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে আসতো। সেহরীর সময় আমরা ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য গায়ে পুল ওভারের উপর দিয়ে কম্বল পেঁচিয়ে এক দৌড়ে ডাইনিং হলে যেতাম। কিছু খাওয়ার রুচি হতো না, তবে দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে না, প্রথম প্রথম একথা ভেবেই জোর করে কিছুটা খেতাম। আরেকটু বড় হয়ে অবশ্য ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই চেষ্টা করতাম যতটুকু পারা যায়, রোযার হুকুম আহকামগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করতে।

ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় আমাদের এক চাচা থাকতেন, হারিছ চাচা। রক্তের সম্পর্কীয় কেউ নন, আব্বার বন্ধু এবং অফিস কলীগ। আমার জন্মের সময় চট্টগ্রামের আগ্রাবাদেও আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকতাম। ওদের আর আমাদের পরিবারের মাঝে প্রায় সমবয়সী ভাইবোন থাকাতে অভিভাবক লেভেলে এবং সিবলিং লেভেলে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। পরে অবশ্য বৈবাহিকসূত্রে আমরা আত্মীয়তেও পরিণত হই। আব্বা এবং হারিছ চাচা উভয়ে প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন, কিন্তু এবারে দুই পরিবারের দুই বাসার মাঝে বেশ দূরত্ব থেকে যায়। কিন্তু তা থাকলে কি হবে, সুযোগ পেলেই আমরা একে অপরের বাসায় বেড়াতে যেতাম। হারিছ চাচা খুবই ধর্মপরায়ন ব্যক্তি ছিলেন। রোযার মাসে উনি তার নিজের বাসায় একটা বড় রুম খালি করে তারাবীর নামায পড়ার ব্যবস্থা করতেন। একজন হাফেজ রেখে উনি এবং হাফেজ সাহেব মিলে তারাবীর নামায পড়াতেন। তখন পাড়ায় পাড়ায় এখনকার মত এতটা নৈকট্যে মাসজিদ ছিল না। রোযার মাস এলেই আমার কানে ভাসে হারিছ চাচার সুললিত কন্ঠে ক্বোরআন তিলাওয়াতের সুর- “কুলিল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি তু’তিল মুলকা…..” এটা ওনার খুব প্রিয় আয়াত ছিল। আমি রোযার মাসে কখনো ওনাদের বাসায় বেড়াতে গেলে অন্ততঃ দু’চারদিন না থেকে আসতে পারতাম না। চাচা পড়াশুনায় ভাল ছাত্রদের খুব স্নেহ করতেন। শৈশব এবং কৈশোরে আমার পড়াশুনার রেজাল্ট সমবয়সী ওনার সন্তানদের তুলনায় ভাল থাকাতে ওদের তুলনায় আমি চাচার কাছ থেকে স্নেহ আদর একটু বেশীই পেতাম। তা’ছাড়া আমার প্রায় সমবয়সী, অর্থাৎ আমার চেয়ে দু’বছরের বড় থেকে দু’বছরের ছোট ওনার চার ছেলে ছিল, যাদের সঙ্গ সান্নিধ্য আমি উপভোগ করতাম, আমাদের মাঝে খেলাধূলোও বেশ জমে উঠতো। মনে পড়ে, সেহেরী খাবার পর চাচা মুখে মুখে কয়েকবার আওড়িয়ে আমাকে রোযার নিয়্যাৎ শিখিয়েছিলেন, যা সেই থেকে আজও আমার মুখস্থ আছে। এখনও আমি সেহেরীর পর রোযার নিয়্যাৎ পড়ার সময় হারিছ চাচাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

সে সময়ের কেনা ইফতার আমার খুব ভাল লাগতো। বিশেষ করে পেঁয়াজু আর বেগুনী। পেঁয়াজু সত্যিকার অর্থেই পেঁয়াজ দিয়ে বানানো হতো, এখনকার মত শুধু খেসারীর ডাল দিয়ে নয়। ছোলাভাজারও একটা আলাদা স্বাদ ছিল। একটা বিশেষ দিনের কেনা ইফতারের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে। তখন রোযাটা পড়েছিল শীতকালে। আমরা স্কুল ছুটির পর দাদাবাড়ী-নানাবাড়ী ঈদ করতে যাচ্ছিলাম, রোযার মাসেই। যমুনা নদী রেলের স্টীমারে পার হয়ে ঠিক ইফতারের সময় কানেক্টিং ট্রেনযোগে বোনারপাড়া রেলওয়ে জংশনে পৌঁছলাম। সেখানে ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় লাগে। তাই কুড়ি মিনিটের মত সময় পাওয়া যায়। আব্বা প্লাটফর্মে নেমে রেলের রিফ্রেশমেন্ট রুম থেকে আমাদের সবার জন্য ইফতার সামগ্রী কিনে আনলেন। খুবই মজার এবং সুস্বাদু ছিল সেই ইফতার। তবে আরেকটা কারণে সেই সন্ধ্যাটা স্মরণীয় হয়ে আছে। ইফতারের পর আম্মা চা খেতে চাইলেন। ট্রেনের জানালার পাশে হাঁক দেয়া এক চা ওয়ালার কাছ থেকে এক কাপ চা কিনে আম্মাকে দেয়া হলো। আম্মার কোলে তখন আমাদের চতুর্থ ছোট ভাইটা, ওর বয়স তখন দেড় দু’ বছর হবে। আম্মা গরম চা খাবেন, চা ছলকে ওর গায়ে পড়তে পারে ভেবে আম্মা ওকে কিছুক্ষণের জন্য আমার বড় বোনের কাছে দিলেন। এদিকে আম্মার চা খাওয়া শেষ হবার আগেই, রেলের ইঞ্জিনটা সজোরে আঘাত করে বগির সাথে জোড়া লাগলো। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে আপির কোল থেকে ছোটভাইটা ট্রেনের ফ্লোরে পড়ে গেল, তবে কোল থেকে পা গড়িয়ে নীচে পড়েছে বিধায় আঘাতটা ততটা গুরুতর হয়নি। সামান্য কিছুক্ষণ কান্না করার পর সবার সম্মিলিত আদরে ভাইটা কান্না থামিয়ে মুখে এক টুকরো হাসির ঝলক এনেছিল। সেই সাথে সবার উদ্বিগ্ন মুখেও হাসির প্রশান্ত রেখা ফুটে উঠেছিলো।

(নেহায়েৎ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। পাঠকের কাছে এর কোন গুরুত্ব থাকার কথা নয়। তবুও একটা সময় আসে যখন মানুষ তার স্মৃতিকথা সবার সাথে শেয়ার করতে চায়। আমিও তাই চাচ্ছি, গুরুত্ব নেই জেনেও। যেসব সহৃদয় পাঠক তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমার এ লেখাটা পড়বেন, তাদেরকে অগ্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম।)

ঢাকা
২৪ মে ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

৬,৩৯০ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “রমজানের স্মৃতি – ১”

  1. রেজা শাওন (০১-০৭)

    ভাই আমি আপনার লেখা খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ি, যদিও সময়- সুযোগ এবং নানাবিধ অকারণ ব্যস্ততায় সব সময় মন্তব্য করা হয়ে ওঠে না। লেখাগুলো আরেকটু দীর্ঘ পরিসরে হলে বোধহয় আরেকটু আনন্দ পেতাম। শুভ কামনা ভাই।

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      ধন্যবাদ, রেজা শাওন। লেখার দৈর্ঘ নিয়ে আমি আসলেই একটু দ্বিধান্বিত থাকি। ব্লগের পোস্ট সাধারণতঃ ৭/৮ শত শব্দের বেশী হলে কেউ পড়তে চায় না। সময়তো সবারই কম। আর দিনে ২৪ ঘন্টার বেশী পাওয়াও যায় না। তবে আমার লেখার প্রতি তোমার আগ্রহের কথা জেনে আশান্বিত হ'লাম, অনুপ্রাণিত হ'লাম। এর পরের পর্বটা একটূ দীর্ঘ হয়ে গেছে, তাই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। এখন তোমার মন্তব্যটা পড়ে কিছুটা দ্বিধামুক্ত হ'লাম। প্রথম পেজ থেকে আমার একটা পোস্ট বেড়িয়ে গেলেই পরেরটা দিয়ে ফেলবো।
      ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা---

      জবাব দিন
  2. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    খায়রুল ভাই, এখন যদিও ধার্মিকভাবে বেলাইনে চলে গেছি। তবে ছোট বেলায় আমিও রোজা রাখতাম। মনে পড়লো ঘটনাগুলো। মা আমাকে রোজা করতে বললে আমার প্রয়াত বাবা বলতেন, থাক এখন রোজা করতে হবে না, বড় হয়ে যদি ও চায়, এমনিতেই করবে। বাবাকে ধার্মিক বলবো না, তবে নামাজ রোজা পড়তেন।

    যাই হোক, এখনো আমার ইফতার করতে ভালো লাগে। রোজার সময় রোজাদারদের চেয়ে আমার উৎসাহ বেশি থাকে ইফতার নিয়ে। 😛

    লেখার দৈর্ঘ্যের ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আপনার লেখা বড় হলেও কিন্তু ফুড়ুৎ করে শেষ হয়ে যায়। মনে হয় আরেকটু বড় হলে মন্দ হতো না। আশা করি ভবিষ্যতে সিসিবির গুটিকয় পাঠকদের নিরাশ করবেন না।

    ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।