কিছুদিন আগে পোস্ট করা আমার “পিছু ফিরে দেখাঃ “কামিজ কা বাটন টুটেঁ হ্যায়”….” শীর্ষক একটা লেখা পড়ে জনৈক পাঠক মন্তব্য করেছেনঃ This is the first instance where somebody wrote about batman. তার এ মন্তব্যটা পড়ে ভাবছিলাম, সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ে ব্যাটম্যানরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল। তাদের ক’জনার কথা আমি মনে রেখেছি?
আমি যখন ময়নামতি সেনানিবাসে (সবার উপরে ময়নামতি) জেন্টেলম্যান ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণরত ছিলাম, তখন আমাদের চারজনের জন্য একজন ব্যাটম্যান বরাদ্দ ছিল, যার নাম ছিল তারা মিয়া। বয়সে সে আমার সমানই ছিল, কিংবা হয়তো দুই এক বছরের ছোটই হবে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে সে ঐ বয়সেই বিবাহিত ছিল। গল্পে গল্পে সে একদিন আমাকে এ কথাটি লজ্জাবনত মুখে জানিয়েছিল। বিএমএতে পান খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু নিজ বাসায় সে যে পান খেত, তা আমি তার লাল মুখ দেখেই বুঝতে পারতাম। সে একদিন বলেওছিল, ওর কিশোরী স্ত্রী প্রতিবার খাওয়ার পরে ওকে পান বানিয়ে খাওয়ায়। ওর এ কথাটা শুনে আমার মনে দুটো সুখী পাখির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছিল। প্রশিক্ষণের সময় আমাদের শারীরিক কষ্ট দেখে তারা মিয়া নিজেই কষ্ট পেত। আমাকে জিজ্ঞেস করতো, এত কষ্ট করেন ক্যামনে? একবার চোখ উঠার কারণে আমি এ্যাটেন্ড ‘সি’ পেয়েছিলাম (প্রশিক্ষণকালীন সময়ে মাঠে না গিয়ে রুমে বিশ্রাম নেয়ার অনুমতি)। মনে পড়ে, তারা মিয়া সেদিন তার চাদরের নীচে লুকিয়ে বাড়ী থেকে গরম দুধ এনে আমায় খাইয়েছিল।
ময়নামতি সেনানিবাসে আমার সামরিক জীবন শুরু হয়, কাকতালীয়ভাবে সেখানেই শেষও হয়। মাঝখানের ৩২টা বছরে আর কখনো ময়নামতি সেনানিবাসে আমার পোস্টিং হয়নি। জেন্টেলম্যান ক্যাডেট হিসেবে শুরু, কর্নেল এ্যাডমিন হিসেবে শেষ! শেষ পোস্টিং এ ময়নামতি সেনানিবাসে এসেই আমি আমার রানার কাওসারকে (ইএমই কোরের) তারা মিয়া সম্বন্ধে যেটুকু স্মৃতি মনে ছিল সেটুকু জানিয়ে নির্দেশ দেই, সেনানিবাসের আশে পাশে অবস্থিত ওর বাড়ী খুঁজে বের করার জন্য। আমার দেয়া যৎকিঞ্চিত তথ্যের সূত্র ধরে সপ্তাহ খানেক চেষ্টার পর একদিন কাওসার আমাকে জানালো, সে তার মিশনে সফল হয়েছে, তারা মিয়ার বাড়ী সে খুঁজে পেয়েছে। তারা মিয়া তাকে বলেছে, সে নিজেই আমার বাসায় এসে আমার সাথে দেখা করবে। একদিন বিকেলে ঠিকই তারা মিয়া তার স্ত্রী ও নাতি নাতনি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমার মনে তরুণ তারা মিয়ার ছবি গেঁথে ছিল। শুভ্র শ্মশ্রুধারী, বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ এ তারা মিয়াকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, বয়স কি করে মানুষকে বাঁকিয়ে দেয়! তারা মিয়ার ফর্সা মুখের লাজুক হাসিটুকু অবশ্য আগের মতই অমলিন ছিল। একজন সুখী গেরস্ত হিসেবে তারা মিয়াকে দেখতে পেয়ে আমি সেদিন ভীষণ খুশী হয়েছিলাম।
কমিশন প্রাপ্তির পর আমার প্রথম ব্যাটম্যান শ্যামলের কথা আগেও একটা পোস্টে লিখেছিলাম। সেই ১৯৭৬ এর পর শ্যামলের সাথে আমার আর কখনো দেখা হয় নাই। মিতভাষী, কিছুটা দার্শনিক প্রকৃতির শান্তিপ্রিয় এই ছেলেটি (এখন নিশ্চয়ই বৃ্দ্ধ না হলেও বার্ধক্যের প্রান্তে উপনীত) জগতের যে প্রান্তেই থাকুক, সুখী থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আমার দ্বিতীয় ব্যাটম্যান ছিল মজিবর রহমান মোল্ল্যা। আমার একজন রুমমেট ওনার দেশের বাড়ী ফরিদপুর জেলার রাজৈর থানা থেকে ওকে আনিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, মজিবর নদী সিকস্তি পরিবারের ছেলে, একদিন তার পরিবার স্বচ্ছল ছিল, একটি ভাল পরিবার হিসেবে তাদের বেশ সুনাম ছিল। অচিরেই মজিবরের আচরণে আমি তার প্রমাণ পেতে শুরু করলাম। সে ছিল আশে পাশের অন্যান্য ব্যাটমেনদের তুলনায় বয়সে এবং উচ্চতায় সবচেয়ে ছোট, কিন্তু তার গলা ছিল সর্বোচ্চ এবং সে ছিল একজন সহজাত নেতা। তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছেলেরাও তার কথা শুনতো, তাকে মেনে চলতো। তার কৌতুকবোধও ছিল অসামান্য। কিছুদিনের মধ্যেই সে আমাদের কাছে একজন হরপুন মোল্লা হিসেবে প্রতিভাত হলো। ঠিকমত ব্রীফিং দিলে হেন কাজ নেই যা সে করে আনতে পারতোনা। সে স্বভাবে প্রতিবাদী ছিল, সময়মত আমাদের মুখের উপরেও উচিত কথা বলতে ছাড়তোনা। ঐ অফিসার যখন বান্দরবানে পোস্টিং হলেন, মজিবর তখন তার সাথে সেখানে যেতে চাইছিল না, কারণ বান্দরবান পাহাড়ী এলাকা। সে নদীর মানুষ, পাহাড় তার ভাল লাগেনা। যাইহোক, তিনি অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে মজিবরকে বান্দরবানে নিয়ে গেলেন। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর্তব্য পালন শেষে তিনি যখন অন্যত্র বদলী হলেন, তখন মজিবরকে এসএসডি বান্দরবানে শ্রমিক হিসেবে একটা ছোট্ট চাকুরী দিয়ে এসেছিলেন। ১৯৯৭ সালে আমি এডিএসটি হিসেবে সরকারী কর্তব্যে এসএসডি বান্দরবান পরিদর্শনে যাই। তখন মজিবর মোল্ল্যা আর রাজৈর, শুধু এ দুটো রেফারেন্সই আমার স্মরণে ছিল। আমি তাই উল্লেখ করে অধিনায়কের কাছে মজিবরের সাথে আমার সাক্ষাৎ লাভের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মজিবরকে আমার সামনে হাজির করা হলো। তারও অবয়বে বয়স তার করাল থাবার চিহ্ন রেখে গেছে। তারও মুখ শ্মশ্রুমন্ডিত, তবে তখনো শ্বেতশুভ্র হয়ে উঠেনি। সদা হাসিখুশী কৌতুকপ্রিয় মজিবরের মুখে আমি অনেক চেষ্টা করেও হাসি ফোটাতে পারছিলাম না। তার মনেও হয়তো আমার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট থাকাকালীন তরুণ বয়সের ছবিটা গাঁথা ছিল। বয়স ও পদবীর ভারে আমিও হয়তো তার কাছে সেদিন দূরের কেউ বলে প্রতিভাত হয়েছিলাম। সে যাবার জন্য উসখুস করছিল। অগত্যা তার সাথে তার পরিবার সম্পর্কে কিছু কুশলাদি বিনিময় করে বিদায় নেই। নদীর মানুষ পাহাড়ে এসে সেখানেই বিয়ে শাদী করে সংসারী হয়েছে। একদিন সেখান থেকেও হয়তো তার সন্তানেরা অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়বে।
রংপুরে বদলী হবার পর মান্নান নামে একটা হাবাগোবা একরোখা ছেলে আমার ব্যাটম্যানের কাজ করে। সেখানে আমি প্রথম পর্বে বেশীদিন ছিলাম না। অনেকদিন পরে আবার রংপুরে গিয়ে তাকে আমি সেনানিবাসে রিক্সা চালাতে দেখেছি। মান্নানের পর ওয়াহিদ নামে একটা ছেলে আমার ব্যাটম্যান হিসেবে যোগ দেয় এবং সৈয়দপুরে বদলীর সময় আমার সাথে আসে। মুকুল নামে আমার গ্রামের একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছিলাম। সে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে অর্থাভাবের কারণে আর এগোতে পারেনি। সে খুবই নিষ্ঠার সাথে কাজ করতো। আসার সময় বাড়ী থেকে সে নবম শ্রেণীর বইপত্র নিয়ে এসেছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে দেখতাম সে বই খুলে পড়াশোনা করছে। আমি সৈয়দপুর স্টেশন অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারী হিসেবেও সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সৈয়দপুর থেকে বদলী হবার সময় মুকুলকে সৈয়দপুর গ্যারিসন সিনেমা হলের usher হিসেবে একটা ছোট্ট চাকুরী দিয়ে এসেছিলাম। পরে মুকুল সেই ছোট্ট চাকুরী করেই তার পিতামাতাকে সাহায্য করা ছাড়াও নিজ চেষ্টায় এসএসসি পাশ করে ইএমই কোরে সৈনিক পদে যোগদান করে। সার্জেন্ট পদবীতে অবসর গ্রহণ করে মুকুল এখন তার নিজ গ্রামে একজন সম্পন্ন গেরস্ত এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। সৈয়দপুরে আমার ঠিক পাশের রুমেই থাকতেন একটি পদাতিক ইউনিটের উপঅধিনায়ক বা 2IC। টাঙ্গাইল নিবাসী ঐ অফিসারের নিজ গ্রাম থেকে আনা আজিজ নামে একজন ব্যাটম্যান ছিল, যে ছিল এইচ এস সি পাশ। অন্যান্য ব্যাটম্যানদের সাথে মেলামেশা বা কাজ করার সময় সে তার শিক্ষার কথা গোপন রাখতো। কিন্তু তাতে কী হবে, তার আচার আচরণে এবং কথা বার্তায় অন্যান্যদের সাথে তার পার্থক্যটা সহজেই প্রকাশ পেয়ে যেত। সেই অফিসার অন্যত্র বদলী হয়ে গেলে আজিজ সৈয়দপুরে থেকে যায় এবং আমার সাহায্য প্রার্থনা করে। আমি তাকেও মুকুলেরই মত একই চাকুরী দিয়ে সাহায্য করি। গত বছর হঠাৎ একদিন সকালে আজিজের ফোনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে আমাকে জানায় যে সে হজ্জ্বে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে সে আমার টেলিফোন নম্বর যোগাড় করেছে শুধু হজ্জ্বে যাবার আগে আমার কাছে তার অন্তরের কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করার জন্যে। ঐ ছোট্ট চাকুরীটি দিয়েই সে অতি কষ্টে ছেলেপুলে মানুষ করেছে এবং সৈয়দপুরেই থিতু হয়েছে। তার ছেলেরা আজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চাকুরী করছে এবং ভাল পরিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে। হজ্জ্বের সময় আজিজ সৌদি আরব থেকেও আমাকে একদিন ফোন করেছিল।
একদিন আমার এক রানার আমাকে জানালো, তার এক চাচাতো ভাই আছে, তার মায়ের অকাল মৃত্যুর পর তার বাবার নববিবাহিত বধূর অত্যাচারে সে যারপরনাই নির্যাতিত। আমি তাকে ব্যাটমান হিসেবে রাখবো কিনা। সে সময় আমার একজন ব্যাটম্যানের প্রয়োজন ছিল, তাই আমি রাজী হ’লাম। সে ছুটিতে গিয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম নামে এক ছেলেকে এনে দিল। পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেটি ছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। আযান হলে তাকে কেউ কোন কাজেই ধরে রাখতে পারতোনা। বুদ্ধিতে একটু খাটো, কিন্তু কাজে নিষ্ঠাবান। সে বছর দুয়েক আমার সাথে কাজ করার পর আমার পোস্টিং হলো বাংলাদেশ দূতাবাস, মাস্কাটে। তখন আমার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে হালিমা নামে পিতৃপরিচয় ও কুলবংশ না জানা একটি এতিম মেয়ে কর্মরত ছিল। মাস্কাটে যাবার আগে ওকে আর শফিককে কোথায় কার কাছে রেখে যাব, এ নিয়ে চিন্তার অন্ত ছিলনা। এমন সময় আমি একদিন রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের পূর্ত কাজ পরিদর্শনে আমার বসের সহগামী হয়েছিলাম। তখন রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাহেদ হাসান সেলিম। তিনি একই সাথে অর্ডন্যান্স সেন্টার এন্ড স্কুলের কমান্ড্যান্টও ছিলেন। ব্রীফিং এর এক পর্যায়ে এসএসও এর কাছ থেকে জানলাম, সেখানে বেসামরিক ইউএসএম পদে কিছু লোক নেয়া হবে। আসার সময়ে কর্নেল শাহেদের কাছে অনুরোধ রেখে আসলাম, ইউএসএম এর একটি পদে শফিককে নেয়ার জন্য। তিনি আশ্বাস দিলেন, যোগ্য বিবেচিত হলে তাকে নেয়া হবে। এভাবেই অলৌকিকভাবে আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তার নেক বান্দা শফিকের জন্য একটা উত্তম রুজীর ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি ওমান যাবার আগে শফিকের বাবার অনুমতি ও পছন্দক্রমে আমাদের সেই গৃহকর্মী হালিমার সাথে শফিকের বেশ ঘটা করেই বিয়ে দিয়ে গেলাম। ওমান থেকে ফিরে আসার পর দেখি শফিক ও হালিমা এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের গর্বিত জনক জননী। ওদের মেয়েটা দেখতে পরীর মত সুন্দর হয়েছে, কেননা শফিক ও হালিমা উভয়েই দেখতে খুব সুন্দর। কয়েক বছর আগে আমি রংপুর থেকে ফেরার পথে শফিককে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করি ওরা এখন কোথায় আছে। সে জানালো সে এখন বগুড়া অর্ডেপে কর্মরত, আড়িয়া বাজারের কাছে তাদের বাসা। আমি রংপুর থেকে ঢাকায় ফিরছি জেনে সে একেবারে বেঁকে বসলো। সে বললো, মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও তাদের বাসায় না বসে যেতে পারবোনা। এ কথার ঘন্টা খানেক পর আড়িয়া বাজার পার হয়েই দেখি, রাস্তার উপর শফিক ওর মেয়ে শাফিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে। চলমান সব গাড়ীর প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল রাখছে। অগত্যা না থেমে পারলাম না। একটা সরু পথ ধরে ওদের বাসায় যেতে হয়। গাড়ীটা রাস্তার পাশে পার্ক করে রেখে ওদের বাসায় আমরা সপরিবারে উপস্থিত হ’লাম। হালিমা প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাঁদতে থাকলো, আবার একটু পরেই ওর স্বভাবসুলভ হাসিমাখা মুখে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আসার সময় সে তার গাছ থেকে কিছু পাকা পেঁপে পেড়ে আমার ছেলের হাতে দিল। পেঁপেগুলো খুবই সুস্বাদু ছিল। আজ আমি ওদের কথা ভেবে বড্ডো তৃপ্ত বোধ করি, ওদের ছেলে হাবীব সাফল্যের সাথে এইচএসসি পাশ করে আজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর্মার্ড কোরের একজন গর্বিত সৈনিক, মেয়েটারও এইচএসসি’র পর ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে।
লেখাটা ইতোমধ্যে অনেক বড় হয়ে গেল। কিন্তু আমার আর দু’জন ব্যাটম্যানের কথা না বললেই নয়। বাবলু দেখতে কালো ছিল, কিন্তু বুদ্ধিমান এবং কর্মপটু। তার রান্নাবান্নার প্রতি একটু ঝোঁক ছিল। তার হাতের বানানো আলুর চপ বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। সে আমার সাথে বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর একবার বাড়ী গিয়ে আর ফেরত আসেনি। এতে আমি তার উপর বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম সে ভেড়ামারায় একটি বেকারীতে শ্রমিকের কাজ করে। আমি যখন চাকুরীর শেষ প্রান্তে, তখন সে হঠাৎ একদিন কুমিল্লায় আমার বাসায় এসে হাজির। অনেক কান্নাকাটি করে মাফ চেয়ে একটা চাকুরীর আব্দার জানালো। আমার দুর্দিনে ওর ভাল সার্ভিসের কথা স্মরণ করে আমি ওকে অন্তর থেকে মা’ফ করে দিলাম। তখন আমার বন্ধু কর্নেল লিয়াকত কুমিল্লার স্টেশন কমান্ডার। তাঁকে অনুরোধ করে একটা মাস্টার রোলের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিলাম। আমার বিদায়ের আগে আমার উত্তরসূরীকে অনুরোধ করে এসেছিলাম, সম্ভব হলে ওর জন্য একটা পাকা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে। আজ বাবলু কুমিল্লা সেনানিবাসের এরিয়া সদর দপ্তরে একজন মেস ওয়েটার হিসেবে কর্মরত। বাড়ী থেকে ওর বৃদ্ধা বিধবা মাকে নিয়ে এসে ওর সরকারী কোয়ার্টার্সে রেখেছে। কর্নেল লিয়াকত এর কাছে আমি এ সাহায্যটুকুর জন্য কৃতজ্ঞ।
সবশেষে, পিপলুর কথা। সে এক আজীব চরিত্র ছিল। তবে ওর একটা বড় গুণ, ও ভীষণ মা ভক্ত ছিল। দুনিয়া একদিকে আর ওর মা আরেকদিকে। সে কেমন করে জানি টুকটাক ইংলিশ বলতেও শিখেছিল। বিশেষ করে কোন অফিসারের সামনে পড়লে ও ওর জানা সব ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে কথা বলার চেষ্টা করতো। বাংলায় কোন রকমে পত্র লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ওর পত্রের নির্যাতনে আমি অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। ওকে বকাঝকা করলে ও নিশ্চুপ থাকতো। রাতে দেখতে পেতাম ও আমার বালিশের নীচে পত্র রেখে গেছে। সেখানে সে তার মনের দুঃখ ঝেরেছে। মূল কথা, ওরা ভীষণ গরীব। ওর একটা চাকুরীর ভীষণ প্রয়োজন। ও ছাড়া ওর মাকে দেখার মত আর কেউ নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সে তার আচরণে আমাকে অতীষ্ঠ করতো, আর বিরক্তিটাকে আরো অসহ্য করে তুলতো তার পত্র চালানের মাধ্যমে। কখনো আমার টেবিলে, কখনো ইউনিফর্মের পকেটে, আবার কখনো বালিশের নীচে পত্র রেখে যেত। ইনিয়ে বিনিয়ে একটাই কথা, ওর একটা চাকুরী চাই। সে কয়েকদফা আমার কাছে এসেছে, স্বেচ্ছায় চলে গেছে, আবার ফেরত এসেছে। চট্টগ্রামে একবার আমার বাসা ছেড়ে গিয়ে নাসিরাবাদে একটা রিরোলিং মিলে চাকুরী নিয়েছিল। রাত জাগতে জাগতে অসুস্থ হয়ে গেলে সে আবার ফিরে এসেছিল। তারপর আবার চলে গিয়েছিল। একদিন শবে বরাতের রাতে বায়েজিদ বোস্তামী মসজিদ থেকে নামায শেষে বের হয়ে দেখি আমার স্যান্ডেল খোয়া গেছে। খালি পায়েই একটা রিক্সা খুঁজছিলাম। হঠাৎ দেখি পিপলু হাজির, সে রিক্সা চালায়। আমাকে দেখে সে তার রিক্সায় উঠতে অনুরোধ করলো। তার উপর আমার রাগ ছিল বিধায় আমি তাকে না করলাম। এমন সময় সে তার স্যান্ডেল জোড়া খুলে আমার সামনে ধরে বললো, স্যার আমার রিক্সায় না উঠলেও এটা পরেন। সামনে অনেক কাদা আছে। আমার মনটা এতে নরম হয়ে গেল। আমি ওর রিক্সায় করে বাড়ী ফিরে এলাম এবং ওকে হালুয়া রুটি খাওয়ালাম।
ঢাকায় ফিরে এসে আমি বেশ জোরেসোরেই চেষ্টা করতে থাকলাম ওর একটা চাকুরীর জন্য। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন হয়তো ওর মাতৃভক্তির কারণেই ওর সহায় হয়েছিলেন। আমার বন্ধু মেজর মোরতাজা আল মাহমুদ তখন সেনাসদর দপ্তরে পিএ পরিদপ্তরে কর্মরত ছিল। ওকে অনুরোধ করায় খুব দ্রুতই ওর চাকুরীটা হয়ে গিয়েছিল। পিপলু’র খুব শখ ছিল সৈনিক হবার। প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাবে সে তা হতে পারেনি। কিন্তু সে ইউনিফর্মকে খুবই ভালবাসতো। আমি সকালে ইউনিফর্ম পরে বের হবার সময় সে আমার ইউনিফর্মটার প্রতি তাকিয়ে থাকতো এবং পরিধানে কোন ত্রুটি চোখে পড়লে তা ঠিক করে দিত। আমার পরোপকারী বন্ধু মেজর মোরতাজা আল মাহমুদ এর দয়ায় সে আজ ইএমই কোরের একজন ইউনিফর্মধারী এনসি(ই)।
টীকাপুঞ্জঃ
ব্যাটম্যানঃ সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার এবং জেসিওদের ইউনিফর্ম এবং অন্যান্য পরিধেয় সরঞ্জামাদি প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সাহায্যকারী ব্যক্তি, যে অন্যান্য ফুট ফরমায়েশও খেটে থাকে।
এনসি(ই)- নন কম্ব্যাটান্ট (এনরোলড) বা তালিকাভুক্ত অযোদ্ধা ব্যক্তি। এরা যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে যায়, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধ করেনা। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাজ করে থাকে।
রানারঃ একজন সামরিক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত স্টাফ। তার কাজ যুদ্ধের সময় অফিসারের বার্তাবাহকের কাজ করা এবং শান্তির সময় ফুট ফরমায়েশ খাটা (সামরিক কাজে)।
ঢাকা
১৮ আগস্ট ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
(ইতোপূর্বে ফেইসবুকে প্রকাশিত)
বরাবরের মতই ঝরঝরে লেখা, স্যার। সরল এবং সুনিপুণ বর্ণনা। পড়ে খুবই ভাল লাগলো স্যার।
ধন্যবাদ ফারাবী, তোমার এ প্রেরণাদায়ক মন্তব্যটা পড়ে আমারও খুব ভাল লাগলো।
ভাল থেকো। শুভেচ্ছা......
বহুদিন পরে মনে হলো "প্রিয়" তালিকায় যোগ করার মত একটা লেখা পড়লাম।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। মন্তব্যে অনেক অনুপ্রাণিত হ'লাম।
ভাল থেকো... সপরিবারে সবাই।
🙂
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
:clap:
ধন্যবাদ।