প্রেম, প্রকৃতি আর প্রার্থনা- আমার চিরদিনের প্রিয় বিষয়, ছোটবেলা থেকেই। প্রশ্ন আসতে পারে, ছোটবেলায় আবার প্রেমের কী বুঝতাম? তখন প্রেম বলতে বুঝতাম স্নেহ, আদর, ভালবাসা। মা যখন শীত আসার আগেই উলের বল আর উল বুননের কাঁটা যোগাড় করে রাখতেন, আর তাঁর স্বল্প অবসরে দিনের পর দিন ধরে উল বুনে আমাদের জন্য সোয়েটার, মাফলার ইত্যাদি বানিয়ে দিতেন, বুঝতাম সেটা ভালবাসা। গোসলের পর মাথা না আঁচড়িয়ে থাকতাম। বড়বোন যখন ডেকে জোর করে মাথা আঁচড়িয়ে দিতেন, বুঝতাম সেটা আদর। পোষা মুরগীটা যখন প্রথম মা হলো, তার তুলতুলে বাচ্চা ধরতে গিয়ে হাতে আঁচড় খেয়েছিলাম। কিছুটা রাগ হলেও বুঝেছিলাম, এটাই মাতৃ্ত্ব, মাতৃস্নেহ। সন্তানের জীবন রক্ষার্থে সে নিজের জীবন বিপন্ন করতে পিছপা হবে না। অন্যদিন হলে সে আমাকে দেখে ভয়ে দৌড়াতো, আজ আমাকে দেখে ধেয়ে এলো।
বয়ঃসন্ধিকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “পোস্টমাস্টার” গল্পটা পড়ে আমি খুবই অভিভূত হয়েছিলাম। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থের মতই হয়ে গিয়েছিলো। আজও পড়ি, এটা আজও আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প। সেটা পড়ে বুঝেছিলাম স্নেহ কি, মায়া কি, ভালবাসা কি, বিরহ কি, বিচ্ছেদ কি। “কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে…” – এই বাক্যাংশটুকু এবং সেই সাথে পোস্টমাস্টারের হৃদয় মথিত স্বগতোক্তি ও লেখকের দার্শনিক ভাবনার ক্রমবিন্যাস এখনো আমার মনে ঝড় তোলে আর যখনি সে ঝড় ওঠে তখনই মনটা শন শন বাতাসের মতই হু হু করে ওঠে।
আমার কাছে স্নেহ মায়ার আরেক নাম প্রকৃতি। ঢাকা শহরে মানুষ হলেও বৎসরান্তে গ্রামের বাড়ীতে যেতাম। সেখানে উন্মুক্ত প্রকৃতির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। কাজিনদের সাথে দিনমন ঘুরে বেড়াতাম আর কিছুকাল শৃঙ্খলিত শহুরে জীবন ছেড়ে শাসনহীন বাউন্ডুলে জীবন উপভোগ করতাম। রাখালের সাথে গরু চড়াতে যেতাম, বাবুই পাখির বাসা দেখে বিস্মিত হ’তাম, কৃষাণ কৃষাণীর সাথে গান গেয়ে মরিচ ক্ষেত থেকে মরিচ তুলতাম, কাঁচা কুঁয়ো থেকে পানি তুলে পরমানন্দে তামাক ক্ষেত সিঞ্চন করতাম। খেঁক শেয়ালের গর্ত খুঁজতাম, গুলতি দিয়ে পাখি মারার চেষ্টা করতাম। প্রকৃতির পশু পাখিদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে অবাক হতাম। খুব ভোরে অন্ধকার বিছানায় শুয়ে পাশের ঘর থেকে আমার বড় নানার দরাজ কন্ঠে ভেসে আসা ফজরের নামাজের সুরা ক্বিরাত শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। রসিক নানা আমার সুন্দর করে সুরা ক্বিরাত পাঠ করতেন, আবার পরে যখন আমাদের সাথে গল্প করতেন, তখন কোমড় দুলিয়ে নজরুলের “চমকে চমকে ধীর ভীরু পায় পল্লীবালিকা বনপথে যায়” গানটি নৃত্য সহকারে গেয়ে শোনাতেন। সারাদিন মনের আনন্দে গ্রামের মাঠে ঘাটে তরুতলে ঘুরে বেড়াতাম আর এ কবিতার কথাগুলোর কথা মনে করতামঃ “আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন, মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন। মাঠ ভরা ধান চাল, জল ভরা দীঘি, চাঁদের কিরণ লাগে করে ঝিকিমিকি”।
আমার আবেগ অনুভূতি আমাকে খুব আন্দোলিত করে যখন আমি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করি। আমি অন্তর থেকে অনুভব করি আমার স্রষ্টা আমাকে খুব ভালবাসেন। এমন অনেকদিন গেছে যখন স্রষ্টার এ অপার ভালবাসার কথা ভেবে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে জায়নামাযে, রাতে বালিশে। আমার মতে প্রার্থনাও ভালবাসারই রূপান্তর। স্রষ্টাকে ভালবেসে যখন প্রার্থনা করতে পারি, তার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত নিজেকে অনেক পরিশুদ্ধ মনে হয়। প্রার্থনায় নিজের কথা আসে, ভালবাসার মানুষের কথা আসে, এমনকি কখনো কখনো কল্পিত ভালবাসার মানুষেরও। প্রার্থনার সাথে আমি সচরাচর প্রেম খুঁজে পাই। প্রেমের প্রত্যাশায়ও প্রার্থনা চলে আসে।
প্রেম, প্রকৃতি আর প্রার্থনার আমার এ ভাবনাগুলো, অনুভূতিগুলো, বিশ্বাসগুলো সম্পূর্ণই আমার। তবু এগুলো পড়ে যদি কোন পাঠক তার নিজের ভাবনার সাথে কিছু মিল খুঁজে পান, তাহলে ভাববো, লেখকের আর পাঠকের মাঝে এক অদৃশ্য যোগসূত্র তো থাকতেই পারে।
ঢাকা
২৯ জানুয়ারী ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ফিরে গিয়েছিলাম আমার ছেলেবেলাতে। আপনার লেখা পড়ে আর ছেলেবেলার উত্তাল দিনগুলো স্মরন করে যুগপৎ আনন্দ আর কষ্ট হল.... জীবন এত ক্ষনিকের কেন?
সোনালী শৈশব ও কৈশোর প্রায়ই আমাকে হাতছানি দিয়ে থাকে। তখন সেসব স্মৃতিচারণে আমারও যুগপৎ আনন্দ আর কষ্ট হয়ে থাকে।
লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তব্যে প্রীত হ'লাম।
স্মৃতিকাতর হলাম ভাই :dreamy:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
ধন্যবাদ মোস্তাফিজ। বিলম্বে উত্তর দেয়ার জন্য দুঃখিত। আশাকরি ভাল আছো।
you are right. i also think that.
অনেক ধন্যবাদ। প্রীত হ'লাম।