(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ দৈর্ঘে একটু বড়। পড়ার মাঝে ধৈর্যচ্যূতি ঘটতে পারে, পড়া শেষে সময়ের অপচয় হয়েছে বলে আফসোস হতে পারে)
সেদিন সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের ঠিক আগে আগে হক সাহেবের দাফন প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হলো। তার ছোট ছেলে ক্ববরের উপর শেষ কয়েকটা মাটির ঢেলা ছিটিয়ে দিয়ে মাওলানা সাহেবের সাথে কন্ঠ মেলালো… “মিনহা খালাক নাকুম, ওয়া ফিহা নুয়িদুকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম, তা’রাতান উখরা” – “মাটি দিয়ে আমি সৃষ্টি করেছি, এই মাটিতেই আবার ফিরিয়ে নেব, এই মাটি থেকেই আবার আমি তুলে আনব“। দাফনে মহিলাদের উপস্থিতির অনুমতি নেই, তাই আকিকুন্নেসা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যান্য কয়েকজন বয়স্কা আত্মীয়া মহিলাদের সাথে সবকিছু দেখছিলেন, আর কেউ কোন সমবেদনার কথা জানাতে এলে দুই এক ফোঁটা করে অশ্রু ঝরাচ্ছিলেন। সবাই যখন মোনাজাতের জন্য হাত তুললো, তিনিও তখন মাথার আঁচলটা আরেকটু টেনে নিয়ে দু’হাত তুলে দোয়ায় সামিল হলেন। একটু দূরে থাকাতে তিনি মাওলানা সাহেবের কোন কথাই শুনতে পারছিলেন না, কিন্তু তবুও স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার এই শেষ পর্বে এসে তিনি আর অশ্রুর বাঁধ ধরে রাখতে পারলেন না। হক সাহেবের বিরুদ্ধে তার এই চল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে অভিযোগের অন্ত ছিলনা, কিন্তু তবুও তাঁর এই শেষকৃ্ত্যে এসে আকিকুন্নেসা হাউমাউ করে কেঁদে আল্লাহ’র দরবারে আরজ করতে থাকলেন, আল্লাহ, তুমি লোকটাকে মা’ফ করে দিও, আমি মা’ফ করে দিয়েছি!
হক সাহেবের পুরো নাম মোহাম্মদ আজিজুল হক। তিনি বগুড়া আজিজুল হক সরকারী কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর নিজ বাড়ীও বগুড়া জেলায়। এ নিয়ে লোকজনের কৌ্তুহলের অন্ত ছিলনা। তাঁর পূর্বসূরী বংশধরদের মধ্য থেকেই কেউ কি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন? এসব প্রশ্নে প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হয়ে নীরব থাকলেও পরে তিনি মাত্র একটি কথায় এর উত্তর দিয়ে চুপ করে থাকতেন, ‘না’। অধ্যাপক হিসেবে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের কাছে তিনি খুব প্রিয় থাকলেও কাঠখোট্টা স্বভাবের জন্য শ্রেণীকক্ষের বাইরে এবং সতীর্থদের মাঝে মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। যতদিন অধ্যাপনা করেছেন, খুব নিষ্ঠার সাথে ছাত্রদের পড়িয়েছেন। যেদিন অবসর নিলেন, সেদিন বাড়ী ফিরে এসে আকিকুন্নেসাকে আগ্রহভরে জানালেন, এখন থেকে তিনি সংসারে মনযোগী হবেন, আর নতুন করে কোন চাকুরী বাকুরী করবেন না। প্রথম কথাটাতে আকিকুন্নেসা বিশ্বাস রাখতে না পারলেও এবং দ্বিতীয় কথাটা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেও তিনি উপরে উপরে খুশী হবার ভাব দেখালেন। শাড়ীর আঁচল দিয়ে তার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বললেন, ‘অনেক তো কষ্ট করেছো, এবারে কিছুদিন বিশ্রাম নাও’। এতদিন একসাথে সংসার করার পরেও মাঝে মাঝে আকিকুন্নেসার মনে হয়, লোকটাকে তিনি এখনও ঠিকমত চিনতে পারেন নি। কখনো তাকে মনে হয় কঠোর হৃদয়ের, অনুভূতিহীন, আবার কখনো মনে হয় তার মত সহজ সরল লোক আর হয়না। শেষোক্ত অনুভূতিটাই তাকে সে মুহূর্তে আচ্ছন্ন করলো। সাথে সাথে লোকটার উপর খুব মায়া হলো। তিনি রান্নাঘরে গিয়ে চটজলদি তার জন্য কিছু নাস্তা আর দুই কাপ চা বানিয়ে এনে তার সামনে এসে বসলেন। অসময়ের এই চা নাস্তা দেখে হক সাহেবের মুখে এক ঝলক বালকসুলভ সরলতার হাসি খেলে গেল। অন্যান্য দিন এরকম অসময়ে চা চাইলে তাকে ঝাড়ি খেতে হতো।
অবসর গ্রহণের পর থেকেই হক সাহেব আর আকিকুন্নেসার মাঝে প্রায়ই টুকটাক ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো, যা সাধারণতঃ হয়ে থাকে। এসব হলে হক সাহেব প্রায়ই নীরবতার অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকতেন। আকিকুন্নেসা রাগে আপন মনে বক বক করে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতেন, ততক্ষণে হয় কোন বেলার খাওয়ার সময় হয়ে যেত, নাহয় শোয়ার। দাম্পত্য জীবনে এ দুটো সময়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাগে গড়গড় করতে করতে কখনো কখনো আকিকুন্নেসা মনে মনে ভাবতেন, ‘আজ ব্যাটাকে না খাইয়ে রাখবো, খাবার বেড়ে দেব না’। তিনি জানতেন, খাবার না বেড়ে দিলে হক সাহেব না খেয়েই শুয়ে পড়বেন। রাগে রাগেই তিনি রান্না বান্না করতেন আর ভাবতেন, তরকারিতে ইচ্ছে করে লবণ কম দেবেন, যাতে হক সাহেবের খাওয়াটা তৃপ্তির না হয়। খাবার বাড়ার সময় মনে মনে ভাবতেন, তরকারির পরিমাণ কমিয়ে দেবেন, মাছের সবচে’ ছোট্ট টুকরোটা তাকে বেড়ে দেবেন। কিন্তু এসব শুধু ভাবাই হয়। অবশেষে দেখা যায়, ঐ দিনের তরকারিটাই সবচেয়ে সুস্বাদু হয়েছে, মাছের সবচে’ বড় টুকরোটাই হক সাহেবের পাতে উঠেছে। এর কারণ, আকিকুন্নেসার ভাবনা আর বিশ্বাসে বৈপরীত্ব কাজ করতো। মনে মনে তিনি যাই ভাবুন না কেন, অন্তরের গভীরে তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বামী ও ছেলেপুলেকে ভাল ভাবে রেঁধে বেড়ে খাওয়ানোটা তার নৈ্তিক দায়িত্ব। সে কারণেই রাগ হলেও তিনি এ দায়িত্বে অবহেলা করতে পারতেন না। এমনকি অসুস্থতার সময়েও না। এদিকে ঝগড়ার পরেও স্ত্রীর এতটা অপ্রত্যাশিত, অঘোষিত আদর পেয়ে হক সাহেবও একাধারে বিস্মিত ও তৃপ্ত হতেন। কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না।
স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হলে হক সাহেবও মাঝে মাঝে এমনতরো কিছু কঠিন সিদ্ধান্তের কথা ভাবতেন, যা আর কারো সাথে কখনো শেয়ার করতে পারতেন না। যেমন, কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ী ছেড়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হবেন, সহায় সম্পত্তি যা কিছু আছে সব বেচে দিয়ে বিদেশে চলে যাবেন, ইত্যাদি। জীবনে আকিকুন্নেসা তাকে যত আঘাত দিয়েছেন, সবগুলোর অনুপুংখ বর্ণনা দিয়ে তিনি উভয়পক্ষের মুরুব্বীদের কাছে নালিশ করবেন, তারা যা সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই তিনি মেনে নেবেন, কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সবকিছু শোনার পর তাদের সিদ্ধান্ত তার পক্ষেই আসবে। এরকম সময়গুলোতে হক সাহেবের একটা নিয়মিত অভ্যেস, বিছানায় সটান শুয়ে পড়ে বালিশটাকে দু’ভাঁজ করে চোখ বুঁজে সিনেমা দেখার মত অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘুমিয়ে যাওয়া। কিন্তু চোখ বুঁজলেই তিনি দেখতে পেতেন, আকিকুন্নেসা খানমের পিতা আনোয়ার খান তাঁর মেয়েকে তার হাতে তুলে দিয়ে বলছেন, “একে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা, সুখে দুখে একে দেখে রেখো”। একথা শুনে আশে পাশের সবাই ডুকরে কেঁদে উঠছে। আকিকুন্নেসাও কাঁদতে কাঁদতেই কত না গভীর বিশ্বাসে তার হাত ধরে চলে এসেছেন তার সংসারে! তারপর থেকে তো সংসার বলতেই তিনি অন্তঃপ্রাণ। হক সাহেব বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আকিকুন্নেসা তার সাথে যেটুকু অন্যায় করেছেন, তা না বুঝে করেছেন। তার অন্তর আকিকুন্নেসার জন্য গভীর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তিনি ধুরমুর করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন। ইচ্ছে হয়, আকিকুন্নেসার কাছে গিয়ে দুটো ভালোবাসার কথা শোনান, যা আকিকুন্নেসা চিরকাল তার কাছে শুনতে চেয়েছে। এগিয়েও যান তার কাছে, কিন্তু ভালোবাসার কথা আর বলা হয়না। মুখে একটা কপট কাঠিন্য এনে এটা ওটা কিছু দরকারী সংসারী কথাবার্তা সেরে নেন। এতেও আকিকুন্নেসা অখুশী হন না, কারণ তিনিও চান, ভারী গুমোট পরিবেশটা কোনমতে কেটে যাক।
ঝগড়ার সময় রাতে আকিকুন্নেসা তার দিকে পিঠ ফিরে শুতেন। তিনি প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতেন। তারপর আস্তে করে হাতটা আকিকুন্নেসার মাথায় রাখতেন। মনে মনে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতেন আর তার জন্য দোয়া করতে থাকতেন। মাঝে মাঝে তার একটা হাত আলতো করে নিজের মুঠোয় নিতেন। কোন কোন সময় এভাবেই দোয়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তেন, আবার কোন কোন সময় তাকে একটু জোর করেই পাশ ফেরাতেন এবং আদর সোহাগে ভরিয়ে দিতেন। আকিকুন্নেসা পাশ ফিরে শুলেও তৃ্তীয় চক্ষু দিয়ে সবকিছু দেখতে পেতেন এবং ঠিক এ মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করতেন। এক নিমেষে দুজনের মধ্যে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যেত। ভালোবাসার বিচিত্র ভাষার তারা নতুন করে পাঠ নিতেন।
হক সাহেব জীবনের শেষদিকে প্রায়ই মৃত্যুর কথা ভাবতেন। এ কথাটা মনে এলেই তিনি চিন্তা করতে শুরু করে দিতেন, জীবনে কার কার কাছে তার দেনা রয়ে গেছে। নিজের পাওনা নিয়ে তিনি ভাবতেন না, কারণ নিজের পাওনাটুকু ভুলে যেতেই তিনি আজীবন পছন্দ করেছেন। আপসে আপ কেউ পাওনা মিটিয়ে দিলে দিলো, নচেৎ নয়, কোন সমস্যা নেই। তিনি মনে মনে ভাবেন, বেশী না হলেও তার যেটুকু সহায় সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটা উইল করে যাওয়া সমীচীন। কখন কি হয়, বলা তো যায় না। তার চোখের সামনেই তো কত চেনামুখ প্রায়ই হারিয়ে যাচ্ছে! একটা লিখিত উইল রেখে গেলে স্ত্রী, ছেলেপুলে আর বৌদের মাঝে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হবার সময় ঝগড়া ঝাটি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই অন্যান্য অনেকের মত হক সাহেবও একদিন কোন নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ করে চলে গেলেন। যেদিন গেলেন, তার দুদিন আগেও আকিকুন্নেসার সাথে তার কোন একটা বিষয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। কথা বলাবলি বন্ধ না থাকলেও, পরিবেশ গুমোট ছিল। তিনি মনের দুঃখে একটা গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। গল্পটা শেষ করে যেতে পারেন নি, মাঝখানেই বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করে চেয়ারের একপাশে হেলে পড়েছিলেন। ঘরে তখন আকিকুন্নেসা ছাড়া আর কেউ ছিলনা। ছেলেপুলেরা যার যার কাজে বাইরে ছিল। হক সাহেবের গোঙানির একটা মৃদু আওয়াজ শুনতে পেয়ে আকিকুন্নেসা দৌড়ে এলেন তার কাছে। কাজের বুয়াকে ডেকে নিয়ে তাকে ধরে ধরে কোনমতে পাশের সোফাটাতে বসালেন। কি করবেন, না করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হক সাহেব একটা নাইট্রোজেন স্প্রে কিনে এনে বেড সাইড টেবিলে রেখে বলেছিলেন, কারো কখনো বুকে তীব্র ব্যথা হলে জিহবার নীচে তিন চারবার স্প্রে করতে। আজ প্রয়োজনের সময় সেই স্প্রেটাকেও তিনি খুঁজে পেলেন না। তাড়াতাড়ি ছেলেদেরকে ফোন করতে শুরু করে দিলেন।
এদিকে হযরত আজরাইল (আঃ) এসে হক সাহেবকে সালাম দিয়ে জানিয়ে দিলেন, তাঁর সময় শেষ। তিনি প্রথমেই তার জবানটা বন্ধ করে দিলেন। দর্শনের অধ্যাপক হক সাহেব বহুদিন জীবনের শেষ সময়ের অবস্থা কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবতেন। তিনি প্রত্যক্ষ করতে থাকলেন, তিনি আনমনে মৃত্যুক্ষণ নিয়ে যেমনটি ভাবতেন, ঠিক তেমটিই সব কিছু ঘটে যাচ্ছে। এসব ঘটতে দেখে তিনি আশ্বস্ত হলেন, তার এতদিনের বিশ্বাস ঠিকই ছিল। তিনিও হযরত আজরাইল (আঃ) কে সালামের প্রত্যুত্তর জানালেন। যাঁর হুকুমে তিনি এ ধরায় এসেছিলেন, তিনিই দূত পাঠিয়েছেন তাকে নতুন এক অদেখা জগতে নিয়ে যাবার জন্য। চিরভীতু হক সাহেব যিনি অসুখ বিসুখেও কোনদিন ভয়ে হাসপাতালে যেতেন না, কি এক আশ্চর্য দৈব শক্তির বলে তিনি শান্তভাবে রাব্বুল আলামীনের কথা স্মরণ করে দূতকে জানালেন, তিনি তার রবের প্রতি আশৈশব বিশ্বাসী ও আত্মসমর্পণকারী, তিনি প্রস্তুত তাঁর কাছে যাবার জন্য! তিনি মনে মনে মহানবী (সঃ) এর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করলেন। জীবনের ভুলগুলোর জন্য আকুল মনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন। অনেকের কথা তার মনে হতে থাকলো। মনে মনে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলেন। দেহ থেকে আত্মার চিরমুক্তি লাভের দৈহিক কষ্ট তিনি অনুভব করতে শুরু করলেন। কল্পনা করলেন, আত্মাবিয়োগের পর তার অসাড় দেহ পড়ে আছে, এখনই তাকে শেষ গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। কে বা কারা তা্র দেহকে নাপাকমুক্ত করে এই শেষ বারের মত পবিত্র করবে, তা তিনি জানেন না, কিন্তু তিনি নিশ্চিত বোধ করলেন যে তার পরিবারের কেউ এ কাজ করবেনা, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সংকোচে। তিনিও জীবনে কখনো কোন মৃতদেহকে আখেরী গোসল করান নি। তার জন্য যারা এ কাজটি করবে, তাদের জন্য তিনি গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করলেন। জীবনের এই প্রান্তিক সময়ে তার রবের কাছে প্রার্থনা জানালেন, তিনি যেন তাদেরকে এ কাজের জন্য উত্তম বিনিময় দান করেন, তাদের দেহ ও অন্তরকে চিরপবিত্র করে দেন। তার জবান বন্ধ হয়ে গেলেও তখনো তিনি তার চর্মচক্ষে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলেন। একে একে ছেলেরা, আত্মীয় স্বজনেরা তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। তাকে কোলাহল করে এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। তার দৃষ্টি ক্রমে ক্রমে একটিমাত্র বিন্দুতে স্থির হয়ে আসছে। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যথায় টনটন করে উঠছে। তীব্র গরম বোধ হচ্ছে। তিনি শুনতে পেলেন, কে যেন বলে উঠলো, বাইরে বৃষ্টি নেমেছে…
হক সাহেবের দাফন শেষ করে সবাই যার যার বাড়ী ফিরে গেলেন। আকিকুন্নেসাও ফিরে এলেন তার নিজ বাড়ীতে। বিছানার অর্ধেকটাতে যেখানে হক সাহেব শুতেন, প্রথমে তিনি সেখানে শুলেন, পরে নিজের জায়গাটাতে, তারও পরে দুজনেরটাতে মিলেই। মনে মনে ভাবতে থাকলেন, এখন থেকে এ গোটা বিছানাটা তার, গোটা রুমটা তার। দুঃখের মাঝেও এক ধরণের স্বাধীনতাবোধ তাকে পুলকিত করে গেল। ঘর নোংরা করা নিয়ে হক সাহেবের সাথে প্রায়ই তার যে বাদানুবাদ হতো, এখন থেকে তা আর হবেনা। নিজের ইচ্ছেমত ঘরটাকে সাফ সুতরো রেখে তিনি মনের সুখে এখানে ঘুমোবেন। রাতে বিছানায় শুয়ে তিনি মনে মনে হক সাহেবকে অনুভব করতে চাইলেন। তার মৃত্যুর আগে আগে এরকম ঝগড়া ঝাটি হওয়াতে মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করতে থাকলেন। চুপ করে চোখ বন্ধ করে থেকে অনুভব করতে চেষ্টা করতে থাকলেন, হক সাহেব তার হাতটাকে আলতো করে মুঠোবন্দী করেন কিনা, কিংবা মাথায় তার হাত রাখেন কিনা। বেশীক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলেন না। অস্থির হয়ে তিনি উঠে এলেন হক সাহেবের লেখার টেবিলে। তিনি তার অসম্পূর্ণ গল্পটা পড়া শুরু করলেন। বেশীদূর এগোতে পারলেন না। গল্পের প্রতিটা লাইনে তিনি হক সাহেবের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে তিনি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠতে থাকলেন। ততক্ষণে সবাই যার যার ঘরে চলে গিয়েছে। তার এই কান্নার আওয়াজ আর কেউ শুনতে পেল না।
ঢাকা
০৬ মে ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।