জীবনের জার্নাল – ৩

এর কিছুদিন পর আমার সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবিটা আব্বা সেই পূরণকৃ্ত ফরমটার উপর আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়ে ফরমটা আমাকে পড়তে দিলেন। তখনই প্রথম ক্যাডেট কলেজ কথাটার সাথে পরিচিত হ’লাম। আগে ক্যাডেট কলেজ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা ছিল না. পূরণকৃ্ত ভর্তি ফরমটা পড়ে বুঝলাম, এটা আমার স্কুলের চেয়েও উন্নত মানের কোন প্রতিষ্ঠান হবে। তবে উন্নত নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কথা ভেবে পুলকিত হবার চেয়ে আমার ভালো লাগার পুরনো স্কুলটিকে ছেড়ে যাবার বেদনাই আমাকে বেশী আচ্ছন্ন করে রাখলো। স্কুলে আমার এক বন্ধু ছিলো, নাম আবুল হাসানাত ফাহিয়ান। তখনো খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি, কারণ সে ছিলো অন্য সেকশনে। শুধু আরবী ক্লাসে আমরা একসাথে হ’তাম। তখনকার দিনে ৫ম-৮ম শ্রেণীতে তৃতীয় ভাষা হিসেবে আরবী অথবা উর্দু নিতে হতো। আমাদের সেকশনের যারা উর্দু নিয়েছিলো, তারা আমাদের সেকশন থেকে ওদের সেকশনে যেত, আর ওদের যারা আরবী নিয়েছিলো, তারা ওদের সেকশন থেকে আমাদের সেকশনে আসতো। ফাহিয়ান আরবী নিয়েছিলো, তাই শুধু আরবী ক্লাসেই আমরা একসাথে বসতাম। সেই ফাহিয়ান একদিন অত্যুচ্ছ্বাসে আমাকে জানালো যে তার বাবা তাকে মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করানোর জন্য একটা ফরম কিনে এনেছে এবং সে অতি শীঘ্রই এই স্কুল ছেড়ে সেখানে চলে যাবে। স্কুল ও পরিবার ছেড়ে যাবার আনন্দ তার চোখেমুখে ঝিকিমিকি করে জ্বলছিলো। কেন, সেকথা পরে বলছি।
আমি তাকে আস্তে করে জানালাম যে আমার বাবাও একই কলেজ থেকে একটা ফরম এনেছেন এবং তা পূরণ করাও শেষ হয়েছে। এ ব্যাপারে আমার মধ্যে তেমন কোন উচ্ছ্বাস দেখতে না পেয়ে ফাহিয়ান আমাকে ক্যাডেট কলেজের আকর্ষণগুলোর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করতে লাগলো, যার মধ্যে প্রধানতম ছিল বাবার শাসন থেকে মুক্তি। ফাহিয়ানের বাবা ছিলেন একজন প্রবাদ পুরুষ। তিনি তার ৬ ছেলে আর ১ মেয়েকে কঠোর নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে মানুষ করেছিলেন। অবশ্য এ কারণেই হয়তো তারা সবাই ‘মানুষ’ হয়েছে। তার ৬ ছেলের প্রত্যেকের নাম রেখেছিলেন আবুল হাসানাত এর পর একজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বসিয়ে। যেমন, চীনা পর্যটক ফা হিয়েন এর নামে আমার বন্ধুর নাম আবুল হাসানাত ফাহিয়ান, ওর অন্যান্য ভাইদের নাম ফুয়াদ, ফারুক, ফেরদৌস ইত্যাদি। তিনি PTI এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। তার ছেলেরা সবাই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত।
ফাহিয়ান সরকারী বৃত্তি নিয়ে পোল্যান্ডের মেরিন একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষ করে কিছুদিন জাহাজে চাকুরী করেছিলো। কিন্তু ওর ধরণ ধারণ ওরকমের চাকুরীর জন্য সাযুজ্যপূর্ণ ছিলনা। সে যে নিজ থেকে ঐ বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলো, মোটেই তা নয়। বরং কোন রকমে দেশ ছেড়ে যেকোন একটা কোথাও গিয়ে সে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলো। নইলে সে জানতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তাকে বাবার সামনে বসে থেকে পড়াশোনার মহড়া চালাতে হতো। তখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পোল্যান্ডের সদাশয় সরকার বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য সেখানকার মেরিন একাডেমীতে পড়ার নিমিত্তে কিছু বৃত্তি দেয়। ফাহিয়ান সেটার জন্য আবেদন করলো এবং নির্বাচিতও হলো. পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ শেষে সে এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করে প্রথম সংসার শুরু করেছিলো, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে (কিংবা সৌভাগ্যক্রমে, হয়তো বা,) সে সংসার টিকেনি। পরে সে এক চেক রমণীর পাণি গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে চেক প্রজাতন্ত্রে আবাস গড়ে তোলে এবং সেখানে সে আজও সুখী জীবন যাপন করছে। সে এখন সেখানে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, প্রতি বছর সে একবার করে দেশে আসে। বৃদ্ধা মাকে দেখার টান তো আছেই, তবে ঠিক এর পরের আকর্ষণটি তার এমসিসি’র বন্ধুদের সাথে আড্ডা। যে ক’টা দিন সে দেশে থাকে, আমাদের সাথেই আড্ডা দিয়ে আর খাওয়া দাওয়া করে সে চলে যায়। ওর সবচেয়ে বড়ভাই আবুল হাসানাত ফারুক পিতার ন্যায় শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন এবং গভঃ ল্যাবোরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। ওর ইমিডিয়েট বড় ও ছোট ভাই যথাক্রমে ফুয়াদ ও ফেরদৌস রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে। ফুয়াদ রাজউক এর চীফ আর্কিটেক্ট হিসেবে অবসর নেয়। ফেরদৌস রংপুর মেডিক্যাল কলেজে ফার্মাকোলজির প্রফেসর হিসেবে এখনো কর্মরত। সবচেয়ে ছোট ভাই এক মালয় মহিলাকে বিয়ে করে মালয়েশিয়াতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। সেও বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী। ওর বাদ বাকী আরেক ভাইয়ের কাহিনী একাই একটা উপন্যাস হবে। তার কথা অন্য আরেকদিন প্রসঙ্গান্তরে বলা যাবে।
ফাহিয়ানের ভাইদের এতটা বর্ণনা দিলাম এই কারণে যে তারা বড় ছোট সবাই আমার ও আমার অন্যান্য বন্ধুদের কাছেও বন্ধুর মতই ছিলো। আর তারা সবাই নিজেদেরকে তাদের পিতার শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বলে মনে করতো। সবার পরিস্থিতি এক হওয়াতে সবাই বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলো। আমরা, মানে ফাহিয়ানের বন্ধুরা তাদের ৭১, শান্তিনগর এর বাসায় (জোনাকী সিনেমা হলের পেছনে) যখন যেতাম, তখন রীতিমত একটা রেকী করে জেনে নিতাম যে ওর বাবা বাসায় আছেন কিনা। তাঁর সামনে পড়ে গেলে আমরাও একই রকম ট্রীটমেন্ট পেতাম, অর্থাৎ তাদের সাথে আমাদেরকেও বই নিয়ে বসে যেতে হতো। একবার কয়েকজন বন্ধু মিলে জোনাকীতে একটা ম্যাটিনী শো দেখবো বলে টিকিট কেটে ফাহিয়ানকে ডাকার জন্য ওর বাসায় গেলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সরাসরি পড়ে গেলাম তার বাবার সামনে, কারণ কি কারণে যেন সেদিন তিনি অফিসে যান নি। বলাবাহুল্য, সেদিন জোনাকিতে আমাদের সীট গুলো ফাঁকাই ছিলো, আর আমরা সবাই টানা আড়াই ঘন্টা ফাহিয়ানের বাবার সামনে বসে এ্যলজেব্রা কষে বিকেলে চা মুড়ি খেয়ে বাড়ী ফিরেছিলাম। আসলে তখন আমাদের গার্জেনরা সন্তানদের দেখভালের ব্যাপারে বোধহয় কম্ বেশী এরকমই ছিলেন। তারা ছেলেমেয়ের বন্ধুদেরকে নিজ সন্তানের মত আদরও যেমন করতেন, শাসনও তেমন করতেন। আমা্র বাসায়ও নতুন কোন বন্ধু প্রথম এলে বাবা, মা কিংবা অন্য কারো না কারো একটা ছোটখাট ইন্টারভিউ এর বৈতরণী পার হয়েই কেবল নিজেকে ওয়েলকাম ফীল করতে পারতো।

চলবে…

ঢাকা
০৬ জুলাই ২০১৫
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

২,০৩০ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ৩”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    তোমার পরের মন্তব্যটার জন্য আগে ধন্যবাদ দিয়ে নি, রাব্বী। আমার নামের বানানটা লিখতে মানুষ সাধারণতঃ দুই ভাবে ভুল করে থাকে। প্রথম অংশটা খায়রুলের জায়গায় খাইরুল, দ্বিতীয় অংশটা আহসান এর জায়গায় হাসান। তুমি নিজে থেকে বানানের ভুলটা লক্ষ্য করে সংশোধন করাতে বেশ মুগ্ধ হ'লাম। যদিও জানি যে আমি এমন কেউকেটা কেউ নই যার নামের বানানটা সবাইকে একেবারে শুদ্ধভাবে লিখতেই হবে, তথাপি নামের বানানটা একটু অশুদ্ধ হলে কেমন জানি লাগে।
    আমার কোন লেখায় বোধহয় এটাই তোমার প্রথম মন্তব্য। ইতিবাচক মন্তব্যে প্রীত হ'লাম। ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    জীবনের জার্নাল শিরোনামটি বেশ লাগলো, ভাইয়া।

    স্মৃতির পাতায় পাতায় ধরে রাখা সুরভিটুকু সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সহজ কাজ নয় মোটে। আপনার লেখায় যে সময়টুকু ধরে রেখেছেন সেই সময়ের সুগন্ধির দাবীদার আরো অনেকেই আছে নিশ্চিত জানবেন।

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      "জীবনের জার্নাল" ণামটা হঠাৎ করেই মনে আসে, "আই লেট দেম সে" শোনার পর। মনে হলো, আই ওয়ান্ট টু হীয়ার এ্যন্ড আই ওয়ান্ট টু সে...
      লেখা যদি সুরভি ছড়ায়, তবে তা হবে সবার মধ্যে লুক্বায়িত একটা সহজাত নস্টালজিক প্রবণতার কারণে, তাতে আমার কোন ক্রেডিট নেই।

      জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    বেশ গতিময় হয়ে উঠেছে সিরিজটা। হাল্কা চালে রসিকতাগুলোও অন্যরকম একটা আমেজ দিয়েছে। :boss: :boss: :boss:
    একটা জিনিস আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয় --- সেই যুগে যখন টিভিই হয়তো আপনারা ছোটববেলায় পাননি, হয়তো বিনোদনের সর্বোচ্চ গণমাধ্যম তখন রেডিও -- অথচ আপনার (এবঙ আমাদেরো) জীবদ্দশাতেই সবকিছু এতটাই এগিয়ে গেল যে, একটা পর্যায়ে এসে আপনি আমি এখানে দিনলিপি, কবিতা, গান, গল্প লিখছি। আমাদের আনন্দ , সৃষ্টিশীলতার একটা বিরাট সময় আর স্থান অর্জন করে নিয়েছে এই ব্লগ। প্রযুক্তির এমন উল্লম্ফন কী আমরা ২০/৩০ বছর আগেও কল্পনায় দেখতে পেরেছিলাম?
    আবার এই আধুনিক টাইম মেশিনে চড়িয়েই আপনি আমাদের ঘুরিয়ে আনছেন আপনার শৈশবে -- অভিনব নয় বলুন? আমার তো মাঝে মাঝে খুব আশ্চর্য লাগে।

    জবাব দিন
  4. সাইদুল (৭৬-৮২)

    খুব ভালো লাগছে। আমারও ওই রকম একজন বাবার কথা মনে আছে। দেখা হলেই কোন সাব্জেক্টে কত পেয়েছি জিজ্ঞেস করতেন। আমরা পারতপক্ষে তাঁর ছায়া মাড়াতে চাইতাম না। তাঁর ছেলেরাও সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      হ্যাঁ, আমাদের সময় অনেক বাবা মা-ই ওরকম ছিলেন। সন্তানের সাথে সাথে তাঁরা সন্তানদের বন্ধুদের উপরেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। এজন্য সন্তানেরা কী রকম বন্ধুদের সাথে মিশছে, সেটা একটু পরখ করে নিতেন। তাদের আলটিমেট উদ্দেশ্য মহৎই ছিলো।
      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, সাইদুল।

      জবাব দিন
  5. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    আমার কৈশোরের স্মৃতিগুলো অনেকটাই কাছাকাছি। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে আমার দূর-সম্পর্কের এক ভাই পড়তেন। ছাত্র হিসেবে একেবারে ফাটাফাটি, এসএসসি-তে দ্বিতীয়, এইচএসসি-তে প্রথম হয়েছিলেন। আমার মার আজন্ম লালিত সাধ ছিল আমি হই তাঁর মত। আমি কতটুকু প্রভাবিত হয়েছিলাম তা সন্দেহকর, তবে বাবা যে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা নিশ্চিত। তিনিও আপনার বাবার মতো করে একরাশ স্বপ্নের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ভর্তির ফর্ম এনেছিলেন, নিয়ম অনুপুঙ্খ মেনে যত্ন করে পূরণ করেছিলেন নিজহাতে, ছবি সেঁটেছিলেন মমতাভরে, চোখে মুখে জ্বলতে-নিভতে দেখেছি জোনাকির মত ঝাঁক ঝাঁক নিম্নমধ্যবিত্ত আশঙ্কিত আকাঙ্ক্ষা।

    যে কোন ভাষা শিক্ষাই বিফলে যায় না জানি। পাঠক্রমে শাসকগোষ্ঠীর অনুকূল ভাষাশিক্ষা জুড়ে দেবার পেছনে যেমন সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটা ভাবনা কাজ করে, ঠিক তেমনি উল্টোফল হিসেবে ওই ভাষার প্রথাবিরোধী লেখককুলের সাথে পরিচিত হবার একটা সুযোগ তৈরি হয়। তবু জিজ্ঞেস করি 'উর্দু' শেখবার পেছনে আপনাদের কি কোন চেতনা অনুপ্রাণিত করতো? নাকি শিখতেন, শেখা বাধ্যতামূলক ছিল, তাই! না, বাধ্যতামূলক ছিল, তাই বা কি করে বলি? অপশনাল হিসেবে আরবী তো ছিলই। আরবী শেখার পেছনে যে মটিভেশন কাজ করত, নিশ্চয়ই উর্দুর বেলায় সেটা অনুপস্থিত ছিল।

    গালিব, মান্টো, চুঘতাই পড়ার জন্য হলেও উর্দুটা শেখা যায়।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      "তিনিও আপনার বাবার মতো করে একরাশ স্বপ্নের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ভর্তির ফর্ম এনেছিলেন, নিয়ম অনুপুঙ্খ মেনে যত্ন করে পূরণ করেছিলেন নিজহাতে, ছবি সেঁটেছিলেন মমতাভরে, চোখে মুখে জ্বলতে-নিভতে দেখেছি জোনাকির মত ঝাঁক ঝাঁক নিম্নমধ্যবিত্ত আশঙ্কিত আকাঙ্ক্ষা।"
      আমার লেখাটা পড়ে আপন বাবাকে এতটা নিবিড় করে আবার ভাবতে পেরেছো, সেটা জেনে ভালো লাগছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের সময়ে বাবারা খুব রাশভারী ছিলেন। বাসায় কথা কম বলতেন, কিন্তু প্রতিটি গৃহকোণে থাকতো তাদের তীক্ষ্ণ নজর। সন্তানদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন, তবে তার বাহ্যিক প্রকাশ থাকতোনা। অনুভূতিশীল হৃদয়সম্পন্ন সন্তানেরা সেটা বুঝে নিত আপন হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে, যেমনটা আমি করতাম। আসলে তারাও বোধকরি তাদের জীবনে ভালোবাসার বাহ্যিক প্রকাশটা খুব কমই দেখেছিলেন। সন্তানদের নিয়ে বাস্তবিকই থাকতো তাদের "ঝাঁক ঝাঁক নিম্নমধ্যবিত্ত আশঙ্কিত আকাঙ্ক্ষা"!
      আমাদের সময়ে একটা নির্দ্দিষ্ট শ্রেণী পর্যন্ত (খুব সম্ভব ৭ম/৮ম) আরবী অথবা উর্দু, এ দুটোর যেকোন একটি ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক ছিলো। বেশীরভাগ ছাত্র আরবী নিত, কারণ বোধকরি পারিবারিক ইচ্ছে, কারণ এতে পবিত্র ক্বোরান পাঠের পথে কিছুটা অগ্রসর হওয়া যেত। অমুসলমান ছাত্ররা, কিংবা যাদের পরিবারে ক্বোরান পাঠ ও ধর্ম চর্চার প্রতি ততটা উৎসাহ ছিলনা কিংবা যাদের পিতামাতা কেন্দ্রীয় সরকারে চাকুরী করতেন আর তাদের পাকিস্তানে বদলী হবার সম্ভাবনা ছিলো, তারা ভাষার প্রায়োগিক সুবিধাটা বিবেচনা করে তাদের সন্তানদের উর্দু পড়াতেন। কাজেই দেখা যায় যে, আরবী আর উর্দু, দুটোর পেছনেই আলাদা আলাদা মোটিভেশন কাজ করতো।

      জবাব দিন
  6. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    আমার জানতে ইচ্ছা হয়, আগেকার বাবারা ওমন ছিলেন কেন?
    আমার ধারনা, তাদের বেশির ভাগেরই নিজেদের তেমন কোন সার্বক্ষনিক সার্কেল বা বিনোদন ছিল না।
    এই "বাবাগিরি"-টাই তাই ছিল তাদের অবসরের শ্রেষ্ঠ্য বিনোদন বা অবসর কাটানোর পন্থা।
    আজকাল আমরা এত কিছু নিয়ে ব্যস্ত, "বাবাগিরি" দেখানোর সময় কৈ?

    বাবাগিরি অংশটা আজকের পর্বের উপহার। আমার অভিজ্ঞতার সাথেও ভালই মেলে......


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
      আমার ধারনা, তাদের বেশির ভাগেরই নিজেদের তেমন কোন সার্বক্ষনিক সার্কেল বা বিনোদন ছিল না।
      এই "বাবাগিরি"-টাই তাই ছিল তাদের অবসরের শ্রেষ্ঠ্য বিনোদন বা অবসর কাটানোর পন্থা।

      একটু দ্বিমত করি। আমার কাছে এটিকে নিম্নমধ্যবিত্ত মনোবৃত্তির সংকট বলে মনে হয় যা তখনকার সময় ও সমাজের অনিবার্য প্রতিচ্ছাপ! দেশ ছিল পরাধীন। বিত্তের পরিমান যাই থাকুক না কেন, পরাধীনতাঁর মানসিক চাপের কারণে অবস্থাভেদে প্রায় সকল বাঙ্গালিরই মধ্যে এই নিম্নমধ্যবিত্ত মনোবৃত্তিজাত উচ্চাশা কাজ করেছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে নিজে যে সাফল্যকে ছুঁতে পারেন নি, সন্তানের ভেতর দিয়ে সেই সাফল্যকে ছুঁয়ে যাবার একটা অপ্রতিরোধ্য বাসনা কাজ করেছে তাঁদের ভেতর। অনেকটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের যেমনটি হয়। মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠে। আর যেহেতু সমস্যাটা কেবলই ব্যক্তিগত ছিল না, এর একটা সামাজিক ব্যাপ্তি ছিল, প্রকারান্তরে আমরা সবাই ছিলাম শোষিত শ্রেণির, তাই নিজেদের ছেলে-মেয়েদের দেখভালের মধ্যে দায়িত্ববোধ সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমাজের পরিমণ্ডলেও সেটার বিস্তৃতি ঘটেছে। আমার বিশ্লেষণ অনুমান নির্ভর, তাই তা ভুলও হতে পারে। এসব মাপবার যুতসই মাপনি থাকে সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে। তাঁরা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। (সম্পাদিত)


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
      • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

        "যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে নিজে যে সাফল্যকে ছুঁতে পারেন নি, সন্তানের ভেতর দিয়ে সেই সাফল্যকে ছুঁয়ে যাবার একটা অপ্রতিরোধ্য বাসনা কাজ করেছে তাঁদের ভেতর"
        "আর যেহেতু সমস্যাটা কেবলই ব্যক্তিগত ছিল না, এর একটা সামাজিক ব্যাপ্তি ছিল, প্রকারান্তরে আমরা সবাই ছিলাম শোষিত শ্রেণির, তাই নিজেদের ছেলে-মেয়েদের দেখভালের মধ্যে দায়িত্ববোধ সীমাবদ্ধ থাকেনি"
        উপরের কথাগুলোর সাথে আমি অনেকাংশে একমত, মোস্তফা।

        জবাব দিন
  7. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "তাদের বেশির ভাগেরই নিজেদের তেমন কোন সার্বক্ষনিক সার্কেল বা বিনোদন ছিল না" - এ কথাগুলো যেমন অনেকাংশে ঠিক হতে পারে, তেমনি "এই "বাবাগিরি"-টাই তাই ছিল তাদের অবসরের শ্রেষ্ঠ্য বিনোদন বা অবসর কাটানোর পন্থা" - এ কথাগুলো বোধকরি ততটা ঠিক নয়। তারা তাদের সন্তানদের কঠোর অনুশাসনে রাখতে চাইতেন হয়তো একটা নিরাপত্তাবোধ জনিত আশঙ্কা থেকে। এই নিরাপত্তার আশঙ্কাটুকু মোটেই শারীরিক নয়। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবা-মা দের জীবনে কোন স্বপ্ন ছিলোনা, তাদের কোন সম্পদ বা অর্থলগ্নি ছিলোনা, সন্তানরাই ছিলো তাদের একমাত্র স্বপ্ন। তারা মনে প্রাণে চাইতেন, তাদের সন্তানেরা জীবনের সকল মাত্রার অর্জনের ক্ষেত্রে তাদেরকে অতিক্রম করে যাবে। এই বোধ থেকেই হয়তো তারা কঠোরতা অবলম্বন করতেন।
    আমার লেখাটা পড়ে তোমার চিন্তাপ্রসূত মন্তব্য দিয়েছো, এজন্য ধন্যবাদ, পারভেজ।

    জবাব দিন
  8. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাদের ইনটেকের একজনের বাবা এরকম ছিলেন। দেখা হলেই রেজাল্ট, পড়াশুনা ইত্যাদি নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। আমরা প্যারেন্টস ডে বা অন্যান্য সময় আঙ্কেলকে এড়িয়ে চলতাম। এখন বুঝি ওসব 'যন্ত্রণাও' ছিল ভালবাসার একধরণের বহিঃপ্রকাশ। :dreamy:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।