জীবনের জার্নাল – ২

তখন সেন্ট্রাল গভঃ বয়েজ হাই স্কুলের প্রদ্গান শিক্ষক ছিলেন জনাব বজলে কাদের। বেশভূষায় তিনি অত্যন্ত পরিপাটি ছিলেন। দূর থেকে দেখা, তাই এর চেয়ে বেশী আর কিছু মনে নেই, তবে এটুকু বুঝতাম যে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরেও তিনি একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। খুবই রাশভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী স্যার বাংলা পড়াতেন, হোম ওয়ার্ক এর ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। পরে শুনেছি তিনি খিলগাঁও হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। গুলজার হোসেন নামে একজন ঢিলেঢালা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়া শিক্ষক ছিলেন, যিনি ইংরেজী, অঙ্ক, ধর্ম সবকিছুই পড়াতেন, তবে তাকে মনে রেখেছি ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকে তার চমৎকার ইংরেজী হাতের লেখার জন্য। সিরাজুল ইসলাম স্যার ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী বই এ বেগম রোকেয়ার উপর একটা ছোট নিবন্ধ ছিল। বেগম রোকেয়ার নাম কেউ Rokeya উচ্চারণ করলে বা এভাবে লিখলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যেতেন। তিনি ওটাকে কেটে দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে Ruqaiyah কথাটা লিখে দিতেন, মুখেও তিনি রুক্বাইয়াহ উচ্চারণ করতেন। পরে জেনেছি যে বেগম রোকেয়া স্বয়ং তার নামটি ওভাবেই লিখতেন। সিরাজুল ইসলাম স্যার সিলেটী ছিলেন। যতক্ষণ ইংরেজী বলতেন, খুব চোস্ত বলতেন। সাধারণ ছাত্রদের জন্য কিছু বাংলায় বুঝিয়ে বলতে গেলেই অরিজিনাল সিলেটী ভাষা বেড়িয়ে পড়তো। অবশ্য আমার কাছে সেটাও মন্দ লাগতো না।

তখন স্কুলটা একটা নবনির্মিত দোতলা বিল্ডিং ছিলো। উত্তরে রাজারবাগ পুলিশ লাইন তথা সদর দপ্তর, একটু এক্সটেন্ডেড দক্ষিণে মতিঝিল কলোনী, পূর্বে শাহজাহানপুর আর পশ্চিমে টি এন্ড টি কলোনী ছিলো। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা থাকতো। আমরা স্কুলের পাঁচিলে বসে রাজারবাগ চানমারিতে পুলিশের প্রশিক্ষণ ফায়ারিং, বার্ষিক কুচকাওয়াজ আর দমকল বাহিনীর অগ্নি নির্বাপনী মহড়া প্রত্যক্ষ করতাম। আমাদের স্কুলের পাশেই ছিলো সেন্ট্রাল গভঃ গার্লস হাই স্কুল। পাশাপাশি দুটো স্কুল একই বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত ছিলো। তবে উভয় স্কুলের জন্য ছিলো একটাই কমন অডিটোরিয়াম। নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী ও ইত্যাকার অনুষ্ঠানাদি এলে বড়ভাইদের দেখতাম খুব আগ্রহভরে অপেক্ষা করতেন কখন ক্লাস শেষে অডিটোরিয়ামের দরজা খুলবে। সেখানে তারা আপুদের সাথে একসাথে রিহার্সাল করতেন। বলাই বাহুল্য, এসব করতে গিয়ে তাদের কারো কারো মধ্যে প্রেমের প্রথম পাঠও নেয়া হয়ে যেতো। এ তথ্য প্রকাশ পেতো এখানে সেখানে এর ওর মুখে আলোচনার মাধ্যমে। যারা লাইলী মজনু বা শিরি ফরহাদের মত হয়ে উঠতো, তাদের নামগুলি জ্বলজ্বল করে কে বা কারা বাথরুমের দেয়ালে কিংবা হেথা হোথা লিখে রাখতো প্লাস চিহ্নের মাধ্যমে। যেমনঃ জামিল+দিনা, সবুজ + রূপা, ইত্যাদি।

স্কুলে আমার রেজাল্ট অভিভাবকদের মোটামুটি সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছিলো বলে স্কুলের উপর তারা ও আমি উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট ছিলাম। আমার জন্য সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিলো টিফিন পিরিয়ডে ছোট টেনিস বল দিয়ে কোনদিন ফুটবল, কোনদিন “বোম্বাস্টিং” খেলা। আর স্কুল শেষে হাঁটা পথে বাড়ী ফেরার আগে কয়েকজন মিলে দুটি দলে ভাগ হয়ে আসল ফুটবল দিয়ে একই গোল পোস্টে কিছুটা সময় ফুটবল খেলে যাওয়া। আবার কোন কোন দিন সোজা বাসায় গিয়ে বই রেখে বাসার আবহাওয়া বুঝে পুনরায় স্কুলের মাঠে চলে আসতাম। সেদিন খেলাটা একটু বেশী হতো। ক্লান্তও বেশী হতাম আবার তিরস্কারের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে বাড়ী ফিরতাম, কেননা আমার প্রতি পাখী ঘরে ফেরার পূর্বেই বাড়ী ফেরার নির্দেশ ছিলো।

এভাবেই স্কুলে দুটো সুখের বছর অতিবাহিত করার পর একদিন টের পেলাম আমাকে নিয়ে বাসার সবাই কি যেন ভাবছে। আজন্ম লাজুক, তাই পরিবারের কারো কাছেই মুখ খুলে কোন কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। একদিন সন্ধ্যায় আব্বা আমাকে এক ফটো স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন ছবি তোলার জন্য। ফিরে এসে দেখলাম, তিনি আর বড়ভাই মিলে মন দিয়ে কি একটা ফরম পূরণ করছেন। বড়ভাই একপা অগ্রসর হয়ে নির্দেশ দিয়ে বসলেন, এখন থেকে আমাকে বাসায় ইংরেজীতে কথা বলতে হবে। ভুলচুক হলেও কোন সমস্যা নেই, তবে ইংরেজী বলতে হবে। এক মহা সমস্যায় পড়ে গেলাম। নিজেই মনে মনে কিছু বাংলা কথাকে সাজিয়ে নিয়ে সেটাকে ইংরেজীতে কিভাবে বলবো তা একনিষ্ঠভাবে আওড়ে যেতাম। কিছুদিন পরে একদিন বড়ভাই আমার ইংরেজীতে কথা বলার ব্যাপারে কিছুটা উন্নতি হয়েছে কিনা তা পরখ করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, “রশুন ইংরেজী কী, তা জানো?” পেঁয়াজ ইংরেজী কী, তা জিজ্ঞেস করলে আমি তার উত্তর দিতে পারবো, সেটা তিনি জানতেন। ধরার জন্যই রশুনের অবতারণা। তাই এসব প্রশ্ন ট্রশ্ন আমার খুব একটা ভালো লাগতোনা, আবার উপেক্ষা বা প্রতিবাদ করার সাহসও ছিলোনা। তবে, আমার ঐ মনে মনে আওড়ানোর অভ্যেসটা একটু একটু করে কাজ দিচ্ছিলো। আমি একটু বিরক্তি নিয়েই বললাম, “আই ডু নট নো এনিথিং এবাউট ইওর রশুন”। এত বড় একটা ইংরেজী বাক্য (তখনকার আমার তুলনায়) খাতায় অবলীলায় লেখতে পারতাম, কিন্তু তা আমার মুখে কেউ কখনো উচ্চারিত হতে শুনেনি। কথাটা শুনে তাই বড়ভাই একটু হকচকিয়ে গেলেও বাবা মা সহ বাসার আর সবাই বোধকরি সন্তুষ্টই হয়েছিলেন এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। পরে অবশ্য বড়ভাইও ঐ হাসিতে যোগ দিয়েছিলেন।

চলবে…

১,৯৫৮ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “জীবনের জার্নাল – ২”

  1. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    সে সময়ের শিক্ষকেরা প্রত্যেকেই ছিলেন কোন না কোন গুণে ভাস্বর! আজকাল পত্র-পত্রিকায় শিক্ষক নামধারী কিছু ব্যক্তির অমার্জনীয় দুষ্টাচরণের বিবরণ পড়ে শিউরে উঠি।
    লেখা চমৎকার এগুচ্ছে, উপভোগ্য হচ্ছে। আশাকরি অচিরেই তা আনন্দ-বেদনার কাব্য হয়ে উঠবে। আপনাদের ক্লাসের সবচেয়ে অবহেলিত ছেলেটির কথা জানতে চাই।


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      তোমার মত মনযোগী পাঠক যেকোন লেখকের জন্য পরম কাঙ্ক্ষিত। মন্তব্য ও পর্যবেক্ষণের জন্য ধন্যবাদ।
      আমি অবাক হ'লাম, তুমি কি করে আমার মনের কথাটাই বলে দিলে। "আপনাদের ক্লাসের সবচেয়ে অবহেলিত ছেলেটির কথা জানতে চাই" হ্যাঁ, এরকম একজন অবহেলিত ছাত্রের কথা না বলে প্রসঙ্গান্তরে যেতে মনটা সায় দিচ্ছিলনা। তোমার কৌতুহলে অনুপ্রাণিত হয়ে তার কথা বলেছি জীবনের জার্নাল – ৪ এ। অপেক্ষা প্রার্থনীয়।

      জবাব দিন
  2. সাইদুল (৭৬-৮২)

    শুধু আপনারবেড়ে ওঠা নয়, আপনার বেড়ে ওঠার সময়টাকেও দেখতে পাচ্ছি।

    যারা লাইলী মজনু বা শিরি ফরহাদের মত হয়ে উঠতো, তাদের নামগুলি জ্বলজ্বল করে কে বা কারা বাথরুমের দেয়ালে কিংবা হেথা হোথা লিখে রাখতো প্লাস চিহ্নের মাধ্যমে।

    মিউনিখের অলিম্পিয়া টাওয়ারেও দেখেছি এইপ্লাশ চিহ্ন।প্রেমের ভাষা সার্বজনীন


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
    • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

      একটা চমকপ্রদ তথ্য পেলাম তোমার কাছে, সাইদুল। আমি ভেবেছিলাম, প্লাস চিহ্নের ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশেরই কালচার।
      আমার লেখায় আমার বেড়ে ওঠার সময়টা তুমি তোমার গল্পকার এর চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছো, এ তথ্যটাও নবীন লেখক হিসেবে আমার জন্য একটা বড় পাওনা। অনেক ধন্যবাদ।

      জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    বেশ উপভোগ করছি আপনার ছেলেবেলার গল্প।

    পরের পর্বের জন্য খুব বেশি অপেক্ষায় রাখবেন না, প্লিজ।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এইভাবে ধীরে এগুনোর বড় সুবিধা হলো পারিপার্শের সহজ অন্তর্ভুক্তি।
    রাজারবাগের ঐ অঞ্চলটা একসময় চষে বেড়িয়েছি। কিন্তু ততদিনে তা ঘিঞ্জি ও জনবহুল হয়ে গেছে। আপনার কথায় "রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা থাকতো। আমরা স্কুলের পাঁচিলে দাঁঁড়িয়ে রাজারবাগ চানমারিতে পুলিশের প্রশিক্ষণ ফায়ারিং আর দমকল বাহিনীর অগ্নি নির্বাপনী মহড়া প্রত্যক্ষ করতাম..." শুনে সেটা কল্পনায় দেখতে দারুন লাগলো...
    পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  5. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:

    জীবনের গল্প জমে উঠছে ধীরে ধীরে, ভাইয়া। ছোট ছোট ডিটেইলগুলো পড়তে ভাল লাগছে। আপনার সময়কার ক্যাডেট কলেজের ঘটনাগুলোর জন্য অপেক্ষা করছি।

    জবাব দিন
  6. রকিব (০১-০৭)

    সিরিজটা জমে উঠতে শুরু করেছে। নীরব পাঠক থেকে কিঞ্চিৎ সরব হলাম পরের পর্বের দাবী দাওয়া নিয়ে!


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  7. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভাই, এত ডিটেইলস মনে রেখেছেন কেমন করে? আমার তো কয়েক বছর আগের স্মৃতিই কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
    শেষে এসে রসুনের 'ঝাঁঝে' মজা পেলাম। 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।