২০১৩ এর এপ্রিল থেকে জুন, বেড়াতে গিয়েছিলেম মার্কিণ মুলুকে। সফরের এক পর্যায়ে পাঁচ দিনের জন্য ফ্লোরিডার নেপলসে, এক বন্ধুর (Half JCC half MCC) বাড়ীতে উঠেছিলাম তার বহুদিনের বকেয়া আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে। সেখানে থাকতেই, ২৭ মে ২০১৩ তারিখে তার এক মিসরীয় বন্ধুর অকস্মাৎ মৃত্যুর খবর আসে। দাফন হবে ‘টাম্পা বে’ এর কাছে, ‘স্কাইওয়ে মেমোরিয়াল গার্ডেন্স’ এর এক সমাধিস্থলে, শ্যামলিমায় ঘেরা নীরব প্রান্তরে।
সেটা ছিল বন্ধুর বাড়ী থেকে প্রায় ঘন্টা তিনেকের ড্রাইভ। বব গ্রাহাম সানশাইন স্কাইওয়ে ব্রীজের পর আরো কিছুদূর যেতে হয়। সেখানে পৌঁছে দেখি দাফন-পর্ব প্রায় শেষের পথে, মাটি দেওয়া হচ্ছে। মরহুম ব্যক্তি জীবনে নিঃসঙ্গ ছিলেন, বহুদিন ধরে তার অস্ট্রিয়ান স্ত্রীকে তালাক দিয়ে একাই থাকতেন। আর বহুবছর ধরে কাকতালীয়ভাবে আমার বন্ধুটির সাথে শুধু জুম্মার নামাজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই। প্রথমে এভাবেই তাদের অল্প স্বল্প জানাশোনা, পরে সখ্যতা এবং তারও পরে বন্ধুত্ব, যার ভিত্তি ছিল বছর বছর ধরে তেমন কোন কথাবার্তা ছাড়াই পাশাপাশি দাঁঁড়িয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করা।
নিঝুম নিরিবিলি পরিবেশে আমিও একমুঠো মাটি ছড়িয়ে দিলাম, আর শান্তি কামনা করলাম সেখানে শায়িত সকলের জন্যে। অনতিদূরেই একটি সমাধিফলক নজর কেড়ে নিল। সমাধিফলক না বলে বলা উচিৎ কালো মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ একটি নামফলক, কবরের উপরে সেঁটে দেওয়া। সবুজ ঘাসে প্রায় চাপা পড়া প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ ছিল সম্ভবতঃ এক বাঙালী মায়ের নাম, ‘নাজমা বেগম – জন্ম মার্চ ২৩, ১৯৩৭ – মৃত্যু অগাস্ট ১১, ২০১১’ (ইংরেজীতে লেখা)। জন্ম-মৃত্যুর তারিখ দেখে ঠাওর করেছিলাম, প্রায় ৭৫ বছর বয়সে এ মায়ের মৃত্যু হয় স্বদেশ থেকে দূরে, বিদেশ বিভুঁইয়ে। সেখানেই রয়ে গেছেন তিনি, চিরতরে।
হয়তোবা তিনি তাঁর কোন সন্তানের ডাকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। হয়তো পরিণত বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। হয়তো কোন কারণে তাঁর দেহ দেশে পাঠানো সম্ভব হয় নাই। তাই ষোল কোটি বাঙালীর দেশের কবরস্থানগুলোর মত জনারণ্য নয় তাঁর শেষ নিবাস। ভাবছিলাম, তারতম্য কি কিছু হবে তাতে?
সেখানে অন্যান্য আরও অনেক ভিন্ন ধর্মালম্বীদেরও সমাধি ছিল। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যেন এক অনন্য নজির। ধারণা হলো, শুধু কবরস্থান পরিদর্শক আর গোরখোদক ছাড়া সেখানে তেমন কারো যাতায়াত নেই। তাই নাজমা বেগমের কবর দেখে মনটা ব্যথিত হলো। তাঁর নামফলক দীর্ঘ ঘাসের আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে মনে হলো, ব্যস্ততার এই দেশে জীবিত লোকদেরই কেউ খবব্র রাখেনা। মৃত ব্যক্তির কবরে কেই বা আসবে দু’দন্ড মৌন সময় কাটাতে! বড় হওয়া ঘাসগুলো কেটে রাখতে! হয়তোবা কেউ কখনো আসেনি, আর আসবেও না।
ব্যথিত হৃদয়ে তার প্রায় ঢাকা পরে যাওয়া কবরের ফলক থেকে কিছু ঘাস উপড়ে দিলাম, একটু পরিস্কার করে দিলাম। আর তার জন্য রেখে এলাম নীরব কিছু আকুতিভরা প্রার্থনা।
নেপলস, ফ্লোরিডা
মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র
৩১ মে ২০১৩
(সর্ব স্বত্ব সংরক্ষিত)
শান্তিতে ঘুমাক মা ... মনটা খারাপ হয়ে গেল লেখটা পড়ে।
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বার বার
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। মন্তব্য আর প্রার্থনার জন্যেও।
আটলান্টায় মুসলিমদের জন্য আলাদা কবরস্থান আছে। আমাদের এই গ্রেভইয়ার্ড গুলো শহর থেকে একটু দূরে হয়। চারদিক দেয়াল ঘেরা জনমানববিহীন প্রায় একটা স্থান। ক্রিশ্চানদের সমাধিক্ষেত্র গুলো আবার খুব সুশোভিত করে রাখে ওরা। রাস্তার পাশ দিয়ে হয়তো ড্রাইভ করছেন আপনি, হঠাৎ চোখে পরলো, দারুণ একটা ফুলের বাগান। প্রতিটি সমাধির ওপরেই তাদের প্রিয়জনেরা মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখে গেছেন তাদের ভালবাসার কথা। সাথেই একটি প্লাস্টিকের ফুলের তোড়া। দূর থেকে তাই এসব গ্রেভইয়ার্ড দেখতে অনেকটা ফুলের বাগান বলে ভ্রম হয়। এমনি এক সমাধি ক্ষেত্রে লেখা ছিল, Always loving, always loved.
"Always loving, always loved" - A nice epitaph of love!
"দূর থেকে তাই এসব গ্রেভইয়ার্ড দেখতে অনেকটা ফুলের বাগান বলে ভ্রম হয়।" - হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। আমিও দেখেছি তা। সাথে কিছু ছোট ছোট আমেরিকান পতাকাও গেড়ে রাখতে দেখেছি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
কবর দেখলে আমারো দাঁড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
কখনো দাঁড়াই।
আমার ছোট মেয়ে রাইদা র কবর ও খ্রিষ্টান কবরস্থানে দেয়া।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাইদার কথা জেনে ব্যথিত বোধ করলাম। আল্লাহ ওকে চিরশান্তিতে রাখুক।
ছোট্ট এক টুকরা ব্যাথা মনে খেলা করে গেল। কবরবাসীদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদেরকেও নাড়া দিয়ে যাক মাঝে মাঝে।
লেখাটা পড়ার জন্য এবং মন্তব্য করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ব্যাপারটা প্রচ্ছদ দেখে বইএর কন্টেন্ট অনুমান করার মত মনেহলো।
আর পড়তে গিয়ে ভাবলাম, আমিও ঐরকম পরিস্থিতিতে ঐরকমই ভাবতাম।
ভাল লেগেছে বর্ননাটা।
একাধারে সুখপাঠ্য ও ভাবনা জাগানিয়া।
এইরকমের আরও কিছু হঠাত আলোর ঝলকানি দেখার অপেক্ষা করবো ভবিষ্যতেও...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
প্রশংসায় প্রীত ও অনুপ্রাণিত হ'লাম। অনুকূল ভাবনার কথাটা জেনেও ভালো লাগলো।
ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে ভবিষ্যতেও কিছু লেখার আশা রইলো।
সেলাম খায়রুল ভাই।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
ধন্যবাদ, মোস্তাফিজ।