নাটাই

১।
-এই টিপু, তোর তো দেখি নতুন নাটাই। কবে কিনলিরে?
-আমার মামা এসেছিল ঐ যে বিদেশ থাকে উনি কিনে দিয়েছে।
-কত দাম রে?
-১২ টাকা, রাজার দোকানেই পাওয়া যায়।
-একটু দেখতে দিবি?
-তুই ফেলে দিবি দেখিস। তারচেয়ে বরং তুই সুতাটা ধর আমি মাঞ্জা দেই । এবার মাঞ্জায় কাচের গুড়া দিয়েছি আমার ঘুড়ি কাটা এইবার কারো সাধ্য নাই।
সারাটা বিকেল টিপুর ঘুড়ি উড়ানোতে সাহায্য করে ফিরার সময় আফসোস হতে থাকে আমার একটা মামা আসত আজ। পকেটের বেলুনটা আজ আর ফুলানো হল না। দুদিন আগেও টিপু ও আমাদের দলেই ছিল, বেলুনে গ্যাস ভরে তার পিছনে একটা সুতা লাগিয়ে দিয়েই আমাদের ঘুড়ি উড়ানো খেলা হত। আজ ও অন্য দলে চলে গেল বড় হয়ে গেল। বেলুনের দাম কম তাই এটাই সম্বল এখনো। ১২ টাকা…। সাত-আট-নয়-দশ-এগার- বার। আরো ৬ টাকা লাগবে, আংগুলে কড়ে গুনে হিসাব করি আমি। অনেক দিনের জমানো ৬ টাকা মাত্র আমার কাছে আছে।

২।
-আম্মু মামা কবে আসবে?
– কিসের আসা কোন মামা।
-ছোট মামা আসে না কেন আমাদের এখানে।
-সন্ধ্যা বেলায় আর কোন কথা নাই যত্তসব পড়া ফাঁকি দেওয়ার বাহানা, পড়তে বস।
বইয়ের পাতায় চোখ দিয়ে হারিয়ে যাই দিপুদের ছাদে। সবাই মিলে ঘুড়ি উড়াই মনে মনে। বাকাট্টা…। এই যা ঘুড়িটা কেটে গেল। আবার ফিরে আসে মন নিজের বাসায়। আব্বু চলে এসেছে এখনি এসে জিজ্ঞেস করবে কি পড়লাম আজ। সাত-আট-নয়-দশ-এগার আআর বার।
খাবার সময় আম্মুর কাছে গিয়ে আবদার করি আমার গত ঈদে জমানো টাকা যেটা আম্মুর কাছেই সঞ্চিত রাখতে হয়েছে সেটা থেকে আমাকে ১০টাকা দেওয়ার জন্য।
-কি করবি তুই টাকা দিয়ে।
মিনমিনে গলায় উত্তর দেই একটা নাটাই কিনব।
-শুনেছ তোমার ছেলের নাটাই কেনার শখ হয়েছে, ঘুড়ি উড়াবেন। আর কি বাকি থাকল। ঘুড়ি কি ভাল ছেলেরা উড়ায়?কাদের সাথে মিশিস তুই? ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে ছাদের থেকে পড়ে হাত পা ভাঙবি এরপর সারাজীবন লুলা থাকতে হবে।
এইরে সেরেছে আব্বু শুনে ফেলেছে এবার আসবে আব্বুর দিক থেকে উপদেশ তাড়াতাড়ি টয়লেটের দিকে চলে যেতে হবে।

৩।
আম্মুর এই ব্যাঙ্ক থেকে একটা টাকা বের করে নেই। দুইটা পঞ্চাশ পয়সা বের করতে পারলেই হবে। এটা কি চুরি হবে? সকালে মসজিদে গিয়ে যখন আরবি পড়ি তখন হুজুর বলেছেন চুরি করলে শাস্তি নাকি হাতের কবজি কেটে দেওয়া। কিন্তু গত মাসে আমিতো আম্মুর ব্যাঙ্কে এক টাকা রেখেছি। আমার টাকাটাই তুলে নেই। এইটা নিশ্চয়ই চুরি হবে না। সাত হয়ে গেল। আট-নয়-দশ-এগার … আর মাত্র ৫ টাকা। কড়ে দিয়ে গুনতে গুনতে দিন যায় তাও টাকা কমে আসে না। বিকেলে কিছু একটা করতে হবে।
মার্বেল গুলো নিয়ে বের হয়েছি। যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা ৩৭ টি মার্বেল । তার মধ্যে এই লাল রঙের মার্বেলটা কি সুন্দর। এর প্রতি লোভ মবিনের সবসময়। ওর কাছে সবসময় টাকা থাকে। ওকে আজ মার্বেল গুলো দিয়ে দিব এর বদলা ও কি আমাকে ৫ টাকা দিবে?
-৩ টাকা দিব সব মার্বেল গুলোর জন্য।
মাত্র ৩ টাকা। তাহলে এই লালটা বাদে নে? ওটা আমার খুব প্রিয়।
-মাথা খারাপ আরে বাকিগুলো দিয়ে আমি কি করব ওটার জন্যই তো টাকাটা দিব।
আচ্ছা যাহ দে। শোন মবিন তোর কাছে টাকা কোথা থেকে আসেরে?
-আমার বড়াপু আছে না। প্রতিদিন আমাকে টিফিন এর জন্য ২ টাকা দেয়।
বাসায় ফিরতে ফিরতে আবার আম্মুর উপর রাগ হয়। গতকাল আমিও টিফিনের জন্য টাকা চেয়েছিলাম উলটা আমাকে বাসা থেকে টিফিন নিয়ে যেতে হয়েছে। ইশশ আমার যদি একটা বড়াপু থাকত। যাই হোক আর মাত্র ২। এগার আর বার। তারপরই নিজের একটা নাটাই হবে। নতুন নতুন মাঞ্জা বানাবার প্ল্যান ঘুরছে মাথায়। টিপু বলেছে আমি নাটাই কিনলে ও আমাকে একটা ঘুড়ি দিবে।

৪।
কয়েকদিন ধরেই বাসার সব কিছু গোছানো হচ্ছে। আমরা নাকি ঢাকা চলে যাব। আমার এখনো নাটাই কেনা হয়নি। কাল নাকি আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে। সবার থেকে বিদায় নেওয়া শেষ। যাওয়ার আগে বলে গতকাল টিপু আমাকে ওর নাটাই দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়াতে দিয়েছিল। জীবনের প্রথম নাটাই হাতে ঘুড়ি উড়ানো। কৃতজ্ঞতায় আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল টিপুটা এত ভাল কেন। মবিন আমার সেই লাল মার্বেলটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। রাত পোহালে আমরা ট্রেনে উঠে পড়ব। ওদের সাথে আর দেখা হবে না। খুব কান্না পাচ্ছে আমার।

-আম্মু ঢাকায় কি ছেলেরা ঘুড়ি উড়ায়? ট্রেনের জানালায় চোখ রেখে জিজ্ঞেস করি আমি। ভাইয়ার সাথে প্রচুর মারামারি করে জানালার পাশে সিটে বসেছি আমি।
-নাহ ঢাকার ছেলেরা খুব ভাল হয়। ওরা অনেক পড়ালেখা করে অনেক ভাল রেজাল্ট করে। এইসব দুষ্টামি করে না। তোমাকেও অনেক পড়ালেখা করতে হবে।
কুঝিকঝিকঝিক শব্দে ছুটে চলা ট্রেনের সাথে শুরু হয় আমার ছুটে চলা, বড় হবার, মানুষ হবার। পিছনে পড়ে থাকে টিপু, মবিন, দিপু, নাটাই, মাঞ্জা, মার্বেল , লাটিম। জীবনে কোন দিন আর ঘুড়ি উড়ানো হয় না আমার। সেই টিপুর হাত থেকে নিয়ে ১০ মিনিট আমার জীবনের একমাত্র ঘুড়ি উড়ানো।

৫১ টি মন্তব্য : “নাটাই”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    কামতপু,
    অসাধারণ লেখা ... :hatsoff:

    (দুই তিন সপ্তাহ আগে মির্জাপুরের পোলাপাইন নিয়া যমুনা রিজোর্টে গিয়া বিয়াপওক ঘুড়ি উড়াউড়ি কইরা আসলাম ...
    দেশে আইসা আওয়াজ দিস ...
    তোর জন্যে আমার টিপু হইতে আপিত্ত নাই ... O:-) )


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. দিহান আহসান

    অনেকদিন পর ভাইয়া লেখা দিলে? 😀
    আমারে আমার ভাইরা দিতোনা ঘুড়ি উড়াইতে, খালি চাইয়া চাইয়া দেখতাম :dreamy: :dreamy:

    অফটপিকঃ ভালো আছো? অনেকদিন মেইল করা হয়ে ঊঠেনা। 🙂

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ট্যাগে 'গল্প' দেও নাই, তাই ধারনা করতেছি এইটা স্মৃতিকথা, সত্যি ঘটনা।
    যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে লেখা বেশ ভালো হয়েছে।

    আর যদি গল্প হয় তাহলে মোটামোটি। 😀

    আমি ঘুড়ি উড়াইছি অনেক।
    আমরা অবশ্য ঘুড়ি বলতাম না, বলতাম ঘুড্ডি।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  4. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    আমি কিন্তু ভাই এক্কেরে ছোট থাকতে ঢাকার আকাশে ঘুড়ি উড়াইছি, ঠিকমত পারতাম না তাই ঘুড়িটা পিছনে ফেলে সারা মাঠ দৌড়াইতাম। 😛
    টাকায় টানাটানি পরলে পলিথিন নিয়া ঘুড়ি বানাইছি। আর মাঝেমাঝে ঐ পলিথিন দিয়াই প্যারাসুট বানায়ে ছয় তালা থেকে ফালায় দিতাম। যারটা পরে পড়বে সে ফার্স্ট! :dreamy:

    রুমে ইশতিয়াক অনেকগুলি ঘুড়ি কিনে রাখছে। এইবার গিয়া আর মিস নাই। 🙂 :salute:

    জবাব দিন
    • কামরুলতপু (৯৬-০২)

      আমরাও পলিথিন দিয়ে ঘুড়ি উড়াইছি। আরেকটা কাজ করতাম বেলুনে গ্যাস ভরে তার নিছে পলিথিন মুরে পলিথিন এর কোনায় আগুন লাগিয়ে ছেড়ে দিতাম। উপরে উঠতে উঠতে একসময় বেলুন ফেটে বেশ জোরে আওয়াজ করত। ঐটার একটা ভয়ংকর দিক ছিল পলিথিনের ফোটা পড়ত নিচে কারো গায়ে লাগলে খবর ছিল

      জবাব দিন
  5. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    তোমার লেখাটা পরে বড়ভাইদের হাত থেকে একটু কিছুক্ষনের জন্য নাটাইটা হাতে নেবার যে কতোটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল - সেই অনুভূতিটা আবার বোধ করলাম। লেখার খাতার পৃষ্ঠা ছিড়ে, আর সাথে শলার কাঠি দিয়ে কতো বার ঘুড়ি বানিয়ে উড়াতে চেয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। কিন্তু কখনও উড়াতে পারিনি। মজার ব্যাপার হলো এই বড় বেলায় সে কাজটায় সফল হলাম। ক্যালিফোর্নিয়ার হেমন্তে ঘুড়ি উড়ানোর ভালো সময়। রেডিমেট ঘুড়িগুলো অল্পতেই আকাশের বাতাসে ভাসতে থাকে। কিন্তু আমার ছেলে যখন নিজের ঘুড়ি উড়ানোর ব্যর্থতায় কেঁদে উঠে তখন মনে পরে যায় একদিন আমারও অমন গেছে। ঠিক যেমন আজ তোমার লেখাটা পড়ে সে কথাই মনে পরলো।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    টিপু ভাই, লেখা ভাল হইছে 😀

    আমি আমার বড় বেলা নিয়া সবসময়ই আফসোস করি। কিন্তু ছোট বেলা নিয়া কোন আফসোস নাই। মোটামুটি মফস্বল শহরেই বেড়ে ওঠা। কাজেই সবরকম আনন্দের কোনটা থেকেই বঞ্চিত হইনি সেইভাবে। যেগুলো বাকি ছিল নিয়মিত নানা বাড়ি যাওয়াতে তাও পূরণ হয়ে গেছে ঠিকঠাক।

    জীবনে অনেক ঘুড়ি উড়াইসি। কিন্তু ঘুড়ি বানানোর দিকে কেন যেন কখনো আমার মনযোগ ছিলনা।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. সামি হক (৯০-৯৬)

    ঢাকা শহরে থেকেও জীবনে বহুত ঘুড়ি উড়াইসি। তখন আমাদের সিদ্ধেশরীতে এতো হাইরাইজ বিল্ডিং ছিল না। আহা কত দিন কাটা ঘুড়ির পিছনে দৌড়াইছি।

    এখন পুরান ঢাকা ছাড়া ঢাকাতে আর কোথাও ঘুড়ি উড়ে না। 🙁

    জবাব দিন
  8. জুলহাস (৮৮-৯৪)

    তুই এত বদ ক্যান??? x-( x-( x-(
    এত সুন্দর সুন্দর লেখা ক্যান দিস্‌??? B-) B-) B-) B-)
    তোরে...তোর চমৎকার লেখারে ভ্যাঞ্চাই!!!!!!!!!!!!!!! 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛 😛


    Proud to be an ex-cadet..... once a cadet, always a cadet

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।