ক্যাডেট কলেজ থেকে বলছি

 

পান্তা ইলিশ

পহেলা বৈশাখ। কলেজের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পান্তা-ইলিশ খাওয়ানো হচ্ছে ক্যাডেটদের। তাও কিনা ব্রেকফাস্টে ! অভূতপূর্ব সৌভাগ্যে ক্যাডেটরা যতটা হতবাক, ঠিক ততটাই কৌতূহলী তাদের স্যাররা। ঘণ্টা বাজতেই ক্যাডেটরা পেঁয়াজ মরিচ আচ্ছামত ডলে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া শুরু করলো। মুখে মুখে হাসি। হাতে হাতে ভাজা ইলিশ !

আনন্দের ভাগীদার হতে প্রিন্সিপাল স্যার পুরো ডাইনিং হল ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ক্যাডেটদের সাথে কথা বলছেন। তার পিছে পিছে আরও কয়েকজন টিচার। ক্লাস সেভেনের এক ক্যাডেটকে খুব ধীরগতিতে খেতে দেখে রফিক নওশাদ স্যার (সৈয়দ রফিকুল হোসেন) জিগ্যেস করলেন,

– এই যে, কেমন লাগছে খেতে?

– জি স্যার, ভালো।

– কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তো?

– না স্যার, সমস্যা হচ্ছেনা। অ্যাঁ, কিন্তু… (চুপ হয়ে গেল)

– কিন্তু কী?

– অ্যাঁ, মানে স্যার, ভাতটা কেমন যেন ভেজা ভেজা !

 

বোজো

আমাদের ফিজিক্সের এক স্যার ছিলেন অবিশ্বাস্য লেভেলের বোরিং জোকার। ক্যাডেটরা বংশ পরম্পরায় বোরিং জোকস তথা ‘বোজো’ তে ঝাক্কাস হয়ে উঠলেও স্যারের প্রতিভার শেকড় কোথায় সেটা এক অমিমাংসিত রহস্য। আমরা তখন ইলেভেনে। এক প্রেপে কারেন্ট ছিল না। আমরা করিডোরে এসে টাইয়ের নট লুজ করে শার্টের হাতা গুটিয়ে ঠাণ্ডা হচ্ছিলাম। স্যার ছিলেন সেদিনের গার্ডে। প্রচণ্ড গরমে তিনিও কাহিল। আমাদের সাথে বাৎচিত করতে করতে হঠাৎ বললেন, আচ্ছা বলো তো ইংরেজি বর্ণমালায় সবচেয়ে ঠাণ্ডা লেটার কোনটা?

আমরা বিভিন্ন উত্তর দিলাম। বিভিন্ন লজিকে। অনেক অনেক বোজো হল সেটা নিয়ে। কারো উত্তর স্যারের পছন্দ হয়না। অবশেষে স্যারের নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে এল উত্তর, কিংবদন্তি এক বোজো……

“ইংরেজি সবচেয়ে ঠাণ্ডা লেটার হল বি। কারণ সে এ-সির মধ্যে থাকে!”

 

নভিসেস প্যারেড

ক্যাডেট কলেজে ‘নভিসেস প্যারেড’ বলে একটা জিনিস আছে। নতুন একটা ব্যাচ ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়ার পরে তাদেরকে সামরিক নিয়মে কুচকাওয়াজ শেখানো শুরু হয়। এগার/বারো বছরের প্রায় ৫০ টি ছেলে যাদের অধিকাংশেরই উচ্চতা ৫ ফুটের কম। যাদের সবাই মায়ের আঁচলের ছায়া থেকে এই প্রথম বেরিয়ে এসেছে। যাদের অনেকেই এর আগে কোনোদিন ভরদুপুরের ঝলসে দেয়া রোদে ঘাম ঝরায়নি।

প্রায় ৩ মাস ধরে সকাল বিকাল প্যারেড চলে। যখন তারা সবকিছুই বেশ ভালোভাবে শিখে ফেলে তখন তাদের এই প্যারেডের একটা প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকে কলেজের প্রত্যেকটি ক্যাডেট, থাকেন শিক্ষক ফ্যাকাল্টির প্রত্যেক সদস্য। আমন্ত্রিত থাকেন ক্লাস সেভেনের প্রত্যেক ছেলের পরিবার। ক্যাডেট কলেজের আধা সামরিক আবহে ক্লাস সেভেনের কাছে এই নভিসেস প্যারেডের গুরুত্ব এমনকি বিজয় দিবসে জাতীয় প্যারেড গ্রাউণ্ডের সম্মিলিত কুচকাওয়াজের চাইতেও অনেক অনেক বেশি। তিন হাউসের ভেতর প্রতিযোগিতা হয়। শুরুতেই ড্রেস চেক আপ। দুইজন মেজর (অ্যাডজুট্যান্ট ও মেডিক্যাল অফিসার) খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জুতা পালিশ, বেল্ট, ক্যাপ, খাকি ড্রেস চেক করেন। বাম পকেটে রাখতে হয় সাদা রুমাল। প্রায় এক মাস ধরে জুতা পালিশ করা হয়। বিয়ের বউকে যেমন পার্লার থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে স্টেজে পাঠানো হয়, তেমনি সিনিয়র ভাইয়েরা অনেকে মিলে সেভেনের একেকটি ছেলেকে নিখুঁতভাবে এই চেক আপের জন্য তৈরি করেন।

আমাদের জুনিয়র কোনো এক ব্যাচের ঘটনা। এক ছেলের সবকিছু চেক করে অ্যাডজুট্যান্ট তাকে বললেন রুমাল বের করতে। সেই ছেলে বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুমালের একপ্রান্ত বের করে দেখাল। সাদা রুমাল। অ্যাডজুট্যান্ট তখন তাকে বললেন পুরো রুমালটাই বের করতে। বেরিয়ে এল নিপুণ হাতে ভাঁজ করা ‘একটি সাদা জাঙ্গিয়া’!!!

এরপরের ঘটনা শুধুই ইতিহাস।

 

স্লিপিং

এক ক্যাডেট হেলমেট না পরে ব্যাটিং করতে নেমেছে। বোলারের বাউন্সারে তাল সামলাতে না পেরে বল লাগলো তার মুখে। উপরের ঠোঁট কেটেকুটে ফালাফালা। সাথে উপরের পাটির দাঁতও ভাঙলো দুই একটা।

ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়া হল। মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট তাকে ভর্তি করে রাখলেন। এদিকে ক্লাসমেট সবাই তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে গেল যে, হেলমেট ছাড়া ব্যাটিং করতে গিয়ে এই কাহিনী হয়েছে সেটা মরে গেলেও বলা যাবেনা ডাক্তারকে। কারণ তাহলে এরপর থেকে অপশনাল গেমসে ক্রিকেট খেলাই নিষিদ্ধ করে দেবে অথোরিটি। ব্যাটসম্যানের কাছাকাছি ফিল্ডিং করতে গিয়ে আচমকা বল লেগে গেছে এই টাইপের কিছু বলতে হবে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার এলেন পরদিন সকালে। তার রুমে আহত ক্যাডেটের সাথে তার কথোপকথন —

– ইয়েস ক্যাডেট, হাউ ডিড ইট হ্যাপেন?

– স্যার, আশিক ওয়াজ বোলিং, রাফি ওয়াজ ব্যাটিং। অ্যান্ড আই ওয়াজ স্লিপিং, স্যার। রাফি হিট দ্য বল অ্যান্ড দ্য বল কাট মি।

দ্রষ্টব্যঃ ক্রিকেট মাঠে ফিল্ডিং এর একটি পজিশনের নাম ‘স্লিপ’।

দ্রষ্টব্য দ্রষ্টব্যঃ ব্যবহৃত নামগুলো কাল্পনিক।

 

দেয়ালপত্রিকা

ক্যাডেট কলেজে দেয়াল পত্রিকা বা দেয়ালিকার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। এখানে বছরে দুইবার আন্তঃ হাউস দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতা হয়। একটার উপলক্ষ একুশে ফেব্রুয়ারি, অন্যটা ষোলই ডিসেম্বর। প্রথমটা বাংলা দেয়াল পত্রিকা, পরেরটা ইংরেজি। এখানে আগাগোড়া সব কাজ ক্যাডেটরা নিজেরাই করে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ক্যাডেট কলেজের সমমানের দেয়াল পত্রিকা আমি কোনো ভার্সিটিতেও দেখিনি, কখনো দেখবো এমন আশংকাও করিনা। যেহেতু বয়স কম থাকে  তাই লেখার মান খুব ভালো না হলেও ছবি, স্কেচ, কম্পোজিশন, আইডিয়া, হাতের লেখা, পরিচ্ছন্নতা আর ওভারঅল গেটআপ যে কাউকে এক কথায় মুগ্ধ করবে। ট্র্যাডিশন হিসেবে সিনিয়ররা এই কাজ জুনিয়রদের শেখায়। ক্লাস সেভেনের চোখ না ফোঁটা পিচ্চি ছেলে/মেয়েটাও ধীরে ধীরে নতুন পথের দিশারী হয়ে ওঠে। বছরের পর বছর ধরে সেই একই নান্দনিকতা নতুন করে ডানা মেলতে থাকে।

দেয়াল পত্রিকার জন্য প্রত্যেক জুনিয়র ক্যাডেট বাধ্যতামূলক ভাবে গল্প/কবিতা/প্রবন্ধ কিছু একটা লিখে জমা দেবে এটাই নিয়ম। কিন্তু সেভেন/এইটের কয়টা পিচ্চি পারে একুশের কবিতা লিখতে? তাই বিভিন্ন পুরনো ম্যাগাজিন থেকে রিমেক/রিমিক্স করে তারা লেখা জমা দেয়। জুনিয়র লাইফে আমিও দিয়েছি। সেইসব কবিতার পেছনে কত মেধা, কত শ্রম আর কত দরদ আমরা ঢেলেছি, আহ! একসময় আমি সিনিয়র হই। ক্লাস ইলেভেনের কথা। ক্লাস সেভেনের লেখা বাছাই করা হচ্ছে। কয়েক ফ্রেন্ড মিলে একেকজনের কবিতা পড়ছি আর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছি। কারণ কয়েকবছর আগে হুবহু এই কবিতাগুলাই আমরাও লিখে জমা দিয়েছিলাম। এমন সময় একটা কবিতায় চোখ আটকে গেল।

“ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত,

বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়

বরকতেরই রক্ত!”

দারুণ কবিতা, কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা লাগলো আমার। অন্যদের দেখালাম। কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর সবাই একসাথে লাফিয়ে উঠলাম, “এই কবিতা না আমরা সেভেনের বাংলা বইতে পড়ছিলাম?? আল মাহমুদের লেখা না???”

সেভেনের সেই ছেলে দেখিয়ে দিল ক্যাডেট কী চীজ!

২,১২৯ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট কলেজ থেকে বলছি”

  1. আহমদ (৮৮-৯৪)

    আসাধারন। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। ক্লাস সেভেনের ঘটনাগুলো মনে পড়লে এখনো মাঝে মাঝে একা-একাই হেসে উঠি।

    অরেকটা কথা না বলে পারছি না। ক্যাডেট কলেজের মত ওয়াল ম্যাগাজিন আমিও আমার জীবনে আর কোথাও দেখিনি।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।