আগস্টের কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী মেজরের দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে কিছু সিদ্ধান্ত নেয় বঙ্গভবণে মিটিং করে। মেজর ডালিমের ওয়েবসাইটেই সেই মিটিংএর উপর কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেই মিটিংএ উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল তাহেরও। সেই মিটিংএই সিদ্ধান্ত আসে মেজরেরা বর্তমান অবস্থায় দেশ ত্যাগ করে কাছাকাছি কোন দেশে অবস্থান করবেন এবং ব্যাংকককেই বাছাই করেন তারা। এরপরেই সিদ্ধান্ত আসে তারা কিভাবে খালেদ-শাফায়েত গ্রুপকে নিষ্ক্রীয় করবেন। তখনকার বঙ্গভবণে অবস্থিত সবাই এটাকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছিল অথবা খালেদ-শাফায়েতকে ভারতের চর হিসেবে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিল ইচ্ছাকৃতভাবেই। কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে গণবাহিনী এবং জাতীয়তাবাদী অন্যান্য গ্রুপগুলোকে খালেদের এই ভারতমুখীতার পরিচয় উন্মোচণ করে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই মিটিংএ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জিয়া এবং মোশতাককে নিয়ে। খালেদ-শাফায়েতকে উৎখাত করার পর সবার আগেই জিয়াকে উন্মুক্ত করে তাকে পুনরায় সেনাপ্রধানের আসনে বসানো এবং জিয়াউর রহমান মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হতে আনুরোধ জানাবেন।(০৩ তারিখ সকালবেলা খালেদ-শাফায়েতের পক্ষ থেকে কর্ণেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক বঙ্গভবণে গেলে প্রেসিডেন্ট তাদের দাবীদাওয়া শুনে খালেদকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলেন এবং মন্ত্রীসভার অনুমতি ছাড়া কিহু করতে পারবেন না বলে জানান। যদি এতে তাদের আপত্তি থাকে তাহলে সে আর প্রেসিডেন্ট থাকবে না)। দেশে অবস্থানরত যেই অংশ এগুলা বাস্তবায়ন করবে তারা ব্যাংককে অবস্থিত মেজর গ্রুপের সাথে সবসময় যোগাযোগ রেখে কাজ করবে। বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের ইউনিটগুলোতে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। দেশ ছেড়ে চলে যাবার ব্যাপারে মেজর ডালিম বলেন , “লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটা ছিল সাময়িক কৌশল মাত্র”।
এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। একটা কথা ছাড়ানো হয় যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত সাজাপ্রাপ্ত বার জনের মধ্যে সাত জনই মুক্তিযোদ্ধা। এখানে কর্ণেল ফারুককে দেখানো হয় ওসমানীর বিশেষ সহকারী হিসেবে। এটা মিথ্যা কথা। ফারুক কলকাতায় রিপোর্ট করে ১২ ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হয় ১৬ই ডিসেম্বর। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওসমানীর সহকারী ছিলেন লেঃ (পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন) নূর। কথিত আছে নারীঘটিত এক কেলেঙ্কারিতে তাকে এই পদ থেকে অব্যহতি দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। “একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা বইয়ে নাম উল্লেখ না করে এই বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। ফারুক বাদে ৬ জন বাকী থাকে যার মধ্যে ০৫ জনই পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
কিন্তু তারাই আবার পাকিস্তান এবং যুক্তরাস্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার আবেদন করতে চান। ০৫ নভেম্বর ১৯৭৫, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো বোস্টারের তারবার্তা থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
Subj:FUTURE PLANS OF MAJORS
WE UNDERSTAND BBC DRAWING ON A REUTERS’ REPORT FROM BANGKOK THAT MAJOR FAROOK RAHMAN SAYING HE AND OTHER EXILES MAY SEEK ASYLUM IN EITHER PAKISTAN OR THE UNITED STATES.IF QUERIED,WE PLAN SAY THAT WE KNOW NOTHING OF THE MATTER.
BOSTER
গত পর্বে বেশ কয়েকজন আরও বিস্তারিত লিখার কথা জানিয়েছিল। তাদের কথার উপর ভিত্তি করেই একটু বিস্তৃতিতেই যেতে চাচ্ছি। এর জন্যই মাঝে মাঝে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে হচ্ছে।তবে সেই সময়গুলা অনেক বেশী ধোঁয়াশার। যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঘটনাগুলোকে সাজাতে। কেউ যদি কোন তথ্যের ভুল দেখাতে পারেন, ধন্যবাদের সাথে সেগুলো গৃহিত হবে।
গত পর্বে শেষ করেছিলাম জেল হত্যা দিয়ে। সেই পয়েন্টে ফিরে যাই আবার।
ততক্ষণে খালেদ-শাফায়েতের অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গভবণ থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপস withdraw করার পর সেটা replace করার জন্য বিডিআর এর দুটি রেজিমেন্টকে বঙ্গভবণে নিয়ে আসার অর্ডার করেছেন সামরিক উপদেষ্টা ওসমানী। ক্যান্টনমেন্টে অস্বাভাবিক সেনা মুভমেন্ট, বঙ্গভবণে মেজর,প্রেসিডেন্ট, সামরিক উপদেষ্টার মিটিং চলছে। সারা বাংলাদেশ তখনো এসবের কিছুই জানে না।কর্মক্লান্ত দিনের পর গভীর ঘুমে মগ্ন আছে সবাই। এমন গভীর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহী গাড়ী পুরান ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে পৌছে। জেলে আটক আওয়ামীলীগ নেতাদের বাইরে নিয়ে আসতে চায়। জেল কোড মেনে সশস্ত্র সৈন্যদের জেলের ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন জেলার আব্দুল আওয়াল। এই নিয়ে ঘাতক দলের সঙ্গে জেলারের কথা কাটাকাটি চলে অনেকক্ষণ। জোর করে জেলে ঢুকে যেতে চাইলে জেলখানার পাগলা ঘন্টা বাজানো হয়। অবশেষে ডিআইজি,প্রিজন কে বাসার থেকে ডাকিয়ে আনা হয় মধ্যরাতে।
রিসালদার মোসলেম ডিআইজি কে জানায় যে ফারুক, রশীদ তাদের পাঠিয়েছে। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে সৈন্যদল। জেল কোডের পরিপন্থী এই বিষয়টা বিনয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে বলেন ডিআইজি, তিনি এভাবে চার নেতাকে তাদের হাতে তুলে দিতে পারেন না। এভাবে চলে প্রায় আধ ঘন্টা। মোসলেম উদ্দিন তাকে বঙ্গভবণে রশীদকে ফোন করতে বলেন। টেলিফোনে রশীদ মোসলেম উদ্দিনের কথামত কাজ করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের পরেও নিজস্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকেন ডিআইজি। কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে সরাসরি বঙ্গবভণে ফোন দিয়ে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলেন এবং তার পরামর্শ চান। মোশতাক মেজর রশীদের কথামত কাজ করার নির্দেশ দেয়। ডিআইজি তখন বাধ্য হয়েই রিসালদার মোসলেম এর নেতৃত্বের দলটিকে সেলের ভিতরে ঢোকার অনুমতি দেন।
তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলাম ছিলেন ১নং সেলে।পাশের সেলে মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান। সবাইকে তাজউদ্দিনের সেলে আনা হয়। তারপর খুব কাছে থেকে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৪ স্তম্ভের তিনজন তখনই মারা যান। তাজউদ্দিনের পায়ে এবং হাঁটুতে গুলি লাগে। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল এবং উনি পানি চাচ্ছিলেন, পানির বদলে বুকের বেয়নেট চার্জ করা হয়। যেই বুকে একটা বাংলাদেশ বাস করত! পাশের সেলেই ছিলেন আওয়ামীলীগের আরেক নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ। নাম লিস্টে না থাকায় বেঁচে যান তিনি। এভাবেই সবার অগোচরে রাতের আঁধারে মেরে ফেলা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে।
নভেম্বর ০৪
জেল হত্যার কথা খালেদকে জানানো হয় ০৪ তারিখ সকাল বেলায়। পুলিশের ডি,আই,জি এ চৌধুরী তাকে এই খবর জানান। উত্তেজিত খালেদ মোশাররফ ডি,আই,জি কে শক্তভাবে উচ্চকন্ঠে চার্জ করতে থাকেন এ কথা কেন তাকে আগে জানানো হয় নি? যখন জানানো হয়েছে তখন মেজরেরা তার হাতের নাগালের বাইরে। খালেদ-শাফায়েত তখনই সিদ্ধান্ত নিল মোশতাককে আর প্রেসিডেন্ট রাখা যাবে না।
সেদিন ক্যান্টনমেন্টের সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে একটা অন্যরকম আবহাওয়া কাজ করছিল। আর্মি চীফকে বন্দী করাটা তারা ভাল চোখে দেখছিল না। চীফের প্রতি একটা সহানুভূতি কাজ করছিল সাধারণ সৈনিকের মনে। যেটি জিয়ার জনপ্রিয়তা এক দিনের মধ্যেই প্রায় দ্বিগুণ করে তোলে। সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করা এবং এটি চাপের মুখেই তিনি করেছেন বিষয়টি সাধারণ সৈনিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সহানুভূতি এবং জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। খালেদের পক্ষে ব্রিগেডিয়ার রউফ জিয়ার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সই করিয়ে আনেন। একই পত্রে জিয়া পেনশনের আবেদনও করেন। দুদিন ধরে ক্যান্টমেন্টে দারুন অনিশ্চয়তার ছাপ। সেনাসদরে গুঞ্জন। খালেদকে এর মধ্যে অনেকে ভারতের চর ভাবতেও শুরু করেছে।
এরই মধ্যে সেদিন দুপুরের কিছু পরে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের Defence attache ব্রিগেডিয়ার ভোরা দেখা করতে আসেন তার হাতে একটা গিফট প্যাকেট ছিল। এটা পূর্ব নির্ধারিত কোন সাক্ষাৎ ছিল না, তাই তাকে সেনানীবাসের মেইন গেটে মিলিটারি পুলিশ আটকে দেয়। কর্ণেল সাবিহউদ্দিন এর কাছে ফোন করে করনীয় জানতে চাইলে ভোরাকে চলে যেতে বলেন কর্ণেল সাবিহউদ্দিন। যাওয়ার আগে ভোরা গিফট প্যাকেটটি রেখে যান যেটা সরাসরি সেনাসদরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরাসরি। ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াতের বই (বাংলাদেশঃ রক্তাক্ত অধ্যায়) থেকে জানা যায় প্যাকেটটি খুলে দেখার সুযোগ পান নি খালেদ। তবে এই ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই সৈনিকদের মনে খালেদের pro-indian হওয়ার গুজবে আরো ইন্ধন যোগায়।
জেনারেল জিয়ার নিজের হাতে লেখা পদত্যাগ পত্র নিয়ে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে যান সকালের দিকে,সাথে ছিলেন নৌ এবং বিমানবাহিনী প্রধাণ। তখন খালেদকে সেনাপ্রধান করার কোন বাধা না থাকলেও মোশতাক মন্ত্রীসভার অনুমোদন ছাড়া বড় কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। বিকালেই মন্ত্রীসভার বৈঠক ডেকেছেন বলে জানান তিনি। মেজরেরা দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরপরই মোশতাক পদত্যাগ করতে চাইলেও খালেদ তাকে চালিয়ে যাবার অনুরোধ করেন। যদিও শাফায়েত এটা চাইছিলেন না।
খালেদ নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্টের যথাযথ অনুমোদনসহ চীফ অব স্টাফ হতে চাইছিলেন,শক্তি দিয়ে বা রক্তপাত করে নয়। এবং এই পয়েন্টেই তিনি মোশতাকের কাছে অনেকটাই নতজানু হয়ে পড়েন। আর সেটা বুঝেই চতুর মোশতাক খালেদের কাছ থেকে সময় নিতে থাকেন এবং খালেদ আসল লক্ষ্য থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে আসতে থাকেন। ব্রিলিয়ান্ট আর্মি অফিসার খালেদ মোশাররফ তখন অনেক অদক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন যার ফলাফল মারাত্নকভাবে তার বিপর্যয় ডেকে আনে। অভ্যুত্থানের নায়ক জেনারেল খালেদ মোশাররফ এরকম সংকট মুহুর্তে কেন প্রেসিডেন্টের পিছনে নতজানু হয়ে ছুটাছুটি করেন তার প্রমোশনের জন্য?এরকম অদক্ষতার পরিচয় খালেদ নিজের কর্মজীবনে এর আগে কখনো দেখান নি। একজন ক্ষমতাধর আর্মি অফিসার কিভাবে প্রমোশন নিতে পারেন সেটা সেদিনই দেখিয়ে দেন কর্ণেল শাফায়েত জামিল।
দুপুরে ২৬ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রীসভার বৈঠক বসে বঙ্গভবনে। জেল হত্যা তদন্তের জন্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধাণ বিচারপতির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠণ করা হয়। জেল হত্যা এবং মেজরদের দেশ ত্যাগ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলে সভায়। মন্ত্রীরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন, এতে শুধু সময়ই নষ্ট হচ্ছিল। সভা শুরুর আগে জেনারেল মোশাররফ এবং বিমান ও নৌ বাহিনী প্রধান ভিতরে এসে সরকারের প্রতি আনুগত্য এবং প্রেসিডেন্টকে মেনে চলার প্রতিজ্ঞা পাঠ করেন। এতে মন্ত্রীরা সবাই গলা খুলে কথা বলার সাহস পান।
সভার এক পর্যায়ে এসে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট তার সামরিক উপদেষ্টার সুপারিশে সেনাপ্রধান নিয়োগ করতে পারেন। তবে ওসমানী স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে সেনাপ্রধান নিয়োগের ব্যাপারে সাধারণ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এ নিয়ে খালেদ মোশাররফের সাথে মোশতাক এবং ওসমানীর কিছুটা উত্তপ্ত বক্য বিনিময় হয়।
ওদিকে ৪র্থ বেঙ্গল হেড কোয়ার্টারে এই সময়ক্ষেপন নিয়ে হতাশা চরমে ওঠে। খালেদ সকালে বঙ্গভবণে গেলেও তার আর কোন খঁজ খবর নেই। টেলিফোনেও তার সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। অস্থির হয়ে ওঠেন কর্ণেল শাফায়েত। সন্ধ্যার দিকে কর্ণেল মালেককে সাথে নিয়ে বঙ্গভবণে যান অস্থির শাফায়েত। বঙ্গভবণে ঢুকেই চিৎকার করে ওঠেন, কোথায় খালেদ মোশাররফ? সবাই বলল, স্যার তিনি কেবিনেট রুমে মিটিং করেন।
তখন কেবিনেটের মিটিং চলছিল। অকস্মিকভাবে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কেবিনেট রুমে ঢুকে যান ছড়ি হাতে শাফায়েত। পিছনে স্টেনগান হাতে পাঁচজন সশস্ত্র অফিসার। মন্ত্রীসভায় গলা খুলে কথা বলা মন্ত্রীরা ভয় পেয়ে একেকজন পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। মেজর ইকবাল খন্দকার মোশতাকের দিকে স্টেনগান তাকে করে বলতে থাকেন, আপনি পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার দেখেছেন কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর দেখেন নি। এখন দেখবেন। অসম সাহসে সামনে এসে দাড়ান ওসমানী। গোলাগুলি না করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান। সেই যাত্র্য বেঁচে যায় মোস্তাক। সেই অস্থির মুহূর্তে যে কোন সময় অস্ত্র গর্জে উঠতে পারত। আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচণা হতে হতে থেমে গেল।
শাফায়েত জামিল খন্দকার মোশতাকের পদত্গযাগ দাবী করে বলেন, আপনি একজন খুনী। আপনি জাতির পিতাকে হত্যা করেছেন। আপনার সরকার অবৈধ। আপনার ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই। আপনাকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। মোশতাক মাথা নেড়ে তখনই রাজী হন।
শাফায়েত মোশতাকের সাথে তখন বেশ খারাপ আচরণ করতে থাকেন। ওসমানী এসবের প্রতিবাদ করলে শাফায়েত তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলেন, আপনি উপদেষ্টা হিসেবে এতদিন ধরে উনাকে কি উপদেশ দিয়েছেন?জেনারেল খলিল প্রতিবাদ করে বলেন দেখো উনাকে এভাবে অপমান করা উচিৎ হচ্ছে না। দয়া করে শান্ত হও। শাফায়েতের চিৎকার আপনি চুপ থাকুন। আর কথা বলবেন না। আপনি জেল হত্যার কথা জানতেন তাও ওদের যেতে দিয়েছেন। আপনাকেও অ্যারেস্ট করা হল। শাফায়েত তখন উত্তেজিত। সাথে থাকা অস্ত্রধারী অফিসারেরা শুধুই সংকেতের অপেক্ষায়।
খালেদ মোশাররফ নিজেও খানিকটা ভড়কে যান জামিলের অবস্থা দেখে। পরিবেশ তখন উত্তপ্ত। ওসমানী শাফায়েত, খালেদকে শান্ত থাকার আহবান জানাচ্ছিলেন। কর্ণেল মালেক শাফায়েতকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাইরে নিয়ে যান। এলোমেলোয়ে মন্ত্রীসভার বৈঠক আবার শুরু হয়।
ওসমানী তাদের প্রস্তাবগুলো মিটিংএ বলে যাওয়ার অনুরোধ করলেন এবং সবই পাশ হবে বলে নিশ্চয়তা দিলেন। পরবর্তীতে কর্ণেল মালেক পয়েন্টগুলো নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন, বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হলো।
১। মুজিব এবং জেল হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবে
২।খালেদ মোশাররফকে চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হবে।
৩।মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকবেন,যতক্ষণ না অন্য ব্যবস্থা হয়। তবে তিনি অসুস্থতার জন্য পদত্যাগ করবেন বলে সম্মত হন।
৪।বঙ্গভবণ থেকে সৈন্য ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবে।
মন্ত্রীসভার বৈঠক চললেও শাফায়েত এবং খালেদ ঘোরাফেরা করে পয়েন্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। মিটিং চলল প্রায় রাত দু’টা পর্যন্ত। শেষ হলে কর্ণেল মালেক মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ৪ জন ছাড়া আপনারা বাকী সবাই বাসায় যেতে পারেন। মন্ত্রীদের তখন কি অবস্থা হতে পারে এটা সহজেই অনুমেয়। এই চার জন ছিলেন, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। বাকীরা বাসায় চলে গেলেন।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়। এয়ার মার্শাল তোয়াব এবং এডমিরাল এম,এইচ খান হাস্যরত খালেদের কাঁধে মেজর জেনারেল র্যাঙ্ক পরিয়ে দেন। পরদিন বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার প্রথম পাতায় তার হাস্যরত ছবিটি ছাপানো হয়।
এভাবেই সেদিনের সেই দীর্ঘ সময় ধরে চলা মন্ত্রীসভার মিটিং শেষ হয়। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মোশতাক। তার এবং তার মন্ত্রীসভার শেষ সময় প্রায় চলে এসেছে। ওসমানীও বিদায় নেবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। কোলাকুলি করলেন মোশতাকের সাথে। বিদায় নেওয়ার ওসমানী বললেন, Sorry old man, we played a bad game. Let us forget and forgive.
চলবে…
তথসূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লেঃ কর্ণেল এম,এ, হামিদ
বাংলাদেশঃ রক্তাক্ত অধ্যায়, ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন
ইন্টারনেট
দারুণ একটা রেফারেন্সমূলক সিরিজ দাঁড়াচ্ছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
ধন্যবাদ ভাই, পরের পর্ব চলে আসবে 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
যথারীতি :hatsoff:
অনেক ইন্টারেস্টিং বিষয় নতুন করে জানছি।
🙂 , ধন্যবাদ নিও নাফিস।
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
ভাই, মোশতাক আর মোস্তাক এর মধ্যে প্যাচ লাগিয়ে ফেলছি... দুজন কি একই ব্যক্তি?
আর খন্দকার মোশতাক এর পরিবার বর্তমানে কি বাংলাদেশে আছে? কৌতুহল হচ্ছে...
বাই দি ওয়ে অসাম পোস্ট এগেইন ::salute:: ::salute::
বানান ভুল ছিল ওটা, দুঃখিত। হ্যা দুইজন একই ব্যক্তি
তাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা কি সেটা ভাল জানি না। বিএনপি'র খন্দকার মোশাররফ হোসেন মোশতাকের কোন আত্নীয় যতদূর জানি। নিশ্চিত বলতে পারছি না।
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
স্বাধীন বাংলার অন্ধকারচ্ছন্ন সময়ের ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসার জন্য তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ।ক্যারি অন 🙂
সময়গুলা খুবই গোলমালের, ভয় পাই যে ঠিকমত আছি কিনা, তথ্যগুলা ঠিকমত দিতে পারতেছি কিনা।
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
:thumbup: :teacup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আপনের হাতের চা খুব ভালা পাই, চিনি আরেকটু বেশী হইলে ভাল হইত 😀
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
খুব সম্ভবত ওসমানীর লেখা আত্মজীবনী টা লেজেহুমোএরশাদ হাপিশ করে দিছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা লাইন। তবে ওসমানীর সেই সময়ের কার্যক্রম সঠিক বলে আমার কাছে মনে হয় না।
এরশাদ অনেক কিছুই নষ্ট করে দিছে, জিয়া হত্যার সাথে যারা কোনভাবেও জড়িত ছিল তাদেরও মেরে ফেলছে। বাট তারপরেও হি ইজ দ্য আল্টিমেট গেইনার।
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
খুব সাধারণ একটা প্রপাগান্ডা আছে যে, মুজিবকে যারা মেরেছেন তারা সবাই বা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
অবাক লাগে,
০১ মুজিব তাইলে কি ছিলেন?
০২ কামাল-জামাল কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না?
০৩ শেখ মণি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না?
০৪ আবদুর রব সেরনিয়াবত কি মুজিবনগর সরকারের হয়ে কাজ করেন নাই?
*** যেই রক্ষীবাহিনী নিয়া এতো কথা তার প্রধান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও অবঃ আর্মির মেজর।
আর রক্ষীবাহিনীর সকলে তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেনই।
Brigadier Nuruzzaman was appointed as the Director General while Major Anwarul Alam Shahid (Deputy Director, Training), Lieutenant Colonel Abul Hasan Khan (Deputy Director, Administration), Lieutenant Colonel Sarwar (Deputy Director, Operations), Lieutenant Colonel Sabihuddin (Deputy Director, Signals) and Lieutenant Colonel Azizul Islam (Deputy Director, Zonal Head Quarter of Chittagong) were his five deputies
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
যারা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মহান বলেন তাদের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন করি। রাসেল, শেখ মনির অন্তঃসত্বা স্ত্রী, সেরনিয়াবাতের দশ,পনের বছরের দুই মেয়ে, এগার বছরের ছেলে, পাঁচ বছরের নাতি এরা কি দোষ করেছিল? বাকীদের এবং তাদের স্ত্রীদেরও ধরে নিলাম তারা অপরাধী। সেইসব মানুষদের দেখলেও আমার করুণা হয় যারা নানান ছুতায় সেই সব মেজরদের মহান বলে গণ্য করে।
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
রাজিব তোর এই প্রসঙ্গে খুব শীঘ্রই জানতে পারবি । মুক্তিযুদ্ধের দলিল রিভিউ করতেছি , ৬০% শেষ , লেখাও শুরু করছি । আশা করি মনপুত হবে ।
ভাই দিবস বেঙ্গল ক্যাভেলরির মেজর নাসিরুদ্দিনের লেখা একটা বই ছিল (নামটা মনে নাই ), তোমার গবেষণায় কাজে লাগত । সম্ভব হলে জোগাড় করে নিও । সাথে অশোক রায়না-র Inside RAW .
৩৩ মইনুল রোডের অনেক গুপ্ত কাহিনিই সেখানে পাবে ।
একটাই তো জীবন , তাই জীবন যেখানে যেমন -- Life is Beautiful .
ভাই, নামটা মনে করে একটু জানায়েন, পড়ব আশা করি।আপনার তথ্যগুলার জন্যই অশেষ ধন্যবাদ। 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
গুড জব।
ক্যারি অন।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
দারুণ।
সিরিজ চলুক। ইনফোগুলো ঠিকঠাক দিও। পরে রেফারেন্স হিসাবে যাতে ব্যবহার করা যায়। কষ্ট করে পড়াশুনা করে লিখছ। ধন্যবাদ নিও।
রেজা ভাই ধন্যবাদ। ইনফোগুলার সত্যতা নিশ্চিৎ করতে একটু বেশী সময় লেগে যায়।
কষ্ট করে পড়ার জন্য ১টা চা খেয়ে নেন। :teacup:
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
তথ্য বহুল লিখা।
ধন্যবাদ ভাই। 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
কস্ট করে লিখছো জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
সময় করে পড়ার জন্যই আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই। আপনার লেখা মিস করি। 🙁
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি
ভাইয়া, কষ্ট করে লিখেছো বলে ধন্যবাদ। কিন্তু একটা বিষয়, তোমার লেখাটা পড়ার পর আমি এই সংক্রান্ত বই খোজাখুজি করে পড়া শুরু করি। প্রথেমেই যে বইটা পড়ছি, তা হল "তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা _ লেঃকর্ণেল হামিদ, পিএসপি"। যে জিনিসটা বলতে চাচ্ছি তা হলো তোমার লেখায় এই বইটার প্রভাব বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করলাম। কিছু কিছু জায়গাতে বইটা থেকে কপি পেস্টও মনে হল। আমাদের ইতিহাসে এই অংশটা কিছুটা ধোঁয়াশায় পূর্ণ এবং স্পর্শকাতর একটা সময় যার ব্যাপারে অনেক রকমের লেখা পাওয়া যায়। আমার ব্যাক্তিগত মত হলো শুধুমাত্র একজন লেখকের লেখা পড়ে এরকম একটা ব্যাপারে লেখালাখি কিছুটা বিতর্কের অবকাশ রাখে। আমি তোমার প্রয়াশকে সাধুবাদ জানাই, তবে সেইসাথে এটাওজানিয়ে রাখা আর কি। বেশি জ্ঞান দিয়ে ফেললাম ... 😉
ভাইয়া, এই বইটার প্রভাব বেশী আছে,সেটা ঠিক। তবে কপি পেস্ট,এটা মনে হয় ঠিক না। আর এই বইটাতে বেশ ভাল কিছু ক্ল্যু দেয়া আছে। এটা দরকারী। হ্যা তবে আপনার কথা ঠিক আছে যে আরো কয়েকটা বই থেকে দরকার। এই লেখাটাতে আমি আরো কয়েকটা রেফারেন্স এনেছি। এখানে মেজর ডালিমের ওয়েবসাইট আছে। কয়েকটা মার্কিন দলিল আছে। এগুলা আপনি তিনটি সেনা অভ্যুত্থান বইয়ে পাবেন না।
আর লেখা নিয়ে যে কোন মন্তব্য অবশ্যই ধন্যবাদ সহকারে গৃহীত হবে। আর ঐ সময়গুলা আসলেই অনেক ক্রিটিক্যাল ছিল এর জন্য সতর্কতার সাথে এগুতে হয়। ধন্যবাদ 🙂
হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি