স্বপ্নের দোষ

লেখার স্থান, কাল,পাত্র সবই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিলে গেলেও যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে লেখক দায়ী নয়।

কিছু একটা মাথার মধ্যে জটলা পেকে আছে হাযম সাহেবের, আস্বাভাবিক ভাবে ঘুম ভেঙ্গে গছে।বাইরে আলো ফুটতে শুরু করেছে কেবল।অনেক দিন ধরেই এই ভোর হওয়া দেখছেন, একটা সময় খুব ভাল লাগত। এখন আর ভাল লাগে না। ভাল লাগাটা চলে গেছে ’৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে। এর আগে পাকিস্তানের সূর্যোদয় দেখতেন তিনি, আহা কি পবিত্র সূর্য ছিল সেটা! ঘরের উপরে ফাঁকা দিয়ে সূর্যটা দেখতে পারবেন ইচ্ছে করেলে,কিন্তু দেখার তেমন ইচ্ছা নাই। এখনকার সূর্যটা অনেকটা হিন্দুয়ানী,ভারতের ষড়যন্ত্রের সূর্য মনে হয়। এতক্ষণে বুঝতে পারলেন শরীরের কোন একটা জায়গায় কোন ঝামেলা আছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকী বিষয়টা বুঝতে পারলেন। পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকতে চেয়েছিলেন একসময়,সেটা হয়ে উঠেনি। তাতে কি? মাঝে সাঝে তাই এদিক সেদিক মানচিত্র আঁকার অভ্যেসটা ধরে রেখেছেন তিনি। এইতো কিছুক্ষণ আগেই লুঙ্গিতে মানচিত্র আঁকা হয়ে গেছে! বেশী বড় না ছোট্ট জায়গা জুড়ে মানচিত্র। বয়স তো আর কম হল না!প্রোডাকশনের কথাও তো মাথায় রাখতে হয়।

কিছুক্ষণের মাঝেই চিন্তার সাগরে ডুবে গেলেন হাযম সাহেব। আহারে কি দিন ছিল! বাহুতে শক্তি ছিল, তেলের দামও কম ছিল, বল সাবান গুলোও ছিল কোমলতায় ভর্তি, আর ছিল বিহারী পল্লী! মেয়েগুলোকে দেখলেই মেশিনে চাবী মারতে মন চাইত! কত বিশাল জায়গা জুড়েই না সে সময়ের মানচিত্রগুলো বিস্তার লাভ করত! বিহারী পল্লীর হেনা মেয়েটার পেটের ভাঁজে কি যেন খুঁজে বেড়াতেন তিনি,মেয়ে না বলে মধ্যবয়স্কা মহিলা বলাই ভাল। এমন করে তাকিয়ে থাকত মধ্যবয়সী সেই মেয়েটা! আহা এদের শরীরের গঠনটাই আলাদা ছিল। তখন ছিল বাহুবলে চরিত্র সমুন্নত রাখার দিন! হাতের মধ্য দিয়েই যে কিভাবে সেই বিহারী মধ্যবয়স্কা এত জীবন্ত হয়ে উঠত সেটার কূল কিনারা পেতে না পেতেই একটা শান্ত শীতলতা অনুভব করে হাযম সাহেবের বাহু তার চরিত্র ঠিক রাখার কাজটি সঠিকভাবে সমাপ্ত করত। যদিও সেই চরিত্র বেশী দিন বাহুর বাহুডোরে সীমাবদ্ধ থাকে নি। কতজনের সাথে আবেগঘণ সময় কাটিয়েছেন এইতো কিছুদিন আগেও!!! আহা! তখন সবই ছিল। নিজস্ব পার্টি ছিল,পার্টির খরচে আলাদা একটা ফ্ল্যাট ছিল। পার্টির এক বড় নেতা আবার এযুগের আধুনিক ছেলেদের মত করে মেশিন চালাতে পারত।কাবিল লোক সে , সুন্দর করে হাযম সাহেবকে বিভিন্ন আধুনিক নিয়মের সাথে পরিচিত করে তুলেছিলেন অল্প কয়েকদিনেই।আহারে ছেলেটাও এখন তার মতই মেশিনে সেলফ স্টার্ট মারে! চোখ ভারী হয়ে আসে হাযম সাহেবের। ভারী চোখেই মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শরীরটা দুর্বল ঠেকছে, এই শরীরে আর কত?

কাল রাতের স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করছেন। গতবারের মত হলে তার দুঃখের সীমা থাকবে না।পাকিস্তানের একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে যে দোষময় স্বপ্নটা দেখেছিলেন। হাতে খুব হিট,চেহারাটাও মাশাল্লাহ, কোনদিন কথা হলে চোখে একটু কাজল দিতে বলতে হবে,আরেকটু টাইট ট্রাউজার পড়লেই ওকে “ক্লিওপেট্রার” মত লাগবে। মেয়েরা অনেকেই সুন্দর চেহারার ছেলেটাকে বিয়ে করার জন্য স্টেডিয়ামে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে রাখে। পারলে তিনিও একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে স্টেডিয়ামে যান! কখন যে তাকে ভাল লেগে যায় বুঝতে পারেন না হাযম সাহেব। ভালোলাগা আর ভালোবাসা তো এক না, এটা না বুঝেই কেন ছেলেটা শীতের ভোরে এমন কাজটি করল? খুব বিরক্ত মনে শীতের সকালে শাওয়ারের নীচে দাড়িয়েছিলেন তিনি। ছেলেটার কথা মনে করে তখন মন ভাল হয়ে গিয়েছিল তার, সুর করে গান গেয়েছিলেন, “ও শাম যখন তখন খেলো না খেলা এমন, ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না”।

এসব ভাবতে ভাবতেই শাওয়ারের নীচে এসে দাড়ালেন হাযম সাহেব,এখন মনে পড়ার কথা, বাংলা ছবিতে যেমন আঘাত পেলে স্মৃতিশক্তি ফিরে আসে,তেমনি তারও ঠান্ডা পানি গায়ে লাগলে স্বপ্ন মনে আসে। আবছা কিছু মনে পড়ছ। আরে এতো সেই হেনা! সবকিছু আগের মতই আছে,ভাঁজ গুলাও একেবারে সঠিক এঙ্গেল এবং গভীরতায় আছে, আরেকটু উপর দিকে উঠতেই মাথায় বজ্রপাত হতে থাকে । পার্টির ফ্ল্যাটে দুইজন,শুধুই একা রোমান্টিক হাযম সাহেব গান ধরেন, এখানে দুজনে নীরজনে সাজাব প্রেমেরো পৃথিবী।

আবছা আলোতে মেয়েটাকে সানী লিওনের মতই লাগছিল, টেবিলের উপর বসেছিল মেয়েটা, মাথায় শিফনের নীল ওড়না জড়ানো ছিল। সানী নাকি এখন অঙ্ক হিট! অথচ কয়েকদিন আগে ওকে কেউ চিনত না, তিনি অবশ্য জানতেন সানী প্রতিভাবান মেয়ে, একে দমায় রাখা যাবে না। ছাইয়ের ভিতর আগুন থাকলে সেটা বের হবেই, আর এ মেয়ে তো নিজেই একটা আগুন। নীল পর্দা জয় করে এখন সে রুপালী পর্দা জয় করতে নেমেছে। মেয়েটাকে একদিন ফ্ল্যাটে নেওয়ার খুব শখ ছিল, এ ব্যাপারে তার প্রিয় নেতার সাথে কথাও বলেছিলেন,যোগাযোগও হচ্ছিল, আর তিনি ওই নেতার কাছ থেকে নিয়মিত তালিম নিচ্ছিলেন, জং ধরা মেশিনটাকে ভালই সচল বানিয়েছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই। এর মধ্যেই তো শয়তান বাঙ্গালীরা তার স্বপ্নে ছাই ঢেলে দিল!

শীতের সকালের ঠান্ডা তাকে এখন আর স্পর্শ করছে না, রাতের স্বপ্নটা এখন পুরো মনে পড়ে গেছে তার, গতবারের মত আর খারাপ লাগা নেই,শুধুই ভাল লাগা। আস্তে আস্তে মন খারাপ হয়ে যায় এই বিশিষ্ট অধ্যাপকের, কেউ তার ভিতরের প্রেমিক হৃদয়টা দেখল না,শুধু বাইরের রাজাকারি হৃদয়টাই দেখল আর নিন্দা করে গেল! বন্ধ হয়ে যাওয়া মেশিন গরম করতে করতে কান্না জড়ানো কন্ঠে হাযম সাহেব গান ধরেন “দুঃখ আমার বাসর রাতের পালঙ্ক। নিন্দা আমার প্রেম উপহার সাত নড়ি হার কলঙ্ক”।

এসব ভাবতে ভাবতেই ভয়ঙ্কর কথাটা মনে পড়ে হাযম সাহেবের। পরশু তার ফাঁসির দিন।বাঙ্গালী তাকে বাঁচতে দিল না, ৭১ সালেই চেনা উচিৎ ছিল বাঙ্গালীদের,এরা ছেড়ে দেওয়ার জাত না। জেলার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,শেষ ইচ্ছার কথা, লজ্জায় বলতে পারেন নি। আজকে হেনাকে দেখে আবার সানী লিওনের কথাটা বারবার মাথায় আসছ। বলবেন নাকি? সানী লিওনের পিঠে তেল মাখানোর খুব খায়েস তার, “জিসম-২” তে নাকি এরকম একটা “সিন” আছে। বজ্জাত পরিচালক তার মনের কথা বুঝল ক্যামনে? নাকি মৃত্যুর পর অপেক্ষা করতে থাকবে ওর জন্য! নিশ্চয়ই তাদের দেখা হবে, কারন তার প্রেম সাচ্চা এবং পবিত্র। এর মধ্যে খবর পেয়েছেন, বাইরে নাকি মিষ্টি বিতরন চলছে, পুরানো,ছেড়া স্যান্ডেলগুলা নাকি এখন চড়া দামে বিক্রী হচ্ছে। লাশের উপর সেগুলা নাকি ছুড়ে মারা হবে। ফেইসবুকে বিভিন্ন ইভেন্ট বানানো হচ্ছে কি কি করা হবে সেদিন। বাঙ্গালী খুব নালায়েক জাতি, কচ্ছপের মত একবার কামড় দিলে আর ছাড়ে না, এইবারও ছাড়বে না।

হাযম সাহেবের চেহারায় আর সানী লিওন ভাসে না, ফাঁসির দড়ির একটা আবছা ছায়া ভাসছে। আজ থকে আর হেনাকে না এই দড়িটাকেই স্বপ্ন দেখতে হবে! শেষ স্বপ্নের দোষের পালা চুকিয়ে ফেলেছেন তিনি। আজ থেকে “ম্যানিলা রোপ” তার স্বপ্নে দোষ ঘটাবে। অধ্যাপক সাহেবের পাপমুক্তির দায়িত্ব দেয়া হইছে এই ম্যানিলা রোপকে। অন্যদিকে ঢাকা এখন ছেড়া জুতা-স্যান্ডেলের নগরী। সবাই জুতা সংগ্রহ ব্যস্ত।যেই রাস্তা দিয়ে হাযম সাহেবের লাশ যাবে সেখানে এখন থেকেই জুতা হাতে দাঁড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের “নালায়েক” জনতা।পরে জায়গা পাওয়া যাবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই!!!

১,২৯৬ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “স্বপ্নের দোষ”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    :)) :)) :))
    :(( :(( :((
    =)) =)) =))

    😀 😀 😀

    অনেক রকম আবেগের খেলা চলতেছে মনে।
    আরো অনেক ইমো লাগবে।
    আহারে নেক পুরুষরে নিয়া এইসব কি!!!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।