ক্লাস ফাইভে থাকতে স্কুলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহে দুইটা বই প্রাইজ পেয়েছিলাম।‘শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু’ আর ‘সায়রা সায়েন্টিস্ট’। দুপুরের দিকে বাসায় এসেই সঙ্গে সঙ্গে ‘শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু’ বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম। বই পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাবার মত অবস্থা হয়েছিল। বিকালে মা স্কুল থেকে আসলে দাদু মাকে বলেছিলেন, ‘ওর যেন কি হইছে, একা একা বারান্দায় বসে জোরে জোরে হাসতেছিল’। সেই শুরু। এর পরের দুই বছর পাগলের মত জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়তাম। স্যারের লেখা একটা নতুন বই হাতে পেলে আমার রীতিমত ক্ষুধা লাগার মত অনুভূতি হত। একটা বই থেকে বের করেছিলাম স্যারের তখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১০৩। আমরা তিন বন্ধু মিলে পাল্লা দিয়ে বই পড়তাম। লিস্ট করে রাখতাম। মনে আছে,৯১ টা পড়া হইছিল সিক্সে থাকা অবস্থাতেই। একটু বড় হবার পর অবশ্য ওনার সব বই আর পড়া হয় নাই। তবে ছোট বেলার সেই চমৎকার অনুভূতিগুলো জীবনেও ভোলার মত না। জী-ব-নে-ও না। ‘আমি তপু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ‘শান্তা পরিবার’, ‘বৃষ্টির ঠিকানা’, প্রজেক্ট নেবুলা পড়ে আমি রীতিমত কেঁদেছি। ‘মেকু কাহিনী’, ‘শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু’, ‘সায়রা সায়েন্টিস্ট’, ‘বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর’, ‘বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা’ পড়ে হাসতে হাসতে চোয়াল ব্যথা করেছি। ‘ক্রূগো’, ‘ফোবিয়ানের যাত্রী, ‘যারা বায়োবট’, ‘জলজ’, ‘সুহানের স্বপ্ন’, ‘ক্রোমিয়াম অরণ্য’, ‘মহাকাশে মহাত্রাস’, ‘অবনীল’ সহ সায়েন্স ফিকশানগুলো এক অর্থে গিলেছি। ‘দস্যি কজন’, ’টিরেক্সের সন্ধানে’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’,’হাত কাটা রবিন’ পড়ে মনে মনে কত এডভেঞ্চারের ছক কষেছি। আরো কত কত চমৎকার বই! এখনো প্রায় সবগুলো বইয়ের কাহিনী মনে আছে। কি সায়েন্স ফিকশান, কি কিশোর উপন্যাস, এমনকি ওনার কলাম ও! ম্যাথ অলিম্পিয়াডে ‘আমি তপু’ বইটাতে স্যারের অটোগ্রাফ নেবার সময় তো আবেগের বশে লিখেই দিয়েছিলাম ‘বইটা খুব সুন্দর হয়েছে’। স্যার ‘অনেক ধন্যবাদ’ লিখে দিয়েছিলেন উত্তরে! এই মানুষটার কাছে আমাদের অনেক ঋণ, অনেক।
আরেকটা সিরিজও রীতিমত গিলতাম। তিন গোয়েন্দা। ভলিউম ১ থেকে ৫৬ পর্যন্ত ( রকিব হাসানের লেখাগুলো!) ২/১ টা বাদে আর স-অ-ব আমার পড়া। একপাশে শুয়ে পড়তে পড়তে মাথার সেই পাশ ব্যথা হয়ে যেত। তারপর অন্য পাশ ফিরে আবার দ্বিগুণ উদ্যমে পড়া শুরু করতাম। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর সদস্য ছিলাম। ওখান থেকেই সাধারণত বেশির ভাগ বই নিতাম। তবে তিন গোয়েন্দার বেলায় আমার আলাদা বুক সাপ্লাইয়ার ছিল। অর্ণব। ওর বাসায় গাদাখানেক তিন গোয়েন্দা ছিল। সুন্দর মত একেকটা করে এনে পড়ে ফেলতাম। একটা তিন গোয়েন্দাও আমি কিনি নাই কোনদিন! এই ছেলেটার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিছু টাকা জমলেই ও বই কিনে ফেলত। বলত, “থাকলে শুধু শুধু শেষ হয়ে যাবে, তারচেয়ে বই কিনে ফেলি”। আমার বইপড়ার একেবারে শুরুর দিকে এর অবদান অনেক। এরকম বন্ধু পাওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। মনে আছে ক্লাস সিক্সের গরমের বন্ধে ৮ টা ভলিউম আর ১১ টা জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়েছিলাম। সাথে টিনিটিন, অ্যাসটেরিক্স এণ্ড ওবেলিক্স, শঙ্কু এই সব কমিক্স ও ছিল। সকালে ক্যাডেট কোচিং করে এসেই দুপুর পেরিয়ে বিকালে খেলতে যাবার আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময়ই পড়তাম। ওই গরমের বন্ধে আমি, আশিক, আর অর্ণব মিলে তো আরেকটু হলেই আশিকদের বাসার পাশের একটা বাড়ির রহস্য ভেদ করতে মাঠেই নেমে গিয়েছিলাম প্রায়। পালা করে বাড়িতে চোখ রাকাহার চিন্তাভাবনা যখন করতেছি তখন আবিষ্কার করেছিলাম বাস্তবে বাড়িতে কোন রহস্য নাই। আসলে এত এত গোয়েন্দার গল্প শুধু পড়ে আমাদের একটু প্রাকটিক্যাল করার ইচ্ছা হচ্ছিল আরকি। জোর করেই!
ক্যাডেট কোচিং করতে আমরা তিনজন পরিচিত এক রিকশায় করে প্রায় আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পড়তে যেতাম। রবিবার দুপুর ২ টার সময় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী বাসার সামনে আসতো, সেখান থেকে একটা টিনটিন কিংবা শঙ্কু টাইপের কমিক্সের বই নিয়ে রিকশাতেই তিনজন মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে পড়তে পড়তে যেতাম। আসার পথে আরো আধা ঘণ্টা মিলিয়ে এক ঘণ্টায় কমিক্সের বইটা শেষ হয়ে যেত। (২-১ বার কোচিং এ বসেও পড়েছি অবশ্য। বলা বাহুল্য, লুকিয়েই!) তারপর সাড়ে পাঁচটার দিকে কোচিং থেকে ফেরার পথেই বাসার থেকে খানিকটা দূরে থাকা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী থেকে একটা বড় বই নিতাম। ঐটা আবার বুধবারের আগে শেষ করে বৃহঃস্পতিবার আবার এক বন্ধুকে দিয়ে তাঁর বাসার ওখান থেকে আরেকটা বই নিতাম। কোন ছাড়াছাড়ি নাই। যত বই পড়ে পারা যেত আরকি! আরো ছোট থাকতে মা তাঁর স্কুলের লাইব্রেরি থেকে ছোটদের বই, কমিক্স এইসব এনে এনে দিতেন। চিল্ড্রেন নলেজ ব্যাঙ্ক তো পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থ হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছিল। ছোটদের মহাভারত ও ঐসময়ই পড়া। গল্পগুচ্ছের থেকে সুচীপত্র থেকে নাম দেখে যে গল্পটা পছন্দ হত সেটাই পড়তাম। আহা, কি আনন্দই না ছিল! দিদিকে ভারতে ডাক্তার দেখিয়ে আসার সময় আমার জন্য আনা উপহার ছিল একটা রূপকথা, আর একটা ভূতের বই। কতবার যে সেই বই দুইটা পড়েছি তা গুণে বলতে পারবো না। পড়তে পড়তে বই দুইটা ছিড়েই ফেলেছিলাম!! বাসায় পড়ার টাইমটুকু বাদে গল্পের বই পড়ার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। অনেক বন্ধুর বাবা-মা পড়তে দিতেননা। আমার খুব খারাপ লাগত তাদের কথা ভেবে।
নাইন-টেন,ইলেভেনের দিকে কলেজের লাইব্রেরী আর হাউজ লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে নিয়ে পড়তাম। তখন বেশি পড়েছি হেনরী রাইডার হ্যাগার্ড, হুমায়ূন আহমেদ, বাংলা আর অনুবাদ ক্ল্যাসিকগুলো। ড্যান ব্রাউনের বই পড়তাম। জীবনে পড়া অন্যতম অসাধারণ বই, ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’ ও কলেজে থাকতেই পড়া। দুপুরের রেস্ট টাইমটাতে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তাম। ক্যাডেট কলেজের অত রুটিনের মাঝে ওইসময়টা আমার অন্যতম পছন্দের নিজের সময় ছিল।সায়ীদ স্যারের বাবার নাকি পাঁচ দেয়ালের লাইব্রেরী রুম ছিল। এক দেয়াল ভর্তি বেশি বই। আমার স্বপ্ন আছে, অনেক অনেক বই ভর্তি আমার একটা রুম থাকবে। বইয়ের গন্ধে ভরা। ভাবতেই কেমন যেন প্রচণ্ড আনন্দ আর কিছুটা অস্থির লাগে। কবে যে হবে!
অনেক দিন পর জাফর ইকবাল স্যারের ‘রূপ-রূপালী’ বইটা হঠাত পড়ে ফেললাম। একটু ছোটবেলার বই আসলে। তবে বড়বেলায় এসে এই বই আমার ছোটবেলার বই সংক্রান্ত সমস্ত স্মৃতি একেবারে হঠাত করে উসকে দিল। তাই মনের আনন্দে লিখে ফেললাম। অহেতুক ব্যস্ততার এই বড়বেলায় এইসব চমৎকার স্মৃতিগুলো অনেক বেশি আনন্দ দেয়। ভাবতে ভাল লাগায়। বই পড়ার আসল মজা তো ভাবনাতেই।
প্রায় সময়ই এই সাইটে আসি।পোষ্টগুলো পড়ি।খুব ভালো
লাগে।এই গল্পটা পড়ার পর বই পড়ার আগ্রহটা বেড়ে গেল।ধন্যবাদ।
তোমার বই প্রীতির কথা জেনে আমি নিজেও অসম্ভব প্রীত হ'লাম। আমার বড় ছেলেও মস্ত এক বইএর পোকা। বই এর চেয়ে উত্তম আর বিশ্বস্ত সঙ্গী আর কিছু হতে পারেনা। পড়ার সাথে সাথে লেখালেখির কাজটাও যথাসম্ভব চালিয়ে যেও।
ধন্যবাদ ভাইয়া 😀
আগে পড়তেই থাকি, ১ লাইন লিখতে গেলে ১০০ লাইন পড়া উচিত!
যোগ্যতা হলে হবে খন 🙂
মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...
আমার বই পড়ার শুরু সম্ভবত ঠাকুরমার ঝুলির হাত ধরে। তারপর ক্লাস থ্রি তে থাকতে চাচা চৌধুরির খোঁজ পেলাম বন্ধুর হাত ধরে, সেই একই ক্লাস এ থাকতে তিনগোয়েন্দার সাথেও পরিচয় হলো "বিষের ভয়" এর মাধ্যমে। এরপর সামনে এমন চমৎকার একটা দরজা খুলে গেল আমার পুরো স্কুলজীবনই তারপর বইয়ের গন্ধে মাখানো। জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম স্মৃতিগুলোও বেশিরভাগ বই পড়া ঘিরেই।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
আমার ও ভাই। ছোট জীবনে অল্প যা কিছু অর্জন তার অনেকটাই বই এর কল্যাণে 😀
মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...
ছোটবেলায় পড়া বই এখন পড়লে ভিন্ন স্বাদ যেমন পাই, তেমনি স্মৃতিরাও হাজির হয় অতর্কিতে।
রঙ বদলায় 🙂
মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...