‘লুয়াং প্রেবাং’ – বিলীয়মান নান্দনিক ইতিহাস, তৃতীয় পর্ব

‘লুয়াং প্রেবাং’ – বিলীয়মান নান্দনিক ইতিহাস

 

তৃতীয় পর্ব

 

ভ্রমণ যাত্রা

 

“পর্তুগালের কোনো বন্দর থেকে জাহাজটা ছেড়ে ছিল। ষোল শতকের
এক দুপুরে। জাহাজে কয়জন নাবিক ছিল তা জানা যায় নি। তবে
সেখানে একুশটা চোর, সাতটা দস্যু, তেরটা ভবঘুরে আর একজন
কবি ছিল। তাদের কারো গন্তব্য ম্যানিলা। কারো মাদাগাস্কার।
সবশেষে জাহাজটা সন্দ্বীপ বা মংলা পৌঁছবে এমন কথা ছিল।
কোথাও পৌঁছানোর আগে জাহাজটা আমার মগজের মধ্যে ডুবে গেছে”।- ইমতিয়াজ মাহমুদ

 

ভ্রমন বিষয়ে আমার নিজস্ব একটা দর্শন বা মতামত আছে। আমার মতে প্রকৃত ভ্রমণ তখনই শুরু হয় যখন আপনি হারিয়ে গেছেন, কিন্তু আপনি জানেন না আপনার হারিয়ে যাবার কথা! কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও কথাটা আমার কাছে সত্য!

 

ছোটবেলায় আমি একজন নির্জন প্রকৃতির বালক ছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের ‘বলাই’ এর মতন। বাড়িতে আমার সমবয়সী কোন সঙ্গী ছিলোনা। বাড়ির পাশের প্রায়ান্ধকার জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে মাটি ফুঁড়ে কোন নতুন চারাগাছ গজাচ্ছে কিনা অথবা টুনটুনি পাখির বাসায় তার বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করাই ছিল আমার প্রধানতম কাজ। চারাগাছগুলোকে আমি তুলে এনে ঘরের জানালার সামনের সূর্যালোকিত মাটিতে লাগিয়ে দিতাম। প্রানান্তকর পরিচর্যা করতাম। বেশির ভাগ চারাই মরে যেত সূর্যের প্রখর উত্তাপে। তবুও আমার আগ্রহের কমতি ছিল না। একের পর এক লাগিয়ে যেতাম!

 

বাড়ি আর বাসার ভেতরের পার্থক্য বিস্তর। আমাদের বাড়ির বিস্তৃতি ছিল অনেক দূর পর্যন্ত। রাতের বেলায় তিন মাইল দুরের বালিজুরি বাজারের ভাঙ্গা হাঁটের মতন। হাঁট যতক্ষণ চলতো, ততোক্ষণ হাঁটের আয়তন থাকতো ছোট। নির্দিষ্ট এলাকার ভেতরে বেচাকেনা চলতো। শব্দেরা গমগম করতে থাকতো। কিন্তু রাতের বেলায় হাঁট যখনই ভেঙ্গে যেতো, তারপর থেকে হাঁটের  আয়তন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকতো। কারণ যে গমগম শব্দ একটা নির্দিষ্ট পরিধির ভেতরে ব্যাপ্ত ছিল তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তো চারদিকে। মনে হতো হাঁট ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই বিস্তৃতি চলতে থাকতো   সবাই বাড়ি ফেরা পর্যন্ত। বাড়িও তেমনি! আমাদের বাড়িটা বিস্তৃত ছিল অন্দরবাড়ি-সদরবাড়ি ছাড়িয়ে পুবের কাছারি ঘর, বাড়ির চারপাশের পগার বা পুকুর, বাড়ির পেছনের বিশাল বাঁশঝাড়, একটু দুরের কামারের ভিটা, বাড়ির দক্ষিণের পদ্মবিল, বাড়ির উত্তরের পদ্মবিল- সবকিছু পর্যন্ত। এই সীমানার ভেতরে  যতক্ষন আছেন ততোক্ষণ আপনি নিরাপদ। আপনার হারিয়ে যাবার কোন অবকাশই নেই। কিন্তু বাসার বিস্তৃতি শুধুমাত্র চতুষ্কোণ চারদেয়ালের মধ্যে সীমিত। পাশের বাসায় কে আছে তাও আমরা অনেক সময়েই জানিনা। এই পার্থক্য জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারণে ছোটবেলায় আমি একবার জামালপুর শহরে আমার জেঠার বাসাকে বাড়ি মনে করে  হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। অতঃপর সেখান থেকে আরও অনেক জায়গায়। সারাটা দুপুর আর বিকেল বিমল আনন্দের মধ্যে কেটেছিল আমার। কিন্তু সন্ধ্যের কিছু পূর্বে আমার জেঠা আমাকে আবিস্কার করেছিলেন ‘বকুলতলা’য় ঘোরাফেরা করতে,আমাকে কান ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাসায়! বাসায় ফিরে সবার উৎকণ্ঠা থেকে বুঝেছিলাম যে দুপুরের পর থেকে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গিয়েছিলো। এই সময়টাতেই আমি বাড়ি ও বাসার পার্থক্য বোঝার সমান্তরালে প্রকৃত ভ্রমণের অর্থ বুঝেছিলাম!

 

কম্বোডিয়াতে আমি জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক। জীবনে আমার প্রথম বিদেশ গমন। কম্বোডিয়া থেকে লাওসে আগমন। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়ে এটাই আমার প্রথম ভ্রমন। বিদেশ-বিভূঁইয়ে। একাকী। আমি চাইলেই প্রকৃত ভ্রমণের স্বাদ গ্রহন করতে পারি!

 

রাতে দোকানে বাইসাইকেল জমা দিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি। রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে। রেস্টুরেন্টের একধারে বিশাল একটা ডান্স ফ্লোর। মাথার ওপরের গ্লোবের মতন ত্রিমাত্রিক ঘূর্ণায়মান বল। সেখান থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।ক্যালিডোস্কোপ থেকে সৃষ্ট বর্ণিল সপ্ত রঙা আলোর মতন।  অপার্থিব পরিবেশ।  লাওসের ভাষায় গান গাচ্ছে। সুরটা আমার পরিচিত। কম্বোডিয়ায় আমাদের দলের দোভাষী নারার কন্ঠে আমি এ ঘরানার গান অনেক শুনেছি। মন খারাপ থাকলেই সে গান করে। গিটার বাজায়। নারা চমৎকার গিটার বাজাতে পারে। কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ে সে থাইল্যান্ডের এক শরণার্থী শিবিরে থাকতো। জীবিকার জন্যে থাইল্যান্ডের ‘পাব’গুলোতে প্রতিনিয়ত গিটার বাজিয়ে গান গাইতে হতো তাকে! আমি নারাকে একবার বললাম আমাকে গিটার বাজানো শিখাতে। নারা প্রবল আগ্রহে আমাকে তালিম দেয়া শুরু করলো। আমাদের মালয়েশিয়ান টিম ক্যাপ্টেন কর্নেল পাক ওয়ান ভীষণ বিরক্ত। আমিও কয়েকদিনেই  বুঝে গেলাম গান পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং শুদ্ধ শিল্পের অন্তর্গত। আমার মতন মানুষের জন্যে নয়!

 

আমার পাশের টেবিলে দুই তরুণ তরুণী। গায়ের রঙ হরিদ্রাভ।  যে কোন মঙ্গোলিয়ানের গায়ের রঙ যা হয়। আমার দিকে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তোবা আমার শরীরের নিবিড়  গাঢ় রঙ তাদেরকে আকৃষ্ট করে থাকতে পারে! যেমনটা আমরা হয়ে থাকি সাদা চামড়ার মানুষদের দেখলে। আমি ডিনার শেষ করতেই তরুণতরুণী দুজনেই  আমার পাশে এসে বসলো।  ছেলেটাই প্রথম হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘হ্যালো’ বলে। জিজ্ঞেস করল, “কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি?” আমি বাংলাদেশের নাম বলতেই ভীষণ অবাক। চিনতেই পারল না। আমি পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার নাম বলতেই দুজনের চোখেই উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি খেলে গেল। সংগের মেয়েটা আমাকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো আমি শ্রীদেবী অথবা হেমা মালিনীকে চিনি কিনা। বোম্বের এই দুই নায়িকা কম্বোডিয়াতেও ভীষণ জনপ্রিয়।আমার কর্মস্থল THALA BARIVAT–এ ছোট্ট একটা টিনের ছাদ  ও কাঠের দেয়ালের তৈরি সিনেমা হল আছে। সন্ধ্যার পর দুই তিনটা শো হয়। একবার ‘শোলে’ ছবির বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের দলের দোভাষী নারাকে নিয়ে আমি ঢুকেছিলাম। কিছুক্ষণের জন্যে। কম্বোডিয়ার ‘খেমার’ ভাষায় ডাবিং করা চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে ১০ মিনিটেই কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। এই সিনেমা হলটা এমন একটা জায়গা যেখানে দলমত নির্বিশেষে সকল কম্বোডিয়ানরাই মিলিত হয়। হিন্দি, থাই অথবা হংকং এর মারপিটের ছবি দ্যাখে! আনন্দে উদ্বেলিত হয়। এই সময়ে আপনার কখনোই মনেই হবে না যে, এই দেশ দীর্ঘদিন যাবত গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়ে আছে! পলপট নামের একজন গণহত্যার মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে!
ছেলেটা মেয়েটিকে পরিচয় করিয়ে দিল, “আমার বান্ধবী। নাম …। তুমি কি একা এসেছ?” আমি মাথা নাড়তেই দুজনেই একসাথে হেসে দিল। পাশ থেকে এক বর্ষীয়সী একজন লাওসের নাগরিক আমাদের কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, “ইউ শ্যুড নট ট্রাভেল এলোন! ইফ এনিথিং হ্যাপেনস টু ইউ, ইওর প্যারেন্টস উইল নেভার নো এবাউট ইট!” অপরিচিত মানুষের প্রতি তার  মায়া দেখে আমি বিমুগ্ধ! এই যুগলই আমাকে জানালো যে, ভিয়েনতিয়েনের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর শহর লুয়াং প্রেবাং। লাওসের পুরনো রাজধানী। হাজার বছরের পুরনো শহর। অসংখ্য মন্দির এবং প্রায় ৬০০’র বেশি পুরনো স্থাপত্য রয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়নাভিরাম। পর্যটকরা এই শহরকে ‘দুনিয়ার স্বর্গ’ বলে ডাকে! আমি শখের পর্যটক! তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম লুয়াং প্রেবাং-এ যাবো!

 

লুয়াং প্রেবাং যেতে বিশেষ পাস বা অনুমতির প্রয়োজন হয়। একই দেশের মধ্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে ছাড়পত্র বা অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে পারে এটা আমার ধারনায় ছিলনা। পরদিন সকাল বেলায় আমি সোজা চলে গেলাম ফরেন মিনিস্ট্রিতে। এক যুবক আনন্দিতভাবে আমাকে অভ্যর্থনা করল। আমি কম্বোডিয়ায় শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত আছি শুনে খুব খুশি। যুবককে ‘লুয়াং প্রেবাং’ যাবার কথা বলতেই সে আমাকে বলল, “তোমার পাসপোর্টটা রেখে যাও। আমি অনুমতি নিয়ে রাখবো। আগামিকাল সকাল ৯ টায় এসে নিয়ে যেয়ো’।

 

আমি যুগপৎ ভাবে বিস্মিত এবং শঙ্কিত! বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে অপরিচিত কাউকে পাসপোর্ট দেবার পর আর যদি ফেরৎ না পাই? তবে আমার কি হবে? তবুও সাহস করে তার কাছে পাসপোর্ট রেখে হোটেলে প্রত্যাবর্তন পূর্বক বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে শুরু করলাম।  দুই ডলারের বিনিময়ে সারাদিনের জন্যে বাইসাইকেল ভাড়া দেবার বিষয়টি আমাকে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করলো। পরের দিন নয়টার অনেক আগেই ফরেন মিনিস্ট্রিতে পৌঁছে গেলাম। তার কক্ষে ঢুকতেই  সে হাসিমুখে আমাকে পাসপোর্ট হাতে দিলো। গমনের অনুমতিসহ!

 

ভিয়েনতিয়েন থেকে লুয়াং প্রেবাং। প্লেনে করে মাত্র ৩০ মিনিটের জার্নি। ক্ষুদ্র, স্নিগ্ধ একটা এয়ারপোর্ট। আমাদের ঢাকার পুরাতন বিমানবন্দরের মতন। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই লুয়াং প্রেবাং শহর। শহরের এক প্রান্তে মেকং ও নামকান নদী দু’টি যুগল সরীসৃপের মিথুন রেখার মতো মিলিত হয়েছে। সঙ্গমস্থলের উপর বেলাশেষের সূর্য অসম্ভব রক্তিম! আমি চারপাশের শহরের দিকে তাকাই। নারিকেল বীথির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট ফরাসি ধাঁচের বাংলো ধরণের বাড়িগুলি। মন্দির ও প্রাসাদের শীর্ষে তামার ছত্রীগুলোতে শেষ বেলাকার সুর্য্যের আলো ঝিকমিক করছে। আমার মন ভীষণ ভাল হয়ে গেলো!

 

(চলবে…)

৫,৩৬৩ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।