‘লুয়াং প্রেবাং’ – বিলীয়মান নান্দনিক ইতিহাস
দ্বিতীয় পর্ব
চন্দন গাছের শহরে বাইসাইকেল আরোহী
“Where I went in my travels, it’s impossible for me to recall. I remember the sights and sounds and smells clearly enough, but the names of the towns are gone, as well as any sense of the order in which I traveled from place to place.”- Haruki Murakami, Norwegian Wood
প্রিয় পাঠক, একটা কথা না বললেই নয়! নতুবা সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। আমি লাওস ভ্রমণে গিয়েছিলাম বর্তমান থেকে দুই যুগ পূর্বে। এই সময়কালে এক লক্ষাধিক বার নিজ অক্ষের ওপরে পৃথিবীর আহ্নিক গতি সম্পাদিত হয়েছে। আট সহস্রাধিকবার পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে এসেছে। যেহেতু দিনপঞ্জি লেখার অভ্যেস আমার কস্মিনকালেও ছিলোনা এবং যেহেতু বিষয়টা নিয়ে ভবিষ্যতে আমি লিখতে পারি এমন চিন্তাও আমার কখনোই ছিলোনা, সেহেতু বিস্মৃতি আমাকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করছে! শত চেষ্টা করেও আমি মেকং এর যে স্থানটা দিয়ে নৌকায় করে আমি থাইল্যান্ড এবং লাওসের মধ্যবর্তী মেকং নদী অতিক্রম করেছিলাম তা বের করতে পারছি না। শুধু মনে আছে নদীর দুই পাড়ই ছিল যথেষ্ট খাঁড়া। আমার শৈশবের ঝাড়কাটা নদীর খাঁড়া পাড়ের মতন। এই নদীতে আমি শরত, হেমন্ত এবং শীতকালে আমি প্রতিনিয়ত নদীর তলদেশ থেকে থেকে ৬০ ডিগ্রি কোণে ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা করতাম। ধনুক থেকে তীর ছোড়ার মতন তীব্র গতিতে। মুহূর্তের ভেতরে বিনা ক্লেশে নদীর তলদেশ থেকে পাড়ে ওঠে পড়তাম। কারণ শিশুরা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব মুক্ত! আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে জানি। নদীর অপর পাড়ের ঠিক ওপরে ছিল আমার ফুপুর বাড়ি। বিমল আনন্দের এক স্থান। স্বর্গের মতন। এখন নাই। কয়লাকান্দি চর যমুনার গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান শতকের প্রথম বছরে। জায়গাটা এখন স্মৃতিহীন ধূধূ বালুচর!
মেকং খাঁড়া পাড় বেয়ে অপর তীরে উঠতেই স্কাইলাইনের ওপরে ৪ জন বাঙালি যুবক। সবাই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ। ঠিক আমার মতন। এরাই বাংলাদেশের প্রথম জেনারেশন যারা চাকুরি করার জন্যে সীমান্ত পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। গন্তব্য মধ্য প্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ দেশ মালা। ১৯৭৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি। অতঃপর এই গন্তব্য ক্রমশ বিস্তৃত হয় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দাঁড়িয়ে আছে এদের ওপরে ভর করে। এদের কর্তৃক উপার্জিত বিদেশিক মুদ্রার ওপরে। কিন্তু বিদেশে এদের অনেকেই যে কি অমানবিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় তা আমরা অনেকেই জানিনা। ভিনদেশের সামাজিক এবং মানবিক অনেক অধিকার থেকেই বঞ্চিত তারা। যুবক ৪ জনের সবাই ব্যাঙ্ককে চাকুরি করে। শ্রমজীবীর ভিসা নিয়ে। ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পূর্বেই বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার কথা তাদের। অতঃপর পুনরায় ভিসা নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাবার কথা। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। এতে খরচ অনেক বেশি। যুবকদের উপার্জিত অর্থে তা খুবই দুষ্কর। একবার দেশে ফিরে গেলে হয়তোবা আর আসাই হবেনা। সুতরাং ভিসার মেয়াদ শেষ হবার অব্যবহিত পূর্বে এরা পার্শ্ববর্তী লাওস বা ভিয়েতনামে ঢুকে পড়ে। অতঃপর তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে সেখান থেকে পুনরায় থাইল্যান্ডের ভিসা সংগ্রহ করে। অন্তত পরবর্তী মাস তাদের কোন পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হবে না। থাইল্যান্ডের পুলিশ ভীষণ শক্তিধর। রয়্যাল থাই পুলিশ। সবাই ভয় পায় তাদের। যুবকেরাই আমাকে বলে দেয় কিভাবে ভিয়েনতিয়েনে যেতে হবে। কোথায় থাকার জায়গা পাওয়া যাবে। আমি নিজেও বিখ্যাত কোন হোটেলে উঠতে আগ্রহী নই। কারণ জীবনকে কাছ থেকে দেখতেই আমি আগ্রহী। বার্ডস আই ভিউ নয়। একটা টুকটুক ভাড়া করে আমি ভিয়েনতিয়েনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। মাত্র কয়েক ক্রোশ দূরে।
ভিয়েনতিয়েন। লাওসের রাজধানী। ১৫৬৩ সন থেকে লাওসের রাজধানী। ১৮৮৭ সালে থাইল্যান্ড অর্থাৎ শ্যামদেশ আক্রমণ করে ধূলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল এই শহরকে। তৎ পরবর্তীতে লাওস ফ্রান্সের উপনিবেশ হয়ে যায়। এই সময়েও ভিয়েন্তিয়েন লাওসের প্রশাসনিক রাজধানী ছিল। লাওস ভাষায় ‘ভিয়েনতিয়েন’ অর্থ ‘চন্দন গাছের শহর’। প্রাচীনকালে নাকি এই শহরে প্রচুর চন্দন কাঠের গাছ ছিল। আমি অবশ্য শহরের ভেতরে কোন চন্দন গাছ দেখিনি। তবে কিছুদূর পর পর নান্দনিক সৌন্দর্যের বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা ছাড়া। প্রতিটি মন্দিরেই ধূপ জ্বলে সকাল সন্ধ্যা। এর গন্ধে মধুময় হয়ে থাকে সকাল-বিকাল। লাইনবদ্ধ শিশু মঙ্কদের গমনাগমন আপনার চোখে মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দেবে। একটা শান্ত সমাহিত ভাব চারদিকে।
উজ্জ্বলতায় ব্যাংককের তুলনায় বিবর্ণ হলেও ভীষণ মায়াবী নগর ভিয়েনতিয়েন। আমাদের দেশের মংলা নদী বন্দরের মতন বন্দর শহর। শহরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে মেকং নদী। উত্তর-পশ্চিম হতে কাস্তের মতন বেঁকে দক্ষিন-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ছে। দূর থেকে চাঁদের মতো মনে হয়। ভিয়েনতিয়েনের আরেক নাম তাই ‘চাঁদ শহর’। চাঁদ শহর নামটা ভাবতেই আমার চাঁদ সদাগরের কথা মনে পড়ে যায়। বেহুলা-লখিন্দরের কথা। মহাস্থান গড়ের কথা। পাহাড়পুর আর শালবনের বৌদ্ধবিহারের কথা। মানবিক এই সভ্যতা কতভাবেই না এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বিস্তার লাভ করেছিলো। লুম্বিনিতে জন্ম নেওয়া গৌতম বুদ্ধের চিরন্তন শান্তির বানী সহকারে। সর্বত্র।
নিরুত্তাপ, শান্ত শহর। ভিয়েন তিয়েন। নগরে প্রবেশের পর প্রথমেই আপনার দৃষ্টিতে আসবে বিশাল নান্দনিক প্রবেশ তোরণ। ১৯৬০ এর দশকে এই তোরণ গড়ে তোলা হয়েছিল । এটি শহরের একটি দারুণ জনপ্রিয় ও বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। লাওসের মানুষ বিদেশি ঔপনিবেশিকদের আগ্রাসন প্রতিরোধ করে মুক্তি অর্জন করেছিল। সেই সংগ্রামের স্মৃতি রক্ষার্থেই এ স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়। এর উচ্চতা ৪৫ মিটার, বিস্তার ২৪ মিটার। দূর থেকে দেখলে একে দিল্লির বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়া গেইট’ এর মতন মনে হয়। একটা বিশাল প্রশস্ত এভিন্যুর শেষ প্রান্তে এর অবস্থান। হাজার হাজার নারীপুরুষ সাইকেল অথবা মোটর সাইকেলে করে চলাফেরা করছে। পরে জানতে পেলাম আমেরিকার টাকা দিয়ে এখানে একটা বিমানবন্দর করার কথা ছিল। কিন্তু লাওস সরকার বিমানবন্দরের পরিবর্তে এই তোরণটি তৈরি করে।
শহরের অধিবাসীরা প্রায় সবাই সাইকেলে অথবা মোটর সাইকেলে চলাফেরা করে। হোটেলের এক ছেলের কথা অনুযায়ী আমি ভিয়েন্তিয়েন শহরের একটা ম্যাপ সংগ্রহ করলাম। অতঃপর একটা সাইকেলের দোকান থেকে দুই ডলার দিয়ে সারাদিনের জন্য সাইকেল ভাড়া করলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম এ কারণে যে, মাত্র দুই ডলারের বিনিময়ে আমাকে ওরা সাইকেলটা দিয়ে দিল। একবারও সন্দেহ প্রকাশ করলো না আমি সাইকেলটা নিয়ে আদৌ ফেরত আসব কিনা!
কম্বোডিয়াতেও আমি একই বিষয় লক্ষ্য করেছি। মানুষের ওপরে প্রবল বিশ্বাস। THALA BARIVAT। আমার এই কর্মস্থল মেকং নদীর পাড় ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। একটা মাটির রাস্তা নদীর সমান্তরালে বয়ে গেছে। এই রাস্তার ওপরে কিছুদূর পর পর কাঠের তৈরি টঙের ওপরে ছোট্ট দোকান। প্রতিটা দোকানেই একটা করে হাড়ি অথবা কাঁচের জার রাখা আছে। হাড়ি বা জারের ভেতরে ‘রাইস ওয়াইন’ কম্বোডিয়ার দেশি মদ। হয়তোবা বাংলাদেশি কেরু মদের মতন। পাশে চায়ের কাপের আয়তনের একটা খালি গ্লাস। মজার ব্যাপার হল দোকানের ভেতরে কোন বিক্রেতা নেই, যাদের অধিকাংশই নারী। তারা বেশীরভাগ সময়েই অবস্থান করে তাদের বাড়ির কুটিরে। সারা দিনমান ধরে পথচারীরা রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে নিজেরাই গ্লাস ভর্তি করে এই সুধা পান করে। অতঃপর একটা কাঠের বা টিনের খোলা বাক্সের ভেতরে মুল্য পরিশোধ করে চলে যায়। গোধূলির পূর্বেই পুরো দেশ মাতাল!
পরবর্তী কয়েকদিনে আমি ভিয়েনতিয়েনের সাইকেল আরোহীদের ভিড়ে মিশে গেলাম। পর্যটকের কোন দৃষ্টিই আমার ভেতরে নেই। নিতান্তই গ্রাম্য যুবকের দৃষ্টি দিয়ে আমি তখনো পৃথিবীকে দেখি। বিখ্যাত স্থান দর্শনের কোন মোহই আমার ভেতরে জন্মায়নি। সারাদিন আমি সাইকেলে করে পই পই করে ঘুরে বেড়াই।ভবঘুরের মতন যে কোন জায়গায় থামি। পথের পাশের লোকজনের সাথে গল্প করি। সবাই বন্ধু প্রবণ। শহর জুড়ে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির। মঙ্ক দিয়ে গিজগিজ করছে। রমরমে অতিথিশালা।নাম ‘বানপাক’। বৌদ্ধ মন্দিরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। অতিথিশালায় ঢুকে দেখি কৃত্তিম উজ্জ্বল আলোর ভেতরে যুবক–যুবতীরা নাচছে। একটু দূরে আমার পূর্ব পরিচিত মেকং। তীরের পাথর গুলোর ওপরে ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ ভেঙে পড়ছে। চাঁদের আলোর ভেতরে ভিয়েনতিয়েনকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়। রাত গভীর হবার পূর্বেই আমি সাইকেলের দোকানে সাইকেল জমা দিয়ে দেই।
অতঃপর ঘরে ফিরে নিরালা নিঝঝুম অন্ধকার!