“জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুনাধারায় এসো”
অবশেষে আজ থেকে তিনদিন পূর্বে আমি সারাজীবনের মতন ধূমপান পরিত্যাগ করলাম!
বর্তমান থেকে ঠিক তিন দশক পূর্বে কোন এক আনন্দিত প্রত্যুষে সিগারেট নামক আপাত নির্দোষ ধুমায়িত বস্তুটির সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয় হয়। আমি তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন স্বাধীন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। অতঃপর এতটা বছর আমাদের পরস্পরের হাত ধরে চলা। কখনো সমতল, কখনো বন্ধুর পথে! সম্পর্কের এই জীবন কখনোসখনো ক্ষীণ হয়ে আসলেও একেবারে শুকিয়ে যায়নি কখনও!
প্রথম বাঁধা আসে আমার বিবাহের অব্যবহিত পর। আমার নববিবাহিতা স্ত্রীর নিকট থেকে। আমার ব্যক্তিগত ধারনা ছিল যে, হাসব্যান্ডদের ন্যুনতম একটা-দুটো ত্রুটি থাকা আসলেই অত্যাবশ্যক! কারন এগুলোর অনুপস্থিতিতে তাদেরকে শোধরানোর কোন অবকাশই তাদের স্ত্রীদের থাকেনা। যা পৃথিবীর সমগ্র নারীকুলের জন্যে আসলেই হতাশাব্যঞ্জক। কাজেই আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, “দ্যাখো, আমরা সবে সংসার শুরু করেছি। পরস্পরের সাথে কথা বলার জন্যে আমাদের অনেক অনেক নতুন বিষয়ের সৃষ্টি হবে। কাজেই সিগারেটের মতন নির্দোষ, নিষ্প্রাণ এবং বায়বীয় বস্তু নিয়ে কেনই বা আমরা পরস্পর ক্লান্ত হবো?” কিন্তু স্ত্রী কনভিন্সড নয়। আমাকে জানাল তার সারাজীবনের একটাই সাধ ছিল যে তার স্বামী হবে এমন একজন যে কখনই ভুসভুস করে সিগারেটের ধুঁয়া ছেঁড়ে মিটারগেজ লাইনের রেলগাড়ির কয়লার ইঞ্জিনের মতন পরিবেশ বিনষ্ট করবেনা। কাজেই সিগারেট আমাকে ছাড়তেই ছাড়তেই হবে এবং সেটা অতিসত্বরই!
এরপর থেকে প্রতিবছর আমরা হুদাইবিয়া ধরনের সন্ধির মধ্যে পরস্পরকে আবদ্ধ করতাম। শর্ত থাকতো আমি পবিত্র রমযান মাসে আমাকে ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। কারন এই সময়ে দীর্ঘ একমাস কালের জন্যে শয়তানরা শৃঙ্খলিত অবস্থায় থাকে। এভাবে সন্ধি করতে করতে কিভাবে আমার বিবাহের পর আরও দুই দশক সময় পার হয়ে গেছে তা আমরা দু’জনে নিজেরাও বুঝতে পারিনি!
সমস্যাটা প্রকট হয়েছিল বিগত রমযানের পর থেকে। আমার স্ত্রী এবং ছোট মেয়ে অন্তর্জাল থেকে ডাউন লোড করে সিগারেট প্রসূত কর্কট (ক্যান্সার) রোগের ভয়ানক সব চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে লেগে গেল। এগুলোর প্রদর্শন আমার ভেতরে কবি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র ইনফারনো (INFERNO) এবং পার্গেটরি(PURGATORY) দুটো অধ্যায়ের নরক যন্ত্রণা দৃশ্যমান করতে সমর্থ হলেও আমার জন্যে তা সহ্য সীমার ভেতরেই ছিল! কারন আমি নিয়তিবাদে বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টার আদেশের এক সেকেন্ড আগে বা পরে আমার প্রস্থান হবেনা। কিন্তু সীমারেখার বাইরে চলে গেলো শুধুমাত্র অতিসাম্প্রতিক অতীতে যখন আমার স্ত্রী আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সকল আলাপ আলোচনার মধ্যে আমার ধূমপানের বিষয়টাকে পর্যালোচনার আইটেম হিশেবে অন্তর্ভুক্ত করতে থাকল। পরিশেষে ফলাফলটা দাঁড়ালো এই যে, যে কোন আলাপচারিতায় আমরা শুধু ধূমপানের বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে সমর্থ হই; আমাদের পারিবারিক বা জাগতিক আর কোন বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলার অবকাশ থাকেনা। সময়ের সল্পতার জন্যে। অথচ প্রতিদিন সকালে সূর্য্যিমামা জাগার কিছুক্ষন পরেই ছোট মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমাকে ছুটতে হয় অফিসের দিকে। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা, নয়টা। যখন ফিরে আসি তখন “নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার” !
কাজেই আজ থেকে তিন দিন পূর্বে আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আমার সুদীর্ঘ তিরিশ বছরের সঙ্গীকে বিদায় জানালাম। গতকাল আমার ছেলেবেলার ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের সাথে স্ব-পরিবারে আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে। এখন তো আবার যে কোন হোটেলে মিলিত হওয়া নিরাপদ নয়! এখানেও আমি বন্ধুদের সিগারেট পানের নিবিড় অনুরোধকে উপেক্ষা করেছি। আমার স্ত্রী ভীষণ খুশি। আমাকে সে আনন্দিতভাবে জিগ্যেস করেছে আমি এতদিন পর সিগারেট ছাড়লাম কোন যুক্তিতে? আমি তাকে সত্য কথাই বলেছি যে, তার কর্তৃক সিগারেট সম্পর্কিত বিষয়ের ঘন ঘন অবতারণাই আমার সিগারেট ছাড়ার একমাত্র কারন। সিগারেটের প্রতি কোন বিদ্বেষ প্রসূত হয়ে নয়! আমার বড় মেয়ে এটা শুনে নীরব থেকেছে এবং ঈষৎ হাসি দিয়ে তার নিজ কক্ষে চলে গেছে। আমার বাসার কাজের ছুটা বুয়া আমার স্ত্রীকে বলেছে যে, আমি হয়তো বাস্তবে সিগারেট খাওয়া ছাড়বনা; বাসার বাইরে লুকিয়ে লুকিয়ে খাব। শুধুমাত্র আমার ছোট মেয়ে বুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে আমি লুকিয়ে সিগারেট খাব শুনে। তার বিশ্বাস নিথ্যা বলে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার মতন মানুষ আমি না। তবে আমি সাতদিনের মধ্যেই সবার সামনেই পুনরায় সিগারেট খাওয়া শুরু করতে পারি!
রাতের বেলায় আমার স্ত্রী অন্তর্জাল থেকে আরেকটা চলচ্চিত্র ডাউন লোড করে এনেছে। এটা ফেসবুক সম্পর্কিত। এই মহান চলচ্চিত্রে প্রদর্শন করা হয়েছে অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার ক্যান্সার রোগের কারন হতে পারে। চলচ্চিত্রের ভেতরে এককোষী রক্তলাল এমিবা’র গতিশীলতা দেখে সে যারপরনাই চিন্তিত।
আমার মনে পড়ে গেল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত সেই লাইন, “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুনাধারায় এসো”! আসলে স্রষ্টা রক্ষা না করলে কেউই আমাদেরকে রক্ষা করতে সমর্থ নয়। আজ বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর ৭৫ তম প্রয়াণ দিবস। সারাজীবন কবি তার প্রিয়জনদের নিজের চোখের সামনেই একে একে হারিয়ে যেতে দেখেছেন! তার হারানোর উপলব্ধিগুলো উঠে এসেছে তার গান বা কবিতা লেখার খাতায়। কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২২ শে শ্রাবণ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ / ০৬ আগস্ট ২০১৬ খৃস্টাব্দ
ভালো লেগেছে ভাইয়া।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
🙂
“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো।
সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো॥
কর্ম যখন প্রবল-আকার
গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার
হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো॥
আপনারে যবে করিয়া কৃপণ
কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন
দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ,
রাজসমারোহে এসো।
বাসনা যখন বিপুল ধুলায়
অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,
ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র,
রুদ্র আলোকে এসো॥” --
মাত্র একটি চরণ উদ্ধৃত করে আমাকে ভাবের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে গেলে, আসাদ!
ধূমপান ত্যাগের ব্রত গ্রহণ করায় আন্তরিক অভিনন্দন।
শুধুমাত্র আমার ছোট মেয়ে বুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে আমি লুকিয়ে সিগারেট খাব শুনে। তার বিশ্বাস নিথ্যা বলে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার মতন মানুষ আমি না --
তোমার ছোট মেয়ের প্রতিক্রিয়া আমাকে স্পর্শ করে গেল। এই না হলে ড্যাডি'স ডার্লিং?