নির্জনতা প্রিয়তা

নির্জনতা প্রিয়তা

(আমার নিচের এই লেখার ওপরের উদ্ধৃতিটা আমি অনুঘটক হিশেবে ব্যবহার করেছিলাম ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তুরস্কের অন্যতম প্রধান লেখক ওরহান পামুকের লেখা হতে! গতকাল অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ৭ জুন তারিখে জন্মগ্রহনকারী প্রিয় লেখকের জন্মদিনে আমার এই ছোট্ট স্মৃতিকথনকে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি হিশেবে ব্যবহার করলাম। তার লেখা উপন্যাস ‘ISTANBUL’ এর প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলাম ছোটবেলায় প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ পড়ে!)

“প্রত্যেকদিন রাতে, আমি যখন কুণ্ডলী পাকিয়ে বিছানায় শুতে যাই, লেপ টেনে নিতে নিতে আমি কী এক মধুর আতঙ্কে তলিয়ে যাই, তলিয়ে যাই স্বপ্ন আর একাকীত্বের মাঝে, জীবনের সৌন্দর্যগুলোর ফাঁকে, এর নির্মমতার খাঁজে; আর ঠিক তখনই আমি কাঁপতে শুরু করি, ঠিক যেরকমভাবে আমি কাঁপতাম আমার ছোট্টকালে, ভয়ের গল্প শুনে বা রূপকথার রাজ্যে…” –ওরহান পামুক

ছোটবেলায় আমাদের বাড়ীতে আমার বয়সী কোন ছেলেমানুষই ছিলনা। ফলে আমার বড় হয়ে উঠছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাইয়ের মতন বন্ধুবান্ধবহীন এক নির্জন প্রকৃতির মধ্যে! আমার মনে আছে বন্যার পানিতে আমাদের বাড়ীর চারপাশটা ভেসে গেছে। আমি ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি। বাড়ির উঠোন কিংবা আশেপাশের গাছপালার মধ্যে গমনাগমনকারী সকল পিঁপড়ে খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছি, তবুও আমার সাঁতার শেখা হচ্ছেনা। কারন আমার কোন বন্ধু বা সঙ্গী নেই যাকে নিয়ে আমি বাবা-মা, প্রিয় পরিচিতদের চোখ রাঙ্গানোকে ফাঁকি দিয়ে গহীন ঘোলা জলে অবগাহন করতে পারি।একদিন আমাদের বাড়ীর সামনে বন্যার পানিতে আমার একদঙ্গল বড় চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরা মনের আনন্দে জলকেলি করছে আর আমি তাদের থেকে মাত্র ১০ গজ দূরে পাঁড়ের কাছের এক কোমর গভীর পানিতে সাঁতার শেখার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ পা পিছলে আমি বন্যার পানির নিচে অবস্থিত পগার পাড় থেকে পগারের গভীর পানিতে পড়ে গেলাম। একজন সাঁতার না জানা মানুষ কিভাবে জলপান করতে করতে মরে যায় সে সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞিতা হয়েছিল এইদিন। ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বাঁচার তীব্র আকুতি নিয়ে আমি যতবারই পানির নিচ থেকে ভেসে উঠি, আমি দেখতে পাই আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাইয়েরা আনন্দিতভাবে জলের ভেতরে জাম্বুরা দিয়ে পলো খেলতে ব্যস্ত। আমার দিকে খেয়াল করার কারুরই ফুরসত নেই। আমি দেখছি বা অনুভব করছি এদের ভেতরে কেউ কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু অদ্ভুত কোন কারনে আমাকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসছেনা! সম্ভবত তারা ভাবছে যে, আমিও তাদের মতন আনন্দিতভাবে জলের ভেতরে একাকী ডুবসাঁতার খেলছি! সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হল প্রানান্তকর চেষ্টায় আমি প্রতিবারই যখন জলের ওপরে মুখ তুলতে সমর্থ হয়ে চিৎকার করে আমার ভাইদের ডাকার চেষ্টা করতে যাই, ঠিক তখনই অদ্ভুত এক মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টান আমাকে পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়! আমার পেট ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে বন্যার পানিতে টেঁপা মাছের মতন। আমার সেদিন সলিল সমাধি সম্পন্ন হয়ে যেতো যদি না আমাদের খালেক চাচা সেখানে গোসল করতে নামতেন। প্রথমে তিনিও ভেবেছিলেছেন যে, আমি পানির সাথে দুষ্টুমি করছি।কিন্তু একটু পর ডুব দেবার জন্যে পানির ভেতরে এগোতেই বুঝলেন আমি গভীর পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তুলে এনে পাঁড়ের শুকনো মাটিতে চরকির মতন ঘুরাতে লাগলেন এবং আমার মুখ থেকে মাধবকুণ্ডের ঝর্ণাধারা উৎসারিত হতে লাগলো! একটু পর তিনি আমাকে মাটিতে নামিয়ে দিতেই আমি ইন্দ্রনাথের মেসতুত ভাই নতুন দা’র মতন তাকে অনুরোধ করে বসলাম, “চাচা, আজকের ঘটনাটা আপনি কাউকেই বলবেননা, আমি লজ্জায় মরেই যাবো!” চাচা হেসে বললেন, “তুই তো মরেই যাচ্ছিলি, আমি না আসলে কে তোকে বাঁচাত?” আমি একটু দূরে জলকেলিরত আমার বড় ভাইদের দিকে তাকালাম, তারা আগের মতনই খেলায় ব্যস্ত। তাদের এক ভাই যে অন্তর্জলি যাত্রা সম্পন্ন করে ইন্দ্রের দরবার ঘুরে এসেছে সে সম্পর্কে তারা মোটেই অবহিত নয়!

কাজেই এক নির্জন বালক হিশেবেই আমার জীবনের পথযাত্রা শুরু হল! মানুষের পরিবর্তে প্রজাপতি, ঘাস ফড়িং-দের সাথেই আমার সখ্যতা বেশি। আমার শৈশবের অনেকগুলো সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যা কাটিয়েছি আমি ফড়িঙের পেছনে পেছনে দৌড়ে! অথবা গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে নিমগ্ন, আমি তখন বিভোর লুব্ধক, সপ্তর্ষি মণ্ডল আর কালপুরুষের মেলা দেখায়!

ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনের সময়ে আমাদের ভূগোল টিচার ফখরুজ্জামান স্যার আমাদেরকে শিখিয়েছিলেন যে, বছরে দুটো মাসে উল্কাপাত হয় সবচেয়ে বেশি। এক ঘণ্টায় অন্তত আট-দশটা উল্কা রোজই দেখা যায়! আমি লাইটস আউটের পরও অনেকদিন রাতে ছাদের ওপরে গিয়েছি শুধু চেক করার জন্যে যে এই মাসগুলোতে সত্যিই উল্কাপাত হয় কিনা তা দেখার জন্যে! কলেজের শেষের দিকে এরিক ফন দানিকেনের ‘দেবতারা কি মহাজগতের মানুষ?’ এই নামের একটা বই এবং সেবা প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত ‘বারমুডা ট্রাইএঙ্গেল’ বা ‘ইউ এফ ও’র ওপরে প্রকাশিত সকল বইই আমাকে দারুন আকর্ষণ করলো।গভীর রাতে আমি অনেকবার ছাদে গিয়েছি শুধুমাত্র ‘ইউ এফ ও’ দেখতে, কেউ জানেনা! আমার সামরিক জীবনও আমাকে সাইজ করতে পারেনি! সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আমার কলেজের বন্ধু ওয়াহিদকে নিয়ে সারারাত আমার বাসস্থান ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন অফিসার্স মেস ‘ বি’ এর ছাদে গভীররাত পর্যন্ত ‘ইউ এফ ও’ দেখার প্রত্যাশায় ছাদের মেঝেতে শুয়ে থাকতাম। আমরা দুই বন্ধুতে মিলে ’৮৮ এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় যখন ঢাকা ভাসছে, তখন নৌকা ভাড়া করে নূহের মতন তিন দিন –তিন রাত ভাসানটেক এলাকার ভেতরে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম।নির্জনতা প্রিয়তার কারনেই জীবনানন্দ, সিল্ভিয়া প্লাথ কিংবা টেড হিউজ আমার প্রিয় কবি হয়ে উঠেছিলেন! নির্জনতাপ্রিয়তার কারনেই আমার এ সি আর–এ প্রতিবছর আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষগন সকলেই একটা কমন বাক্য লিখেছিলেন, “তিনি একজন ভদ্র, নম্র এবং মৃদুভাষী অফিসার!” নির্জনতা প্রিয়তার কারনেই অনেকে আমাকে অ্যারোগেনট ভেবেছে! নির্জনতা প্রিয়তার কারনেই আমি অবসরের পর দুইবার চাকুরি বদল করেছি! নির্জনতা প্রিয়তার কারনেই সংসারে স্ত্রীর সাথে আমার যত খুনসুটি!

“গভীর অন্ধকারে আকাশে রাখলে চোখ
পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকে না
থাকে না মানববন্ধন, ভালোবাসা …“-চন্দনকৃষ্ণ পাল

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

০৮ জুন ২০১৬
 

৪,০৭০ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “নির্জনতা প্রিয়তা”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    সাঁতার শেখার স্মৃতি, ছোট ভাইটির এমনত্রো টুপ করে পানিতে পড়ে তলিয়ে যাবার দৃশ্য (তখন আমিও ছোট। চিতকারে এক মুরুব্বী মহিলা পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে এনেছিল তাকে।) যেমন মনে পড়লো। তেমনি মনে পড়লো ইউএফও বা অমন ভাবনাগুলোকে নিয়ে পড়া নানান বইয়ের স্মৃতি। মনে আছে, এমনই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে, একবার এই বিষয়ে আমাদের দেশেও ইউএফও নেমেছে এই রকম বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। তখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি। ক্লাস নাইন।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।