আরন্যক
“আমার হাতের তালুতে আকাশ/রাতের গভীরে ঢাকা সপ্তর্ষি/কে আমাকে খুঁজে পাবে?” – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ছোট বেলা থেকেই বনে বনে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে আমার! একদম প্রাগৈতিহাসিক ঘন বনে, যেখানে ঢুকলে নিজেই বেরোনোর পথ খুঁজে পাব না কোনোদিন!পথ হারিয়ে আমি ঘুরতে থাকব নিবিড় বন-পাহাড়ের ভেতরে অনন্ত কাল!
আমার সেনাবাহিনীতে প্রথম বদলি হয়েছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ৫ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নে। কিন্তু এই ইউনিটে থেকেও আমার পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকুরি করার সৌভাগ্য হয়নি, কারন আমাকে ফাইফরমাশ খাটানোর জন্য ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানিতে না পাঠিয়ে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরেই রেখে দেয়া হয়েছিল।ছিটেফোঁটা কাজে কখনো-সখনো আমার খাগড়াছড়ি, বান্দরান, কাপ্তাই বা রাঙামাটিতে যাবার সুযোগ ঘটলেও আমার সামগ্রিক সামরিক জীবনের পারস্পেটিভে তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। একটা অবিচ্ছিন্ন-নিবিড় পার্বত্য জীবন কাটানোর অবকাশ হয়েছিল আমার ৯০ এর দশকের শেষার্ধে ১৯৮৮ সালে, আমাকে রাজধানী ঢাকা হতে বিচ্ছিন্ন করে সংযুক্ত করা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জোনের একটা রাইফেল ব্যাটালিয়নের সাথে (বর্তমানে বিজিবি ব্যাটালিয়ন) অনূর্ধ্ব এক বছর সময়কালের জন্যে। আমার এই আনন্দ যাত্রা শুরু হয়েছিল রাঙ্গামাটি সদর হতে পায়ে হেঁটে পেট্রোলিং করার মধ্য দিয়ে এবং সমাপ্ত হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী নতুন স্থাপিত সিআইও ক্যাম্প দশরথ ক্যাম্পে। নামটা শুনে আমি ভীষণ মজা পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার রাজধানী ছাড়ার মতন রাম-লক্ষন-ভরত এবং সীতাকে অযোধ্যার রাজবাড়িতে রেখে রাজা দশরথই তার সমস্ত রাজ্যপাল ছেড়ে নিবিড় পাহাড় ও অরণ্যের মধ্যে বাণপ্রস্থে যাবার উদ্দেশ্যে তার এই শেষ গন্তব্য তৈরি করে নিয়েছেন! ইউনিট অধিনায়ক মেজর হুমায়ুন এবং উপ অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সাইফ এর নেতৃত্বে যথারীতি মধ্যরাতের পর লিঙ্ক পেট্রোল শুরু করে পথিমধ্যে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পের সাময়িক আতিথেয়তা গ্রহন করতে করতে আন্দমানিক ক্যাম্পে লাঞ্চ করে আমার ক্যাম্পে পৌঁছাতেই সূর্য ডুবে গিয়েছিল পাহাড়ের অপরদিকে। পথিমধ্যে আমি দেখেছি পাহাড়ের অপরুপ সৌন্দর্য। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন পাহাড়ের পর পাহাড়ের সারি। দুই সারি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে জঙ্গলের বুকে গভীর ক্ষতচিহ্নের মতো বিসর্পিত রেখায় বয়ে যাওয়া ঝর্ণার স্বচ্ছ জল। ঝর্ণার দুপাশ ঘিরে ঘন-বিন্যস্ত ঝোপের ভেতর বুনো ফুলের গন্ধ। এলিফেন্ট গ্রাসের সবুজ ঢেউয়ে আবৃত সমস্ত চরাচর!
আমার ক্যাম্পের উচ্চতা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ৩০০ ফুটেরও বেশি। পাশাপাশি কয়েকটা উঁচু পাহাড়ের মাথা বা টিলার ওপরে ক্যাম্পটা স্থাপন করা হয়েছে। আমার কুড়ে ঘরটা সবচেয়ে উঁচু টিলার ওপরে। এখান থেকে ক্যাম্পের অন্যান্য টিলার ওপরে স্থাপিত লোকেশনগুলো ছাড়াও সমস্ত বিশ্বচরাচর পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব!প্রতিটি টিলা আবার পরস্পর সংযুক্ত হয়েছে প্রতিটা থেকে আসা রিজলাইন দিয়ে। কেন্দ্রে কোম্পানি সদর দপ্তর। কেন্দ্র থেকে একটা রিজলাইন উত্তরের দিকে প্রবাহিত হয়ে গোলাকৃতি হেলিপ্যাডে যেয়ে মিলেছে। হ্যালিপ্যাডের চারপাশ ঘিরে থাকা পাহাড়গুলোর মাথা রঙ-বেরঙের গাছপালায় ছেয়ে আছে। আমি প্রতিদিন সকালে এখানে দৌড়াতে আসি একাকী! যদিও আমার ক্যাম্পের উপ অধিনায়ক বি ডি আর জেসিও আমাকে বেশ কয়েকবার আমাকে নিষেধ করেছে এখানে একাকী না আসার জন্য। নিরাপত্তাজনিত কারন দেখিয়ে বলেছে, “স্যার, আপনি দৌড়াতে গেলে আপনার রানার এবং আরও দুই তিন জনকে সাথে নিয়ে যাবেন”। কিন্তু সকালের ওই সময়টাতে আমার একাকী থাকতেই ভাল লাগে। সকালের নরম আলোতে আমি যখন হেলিপ্যাডে যেয়ে দাঁড়াই, তখন আমার পায়ের নিচে সমস্ত গাছ গাছালির মাথা জুড়ে হাজারো রঙের বুনো ফুলের ছড়াছড়ি। আমার মনে হয় ফুলরুপী এক নক্ষত্রের বাগানের ভেতরে আমি যিশু খ্রিস্টের মতন দাঁড়িয়ে আছি! একটু পর সামনের রিজলাইনকে অপরূপ সোনালী আভায় রাঙিয়ে দিয়ে পূর্ব দিগন্তে উদীয়মান হয় দিবাকর। হলুদ নরম আলোয় ভরে যায় চারদিকের প্রকৃতি। প্রতিটা মুহূর্তকে মনে হয় প্রাচীন স্ফটিকের মতন উজ্জ্বল–মনোহর!
ক্যাম্প থেকে তিন লাইন পরস্পরের সমান্তরাল পাহাড়ের ওপারে উঁচু নীলাভ একটা পাহাড়ের পাদদেশে একটা ভারতীয় শহর। এই বিশাল চরাচরের মধ্যে ঐ শহরেই শুধুমাত্র বিদ্যুতের অস্তিত্ব আছে, যা বোঝা যায় শুধুমাত্র সূর্যাস্তের পর; রাতের অন্ধকারে মনে হয় হাজার হাজার জোনাকিরা খেলছে! প্রতিদিন সকালে সূর্য বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এই শহরটা কুয়াশার মতন অস্পষ্ট হয়ে যায়। তখন পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এর ওপরের পিচের রাস্তার পারদের আঁকাবাঁকা স্রোত ছুটে চলেছে ক্ষুধার্ত কোন অজগরের মতো অনির্দেশ্য কোন গন্তব্যের পানে। যেন মুখ থেকে ছিটকে পালিয়ে যাওয়া শিকারের সন্ধানে তার এই অভিযান।
আমার ক্যাম্পের তলা দিয়ে প্রথমে ঝর্না সৃষ্ট একটা জলাভূমি এবং তারপরেই অনেকগুলো ছোট ছোট পাহাড় যাদের মাথা ঢেকে আছে ছেদহীন অরন্যে। এই বিশাল অরন্যে বসবাস করে চিতাবাঘ, চিত্রল হরিন, শম্বর হরিন, হয়ত নীলগাইও ! প্রতিদিন আমাকে স্নান করতে নামতে হয় ক্যাম্পের নিচের ঝর্ণাতে। এই ঝর্ণাটা প্রবাহিত হয়ে এসেছে আমার ক্যাম্পের মাথার দিক থেকে অদৃশ্য কোন উৎস হতে। এর প্রবাহটা নিচের দিকেই প্রবল। এই ঝর্ণার জলেই আমি প্রতিনিয়ত অবগাহন করি। ঝর্ণার ঠিক উলটোদিকের পাহাড়ের পাদদেশে একটা কাল রঙের অতিকায় প্যান্থার সকাল বিকাল বিচরন করে। এর কারনে আমাদেরকে পানি সংগ্রহ অথবা স্নান করার জন্যে দল বেঁধে যেতে হয় সশস্ত্র এস্কর্ট নিয়ে। দুই পাহাড়ের মাঝখানে জলজ ‘ডেড গ্রাউনড’ থাকার কারনে আমরা সেটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লেও অত দূর পৌছায়না। ফলে প্যান্থার আমাদের গুলির বিপরীতে কোন প্রতিক্রিয়াই প্রদর্শন করেনা, বরং আমাদের নিক্ষিপ্ত শুধু গুলির শব্দই পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে। আমরা দুই-একবার প্যান্থারটাকে শিকার করার জন্য পেট্রোল নিয়ে বের হয়েছিলাম, কিন্তু জলাভূমি অতিক্রম করে ওটার ধারে কাছে পৌঁছানোর আগেই ওটা তালেবান জঙ্গিদের মতন গহীন অরন্যের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, আবার কোন নিরাপদ মুহূর্তে পুনঃ প্রত্যাবর্তনের জন্য!
আমি প্রায় রাতেই পেট্রোল নিয়ে জ্যোৎস্না রাতে ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাই। আমার দুধারে শালের বন আর জংলী কলার গাছগুলো কাঁপতে থাকে জ্যোৎস্নার রং মেখে। পাশের পাহাড়ের ওপরে বুনো হরিণগুলো আমলকী গাছের নীচে সারারাত ধরে আমলকী খায়। আমরা পাশ দিয়ে যাবার সময়ে মাঝে মধ্যে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকায়, তবে বেশির ভাগ সময়ে ভ্রুক্ষেপই করেনা আমাদের দিকে। একটু পর পর ঝর্ণা পার হতে হয়। ছোট্ট ঝর্ণা, এখানে সবাই ডাকে ছরা বলে। এতে জলের পরিমান খুবই কম; হাটুঁ পর্যন্তও ডুবেনা। হেঁটেই পার হওয়া যায়। কিন্তু বৃষ্টি বাদলের দিনে এই ছরাই ভয়ঙ্কর রুপ নেয়। তখন এর প্রবল স্রোতকে এড়িয়ে সাঁতার কেটেও পার হওয়া অসম্ভব। ঘণ্টায় বিশ ত্রিশ মাইল বেগে দুর্দান্ত স্রোতে প্রবল শব্দ করে জল নেমে আসতে থাকে তখন এই ছরা গুলোর ভেতর দিয়ে। অনেকটা স্বপ্ন থেকে হঠাৎ-জাগা নির্ঝরের বজ্র-গর্জনের মতন। ঝর্ণার স্বপ্নভঙ্গের কলরোল তখন মাইল মাইল দূর থেকেও কানে আসে!
মাঝে মধ্যে রাতে প্রবল চাঁদ ওঠে। অর্ধতন্দ্রায়, অথবা পরিপূর্ণ স্বপ্নের মধ্যেই আমি দেখি হয়তবা ক্যাম্পের অন্য সকলেও দেখে যে, চাঁদের আলোয়, জল-কল্লোলে আর বনের মর্মরে সমস্ত পৃথিবীটাই অবাস্তব হয়ে গেছে। আমরা কেউই অবাক হইনা! কারন আমরা সবাই জানি যে এমন একটা আশ্চর্য পটভূমিতে সবই সম্ভব, সবই স্বাভাবিক। পাশের পাহাড় থেকে কানে ভেসে আসে হরিনের মিষ্টি ডাক! এমন অপূর্ব বন-জ্যোৎস্নায় সে হয়তো হরিণীকেই সন্ধান করে ফিরছে, যেমন করে আমরা পুরো দেশবাসী নিরন্তর খুঁজে ফিরি হিংসা– হানাহানিমুক্ত স্বদেশ!
“ মাটি পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি,/না এলেই ভাল হতো অনুভব করে;/এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে –সব বুঝেছি/শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জল ভোরে/দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয় –/শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।-জীবনানন্দ দাশ)
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
মাঝে মধ্যে রাতে প্রবল চাঁদ ওঠে। অর্ধতন্দ্রায়, অথবা পরিপূর্ণ স্বপ্নের মধ্যেই আমি দেখি হয়তবা ক্যাম্পের অন্য সকলেও দেখে যে, চাঁদের আলোয়, জল-কল্লোলে আর বনের মর্মরে সমস্ত পৃথিবীটাই অবাস্তব হয়ে গেছে।
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ভাল লেগেছে 🙂
শ্রান্ত পথিক আমি, বেলাশেষে-
চারপাশে অভেদ্য-দুর্গম পাঁচিল তুলে
বসে থাকি নষ্ট ঘরে
হিসাবের খাতা মেলে খুঁজি কতোটা অপচয় হলো।
🙂
লেখাটা চমৎকার হয়েছে, আসাদ। লেখার সূচনাতে আর শেষে যথাক্রমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দুটোও খুব যথার্থ হয়েছে। পড়ার সময় মনে হচ্ছিলো, আমিও বুঝি কোন অরণ্যের শীর্ষে বসে জ্যোৎস্নায় অবগাহন করছি, পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোন নৃ্ত্যপটিয়সী ছরার নূপুরের শব্দ শুনছি। আমলকি খাওয়া হরিণের ডাক শুনছি, জল-কল্লোলে আর বনের মর্মরে অবাস্তব মনে হওয়া সমস্ত পৃথিবীটাকে দু'চোখ ভরে দেখছি।